৩০শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার, সকাল ৭:৫৯
আলবেয়ার কামুর ‘দ্য প্লেগ’-এর ডাক্তার চরিত্র
শুক্রবার, ২৪ জুলাই, ২০২০

মিল্টন বিশ্বাস

করোনা ভাইরাসের মহামারিতে চিকিৎসকরা আমাদের প্রতিদিনের সংকটে পাশে থাকছেন; আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছেন। রোগী এবং সহকর্মীদের প্রতি তাদের প্রতিদিনের দৃষ্টিপাত, রোগীদের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা, ভাবাবেগে না চলে বাস্তবতাকে মেনে চলা- অন্যতম প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসেও আমরা দেখতে পাই, প্লেগ মহামারিতে ডাক্তারদের অপরিসীম সাহস, ধৈর্য, আর পরদুঃখকাতরতার চিত্র। যন্ত্রণা, মানসিক কষ্ট এবং মৃত্যুর কারণগুলো কীভাবে মানুষের নীতিকে খেয়ে ফেলে আর সেখানে স্বাধীনতা কীভাবে স্থানিক, কিংবা অল্প জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কেমন ক্ষুদ্র- তার চিত্র অসাধারণভাবে ফুটে উঠেছে কাহিনিতে।

১৯৪৭ সালে প্রকাশিত ফরাসি ঔপন্যাসিক আলবেয়ার কামুর (১৯১৩-১৯৬০) ‘লা পেস্ত’ বা ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সেরা ইউরোপীয় উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৪১ সালের এপ্রিলে প্লেগ জীবাণু নিয়ে কাহিনি শুরু হয়। লেখক দেখিয়েছেন ওই জীবাণু ইঁদুর থেকে মানুষের মধ্যে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যা আলজেরিয়ার সমুদ্র উপকূলের ওরান নামক একটি সাধারণ শহরের অর্ধেক জনসংখ্যাকে ধ্বংস করে দেয়। বইটির পৃষ্ঠা উল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা দেখতে পাই ওরান শহরের বাসিন্দারা পর্যাপ্ত অর্থ আয় করলেও তাদের জীবনযাত্রা অস্বচ্ছল, অধিকাংশই দরিদ্র। তবু আনন্দ ছিল প্রাত্যহিকতায়, দৈনন্দিন কাজে আশা জেগে থাকত। হঠাৎ এক রহস্যময় ও অদ্ভুত বাতাস স্বাভাবিকতার চেয়ে দ্রুত প্রবাহিত হয়ে তাদের জীবনকে আতঙ্কিত করে তোলে। শুরু হয় দুর্বিষহ আর বীভৎস ঘটনাধারা। কথক ডাক্তার বার্নার্ড রিও প্রথমে একটি মৃত ইঁদুর দেখতে পায়; পর্যায়ক্রমে নিজের ঘরের বাইরে, শহরের অলিতে-গলিতে অসংখ্য দৃষ্টিগোচর হয়। শীঘ্রই অজানা মহামারি ওরানকে ধরে ফেলে, এই রোগটি এক নাগরিক থেকে অন্য নাগরিকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রতিটি সড়কে, বাসস্থানে ভীতিজনক অবস্থার উদ্ভব ঘটে। কথক রিওয়ের মাধ্যমে লেখক প্লেগে পীড়িত পৃথিবীর অতীত ইতিহাস বিবৃত করেছেন। লেখক জানতেন চতুর্দশ শতকে ইউরোপে ব্ল্যাক ডেথের কবলে পড়ে ৫০ মিলিয়ন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল, ১৬৩০ সালে শুরু হওয়া ইতালির লম্বার্ডি এবং ভেনেটো জুড়ে প্লেগে ২৮০,০০০  নিহত হয়, ১৬৬৫ সালের লন্ডনের ভয়ঙ্কর প্লেগ মহামারি এবং ১৮ ও ১৯ শতকের মহামারি চীনের পূর্বাঞ্চলের শহরগুলিকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে ।

কারো কারো মতে, কামু সংকীর্ণ অর্থে প্লেগ নিয়ে কেবল একটি গল্প লেখেননি। বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে হিটলারের নাৎসি দখলদার সম্পর্কে একটি রূপক ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন তাঁর আখ্যানে। অর্থাৎ ‘লা পেস্ত’কে নাৎসিদের দখল এবং প্রতিরোধের উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অন্যদিকে ব্যাধিতে গৃহবন্দিদশাকে জীবিতদের অভিজ্ঞতা ও যুদ্ধের প্রতিরোধের রূপক, আর মহামারিতে মৃত্যুকে ফ্যাসিবাদের ভয়াবহ গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করেছেন অনেকেই। কারো কাছে মনে হয়েছে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সামষ্টিক প্রতিরোধের চিন্তা তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসে। জীবাণু যেমন বিনা কারণে নিরীহ মানুষকে আক্রান্ত করে মৃত্যুলীলায় আবিল করে তুলেছিল তেমনি হিটলারের ফ্রান্স আক্রমণটি প্লেগের মতো ছিল বিনা কারণে। অবশ্য সিমোন দ্য বোভোয়ার মনে করেন, প্লেগ একটি প্রাকৃতিক ঘটনা যা মানবসৃষ্ট নয়। কিন্তু হিটলারের ফ্যাসিবাদ তো রাজনৈতিক মানুষের সৃষ্টি। ফ্যাসিজমকে প্লেগ হিসেবে দেখানো হয়নি এ আখ্যানে। এটি মহামারির বাস্তব উপাখ্যান। মহামারির মধ্যে পড়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্মমভাবে মরে যাওয়া মানুষের গল্প। কামু যক্ষ্মায় ভোগা মানুষ, তিনি জানেন রোগকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করার কিছু নেই। দ্বিতীয়ত, উপন্যাসে কামুর ভিন্নরকম বয়ানের ধরন ক্যাটাগরির জায়গা থেকে একে ফ্যাসিবাদি টেক্সটের কাতার থেকে আলাদা করে। একটি সংক্রামক রোগ নিয়ে আখ্যান বিন্যাসে তার প্রেরণা যাই হোক না কেন তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন মানবতাকে। আর এই মানবতা প্রকাশ পেয়েছে ডাক্তার ও তার সহকর্মীদের চরিত্রকে রূপায়ণের মধ্য দিয়ে।

২.

‘দ্য প্লেগ’ ইতিহাস ও নাটকীয় ঘটনার দৃষ্টান্ত হলেও তা কাহিনিতে একটি চিরায়ত বক্তব্যে ঋদ্ধ। আসলে বিশ্বের সমস্ত মানুষই কোনো না কোনো সময় বিক্ষিপ্তভাবে নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে; তা হতে পারে মারণঘাতি ‘করোনা ভাইরাস’ দ্বারা অথবা কোনো দুর্ঘটনা বা আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের ক্রিয়াকলাপের জন্য। ওরানের নাগরিকরা প্রথমে ব্যাধির আক্রমণ মেনে নিতে পারে নি। এমনকি যখন শহরটির এক চতুর্থাংশ মারা যাচ্ছে তখনও তারা কল্পনা করতে থাকে যে এটি জীবিতদের ক্ষেত্রে ঘটবে না। তারা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিনির্ভর তথা ফোন, বিমান ও সংবাদপত্রসহ আধুনিক বিশ্বের মানুষ। তারা তো ঠিকই ভেবেছে, তারা কেন ১৭ শতকের লন্ডন বা ১৮ শতকের চীনের ক্যান্টনের মতো মহামারির কবলে পড়ে মারা যাবে। আখ্যানের ভেতর একটি চরিত্রের মুখে বলাও হয়, এটা প্লেগ হতেই পারে না কারণ প্রত্যেকেই জানেন যে এটি পশ্চিমা দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। কামু লেখেন- Yes, everyone knew that, except the dead.

আলবেয়ার কামু নিজে জানেন মৃত্যু যখন আসে তখন তা থেকে আমাদের নিস্তার নেই, সেখানে ইতিহাসের প্রগতি মিথ্যা, সেখানে আমাদের ভাবাবেগের কোনো মূল্য নেই। দুর্বলতা থেকেও রেহাই পাওয়া যায় না। বেঁচে থাকা সর্বদা জরুরি ছিল এবং থাকবে; এটি সত্য, এটি অনিবার্য যা থেকে পলায়ন অসম্ভব। প্লেগ থাকুক বা না থাকুক, সর্বদা রয়েছে মৃত্যুভীতি। হঠাৎ মৃত্যু আসতে পারে, এটি এমন একটি ঘটনা যা আমাদের জীবনকে তাৎক্ষণিকভাবে অর্থহীন করে দেয়। এভাবেই লেখক জীবনের অ্যাবসার্ডিটি বা অযৌক্তিকতা সম্পর্কে কথা বলেন। এই অযৌক্তিকতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে আমাদের হতাশায় নিমজ্জিত না হয়ে বরং বেঁচে থাকার জন্য আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা উচিত।

প্লেগের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের আতঙ্কিত করার চেষ্টা করে না, কারণ আতঙ্ক একটি বিপজ্জনক তবে ক্ষণস্থায়ী অবস্থার প্রতিক্রিয়া। আর এটা থেকে আমরা শেষ পর্যন্ত সুরক্ষা বা নিরাপত্তা পেতে পারি। কিন্তু এ বিশ্বে জীবন তো কখনও নিরাপদ নয়- এ কারণেই, আমাদের পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসতে হবে এবং দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে, আশা বা নিরাশার দোলায় দোদুল্যমান না থেকে দায়িত্ব পালন করা উচিত। জীবন তো মৃতের আবাসস্থল, কখনও তা হাসপাতাল নয়।

৩.

ওরান নগরে প্লেগের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে বিশেষত, যখন এক সপ্তাহে ৫০০ জন মারা যায়, তখন প্যানালু নামে একজন ক্যাথলিক ধর্মযাজক এই মহামারিকে ঈশ্বরের শাস্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তবে ডা. রিও ম্যাজিস্ট্রেট অথনের ছোট ছেলেকে যেভাবে মরতে দেখেছেন তাতে আরও ভাল করে জানেন- দুর্ভোগ বিস্তৃত হয়েছে সকলের মাঝে, এটির কোনও অর্থ খোঁজা চলে না, এটা সাধারণত অ্যাবসার্ড। এখানে স্নেহ ও দয়া ভূলুন্ঠিত। প্লেগে আক্রান্ত চারিদিকের মানুষের দুঃখ-কষ্ট কমাতে ডাক্তার অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। উপন্যাসের শেষে আমরা দেখতে পাই, প্রিয় বন্ধু তারিউ তার বাসায় মারা যান। শহরের বাইরে স্যানাটোরিয়ামে থাকা রিওয়ের স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ আসে টেলিগ্রামে। রোগীর সেবা করা ও মহামারি মোকাবেলার জন্য দিনরাতের শ্রম দেবার পরও রিও কিংবা ডাক্তার ক্যাসেল নিজেদেরক হিরো মনে করেন নি, বিষয়টি বীরত্ব করার মতো কিছু না তাদের কাছে। উপন্যাসে আছে-This whole thing is not about heroism, Dr. Rieux says. It may seem a ridiculous idea, but the only way to fight the plague is with decency.  প্লেগের মতো মহামারির বিরুদ্ধে ডাক্তাদের লড়াই করার একমাত্র উপায় হলো সহমর্মিতা, ভাল ব্যবহার আর শালীনতা বজায় রাখা। নিজের কাজের মধ্য দিয়ে সমাজের কাছে গ্রহণীয় এসব আচরণ আত্মপ্রকাশ করে।  

অবশেষে, এক বছরের কিছু কম সময় পরে প্লেগের সংক্রমণ শেষ হয়। শহরবাসী ব্যাধিমুক্তির আনন্দে উল্লসিত হয়ে ওঠে। দুর্ভোগ শেষে স্বাভাবিকতা ফিরে আসে। কিন্তু ডা. রিও জানতেন যে এই মহামারি দূর হওয়া চূড়ান্ত বিজয়ের গল্প হতে পারে না। মানুষের এ বিজয় উল্লাস যে কোনো দিন আবার হয়তো বিপন্ন হবে। কেননা প্লেগের জীবাণু কখনোই সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় না, অদৃশ্যও হয় না চিরতরে; বছরের পর বছর এই জীবাণু সুপ্ত থাকে আসবাবপত্রের মাঝে, কাপড়চোপড়ের বাক্সের ভেতর; ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করে শোবার ঘরে, ভাঁড়ারে, বড় বড় ট্রাংক, বইয়ের শেলফে; তারপর সেই দিনটি আসে যেদিন এই জীবাণু মানুষের সর্বনাশ এবং শিক্ষার জন্যে আবার তার ইঁদুরগুলোকে জাগিয়ে উত্তেজিত করে মরবার জন্যে, এবং ঝাঁকে ঝাঁকে ওদেরকে পাঠিয়ে দেয় আনন্দমুখর কোনো শহরে। অবশ্য প্লেগের আখ্যানে মহামারির বিরুদ্ধে ডাক্তাররা কী করেছিলেন এবং কী করা উচিত, নিঃসন্দেহে এটিই রেকর্ড হিসেবে ২০২০ সালের করোনা পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ।

৪.

আলবেয়ার কামু আমাদের এই একুশ শতকের করোনাভাইরাস কবলিত সময়ের নন আর তিনি বিশ্বের সেরা মহামারি বিশেষজ্ঞও নন। কিন্তু প্লেগ কবলিত মানুষের বাস্তবতা ঠিকই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন, সেসময়ের নগরজীবন ও লকডাউনে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটি আধুনিক শহরের মানুষের প্রকৃতিকে সঠিকভাবে অঙ্কন করেছেন। আমরা না জানলেও তিনি জানতেন, আমরা প্রত্যেকেই নিজের ভিতরে জীবাণু নিয়ে বাস করছি আর কেউ-ই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় অনন্য নই- everyone has it inside himself, this plague, because no one in the world, no one, is immune.

কাহিনি :

‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসের শুরুতে রয়েছে ওরান শহরের একটি বর্ণনা। প্রকৃতি সেখানে নিষ্ঠুর- গ্রীষ্ম ও শীতে।এই প্রকৃতির নির্দয় বিস্তারের সাথে মানুষের নিরানন্দময় জীবনের কথা আছে। সাধারণ মানুষের সংসারে জিনিসপত্রের অভাব লেগেই থাকে, আর আছে মানুষের মনের বিচিত্র অভাববোধ। শনি ও রবিবার ছুটির দিন মানুষ আনন্দ উপভোগ করে- প্রেমলীলায়, সমুদ্রস্নানে আর সিনেমা দেখে; অন্যদিনগুলো টাকা উপার্জনে কাটে। তবে এখানে অসুস্থ হলেই মানুষ সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

১৬ এপ্রিল ডাক্তার রিও অপারেশন শেষে বের হয়ে একটি মরা ইঁদুর দেখতে পান। ১৭ এপ্রিল শহরে মরা ইঁদুর বৃদ্ধি পায়। ১৮ এপ্রিল থেকে সেখানে আতঙ্ক শুরু হয়। ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৮ হাজার ইঁদুর মরে। ৩০ এপ্রিল তাদের মৃত্যু বন্ধ হলে ইঁদুর থেকে জীবাণু মানুষকে আক্রান্ত করা শুরু হয়। প্লেগে প্রথম মৃত্যু হয় দারোয়ান মিশেলের। সে মরার আগে বলে যায়, ‘ইঁদুরগুলো তার সর্বনাশ করেছে।’ এটি ছিল আলবেয়ার কামুর একটি বার্তা যা পরের পর্বগুলোতে আরো পরিষ্কারভাবে উন্মোচিত হয়েছে।

ডাক্তারদের পক্ষ থেকে বলা হয় সংক্রমণ বন্ধ না হলে প্রতিষেধক ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারিভাবে ঘোষণা করতে হবে প্লেগ দেখা দিয়েছে। প্রথমে যখন সংবাদপত্রে মৃত্যুর খবর বের হয় নগর কর্তৃপক্ষ (প্রিফেক্ট) তখন নগরবাসীকে ব্যাধি প্রতিরোধে নোটিশ প্রদান করেন। অসুস্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষকে খবর দিতে ও জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে বলা হয়। কিন্তু দিনে দিনে মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রথমদিকে জেলা কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় ইঁদুরের মতো দলে দলে মরতে আরম্ভ করে মানুষ। লোকচক্ষুর অন্তরালে বাড়ি বাড়ি মানুষ মারা যাচ্ছে যা কেবল ডাক্তাররা জানতেন, সাংবাদিকরাও সে ভয়াবহতার খবর পায় নি। ডাক্তাররা বুঝতে পারেন মহামারি শুরু হয়েছে।

ডাক্তার ক্যাসেল অভিজ্ঞ চিকিৎসক। মিশেলের মৃতদেহ পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার আগেই তিনি নিশ্চিত হন এটা প্লেগের জীবাণু। এই রোগের একমাত্র ওষধ ‘সিরাম’ পর্যাপ্ত না থাকায় তার চিন্তার কথা রিওকে জানান। জীবাণুগুলো যে একই গোষ্ঠীর অর্থাৎ প্লেগ সেটা উভয়ে নিশ্চিত হন। তখন রিও প্লেগের ইতিহাস স্মরণ করেন। বিশ্বে ৩০টি বড় বড় প্লেগ এসেছে। মারা গেছে ১০ কোটির মত মানুষ। প্লেগের ইতিহাসে একদা একদিনে কনস্টান্টিনোপলে মারা গিয়েছিল ১০ হাজার। চীনের ক্যান্টনে ৭০ বছর(উপন্যাসের কাহিনিকাল থেকে) আগে মানুষ মরার আগে ৪০

হাজার ইঁদুর মরেছিল। উপন্যাসে মূলত বুবোনিক প্লেগে (bubonic plague)  আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করতে দেখা যায়। যাদের লসিকা গ্রন্থির স্ফীতি ও তীব্র প্রদাহের সঙ্গে জ্বর ও ব্যথার কথা জানা যায়। তবে নিউমোনিক প্লেগ (pneumonic plague) এ আক্রান্ত রোগীও পাওয়া যায় রিওর হাসপাতালে; জীবাণু এসব রোগীর ফুসফুস সংক্রমিত করে নিউমোনিয়ার সঞ্চার করেছে। কফ কিংবা থুতুর মাধ্যমে প্লেগের ব্যাকটেরিয়া সুস্থ মানুষের নাসিকা পথে সহজে ঢুকে পড়ে ও দেহে সংক্রমণ ঘটায়। ব্ল্যাক ডেথ (black death) বা  সেপ্টিসিমিক প্লেগ (septicaemic plague) হলো রোগীর রক্তে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ। রোগীর শ্বসন নিষ্ক্রিয় হওয়ার কারণে দেহ কালচে বর্ণ ধারণ করে ও লাল হয়ে যায় এবং চিকিৎসা না হলে তার মৃত্যু অবধারিত। আর প্লেগে আক্রান্ত রোগী অন্যকে সংক্রমিত করে।

রোগী বাড়তে থাকলে রিও ক্যাসেলকে জানান, অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। রিচার্ডকে টেলিফোনে বলেন, শুধু নোটিশ এবং ইস্তেহার দিয়ে কোনো লাভ হবে না; রোগের বিরুদ্ধে সত্যিকারের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে; আর নয়তো কিছু না করাই ভাল। ৪৮ ঘণ্টায় ১১ জন মারা যাবার পর কর্তৃপক্ষকে ডাক্তাররা বোঝাতে সক্ষম হন। প্রিফেক্ট-এর অফিসে স্বাস্থ্য কমিটির সভা হয়। সেখানে রিচার্ড, ক্যাসেল ও রিও এবং আরো ডাক্তাররা উপস্থিতি ছিলেন। রিও জানান, দিন দিন সংক্রমণ বাড়ছে। এক্ষুণি ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে ২ মাসের মধ্যে শহরের অর্ধেক মানুষ মারা যাবে।

প্লেগের দ্রুত বিস্তার ঘটায় ডাক্তার ক্যাসেল বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি আরম্ভ করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান লাইব্রেরিতে ও সিদ্ধান্তে পৌঁছান- ইঁদুরগুলো মারা গেছে প্লেগে কিংবা তারই কাছাকাছি কোনো রোগে, ফলে লক্ষ লক্ষ মাছির প্রাদুর্ভাব হয়েছে। এখনি ওগুলোকে ধ্বংস করতে না পারলে জ্যামিতিক হারে বাড়বে প্লেগের জীবাণু। তার কথাই সত্য হয়। প্লেগের শিকার বাড়ে। প্রথম দিনে মৃত ১৬, দ্বিতীয় দিনে ২৪, তৃতীয়দিনে ২৮ এবং চতুর্থ দিনে ৩২। ফলে প্রিফেক্ট স্বীকার করেন অবস্থা উদ্বেগজনক। সরকারকে নির্দেশ দেবার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। রিও রোগের উপসর্গ বর্ণনা করে মৃতের সংখ্যাসহ বিবরণ কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে পাঠানোর জন্য তৈরি করে দেন। প্যারিস থেকে সিরাম এসে পৌঁছালে, চিন্তিত রিও আরো সিরাম পাঠাতে বলেন। মহামারিটি গোপনে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, এ কারণে নিজেকে বাঁচানোর জন্য বুঝে উঠতে মানুষের বেশ সময় লাগে। শহরের খবরের কাগজগুলোও প্রথমদিকে সঠিক তথ্য প্রদান করা থেকে বিরত ছিল।

বসন্ত আবির্ভূত হবার পর সরকার থেকে নির্দেশ এলো- ‘শহরে প্লেগ, বন্ধ করে দাও শহরের ফটক।’ রোগের জীবাণু বাইরে ছড়িয়ে যেতে পারে বলে শহর ছেড়ে কাউকে বাইরে যাবার অনুমতি দেয়া হলো না। ফলে মানুষের আচরণ পাল্টে গেল। সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অপরের চিন্তা না করে নিজে একা বাঁচার ভাবনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল তারা। প্লেগ শহরবাসীকে ঠেলে দিল নির্বাসিত জীবনে। শহরবাসীকে আকস্মিক বিচ্ছিন্ন অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়ে শহরের ফটকে পাহারদার হয়ে বসল প্লেগ নিজেই। ম্যাজিস্ট্রেট অথন জানালেন, মারাত্মক ক্রিমিন্যাল কেসগুলো কমে এসেছে। আইন-কানুন মানুষ এখন অনেক ভালোভাবে মেনে চলে। প্লেগের আবির্ভাবে তৃতীয় সপ্তাহে মারা গেছে ৩০২, পঞ্চম সপ্তাহে ৩২১, ষষ্ঠ সপ্তাহে ৩৪৫ জন। কাহিনির দৃশ্যপটটি এরকম- প্রথমে শহরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে হঠাৎ ইঁদুর মরার মাধ্যমে শুরু হয় আতঙ্ক। এরপর সরকারের উদাসীনতা, গুজব আর অলসতার কারণে জনগণের মধ্যে মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ। সংক্রমণটি জ্যামিতিকভাবে দ্রুত ছড়ায়।

কর্তৃপক্ষের নির্দেশ জারির পর শহরের মানবজীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চোরাকারবারীদের সুবিধা ঘটেছে কিন্তু নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাতে পারেনি কেউ। এজন্য সাংবাদিক র‌্যাঁবেয়ার প্যারিসে ফিরে যাবার আবেদন নাকচ হয়ে যায়। রোগ সংক্রমিত হয়নি এটা ডাক্তার রিও লিখে দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কারণ এটিই শহর ছেড়ে যাবার অনুমতি দেবার পক্ষে যথেষ্ট কারণ নয়। রিও বলেন- শহরে প্লেগ দেখা দিয়েছে। তাই এক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী আমার যা কর্তব্য আমাকে তা করতে হবে। তবে সরকারি দায়িত্বের খাতিরে অনেক পরিচিতের ব্যক্তিগত কাজ তিনি করে উঠতে পারেননি।  এভাবেই একজন ডাক্তার সততা দেখিয়েছেন মহামারির সময়।

মৃত্যু হচ্ছে সপ্তাহে পাঁচশত। দিনের পর দিন ডাক্তার রিওকে ডিউটি দিতে হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে। পরিচালনা করতে হচ্ছে ৩টি হাসপাতাল। তার তত্ত্বাবধানে চলছে শহরের চিকিৎসাব্যবস্থা। রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো থেকে শুরু করে সব কাজ নিজে তদারকি করেন তিনি। ইনজেকশন দেয়া থেকে শুরু করে পুঁজ বের করা পর্যন্ত কাজ নিজ হাতে করতে হয় তাকে। রোগী একবার হাসপাতালে পৌঁছালে মৃত্যু না হওয়া অবধি কেউই তার মুখ দেখতে পায় না। কিন্তু ডাক্তার ও নার্সকে সদাজাগ্রত থাকতে হয়।

মহামারির মধ্যে ডাক্তাররাই জনগণের বাসায় বাসায় গিয়ে রোগী দেখে এসেছেন। প্রথম দিকে অসুস্থদের হাসপাতালে পাঠাতে না চাওয়ায় জনগণকে বাধ্য করার জন্য ডাক্তারের সঙ্গে একজন পুলিশ অফিসার উপস্থিত থেকে রোগীর বন্দোবস্ত সম্পন্ন করেন। এর পরই নগর কর্তৃপক্ষকে স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী গড়ে তুলতে হয়।  অন্যদিকে ডাক্তাররা বুঝতে পারেন প্যারিস থেকে আসা নতুন সিরামগুলো আগের সিরামের মতো কাজ দিচ্ছে না। ফলে মহামারি নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। ডাক্তারদের পরামর্শে কিছু নতুন আইন-কানুন প্রবর্তন করলেও অবস্থার তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে দিনে মৃত্যু ১২৪ জন ছাড়িয়েছে।

সিদ্ধান্ত হয়- বাধ্যতামূলত সবল দেহের সব মানুষকেই মহামারি প্রতিরোধে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে হবে। তারিউ কিছু সংখ্যক লোককে নিয়ে ‘স্যানিটারি স্কোয়াড’ গঠন করেন। এভাবে অনেকগুলো দল গড়ে ওঠে। দুর্যোগ মোকাবিলায় সাহায্য করেন তারা। প্লেগকে পরাজিত করার জন্য তারা দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হন। তারিউ, রিও ও তাদের বন্ধুবান্ধব অটল থাকেন সেবার কাজে।  ডাক্তার ক্যাসেল মহামারির মধ্যে হাতের কাছে যেসব যন্ত্রপাতি পেয়েছেন তা দিয়ে সিরাম বানাতে চেষ্টা করেন। রিও ও ক্যাসেল নিজের শরীরের দিকে না তাকিয়ে কাজ করে গেছেন একটানা বার ঘণ্টার বেশি।

রিও অবশ্য একসময় র‌্যাঁবেয়াকে জানান, পরিস্থিতি সামলানোর জন্য যন্ত্রপাতি এবং লোকের অভাব রয়েছে ওরানে। অবস্থার অবনতি ঘটলে তারা সামলাতে পারবেন না। যদিও বাইরে থেকে কিছু ডাক্তার এসেছেন। র‌্যাঁবেয়া নিজেও স্যানিটারি স্কোয়াডে যোগদান করে। সে জানতে পারে রিও যা করছেন তা বীরত্ব নয় নিজের দায়িত্বটুকু যথাযথভাবে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার জন্যই করছেন। তার স্ত্রী স্যানাটোরিয়ামে আছেন, চিকিৎসা চলছে। নিজের বাসায় মা একাকী।

আগস্টের মাঝামাঝি প্লেগ শহরের সবকিছু গ্রাস করে ফেলে। ঘিঞ্জি এলাকা থেকে বাণিজ্যিক এলাকা আক্রান্ত হলে ওইসব এলাকাকে শহরের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে ফেলা হয়। সকল শ্রেণিপেশার মানুষ আক্রান্ত হওয়ায় বোঝা যায় প্লেগ মানুষের সব পরিচয় মুছে ফেলে। ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসে ব্যাধি কবলিত সাধারণ মানুষকে গুজবে বিশ্বাস করতে দেখা যায়। যখন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে তখন হঠাৎ বাজার থেকে পেপারমেন্ট লঞ্জেস উধাও হয়ে যায়। মানুষের মাঝে প্রচার করা হয় পেপারমেন্টে প্লেগ মুক্তি ঘটে। ২০০ বছর আগে ইউরোপে প্লেগের ডাক্তাররা সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য একধরনের তৈলাক্ত পোশাক ব্যবহার করত। সেই সংবাদ জানার পর আক্রান্ত নগরীতে রেইনকোর্ট ব্যবহার করা শুরু করে আতঙ্কিত মানুষ। আর ঈশ্বরভীত মানুষগুলো আতঙ্কিত হয়ে পড়ে বেশি। সামষ্টিক হতাশার মধ্যে পড়ে যায় শহরটি। সুবিধা বঞ্চিতদের মতো ধনী মানুষেরাও মানসিকভাবে সুবিধা বঞ্চিত হয়ে পড়তে থাকে।

এপ্রিলে প্লেগের বিস্তার শুরু হলে একটানা অক্লান্ত পরিশ্রমের পর সেপ্টেম্বরে এসে রিও এবং ওর বন্ধুরা এতদিনে এই প্রথম অনুভব করেন ভীষণ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছেন তারা। রিও লক্ষ করেন সব ব্যাপারে কেমন যেন উদাসীন হয়ে উঠেছেন সবাই। দিনরাত কাজ করার ফলে ক্লান্ত তারা। আবেগহীন উদাসীনতার সঙ্গে তারা দেখতে থাকেন ভাল খবর কিংবা কারো সুস্থ হওয়ার সংবাদকে। সবচেয়ে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত মনে হয় ডাক্তার ক্যাসেলকে। রিওকে জানতে পারেন, ডাক্তার ক্যাসেল বেশকিছু টিকা তৈরি করেছেন, টিকাগুলো পরীক্ষা করে দেখা দরকার। কেবল নিজের সুখের কথা চিন্তা করা লজ্জার বলেই এই ডাক্তাররা নিরলসভাবে কাজ করেছেন। অক্টোবরের শেষে ক্যাসেলের টিকা ম্যাজিস্ট্রেট অথনের প্লেগ আক্রান্ত ছোট ছেলেকে দিয়ে পরীক্ষা করানো হয় কিন্তু শিশুটি মারা যায়। অবশ্য ডাক্তারদের প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। শিশুটি মারা যাবার পর রিওয়ের উৎসাহে ফাদার প্যানালু কোয়ারেন্টাইন স্টেশনে র‌্যাঁবেয়ার জায়গায় কাজ করতে রাজি হন। রিওকে দায়িত্ব নিয়ে ছুটতে দেখে সাংবাদিক র‌্যাঁবেয়া যে এই শহরের বাসিন্দা নয় বলে নিজেকে বহিরাগত ভাবত, সেও এখানকার একজন হয়ে যায়। শহরের একটি অঞ্চলের দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়। প্যানালুকে রিও জানান- আত্মা নয় মানুষের দেহকে কীভাবে সুস্থ রাখা যায় তা নিয়ে কাজ করছেন তিনি। মনেপ্রাণে মৃত্যুব্যাধিকে ঘৃণা করে, রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। তাকে এ কাজ থেকে কেউ বিচ্ছিন্ন করতে পারবেন না স্বয়ং ঈশ্বরও না। 

ডিসেম্বরে মৃত্যুর সংখ্যা কমতে শুরু করে। জানুয়ারিতে মহামারি দূর হয়েছে বলে নগর কর্তৃপক্ষের কাছে মনে হয়। এজন্য ২৫ জানুয়ারি উৎসবে মেতে ওঠে লকডাউনে বন্দি কিন্তু সুস্থ মানুষগুলো। ২৫ জানুয়ারি শহরের ফটক উন্মোচিত হচ্ছে, যখন নগরবাসী মারীমুক্ত জীবনে উল্লাসে উজ্জীবিত তখন ডা. রিও তার সঙ্গীসহ শূন্যতার মধ্য দিয়ে ভেসে চলেছেন। রিও, তারিউ, র‌্যাঁবেয়া এবং ওদের অন্যান্য সহকর্মীরা সেই উল্লাসে সম্পৃক্ত হতে পারেননি। এর পরই তারিউ রিওয়ের বাসায় প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

আখ্যানে প্রায় এক বছর পর রোগ দূর হওয়ার কারণ হলো- সিরামের প্রয়োগ, হাসপাতালে ভর্তি এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অগ্রগতি; গার্হস্থ্য আবাসনে নগর কর্তৃপক্ষের নজরদারি, ইঁদুরকে মানুষের আবাস থেকে দূর করা এবং সর্বোপরি মহামারি রোগের স্বাভাবিক উত্থান ও হ্রাসের প্রাকৃতিক কারণে ওরান নগর থেকে মহামারি দূর হয়। প্লেগের ব্যাকটেরিয়া নগর ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেও সংক্রামক জীব হিসেবে ইঁদুরকে চিহ্নিত করায় চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটে। সতর্ক হয় মানবসমাজ।

চরিত্র :

ডাক্তার বার্নার্ড রিও, প্রবীণ ডাক্তার ক্যাসেল, রিওয়ের সহকর্মী ও মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ডাক্তার রিচার্ড, নগর কর্তৃপক্ষ প্রিফেক্ট, ম্যাজিস্ট্রেট অথন, প্যারিস থেকে আসা সাংবাদিক র‌্যাঁবেয়া, অন্য শহর থেকে আসা জাঁ তারিউ (আউটসাইডার বা লেত্রাঁজের এর মারসো, দি ফল উপন্যাসের আইনজীবী জাঁ বাপ্তিস্ত ক্লামাঁসের সঙ্গে মিল আছে), স্থানীয় গির্জার ধর্মযাজক ফাদার প্যানালু, মিউনিসিপ্যাল অফিসের কেরানি জোসেফ গ্রাঁদ আর মশিয়ে কটার্ড, মাদাম রিও ও রিওয়ের মা, মিশেল এবং রিওয়ের পরিচিত একজন হাঁপানি রোগী উপন্যাসের সক্রিয় চরিত্র।

উপন্যাসের কাহিনি সূত্রে আমরা দেখেছি, ওরান শহরে হাজার হাজার ইঁদুর, প্রথমে জনসাধারণের নজরে না থাকলেও অলি-গলিতে মারা যেতে শুরু করে। একসময় স্থানীয় সংবাদপত্রগুলি এই ঘটনার খবর দেয়। কর্তৃপক্ষ জনসাধারণের চাপের প্রতিক্রিয়ায় মৃত ইঁদুর সংগ্রহ করে চাপা দেয়। ডাক্তার রিও ও ক্যাসেল সর্বপ্রথম বুঝতে পারেন এই ইঁদুর বুবোনিক প্লেগ ছড়িয়ে দেওয়ার অনুঘটক। করোনভাইরাস আক্রান্ত পরিবর্তিত বিশ্বের কাছে ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসের এই ডাক্তার চরিত্র এবং তাদের সহকর্মীদের সেবাকর্মের বিবরণ সত্যিই প্রাসঙ্গিক।

আখ্যানে সক্রিয় চরিত্রগুলির মাধ্যমে কামু পাঠকদের সামনে প্লেগে আক্রান্ত নগরবাসীর মানসিক মনোভাব তথা মানব প্রকৃতির স্বরূপ তুলে ধরেছেন। ভাল ও অসুস্থতা দিয়ে তাদের আচরণ চিহ্নিত হয়েছে। প্লেগের ভয়াবহতার মধ্যে ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা কেবল পর্যাপ্ত সুরক্ষা চেয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যাননি বরং নিজের জীবন বিপন্ন করে মানুষের সেবা করে গেছেন। আসলে দশ মাস ধরে প্লেগের বিস্তৃতিতে কামু দক্ষতার সাথে নগরবাসীদের পরিবর্তিত আচরণ ও অভিযোজন ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করেছেন। জনসাধারণ যে সমস্যাগুলির মুখোমুখি হয়েছিল এবং কীভাবে তারা ডাক্তারদের সাথে আচরণ করেছে, সেগুলি সমাধান করতে তিনি কয়েকটি চরিত্রের বিশদ বিকাশ দেখিয়েছেন।

কামুর ‘দ্য প্লেগ’উপন্যাসের এক জায়গায় ডাক্তার বার্নার্ড রিওকে তারিউ জানাচ্ছেন, ‘এই প্লেগের কাছে তার এ বীরত্ব টিকবে তো?’ রিও উত্তর দেন, ‘সেটা জরুরি না। জরুরি হচ্ছে এ ক্রমাগত সংগ্রাম করে যাওয়াটা।’

এই ডাক্তার উপন্যাসটির বর্ণনাকারী এবং প্রধান চরিত্র। প্রায় ৩৫ বছর বয়সী, মাঝারি উচ্চতা এবং প্রশস্ত কাঁধ, কালো চোখ ও কালো চুলের একজন মানুষ হিসেবে তাকে বর্ণনা করেছেন ঔপন্যাসিক। এই ডাক্তার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একজন সার্জন। উপন্যাসের শুরুতে, এক বছর যাবৎ অসুস্থ তার স্ত্রী শহর ছেড়ে একটি স্যানাটোরিয়ামে রওনা হন। 

ঝাঁকে ঝাঁকে ইঁদুর মরার ফলে ওরান শহরটি যে বিপদের মুখোমুখি হয়েছে সেই পরিস্থিতির গুরুত্ব অন্যরা বুঝতে পারে না। তরুণ ডাক্তার রিও বুঝতে পেরেছিলেন যে ওরান শহরে প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ঝুঁকির মধ্যে থাকা বিষয়টিকে ধরে ফেলেন এবং কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে অবিলম্বে পদক্ষেপ না নেওয়া হলে মহামারির জীবাণুটি কয়েক মাসের মধ্যে শহরটির অর্ধেক জনসংখ্যাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য মারণঘাতি হয়ে উঠবে। প্রথম সভাতে দেখা যায়, নগরের কর্তা প্রিফেক্ট নগরবাসীকে সতর্ক করতে চান না। তিনি এই রোগটি কী তা বলা এড়াতে পছন্দ করেন। মানুষের মৃত্যুর কারণকে ডাক্তাররা যখন প্লেগ বলেছেন তখন এই শব্দটি প্রচার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। এভাবে রিওয়ের মতো একজন নিবেদিত চিকিৎসকের প্লেগের মতো মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে সতর্কবার্তা কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে উপেক্ষা করেন। কয়েকটি নোটিশ দিয়ে জনগণকে সতর্ক করে সুখী থাকেন প্রিফেক্ট।

ডা. রিও এই পরিস্থিতির মধ্যে তার অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যাধি বিস্তারের অবস্থা বুঝে উৎকণ্ঠিত হয়েছেন। প্লেগে মিশেলের মৃত্যুর পর অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন আর হাসপাতালের ব্যস্ততা দিন দিন বাড়তে থাকে। আক্রান্তদের কোনও সহজ নিরাময় ব্যবস্থা না থাকলেও তার সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্যায় ও আপসকে পিছনে ফেলে জনগণের জন্য কাজ করেছেন রিও। সম্মিলিতভাবে মানুষের দুর্দশা মোচনে সচেষ্ট হয়েছেন। পালিয়ে না গিয়ে এভাবে প্রতিরোধের মনোভাব পোষণই এই চিকিৎসকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্লেগ চলাকালীন মৃত্যুর পৃথক ভাগ্য একসময় সম্মিলিত নিয়তিতে পরিণত হয়। কারণ প্লেগ সকলকে ভাগ করে দেয়। প্রেম এবং বন্ধুত্ব বিবর্ণ হয়। নির্বাসন ও বঞ্চনা জেগে থাকে নির্বিকার।

মহামারি চলাকালীন রিও একটি সহায়ক হাসপাতালের প্রধান এবং আক্রান্তদের চিকিৎসা করার জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন। সিরাম ইনজেকশন দেন এবং ফোড়াগুলিকে ফাটিয়ে পুঁজ বের করেন, তবে তিনি আরও কিছু কাজ করেন। তার দায়িত্বগুলি শেষ করেও তাড়াতাড়ি গৃহে ফিরে যান না। বরং শহরের বাসায় বাসায় ঘুরে রোগী দেখে বেড়ান।  অন্যান্য ভুক্তভোগীদের জন্য যে মমত্ববোধ তিনি অনুভব করেন তা পরিবারের প্রতিও দেখান না। যদিও গৃহে তার মা একাকী থাকেন। ব্যক্তিগত আবেগ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সক্ষম হওয়ায় তার পক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসুস্থকে হাসপাতালে পাঠানো সহজ হয়েছে, অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। প্রায়শই তাকে অনুরোধ করা হয়েছে যাতে এটি না করা হয় কারণ বাসিন্দারা জানেন হয়তো সেই ব্যক্তিকে আর কখনও দেখতে পাবেন না। রিও দায়িত্ব নিয়েই রোগ মোকাবেলায় কাজ করেছেন কারণ তিনি একজন চিকিৎসক এবং তাঁর কাজ হল মানুষের দুর্দশা দূর করা।  দুর্ভোগের বাস্তবতায় তাকে কঠোরও হতে হয়েছে। দুর্দশা এবং জনগণের আতঙ্ক- উত্তেজনাকে মোকাবিলা করেছেন তিনি। তাঁর ভেতর উদ্বেগজনক পর্যবেক্ষণও ছিল। তিনি ধর্মযাজকের মতো কোনও মহৎ, ধর্মীয় উদ্দেশ্যে এটি করেন নি (তিনি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখেন না)। কোনও হতাশা ছাড়াই যা করা দরকার তা করেছেন, কিন্তু তিনি জানেন যে মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই এমন একটি জিনিস যা করেও তিনি কখনই জিততে পারবেন না।

ডাক্তার রিওয়ের কয়েকটি চৌম্বক বৈশিষ্ট্য :

ক)  প্লেগের মহামারি মোকাবেলায় কঠোর পরিশ্রম করেছেন একজন কট্টর নাস্তিক কিন্তু মানবতাবাদী ডাক্তার রিও। তার মা রয়েছেন ওরান শহরে তার বাসায় আর অসুস্থ স্ত্রী তার কাছ থেকে দূরের অন্য এক শহরের স্যানাটোরিয়ামে। উপন্যাসের শুরুতে রিও তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে পৃথক হয়েছিলেন, তবে প্লেগ আক্রান্তদের স্বার্থে তিনি নিজের ব্যক্তিগত দুর্ভোগ, ব্যক্তিগত মমত্ববোধকে- প্লেগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্ত করেননি। বিভ্রান্ত ও আতঙ্কিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঘটে যাওয়া ব্যাধির দুর্দশা কাটাতে তার ব্যক্তিগত কষ্টকে সামনে আনেননি কখনও।

খ) কাজ করে রিও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে রোগীদের চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা নিয়ে বীরত্ব করার কিছু নেই। রিও পুরোহিতের মতো শিথিল জীবনযাপনের শাস্তি হিসেবে প্লেগকে ঈশ্বর প্রেরিত ব্যাধি হিসেবে দেখেননি। ম্যাজিস্ট্রেট অথনের ছেলের বেদনাদায়ক মৃত্যুর পর পুরোহিত যুক্তি দিয়েছিলেন যে ঈশ্বর-বিশ্বাসের পরীক্ষা এটি। এই ধর্মযাজক অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারই তাকে দেখতে যান। ডাক্তার তার বিপরীতে দৃঢ় নৈতিকতায় স্থিতধী ছিলেন। প্লেগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সংগঠিত করেছেন অন্য সকলকে, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের প্রয়োজন ছাড়াই তাঁর মহান আকাঙ্ক্ষা একজন সাধু হওয়ার চেয়ে ছিল বেশি বাস্তবসম্মত। সামষ্টিক মানুষের কল্যাণের জন্য নৈতিকভাবে নিজেকে মানবতার দায়ের সঙ্গে অঙ্গীভূত করেন তিনি।

গ) রিও একজন নাস্তিক এবং মানবতাবাদী, তবে তিনি দার্শনিক বা ধর্মীয় উত্তর খোঁজার চেয়ে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার দিকে বেশি মনোনিবেশ করেছেন। তার নিরন্তর প্রচেষ্টা ও প্রচুর ক্লান্তি সত্ত্বেও প্লেগের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম চলতে থাকে। তিনি নিজের সমস্ত দক্ষতা এবং শক্তি দিয়ে প্লেগের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তিনি মৃত্যু এবং রোগের সাথে লড়াই করেন কারণ তিনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার। নিজের জীবনকে মূল্যবান বলে মনে করলেও মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং স্বাস্থ্য অর্জনে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে তার ভূমিকা ছিল অনন্য। অসহায় মানুয়ের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অপরিসীম।

ঘ) ডা. বার্নার্ড রিও দায়বদ্ধ। তিনি দিনের পর দিন প্রাণঘাতী সংক্রমণের মাঝে প্রাণবন্ত হয়ে  ঝুঁকি নিয়ে অপরের জীবনকে বাঁচিয়েছেন। যদিও তাঁর মতে, ঝুঁকিপূর্ণ ও অসাধারণ কাজ বীরত্বের গল্প নয়; এটি নিছক চিকিৎসকের কাজ- তবু আমরা মনে করি তা বীরত্বের গল্পই। মহামারি এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে কেউ বেঁচে থাকলেও তার যত্ন নেওয়ার কেউ থাকবে না। তারপরেও এবং তার নিজের জীবনের যথেষ্ট ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, তিনি ব্যক্তিগতভাবে এবং নার্স ও স্বেচ্ছাসেবকদের তদারকি করে রোগীদের ভাল করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

ঙ) উপন্যাসের সকল ডাক্তারেরই কাজ ছিল রোগীদের যথাসম্ভব সর্বোত্তম সেবা দেওয়া। প্রধানত বেদনাদায়ক বুবোনিক প্লেগের কোনও অ্যান্টিবায়োটিক ছিল না, এবং মহামারিতে ডা. ক্যাসেলের তৈরি সন্দেহজনক কার্যকারিতাসহ দেরিতে একটি পরীক্ষামূলক টিকা ব্যবহার করা হয়েছিল। তবে সকল চিকিৎসাকর্মী নিবেদিতপ্রাণ এবং অনেক উন্নত চেতনার অধিকারী ছিলেন। তার প্রতিবেশী এবং তারিউয়ের মতো বন্ধুরা এগিয়ে আসেন। তারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে চিকিৎসা ও কর্তব্য নিয়ে সহায়তার হাত বাড়ান। বিপর্যয়ের মধ্যে তার ব্যক্তিগত উৎসাহে একাধিক টিম কাজ করে।

চ) ডাক্তার রিও জানেন মহামারি থেকেও মঙ্গল আসে। আক্রান্তদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে মানুষের চোখ খুলে দেয়। আর দুর্দশা দেখে মানুষের চেতনার আসে পরিবর্তন। কিছু করার জন্য সংগ্রাম চালানোর উৎসাহ পায় মানুষ। আগে অসুস্থ লোকদের নিরাময় করা দরকার বলেই রিও মৃত্যুর বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তি দিয়ে সংগ্রাম করার কথা বলেছেন। বিজয় কখনও স্থায়ী না হলেও তিনি লড়াই ছেড়ে দেওয়ার কোনও কারণ নেই বলেছিলেন তারিউকে। মহামারি কখনও শেষ না হলে সেটি হতো তার পরাজয়। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নিরাময়কারী এই ডাক্তার।

ছ) তিনি ওরানের নাগরিকদের রক্ষা করতে চান। বর্ণনাকারী হিসেবে রিও মন্তব্য করেছেন যে, মানুষের সবচেয়ে খারাপ ধরনের অজ্ঞতা হতে পারে তার নিজের অজ্ঞতা না জানা। এজন্য তিনি যা জানেন না তা স্বীকার করেছেন, তবে তিনি যা জানেন তা দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করেছেন। কর্তব্য এবং যৌক্তিক বাধ্যবাধকতার কথা বলেছেন। রাতদিন কাজ করেছেন তবু তিনি বলেছেন, ‘আমি এটাই করছি, তবুও আমি কেন জানি না।’ নাস্তিক সত্ত্বেও কাজ করেন- কারণ মানুষ ও মানুষকে রক্ষা করার জন্য কোন ঈশ্বর নেই বলেই তাকে পদক্ষেপ নিতে হবে- যা আসলে মানবতাবাদী মনোভাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবুও এই ডাক্তার উপন্যাসের সব না হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানবতাবাদের পক্ষে লড়াই করেছেন।

মূলত ওরানের জনগণের মধ্যে ডাক্তার রিওকে যুক্তিযুক্ত কণ্ঠস্বর হিসেবে চিত্রিত করেছেন আলবেয়ার কামু। এই ডাক্তার প্লেগ মহামারির প্রথম প্রাদুর্ভাবের সময় কর্তৃপক্ষকে পদক্ষেপ নিতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। রিও সদয়, নিঃস্বার্থ এবং বীর। সর্বোপরি তিনি নম্র। নগরের অনেক চিকিৎসক ও সমস্ত সার্জনদের মধ্যে তিনি একজন কর্মক্ষম প্রশাসকও। তিনি বন্ধুদের সাথে তাঁর দর্শন এবং নাস্তিক্যবাদ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। সর্বোপরি তিনি বিশ্বাস করতেন তাঁর কাজটি করতে হবে। ক্লান্ত হলেও তিনি তাঁর কাজ চালিয়ে গেছেন। সাধু-সন্তদের চেয়ে সাধারণ মানুষ তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বীরত্ব এবং পবিত্রতা তার কাছে সত্যই কোনো আবেদন সৃষ্টি করে নি; কারণ একজন শুদ্ধ মানুষ হওয়ার জন্যই তার আগ্রহ ছিল বেশি। মহামারিতে অনেক দুর্দশা, বিপর্যয় সেখানে চিকিৎসক হিসেবে তার কাজ জীবন বাঁচানো, ওরানের নাগরিক হিসেবে, মানুষ হিসেবেও।

অন্যদিকে দুই ডাক্তার চরিত্র ক্যাসেল ও রিচার্ড ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসে প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থিত হয়েছেন। অভিজ্ঞ ও প্রবীণ চিকিৎসক ক্যাসেল প্রথম ব্যক্তি যিনি ওরানের সমস্ত ইঁদুর মারা যাওয়ার পরে উদ্ভূত মারাত্মক অসুস্থতার প্রসঙ্গে রিওকে প্লেগের কথা বলেছিলেন। মহামারি মোকাবেলায় কঠোর পরিশ্রমে শরিক হন তিনি এবং বেঁচে থাকা রোগীদের অ্যান্টিবডি যুক্ত করার জন্য একটি টিকা তৈরি করেন। ওরানের মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ডাক্তার রিচার্ড । রিও ও ক্যাসেল যখন পরামর্শ দেন যে আজব রোগটি বুবোনিক প্লেগ তখন ডা. রিচার্ড তা বিশ্বাস করতে চান নি। তিনি তাৎক্ষণিক, সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়ে ‘জনগণকে আতঙ্কিত’ করার পরিবর্তে ‘অপেক্ষা করুন এবং দেখুন’দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন।

গ্রাঁদ, তারিউ, র‌্যাঁবেয়া- এরা চিকিৎসক নন, তবুও তারা নিবেদিতপ্রাণ ডাক্তারদের মতো প্লেগের সাথে লড়াই করেছেন; একজন মানুষ হিসেবে তাদের কাজ করার পক্ষে যুক্তি ছিল, ডাক্তার হিসেবে নয়।অবশ্য ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসে মহামারি মোকাবেলায় ডাক্তার-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসই ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

উপসংহার

আলবেয়ার কামু তাঁর সাহিত্যে বারবারই জানিয়েছেন, জীবন অর্থহীন। কিন্তু অর্থহীন জেনেও আমরা নিজেরাই নিজেদের জীবনের অর্থ দাঁড় করাতে সচেষ্ট। মহামারি আক্রান্ত ওরানের মানুষের ব্যক্তিগত অভীপ্সা থেকে সামষ্টিক চেতনায় উত্তরণের মধ্যে এই অর্থময়তা পরিস্ফুটিত। অর্থাৎ অনিবার্য মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার জন্য অবিরাম প্রচেষ্টাই এনে দিতে পারে জীবনের অর্থ। প্লেগ মূলত ইঁদুরের একটি রোগ এবং মানুষ কেবল ঘটনাক্রমে এর শিকার হয়। একসময় মানুষ তাকে জয়ও করে। কিন্তু সংক্রামক জীবাণু অবদমিত জিনিসের মতো ঘুরে বেড়ায়, সে ফিরে আসবেই। জীবাণু চতুরতার সঙ্গে রোগ ছড়ায়। তারা মানুষের দুর্বলতা খুঁজে বেড়ায়। আর মানুষ কেবলই দুর্বল, কিন্তু ভান করতে থাকে যে তারা সবসময়ই সচল ও শক্তিশালী।

এজন্য সামগ্রিকভাবে কামু মানবসমাজের একটি মূল সমস্যা চিহ্নিত করেছেন, আর তা হলো- ‘অন্যের কষ্ট বোঝার অক্ষমতা’। তিনি বলেন, এর একমাত্র সমাধান হল সংক্রমণে মৃত দেহগুলি এমন জায়গায় রাখা হবে যেখানে প্রত্যেকে তাদের দেখতে পাবেন এবং তারপরে একজন মানুষ মৃত ব্যক্তিকে সত্যের আলোকে দেখে বুঝতে পারবেন যে, তারা আসলে মানুষ ছিলেন। কামু বলতে চেয়েছেন, ‘জীবাণু হলো প্রাকৃতিক, বাকি সকল কিছু স্বাস্থ্য, সততা ও বিশুদ্ধতা যা মানুষের ইচ্ছায় সৃষ্ট।’ ডাক্তার রিও এটাই বিশ্বাস করতেন। তাই অবিশ্রান্তভাবে মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ করে গিয়েছেন। তিনি প্লেগ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারতেন, প্রাণ যেতে পারত যেকোনো মুহূর্তে। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি এও অনুধাবন করেছিলেন প্রতিরোধ গড়ে না তুললেও প্রাণ যেতে পারে। তাই যখন মৃত্যু ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ নেই, তখন তিনি বেছে নেন মৃত্যুর বিরুদ্ধে সংগ্রামকে; যে সংগ্রাম একার নয়, সবার অস্তিত্বের সংগ্রাম। আশাবাদের ঘোষণা দেন তিনি। আর এভাবেই অভূতপূর্ব সামষ্টিক চেতনা এবং মানবিক অবস্থার স্বরূপ আত্মপ্রকাশ করে ‘দ্য প্লেগ’-এর  আখ্যানে।

(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস,  বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *