১৫ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, সোমবার, সকাল ৯:১০
অ্যালান পোর দাঁড়কাক
সোমবার, ২০ জুলাই, ২০২০

রাস্তাটার নাম মিলিটারি স্ট্রিট কেন, বোঝা গেল না। এটি থেকে এক ব্লক পরেই সেন্ট ক্লেয়ার নদী থেকে বের হয়ে আসা ছোট্ট একটা শাখানদী—ব্ল্যাক রিভার। সেন্ট ক্লেয়ারের ওপারে কানাডার সার্নিয়া, আর এপারে মিশিগানের পোর্ট হিউরন। সেই নদীর জল সমুদ্র–নীল, তার ওপরে যে বিশাল উঁচু ইস্পাতের সেতুটি দুই দেশকে মালার মতো গেঁথে নিয়েছে, সেটার নামও ব্লু ওয়াটার ব্রিজ। নীল জলের সেই নদী দিয়ে মাঝেমধ্যে দেখা মেলে প্রাচীনকালের নৌকার মতো জলযান। সেতুর নিচে রেলিংঘেরা বাঁধানো তীরে বসে মানুষ নদীতে ছিপ ফেলে বসে থাকে ধ্যানী বকের মতো। মধ্যরাত পেরিয়ে গেলেও দেখা মেলে এসব শৌখিন মৎস্যশিকারিদের।

মিলিটারি স্ট্রিটের ওপর একটা কফি হাউসের নাম ‘র​্যাভেন’। সাইনবোর্ডের রংও কালো, সেটার নিচে দাঁড়ে বসা বেশ নধর একটা কালো দাঁড়কাকের মূর্তি। তিনতলা বাড়িটির বহিরঙ্গে কালচে কাঠের প্যানেলের সজ্জার কারণে পুরো ভবনটিতে যেন কালো ছায়া পড়ে আছে। সামনের প্রশস্ত সাইডওয়াকে কয়েকটা চেয়ার–টেবিল। সেখানে দাঁড়াতেই ভরদুপুরের উজ্জ্বল রোদের ভেতর প্রায় ফাঁকা বড় সড়ক ধরে অ্যালান পোর ‘র​্যাভেন’ কবিতার বিষণ্নতা ছড়িয়ে আচমকা সাইরেন বাজিয়ে তীব্র গতিতে বাঁক নিয়ে ছুটে যায় একটা অ্যাম্বুলেন্স।

কাচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে সামনে পড়ে ছোট বার কাউন্টার, সামনে একচিলতে জায়গায় সাজানো বসার জায়গা, কাবার্ডের মাথার ওপর বসা কালো বিড়ালের মূর্তির জ্যান্ত চোখ সামান্য আলোর মাঝেও নিষ্পলক তাকিয়ে। বারটিকে পাশ কাটিয়ে করিডর ধরে এগিয়ে গেলে দোতলায় ওঠার জন্য পুরোনো ধাঁচের কাঠের সিঁড়ি, অনুজ্জ্বল আলোর ঘাটতি পূরণ করে দিয়েছে দেয়ালজোড়া বুকশেলফ আর পেইন্টিং। বিচিত্রধর্মী সব বইভর্তি শেলফের সামনে একের পর এক টেবিল পাতা, মাথার ওপর উপযুক্ত শেডের স্পটলাইট, তার কোনোটির ছায়ায় কালো কাকের মূর্তি, কোনো শেলফের মাথার ওপর পা ঝুলিয়ে, কোনোটির ওপর উবু হয়ে বসে নিচের টেবিলের দিকে তাকিয়ে বসে আছে মেকি নরকঙ্কাল।

রেস্তোরাঁর মেনু বইয়ের ভেতর অপেক্ষা করে ছিল আরেক চমক। ক্যাফেটার নাম যে অ্যালান পোর বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য র​্যাভেন’ থেকে উৎসারিত, সেটা আর বলে দিতে হয় না। মেনুর পাতায় পাতায় এডগার অ্যালান পো, কাকের ছবি, অ্যালান পোর কবিতা, বিভিন্ন মেনুর নামের ভেতর অ্যালান পো। তাঁর গল্প ‘ওভাল পোর্ট্রেট’, ‘প্রিম্যাচিওর বিউরিয়াল’, ‘ব্ল্যাক ক্যাট’, ‘পিট অ্যান্ড পেন্ডুলাম’, ‘আ ডিসেন্ট ইনটু দ্য মেলস্টর্ম’, কিংবা কবিতা ‘স্পিরিট অব দ্য ডেড’, ‘হন্টেড প্যালেস’, ‘দ্য এনিগমা’ অথবা ‘ভ্যালেন্টাইন’ দিয়ে নাম দেওয়া হয়েছে খাবারের বিভিন্ন পদের। অ্যালান পোর ‘ড্রিমল্যান্ড’ ও ‘টু হেলেন’ কবিতার পুরোটাই তুলে দেওয়া আছে মেনুর এক পাতায়। এ কথা অনেকেরই জানা আছে যে জীবনানন্দের অবিস্মরণীয় কবিতা ‘বনলতা সেন’কে কেউ কেউ পোর ‘টু হেলেন’ প্রভাবিত বলে মনে করেন। বনলতা সেনকে কেউ হেলেনের প্রতিদ্বন্দ্বী স্বীকার না করলেও র​্যাভেনের মেনু বইয়ের এক জায়গায় হেলেনের একটা পোর্ট্রেট দিয়ে তার নিচে পরিচিতি দেওয়া আছে, ‘সারাহ হেলেন হুইটম্যান’ (১৮০৩–১৮৭৮), যাকে উদ্দেশ করে ‘টু হেলেন’ কবিতাটি রচনা করেছিলেন পো। গল্প ‘ব্ল্যাক ক্যাট’ থেকে অ্যালান পোর উদ্ধৃতির বাইরে আরেকটি উদ্ধৃতি পাওয়া গেল পানীয়র মেনু বইয়ে, ‘যেমন বলেছিলে মাতাল হয়ে ভদ্রস্থ থাকবে, সব সময় তেমনই করো, সেটা তোমার মুখটা বন্ধ রাখবে।’ উদ্ধৃতিটি আর্নেস্ট হেমিংওয়ের।

ভেতরের বিনম্র আলোর ভেতর থেকে বের হয়ে এলে বাইরের কালচে ছায়াময় বাড়িটির বহিরঙ্গেও যেন ‘দ্য র​্যাভেন’ কবিতার বিষণ্নতা লেপ্টে থাকে। মাথার ওপরের দাঁড়কাকের মূর্তিটি যেন কবিতার সেই ‘এবং দাঁড়কাক, ওড়েনি আর কখনোই সে, বসে আছে, এখনো বসেই/ ঘরের দরজায় দাঁড়ানো দেবতা প্যালাসের ম্লান মূর্তির ওপর/ স্বপ্ন দেখা দানবের মতো তার দুচোখ/ বাতির আলোয় মেঝের ওপর আছড়ে পড়ছিল তার দোল খাওয়া ছায়া।’

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *