২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, মঙ্গলবার, দুপুর ১২:৩৯
অলসতা আমার রমণীর মতোই প্রিয়: হেলাল হাফিজ
সোমবার, ২০ জুলাই, ২০২০

কবি কেমন আছেন?

সময়বিশেষে এই প্রশ্নটা নিরর্থক, সময়বিশেষে বেয়াদবিও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। নভেল করোনাভাইরাস, কোভিড–১৯, তছনছ করে দিয়েছে আমাদের যাবতীয় স্বাভাবিকতা। মন জাড্য করে দিয়েছে। প্রায় অচিন কিছু ভিনদেশি শব্দ ইদানীং খুব চেনা হয়ে গেছে আমাদের—কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, লকডাউন। অন্তরীণ নিরর্থক সময়। জানি না আমরা আক্রান্ত কি না, কোভিড–১৯-এ আক্রান্ত কি না, মানসিক বৈকল্যে আক্রান্ত কি না। এই সময় বেয়াদবি হলেও আমাদের জানা দরকার, কবি কেমন আছে?
প্রেসক্লাব লকডাউন।
কবি কেমন আছেন?
রেস্তোরাঁ-হোটেল বন্ধ।
কবি কেমন আছেন?
আলীম উসকাল। কল দিলাম।
বেশির ভাগ অপারেটরই কল দিলে এখন ২০-২২ সেকেন্ড ধরে করোনা সর্তকতার কথা শুনতে হয়। মুঠোফোন কোম্পানি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান।
মানুষের ভালো-মন্দ তারা দেখবেই। ভালো।
সর্তকতা শুনলাম, রিংটোন শুনলাম।
কবি ধরলেন, ‘কে? ধ্রুব?’
‘হ্যাঁ হেলাল ভাই।’
‘তুই কেমন আছিস? ঘরে আছিস তো? বাইরে বেরুবি না কিন্তু একদম—’
‘আমি ভালো আছি, হেলাল ভাই। আপনি কেমন আছেন, বলেন?’
‘আমি তো রাজকীয় সুখে আছি রে। তুই কিন্তু সাবধানে থাকিস।
এত মায়া পাই কোনখানে আর?’
‘আমি সাবধানেই আছি, হেলাল ভাই। আপনার দিন কেমন কাটছে বলেন? কী করছেন? কবিতা লিখছেন? ফেসবুক করছেন?’
হেলাল ভাই। হেলাল হাফিজ।
স্বাভাবিক দিন যাপনের রুটিন কী কবির?
ঘর নাই। হোটেলে থাকেন। হোটেল কর্ণফুলী ইন্টারন্যাশনাল। প্রেসক্লাবের উল্টো দিকে পড়েছে। রুম ২০২। সিঙ্গেল রুম, অপরিসর। অ্যাটাচড বাথ আছে। কবি থাকেন বলতে শুধু ঘুমান এই রুমে। নাহলে তার দিন কাটে—এবং রাতের কিছু অংশ—প্রেসক্লাবে। নির্দিষ্ট করে বললে প্রেসক্লাবের মিডিয়া সেন্টারে। আগে কার্ড রুমে বসতেন। কার্ড খেলতেন। বহু আগে ছেড়ে দিয়েছেন। মিডিয়া সেন্টারে বসে এখন ফেসবুকিং করেন, কখনো কবিতা। সর্বশেষ কবিতা এসব লকডাউন-টাডাউনের আগে লিখেছেন। ফেসবুকে আছে। একলাইনের কবিতা,
‘আমি কেউ না, কিছু না।’
স্বাভাবিক সময়ের কবিতা। অস্বাভাবিক এই সময়ে আর কোনো কবিতা লেখেননি। রাজকীয় সুখ একটা কারণ হতে পারে এর? জিজ্ঞেস করার মতো বেয়াদবি করতে আমার মন সায় দেয়নি। কবি ভালো আছেন, এটা স্বস্তির। রাজকীয় সুখে আছেন, এটা আনন্দের।
‘হোটেলেই আছেন?’
‘না। আমি আছি আমার বড় ভাইয়ের বাসায়। মার্চের একুশ তারিখ থেকে আছি। আমার ভাই দুলাল হাফিজ। ভাবি রওশন হাফিজ। আমি তাকে বউদি ডাকি। একটাই মেয়ে তাদের। রিনি, আমার আত্মজার চেয়েও অধিক আত্মীয় সে।’ টেলিভিশনে প্রেসক্লাব লকডাউনের খবর দেখে এই রিনিই পিক করেন কবিকে। প্রেসক্লাবের মানুষজন না হলে দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। কবি এখন কোথায় যাবেন, কী করবেন? প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম এবং সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমীনের উদ্বেগ মনে রাখার মতো, ‘আপনাকে নিয়ে আমরা চিন্তা করছি হেলাল ভাই।’

চিন্তা আরও অনেকে করেছেন। করোনা আতঙ্কের শুরু থেকেই অনেকে প্রস্তাব করেছেন কবিকে—করোনার এই সময়টা আপনি আমার সঙ্গে থাকুন। বা আমাদের সঙ্গে থাকুন।

‘আমার দুই বিদুষী কবি বন্ধু, একজন দিনাজপুরে থাকে  শাহিন আখতার, একজন ঢাকায়, রাশেদা তিথি, দুজনই আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, করোনার দীর্ঘ সময়টা তাদের পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য। রাশেদা তিথির একটা মেয়ে আছে। সিগমা। তাকেও আমি খুব পছন্দ করি। কিন্তু আমার যাওয়া হয়নি, অলসতাও আমার রমণীর মতোই প্রিয় বলে।’

তাড়াহুড়ো করে কবিকে তাঁদের বাসায় নিয়ে গেছেন রিনি। হোটেলের রুমে কিছু কাপড়চোপড় রয়ে গেছে কবির, বইপত্র রয়ে গেছে। মিস করেন সেসব?
‘না। বউদি, রিনি, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি। আনন্দে কাটাচ্ছি।’
রিনির এক ছেলে—ফারহান, দুই মেয়ে— রায়না, ইউস্না। অতি আদরের নাতি-নাতনি কবির। এদের সঙ্গে আনন্দে কাটাচ্ছেন। সেই আনন্দ কেমন লাগছে কবির?
‘সারা জীবন একা কাটিয়েছি, অনাদর ও অবহেলায় বড় হয়েছি, এখন সাংসারিক এই আদর-আপ্যায়ন—এগুলো ঠিক গায়ে সয় না। তবে ভালো লাগছে। ভালো লাগছে।’
‘ফেসবুকিং করেন না এখন?’
‘আমার তো অ্যান্ড্রয়েড ফোন নাই। মাঝেমধ্যে নাতির ফোন নিয়ে দেখি। ফারহানের ফোন। সে কিছু বিরক্ত হয় বুঝি, তারও তো অনেক বন্ধু, ফোন লাগে। আমি অবশ্য বেশি সময় দেখি না। রিনি সম্পর্কে আরেকটু কথা বলি। আমি যখন অসুস্থ ছিলাম, ল্যাব এইডে ছিলাম, এই রিনিই কিন্তু আমার যাবতীয় দেখাশোনা করত। কেবিনে থাকত। আমার ভাতিজি।’
আত্মজার অধিক যে ভাতিজি।

২১ মার্চের পর মাত্র এক দিন কবি ভাইয়ের বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। রিনির গাড়িতে। প্রেসক্লাবের অগ্রণী ব্যাংকে কিছু কাজ ছিল, কাজ শেষ করে আবার ফিরে গেছেন সাংসারিক আদর-আপ্যায়নের জগতে। সেই জগতেই আছেন এখনো।

আলীম একটা প্রশ্ন করতে বলেছিল কবিকে। তাঁর প্রেমিকাদের সঙ্গে এখন যোগাযোগ আছে কবির? প্রশ্নটা আমি করিনি। করা হয়নি। কবির এক প্রেমিকা কবি, আমার সামান্য পরিচিত, ফোনে কথা হয়েছে ইদানীং।
‘হেলাল ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়?’
‘না, প্রেসক্লাব তো লকডাউন।’
‘ফেসবুকে যোগাযোগ হয় না?’
‘ফেসবুকেও উনাকে পাই না।’
কী দুঃখ!
কোভিড-১৯-এর আজব দিন যায়।
কবি হেলাল হাফিজ রাজসুখে আছেন।

বিরহে আছেন কবির প্রেমিকারা।

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *