৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার, সন্ধ্যা ৬:০৩
কবর- মুনীর চৌধুরী
শনিবার, ১৩ মার্চ, ২০২১

কবর

১৭ /১/৫৩

চরিত্র

নেতা

হাফিজ

ফকির

গার্ড

ছায়ামূর্তি কয়েকটি

(মঞ্চে কোনরূপ উজ্জ্বল আলো ব্যবহৃত হইবে না। হারিকেন, প্রদীপ ও দিয়াশলাইয়ের কারসাজিতে নাটকের প্রয়োজনীয় ভয়াবহ, রহস্যময়, অশরীরী পরিবেশকে সৃষ্টি করিতে হইবে।

দৃশ্য : গোরস্তান। সময় : শেষ রাত্রি।

চার ফুট উঁচু একটি পুরু কাল কাপড়ের মজবুত পর্দা দ্বারা মঞ্চটি দুই অংশে বিভক্ত, লম্বালম্বিভাবে নয় পাশাপাশি। সামনের অংশে কি ঘটিতেছে সবই দেখা যাইবে; মঞ্চের পশ্চাৎ অংশে কেহ দাঁড়াইলে দর্শকের চোখে পড়িবে না।

পর্দা উঠিলে দেখা যাইবে খালি মঞ্চের ডান কোণে একটি লণ্ঠন টিম টিম করিয়া জ্বলিতেছে। সামনে একটি মোটা পোর্টফোলিও ব্যাগ, মুখ খোলা। পাশে একটি ছোট গ্লাস, খালি। একটি রুমাল মাটিতে পাতা রহিয়াছে। মনে হয়, এইমাত্র তাহার উপর কেহ বসিয়াছিল। সেই লোকটিই মঞ্চের ভিতরে আবার ঢুকিল। হৃষ্টপুষ্ট বড়-সড় শরীর। চালচলন গণ্যমান্য নেতার মতো। ভারিক্কী উপযুক্ত সাজগোজ। ভিতরে ঢুকিয়াই আবার ডাকিল-)

নেতা : গার্ড। গার্ড!

(নীল কোর্তা পাজামা পরা গার্ডের প্রবেশ। পায়ে খয়েরী ক্যাম্বিসের জুতা। পাজামার প্রান্তদেশ মোজার মধ্যে গোঁজা। হাবভাবে প্রভু ভক্তির ঝলক; কিন্তু আপাততঃ একটু হতবুদ্ধি ও ভয়ার্ত ভাব। হাতে নিভন্ত লণ্ঠন। ছুটিয়া প্রবেশ।)

গার্ড : জী-হুঁজুর! (দ্রুত নিঃশ্বাস)

নেতা : কি রকম গার্ড দিচ্ছ? তোমাদের পাহারা দেবার এই নাকি নমুনা? ছিলে কোথায় এতক্ষণ? কতক্ষণ ধরে ডাকছি কোন সাড়া নেই।

 গার্ড : পরথম পরথম ঠাওর করতে পারি নাই হুজুর। এমন ঠাণ্ডা আর আন্ধার হুজুর যে কানের মধ্যে খামুখাই কেবল ঝাঁ ঝাঁ করে।

নেতা : তোমার পোষ্টিং কোথায় ছিল?

গার্ড : ঐ পশ্চিম কোণে। ঐ কিনারের শেষ লাল বান্ধানো কবরের পাড়।

নেতা : ওখান থেকে এখানে আসতেই একেবারে হাঁপিয়ে পড়েছো? বাহাদুর গার্ড দেখছি। বাতি নিভিয়ে রেখেছ কেন?

 গার্ড : (চমকাইয়া হাতের লণ্ঠন দেখে) ওহ্! এ্যা পইড়া গ্যাছলাম। তাড়াতাড়ি কইরা আইতে গিয়া পইড়া গ্যাছলাম গর্তের মধ্যে।

 নেতা : গর্তে?

গার্ড : কবর। পুরান কবর হইবে। একদম ঠোসা আছিল। না বুইঝা পা দিতেই একদম ভস্ কইরা ভিতরে ঢুইকা গেছি।

 নেতা : idiot! চোখ মেলে পথ চলো না? খেলার মাঠ পেয়েছ না কি? এটা গোরস্থান। সাবধানে পা ফেলতে পার না? যাও। ডিউটিতে যাও।

(অন্যদিক হইতে নিঃশব্দে প্যান্ট-কোর্ট মাফলার চাদর জড়ানো কিন্তু তকিমাকার এক ব্যক্তির প্রবেশ। নেতা তাহাকে লক্ষ্য করে নাই।)

গার্ড : জী-হুঁজুর। (স্যালুট)

নেতা : যাওয়ার পথে আবার আরেকটার মধ্যে পোড়ো না। কাতার দেখে আল দিয়ে চলবে। যাও। কোন কাজ নেই। এমনি ডেকেছিলাম। বাতিটা জ্বালিয়ে দিও।

গার্ড : জী হুজুর। (স্যালুট। প্রস্থান)

ব্যক্তি : (নেতার পিছনে) তখনই বলেছিলাম স্যার এসব আজে বাজে লোক

নেতা : (চমকাইয়া) কে? তুমি কে?

ব্যক্তি : আমি ক্লার, ইন্সপেক্টর হাফিজ।

 নেতা : ওহ! আপনি! এমন করে নাকে-মুখে কাপড় জড়িয়েছেন যে, অন্ধকারে চকে ঠেছিলাম। ভবিষ্যতে ওরকম আর করবেন না। না, ভয় পাইনি। গত চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ভয় কখনই মনে ঢুকতে পারেনি। তবু ডাক্তার বলেছে। আমার নাকি হার্ট উইক। সাবধানে থাকতে বলেছে। কি বলছিলেন বলুন

(বসিয়া গ্লাসটা হাতে লইবে এবং অন্যমনস্কভাবে পোর্ট-ফোলিও ব্যাগটার মুখ খুলিবে। ইন্সপেক্টর হাফিজ খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলিতে চেষ্টা করিবে। কিন্তু নজর পুরাপুরি নেতার হাতের দিকে।)

হাফিজ : এই বলছিলাম, এ সব হাবাগোবা লোক সঙ্গে না আনলেই পারতেন। কাজ বানাবার চেয়ে পণ্ড করাতেই বেটারা বেশি পটু।

নেতা : তা হোক। ওরা আমার বিশ্বাসী লোক। আপনার সারা অফিস চুড়লেও অমন লোক জুটতো না।

হাফিজ : এটা স্যার ঠিকই বলেছেন। সব একেবারে হারামীর বাচ্চা। বেতনটাকে পাওনা দাবি হিসেবে আদায় করতে চায়, নিমক বলে মানে না। এজন্যই তো আজকাল কোন অফিসেই ফেইথ-ডিসিপ্লিন এগুলো খুঁজে পাবেন না স্যার!

নেতা : হুম্ (ব্যাগটা আবার দেখেন। চারদিকে কি যেন খুঁজিতেছেন।)

 হাফিজ : তবু কিছু কাজ আছে স্যার, যা বিবির সামনেও বেপর্দা করতে নেই। তাছাড়া শহরে কারফিউ লাগানো থাকতে এখানে গার্ডের কোন দরকার ছিল না। কটাই বা লাশ আর। গোর-খুঁড়ে ওগুলোকে নিয়ে আমি একলাই সব। সাফসুফ করে রাখতাম। তার ওপর শীতের মধ্যে আপনি কষ্ট করে….

নেতা : কিছু কাজ আছে যা অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না, তা সে যতই পটু হোক না কেন! (দাঁড়াইয়া পড়িয়া খুঁজতে থাকে।)

হাফিজ : কিছু খুঁজছেন স্যার?

নেতা : হ্যাঁ। একটা বোতল, ঐ গ্লাসটার পাশেই ছিল। ভূত-জিনে আমি বিশ্বাস করিলেও, তারা কেউ এসে একেবারে বোতল সমেত আমার হুইস্কি শেষ করে যাবে- মনে হয় না। একটু আশেপাশে খুঁজে দেখুন তো, আমিই ভুলে কোথাও ফেলে গেছি নাকি।

হাফিজ : ব্যাগের ভিতর পুরে রাখেন নি তো?

নেতা : না। ওগুলো ভরা বোতল! একটা কিছু খালি হয়েছিল।

 হাফিজ : ওহ! তাইতো। এ-তো বড় সাংঘাতিক কথা! না না। ভাল করে খুঁজে দেখা দরকার। বোতলটা কি রকম স্যার?

 নেতা : না খেয়ে থাকলে বোঝানো যাবে না।

হাফিজ : না স্যার, মানে স্যার আমি, বোতলটার শে-গড়নের কথা বলছিলাম।

নেতা : ওহ্ খুঁজে দেখুন। আমি নতুন একটা খুলছি, আপনি ওটার খোঁজ করুন।

হাফিজ : (দর্শকদের দিকে পিছন দিয়া, মঞ্চের অন্য কোণে উপুড় হইয়া কি খোঁজে। তারপর মাটিতে একবার হাত ঠেকাইয়াই চিৎকার করিয়া উঠে।)

পেয়েছি! পেয়েছি! স্যার! এই যে! এইটে না স্যার?

 (একটি খালি মদের বোতল তুলিয়া দেখায়।)

নেতা : অত জোরে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠবেন না। গত চার-পাঁচ বছরের মধ্যে কোন দিন ভয় পাইনি, এটা ঠিক। তাহলেও এটা গোরস্থান। খেলার মাঠ নয়। হঠাৎ চেঁচালে বুকে লাগে। আপনাকেও বলেছি একবার দেখি। হ্যাঁ। বোতল এটাই।

হাফিজ : কিন্তু মানে, একদম খালি যে স্যার!

নেতা : তাতে ক্ষতি নেই। যে খেয়েছে সে যে বোতল শুদ্ধো সাবাড় করতে সক্ষম নয়, বর্তমানে সেটাই আমাদের জন্য এরকম জায়গায় সুখের কথা। অন্ততঃ ভয়ের কথা নয়।

হাফিজ : ভয়? কি যে বলেন স্যার। মানে আমি ভেবেছিলাম হয়ত এমনিতেই কারো পায়ের ধাক্কা লেগেই ছিটকে পড়ে গিয়ে থাকবে। সব হয়তো মাটিতে গড়িয়ে পড়ে বরবাদ হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই ঐ গার্ড ব্যাটার কাণ্ড। কবরে গর্ত থেকে উঠে এসে সোজা আপনার বোতলের ওপরই হয়ত আবার হোঁচট খেয়েছে। অমন দামী জিনিসটা নষ্ট করে দিল স্যার!

নেতা : আপনাকে প্রথম ভেবেছিলাম নেহায়েৎ সরকারী কর্মচারী। এত দরদী লোক বুঝিনি।

হাফিজ : সব মাটিতেই পড়েছে স্যার। হাত দিয়ে দেখলাম। জায়গাটা ভিজে একেবারে কাদা কাদা হয়ে গেছে।

নেতা : আপনার এ চাকরি নেয়া সার্থক হয়েছে। এবার একটু বসে আরাম করুন। ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা। আপনার পা শুদো কাঁপছে।

হাফিজ : অ্যাঁ! পা? টলছে- মানে, কাঁপছে? ওহ! হ্যাঁ, তাইতো ইস্ কি বেজায় শীত। একটু বসি তাহলে স্যার, এ্যা?

(নেতা তখন হোকা পোর্ট-ফোলিও ব্যাগ হইতে নতুন বোতল খুলিয়া ক্রমাগত ঢালিতেছেন।)

নেতা : ওদিককার কাজ কতদূর এগুলো? আর কতক্ষণ দেরী হবে?

হাফিজ : প্রায় হয়ে এল বলে। এতক্ষণ সব চুকে দু-একটা যেত। গোলমালে কাজে বাধা না পড়লে কখন সব শেষ করে ফেলতাম।

নেতা : গোলমাল? গোরস্থানের মুর্দারাও মিছিল করতে শিখেছে নাকি?

হাফিজ : কি যে বলেন স্যার। ঐ পোর খুঁড়েগুলো দু-একটা আপত্তি তুলেছিল, সেটা মেটাতে একটু দেরী হয়ে গেল।

নেতা : আপত্তি? টাকা-পয়সা নিয়ে আপনি কোন গোলমাল করেন নি তো? আপনাকেও বলেছি যে, টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। যা দরকার তার চেয়েও বেশি ছড়িয়ে যান। সরকারের অনুমোদন আমি যোগাড় করে দেবো। টাকা ঢালতে আপনার কষ্ট হয় কেন? কমতি পড়লে আপনি আমার কাছে চেয়ে নিতেন।

হাফিজ : সে কি স্যার আমি বুঝিনি? সরকারের কাজে সরকারী টাকা খরচ করতে আমি পিছ-পা হব কেন? তবে ঐ ছোট লোকগুলোর আবার অদ্ভুত সব ধর্মীয় কুসংস্কার রয়েছে কিনা তাতেই তো যত ফাঁকড়া বাঁধে। মজুরীতে ষোল আনা আদায় করবেই, তার ওপর ধর্মের নাম করে সাত রকম ফষ্টিনষ্টি! কুসংস্কারই দেশটাকে খেল স্যার!

 নেতা : আমার বক্তৃতা আমাকে শোনাবেন না। কি ঘটেছে তাই বলুন।

 হাফিজ : হাসপাতাল থেকে লাশগুলো তাড়াহুড়ো করে টেনে হেঁচড়ে গাড়িতে তুলতে হয়েছে। তার ওপর এতখানি পথ ট্রাকে আনা, ঝাঁকুনি কিছু কম খায় নি। আর ডাক্তারগুলোও যেমন পশু মরাগুলোকে কেটে-কুটে একেবারে লাশ করে রেখেছিল।

নেতা : এসব কাজে নার্ভাস হলে এত বড় প্রতিষ্ঠানের নেতা হতে পারতাম না। তবু আপনাকে বলেছি আমার হার্ট একটু উইক! বেশি স্ট্রেইন সহ্য হয় না। বাজে কথা না ঘেঁটে আসল কথাটা বলুন।

হাফিজ : যা হবার তাই হয়েছে। টানা হেঁচড়ায় আর ট্রাকের ঝাঁকুনিতে গাড়ীর মধ্যেই। লাশগুলো একেবারে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। কাটা টুকরাগুলো এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় এখন আর বোঝবার উপায় নেই, কোনটার সঙ্গে কোনটা যাবে।

নেতা : তাতে কি হয়েছে? (নতুন বোতল খুলিবে)

হাফিজ : আর ওটা খাচ্ছেন স্যার? মানে, তাই দেখে আমি গোর-খুঁড়েগুলোকে বল্লাম আলাদা আলাদা করে অতগুলো কবর বানিয়ে কি দরকার। একটা বড় মতোন গর্ত করে সবগুলো তার মধ্যে ঠেসেচুসে পুরে মাটি চাপা দিয়ে দিলেই হয়।

 নেতা : Resourceful officer! আপনার নামটা মনে রাখতে হবে। সকালে পার্টি হাউসে আসবেন, রিকমেণ্ডেশন লিখে দেবো। হাফিজ : মেহেরবানী স্যার! পাকিস্তান হবার পর আমরা পেটি-অফিসাররাই কেবল কিছু পেলাম না। পাকিস্তানের জন্য এত ফাইট করে, আমাদের এখনও সেই দশা! যদি আপনারাও আমাদের দিকে ফিরে না তাকান আমরা বাঁচব কি করে? আমাদের তো কোন রাজনীতি নেই স্যার! সরকারই মা-বাপ! যখন যে দল হুকুমত চালায় তার হুকুমই তামিল করি।

নেতা : এর মধ্যে গোলমালটা কিসের? আপত্তি উঠলো কোথায়?

হাফিজ : এ্যা? ওহ্। ইয়ে মানে, ঐ গোর-খুঁড়ে। বজ্জাত ব্যাটারা বলে কিনা “কভি নেহি।” বলে কিনা মুসলমানের মুর্দা, দাফন নেই, কাফন নেই, জানাজা নেই- তার ওপর একটা আলাদা কবর পর্যন্ত পাবে না? এ হতে পারে না, “কভি নেহি!” গো ধরে বসে রইল। কত বোঝালাম।

নেতা : আহাম্মকী করেছেন। সরকারী কাজ করেন কি-না! পাবলিক সেন্টিমেন্ট বোঝেন না। বোঝাতে গিয়ে সময় নষ্ট না করে ওদের খুশী মতো কাজ করতে দিলে আপনার ইজ্জত ডুবত? সমাজ সংস্কারের বক্তৃতা দেবার জন্য আপনাকে সরকার বেতন দেয় না। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আকাশ ফর্সা হয়ে যাবে- আজান পড়বে- কারফিউ শেষ হবে। লাশগুলো নিয়ে আপনি এখনও মিটিং করছেন?

 হাফিজ : আমি সঙ্গে সঙ্গে ওদের কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।

নেতা : তাহলে এতক্ষণ দেরী হচ্ছে কেন?

হাফিজ : ঐ তখনই তো স্যার আরেকটা নতুন ফ্যাকড়া বাধল। কোথাথেকে ছুটে এসে ঐ মুর্দা ফকির চঁচামেচি শুরু করে দিল।

নেতা : কে? আপনাকে এতবার করে বলছি, দম্কা দম্কা একেকটা উদ্ভট কথা আমাকে বলবেন না। ধরাক করে বুকে লাগে! যা বলবার তা নাটক করে টিপে টিপে না বলে খোলাখুলি প্রথমেই সবটা বলে ফেলতে পারেন না। (বুকে হাত বুলাইয়া) এই মুর্দা ফকিরটি কে আবার? কবর খুঁড়ে বেরিয়েছে নাকি? কারফিউর মধ্যে এখানে ঢুকল কি করে? গার্ডগুলো কি করছিল?

 হাফিজ : এখানেই থাকে স্যার। গোরস্থানের বাইরে কখনও যায় না। বলেই তো ওই নাম। দিনরাত এখানেই পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে কবরের সঙ্গে আলাপ করে। পাগল! বদ্ধ পাগল!

নেতা : হুম!

হাফিজ : লোকটা এমনিতে ভাল লেখা-পড়া জানে। ভাল আলেম, গ্রামের স্কুলে মাষ্টারী করত। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষে চোখের সামনে ছেলে মেয়ে মা বৌকে মরতে দেখেছে! কিন্তু কাউকে কবরে যেতে দেখেনি। মুর্দাগুলো পচেছে। শকুনে খুবলে দিয়েছে। রাতের বেলায় শেয়াল এসে টেনে নিয়ে গেছে। সেই থেকে পাগল। গোরস্থান থেকে কিছুতেই নড়তে চায় না। বলে মরে গেল কেউ যদি কবর না দেয়। মরার সময় হলে, কাছাকাছি থাকব, চট করে যাতে কবরে ঢুকে পড়তে পারি। বড় ট্র্যাজিক স্যার।

 নেতা : অনেক খবর রাখেন দেখছি।

হাফিজ : চাকরি। চাকরি স্যার। চারদিকের হরেক রকমের খোঁজ আমাদের রাখতে হয় স্যার।

নেতা : বেশি খোঁজাখুজি করতে গিয়ে নিজের বুদ্ধিটাই কোথায় যেন খুইয়ে এসেছেন? মেহেরবানী করে তাড়াতাড়ি বলবেন কি গোলমালটা কিসের! লাশগুলো মাটি চাপা দিতে এত দেরী হচ্ছে কেন? ঠাণ্ডায় আপনার মগজ জমে গেছে। কেবল এলোমেলো বকছেন। নিন। (বোতলটা আগাইয়া দিয়া) এক চুমুক টেনে নিন। শরীর গরম হবে। বুকে সাহস পাবেন। কথা গুছিয়ে বলতে পারবেন। নিন।

 হাফিজ : আপনার সামনে স্যার? তার ওপর এখন স্যার নন ডিউটি

নেতা : তাকালুকের সময় নেই। লাশগুলো মাটি চাপা দিয়ে কারফিউ শেষ হবার আগে আমাদের এখান থেকে সরে পড়তে হবে। ঢিলেমির এটা সময় নয়। ধরুন। এক চুমুক টেনে চট পট কাজটা শেষ করে ফেলুন।

হাফিজ : বোতলে মুখ লাগিয়ে খাব স্যার?

নেতা : কেন চুসনি লাগিয়ে দিতে হবে নাকি?

(হাফিজ বোতলটা মুখে লাগাইয়া চো চো করিয়া একদম খালি করিয়া ফেলিল। ঢক করিয়া বোতলটা মাটিতে রাখিয়া চোখ বড় করিয়া এক মুহূর্ত থম্ থম্ ধরিয়া থাকে। তারপর আকৰ্ণ বিস্তৃত হাসিতে উদ্ভাসিত হইয়া…….)

হাফিজ : এ মালটা স্যার আরো ভাল। একেবারে কলজে গিয়ে ঘা মারে।

নেতা : মুর্দা-ফকির লাশগুলো দেখেছে?

হাফিজ। : এ্যা! ওহ্ হ্যাঁ, মানে না। বোধ হয় দেখেনি। ও ব্যাটার চলাফেরা কিছু ঠাওর করা যায় না। কোত্থেকে হঠাৎ হুস্ করে একেবারে সামনে এসে পড়ে। বোধ হয় আড়াল থেকে গোরখুঁড়েদের সঙ্গে আমার কথাবার্তা শুনে থাকবে। আচমকা পেছন থেকে লাফিয়ে পড়লো। ঠিক আমাদের মাঝখানে। তারপর কি তুখোড় বক্তৃতা। আমিতো গোর-খুঁড়োদের কথা মেনেই নিয়েছিলাম। এ-ব্যাটাই না কোত্থেকে উড়ে এসে ওদের বুঝাতে শুরু করলো : কিছুতেই না, একটা কবরেই কাজ সারতে হবে। যে হারে মানুষ মরছে তাতে নাকি শেষটায় ওর কবরের বাজারে ঘাটতি পড়ে যেতে পারে। দেখুনতো কি সব বিদঘুঁটে কথা!

নেতা : ওকে শুদ্ধ পুঁতে ফেললেন না কেন?

 হাফিজ : কি যে বলেন স্যার। মন ভুলিয়ে কাজ আদায় হলে জানে মেরে ফয়দা কি? পাগলা আদমি, একটু তাল দিয়ে কথা বলতেই শুড় শুড় করে আমার সঙ্গে চলে এলো। ওকে ওই দিকে পার করে দিয়ে আমি পাহারা দিচ্ছিলাম। আর এই শালারাও সেই কখন থেকে শাবল চালাচ্ছে, এখনও নাকি খোঁড়াই শেষ হলো না! (ঘড়ি দেখিয়া) এতক্ষণে নিশ্চয়ই প্রায় হয়ে এসেছে।

নেতা : (গ্লাস চুমুক দিয়া) না। কাজটা ঠিক হয়নি। এসব ফকির দরবেশ বড় ধড়িবাজ লোক হয়! কোত্থেকে কি উৎপাত সৃষ্টি করবে কে জানে।

হাফিজ : লাশ ও ব্যাটা দেখেনি। দেখলেও কিছু বুঝতে পারতো না। রক্ত মাংসের স্তূপ। দেখে ও কি বুঝবে? এ রকম লাশ তো ট্রেনচাপা মড়ারও হতে পারে।

নেতা : গুলী চলছে দুপুর বেলা। খবর দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে সঙ্গে সঙ্গে এফোর ওফোঁর। ফকির হোক পাগল হোক-শহরে থেকেও এ খবর ওর কানে পৌঁছেনি তা ভাবতে আমি রাজি নই। এসব খবর ঝড়ো হাওয়ার মুখে আগুনের ফুলকীর মতো ছড়িয়ে পড়ে।

 হাফিজ : মুর্দা-ফকির ঝড়ও বোঝে না, আগুনও বোঝে না। ও তো এক রকম কবরের বাসিন্দা। ভাষার দাবিতে মিছিল বেরিয়েছিল বলে পুলিশ গুলী করে। কয়েকটাকে খতম করে দিয়েছে- এত কথা বোঝবার মতো জ্ঞান-বুদ্ধি ওর নাই। লাশ দেখলেই ও মুখের মধ্যে ভাত গুঁজে দিতে চায়- কারণ ধারণা, মানুষ শুধু এক রকমেই মরতে পারে- খেতে না পেয়ে। পাগল, বদ্ধ পাগল।

 নেতা : কিন্তু লাশগুলোকে কোথায় কবর দেয়া হচ্ছে তা তো ও দেখেছে। সকাল বেলা যদি কাউকে আঙ্গুল দিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে দেয়? লাশ নিয়ে নিয়ে মিছিল করতে না পেরে ক্ষেপে গিয়ে সকাল বেলা যদি ছাত্ররা এখানেও খোঁজ করতে আসে?

হাফিজ : আপনারা লীডার। অনেক দূর ভাবেন। আমরা পেটি অফিসার, হুকুম তামিল করেই খালাস। কি করতে হবে?

(স্তব্ধতা)

নেতা : ওটাকে শুদ্ধো পুঁতে দাও।

হাফিজ : এ্যা? কি বলছেন স্যার? আপনি এক্সাইটেড হয়ে গেছেন স্যার। আর খাবেন না এখন।

নেতা : আমার মাত্রা আমি জানি। পুঁতে ফেল। দশ পনেরো-বিশ-পঁচিশ হাত- যত নিচে পারো। একেবারে পাতাল পর্যন্ত খুঁড়তে বলে দাও। পাথর দিয়ে মাটি দিয়ে, ভরাট করে পুঁতে ফেল। কোনদিন যেন আর ওপরে উঠতে না পারে। কেউ যেন টেনে ওপরে তুলতে না পারে। যেন মিছিল করতে না পারে, শ্লোগান তুলতে না পারে, যেন চাচাতে ভুলে যায়।

হাফিজ : আপনি বড় এক্সাইটেড স্যার! এ-সব কাজ বড় সূক্ষ্ম স্যার! এক্সাইটমেন্ট সব পণ্ড করে দিতে পারে। আমাদের ট্রেনিং-ই এ জন্য অন্য রকম। কোন সময়ই আমাদের উত্তেজিত হতে নেই। ভান করতে পারি কিন্তু আসলে উত্তেজিত নই।

নেতা : পুঁতে ফেল।

হাফিজ : ভুল খুব ভুল হবে। যাই করতে হয় স্যার খুব কুললী করতে হবে। এসব আমাদের রীতিমত প্রাকটিস করে আয়ত্ত করতে হয়েছে। এতে কাজ হয়। আমি একবার ঐ দিকটা দেখে আসি। এত দেরী হচ্ছে কেন বুঝতে পাচ্ছি না।

নেতা : যান তাড়াতাড়ি যান! আপনার কথা শুনতে শুনতে কানে তালা লেগে গেছে। নেশাটা পর্যন্ত জমতে পারছে না। আর বেশিক্ষণ আপনাকে দেখলে, আপনাকে শুদ্ধো পুঁতে ফেলতে ইচ্ছে হবে।

 হাফিজ : এ্যা। ওহ্- হে হে হে! আপনার কথা শুনলে হাসি পায় ঠিক। কিন্তু, মানে পিলে পর্যন্ত চমকে ওঠে স্যার। বুকটা ধড়ফড় করে উঠেছে। উঠতে গিয়ে মনে হলো যেন পড়ে যাবো। বড়ো ভয় পেয়ে গেছি স্যার। আরেকটু দেবেন স্যার? খেলে একটু মনে সাহস আসবে। এই নতুন বোতলটা কেমন স্যার?

নেতা : (চোখ তুলিয়া) আপনার মাত্রা আমার জানা নেই। এই দফায় একটু কমিয়ে দিলাম। (গ্লাসে কিছুটা ঢালিয়া বোতলটা তুলিয়া দিলেন।)

(নিঃশব্দে পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে মুর্দা ফকির। কেহ তাহাকে দেখে নাই! সর্বাঙ্গ কম্বলে ঢাকা। রুক্ষ ময়লা। চুল তীক্ষ্ণ কোটরাগত চক্ষু জ্বলিতেছে। হাফিজ ও নেতা বোতল ও গ্লাস চুমুকে চুমুকে শেষ করিয়াছে।)

ফকির : (হাফিজের কাঁধে হাত দিয়া) ঝুঁটা। (হাফিজ ও নেতা সভয়ে চিৎকার করিয়া উঠে। নেতা দুর্বল হৃৎপিণ্ড চাপিয়া ধরে।)

 নেতা : কে?

হাফিজ : এ্যা! ওহ আপনি? হঠাৎ অন্ধকারে চিনতে পারিনি হুজুর।

 ফকির : ঝুঁটা মিথ্যাবাদী! আমাকে চিনতে পারো না। এ-গোরস্থানে এমন কেউ নেই। জিন্দা-মুর্দা কেউ না। জিন্দা আর মুর্দায় পার্থক্য বোঝে? দেখলে চিনতে পারবে।

হাফিজ : সে হুজুর আপনার দোয়ায়।

ফকির :ঝুঁটা! তুমি কোনো পার্থক্য বোঝে না। তুমি বাঁচাল নালায়েক। তোমার মতো জিন্দা আদমীকে কেউ দোয়া করে না। পাগলেও না। তুমি আমাকে ধোকা দিয়েছ। আমি ওদের ভালো করে দিয়েছি, ওরা মুর্দা নয়। মরেনি। মরবে না। ওরা কখনো কবরে যাবে না। কবরের নিচে ওরা থাকবে না! উঠে চলে আসবে।

 হাফিজ : আপনি তো এইদিকে ছিলেন। ওদিকে গেলেন কখন?

ফকির : বাবা। তোমরা শহরের অলি-গলি যেমন চেন, এ গোরস্থান আমার তেমনি চেনা। এখানে কবরের নিচ দিয়ে সুড়ং আছে। আমি তৈরি করেছি। নইলে তোমাদের সঙ্গে পারব কেন?

 হাফিজ : হো হো হো। আপনি বড় মজার কথা বলেছেন হুজুর।

 ফকির : এইতো ঠিক বুঝতে পেরেছ বাবা! তুমি আমায় ফাঁকি দিতে চেয়েছিলে। ভেবেছিলে পাসপোর্ট করিয়েই ওপার চালান করে দেবে! পরীক্ষা না করে কি আর আমি এমনি যেতে দি!

হাফিজ : সালাম হুজুর! আপনি বুঝি এখানকার পাসপোর্ট অফিসার? মাফ করে দিন হুজুর, এতক্ষণ চিনতে পারিনি।

ফকির : সাবাস বেটা। তোর নজর খুলছে।

হাফিজ : তা হুজুর এখন অনুমতি দিন ওদের পার করে দি।

ফকির : না আমি প্রথমেই সন্দেহ করেছিলাম একটা কিছু গোলমাল নিশ্চয়ই আছে। তাই না চুপে চুপে সুড়ং দিয়ে ঢুকে এক্কেবারে তোমাদের ঢাকা মোটর গাড়ীর ভেতর গিয়ে উঠলাম।

 নেতা : ইন্সপেক্টর।

ফকির : প্রথমে দেখে মনে হলো ঠিকই আছে। কোনটার বুকের কাছে এক খাবলা গোশত নেই, কোনটার ফাটা খুলি দিয়ে কি সব গড়িয়ে পড়ছে, ভাবলাম ঠিকই আছে। কবরের কাবেল। কিছু নয়, শেয়াল-শকুনে খামছে কামড়ে একটু খারাপ করে গেছে। তারপর হঠাৎ খেয়াল করে দেখি- না তো ঠিক নাই। উঁহুম!

হাফিজ : সে কি হুজুর। ঠিক। সব তো ঠিকই আছে।

 ফকির : চোপরও। ঠিক নেই। গন্ধ ঠিক নেই। তোমরা চোরাকারবারি। আমি খুঁকে দেখেছি গন্ধ ঠিক নেই।

হাফিজ : গন্ধ?

ফকির : বাসি মরার গন্ধ আমি চিনি। এ লাশের গন্ধ অন্য রকম। গ্যাসের বারুদের গন্ধ। এ-মুর্দা কবরে থাকবে না। বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ হাত যত নিচেই মাটি চাপা দাও না কেন- এ মুর্দা থাকবে না। কবর ভেঙে বেরিয়ে চলে আসবে। উঠে আসবে।

হাফিজ : ওহ! তাহলে বলুন কবর দেয়া হয়ে গেছে। থাক। গন্ধ থাকুক। মাটির নিচ থেকে নাকে লাগবে না।

ফকির : ওরা জোর করে কবর দিয়ে দিল। আমায়ও বলল না। আমিও তোমাদের কথা মানবো না। ও মুর্দা কবরের নয়। আমিও ওদের ডেকে তুলে নিয়ে চললাম। হাফিজ : খোদা হাফেজ

(ফকির কিছুদূর যাইয়া আবার ফিরিয়া আসে। টানিয়া টানিয়া চারিদিক হইতে কি শুকিতে চেষ্টা করে। নিজের শরীরও শুকে দেখে।)

 ফকির : না, আমার গায়ের গন্ধ নয়। দেখি- (আগাইয়া আসিয়া একবার হাফিজের গা শুকিবে। তারপর ঝুঁকিয়া হাফিজের মুখের ঘ্রাণ নিয়াই জ্বলজ্বলে চোখ। বিস্ফোরিত করিয়া দেয়। ছুটিয়া নেতার মুখের ঘ্রাণ নেয়। মুখচোখ অধিকতর উজ্জ্বল করিয়া) উহ্! তাই বলো! এইবার পেয়েছি। ব্যাটারা কি ভুলই না করেছে!

নেতা : ইন্সপেক্টর, লোকটাকে দূর করে দাও এখান থেকে। ফকির। গন্ধ! তোমাদের গায়ে মরা মানুষের গন্ধ! তোমরা এখানে কি করছো? যাও তাড়াতাড়ি কবরে যাও। ফাঁকি দিয়ে ওদের পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা বাইরে থেকে মজা লুটতে চাও, না? না, না। আমার রাজ্যে এসব চলবে না। গন্ধ শুকে তোমাদের গায়ে মুখে পাই মরার গন্ধ। তোমাদের সময় হয়ে গেছে। ছিঃ, এরকম ফাঁকি দেয় না! আমি ওদের তুলে নিয়ে আসছি, তোমরা তৈরি হয়ে নাও। ইস্! গোর-খুঁড়েরা কি ভুলই না করেছে! না, না এতো হতে পারে না।

(বিড়বিড় করিতে করিতে ফকিরের প্রস্থান। মঞ্চে বিমূঢ় নেতা। হাফিজ হাসিতেছে প্রাণ খুলিয়া হাসিয়া লইতেছে। সাফল্যের হাসি। পানাধিক্য হেতু কিঞ্চিত বেসামাল।)

হাফিজ : হে হে হে হে স্যার! সব খতম স্যার। আমরা এখন ফ্রি! দেখলেন তো, পাগলটাকে কি রকম পোষ মানালাম। পাগলটাকে এত হুজুর হুজুর না বললে হয়ত গায়ের দিকেই ছুটতো। আর শরীরটা অনেকক্ষণ থেকেই এমন নড়বড়ে মনে হচ্ছে যে, এর ওপর এখন কিছু এসে পড়লে পাত্তা পাওয়া যেত না।

নেতা : ভালো হতো। তুলে নিয়ে আপনাকে শুদ্ধো পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা করতাম।

হাফিজ : ঐ একটা নোংরা কথা বারবার বলবেন না, স্যার। তাহলে আমিও আপনার সম্পর্কে দু’একটা হক্ কথা বলে ফেলবো কিন্তু।

নেতা : যেমন?

হাফিজ : যেমন? বেশ। একটা বলছি। আমাকে তুলে নিয়ে যাবার মতো ক্ষমতা বা অবস্থা আপনার এখন নেই। আপনি এখন নিজেকে নিজে খাড়া রাখতে পারলেই প্রচুর হাততালি পাবেন। বক্তৃতা না করলেও হাততালি দেবো।

নেতা : মারহাবা! সাবাস! খুব ধরেছেন। ডিপার্টমেন্টের মুখ উজ্জ্বল করবেন একদিন। একবারও তো ঠিক মতো উঠে দাঁড়াইনি, ধরে ফেললেন কি করে?

হাফিজ : অনেকদিন হলো এ-লাইনে আছি স্যার, এতটুকু বুঝবো না?

নেতা : সবটা ঠিক ধরতে পারেন নি। উঠতে হয়ত কষ্ট হবে, কিন্তু বক্তৃতা আমি ঠিক দিতে পারব। কি, বিশ্বাস হয় না বুঝি?

 হাফিজ : বিশ্বাস? হ্যাঁ! পারবেন। তা পারবেন। আমি, আমার ব্রেনটার ঠিক আছে। যে কোনও পরিস্থিতিতে এখনও আমার ডিউটি ঠিক করে যেতে পারবো তবে, তবে মানে এই চোখ, আর কান খামোকাই একটু বেশি কাজ করছে বলে ভয় হচ্ছে।

 নেতা : ভয়? ভয় কিসের? তুমি মনে করেছো ঐ মুর্দা ফকিরের কথায় আমি ডরাই। এখান থেকে যাওয়ার আগে ওটাকে মুর্দা বানিয়েই যাবো। কোথাকার আমার জিন্দা পীর এসেছেন- ওর কথায় গোর থেকে লাশ উঠে আসবে।

হাফিজ : কিছু মনে করবেন না স্যার। একটা ওয়াল পুছ করছি আপনাকে। মনে করেন, সত্যি যদি ঐ মুর্দা ফকির লাশগুলোর একটা মিছিল নিয়ে এসে দাঁড়ায়- কি করবেন তখন আপনি?

নেতা : সব্বাইকে, আপনাকে শুদ্ধো এক সঙ্গে পুতে ফেলতাম। হাফিজ আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে রসিকতা করিনি। ঐ মুর্দা ফকির শুনেছি অনেক কিছু জানে। কিন্তু যদি আসেও আমি ভয় পাই না। একটুও না। প্রথমে হাসবো। দেখবো। এগিয়ে যাবো। হাত মেলাবো। ভয় কিছুতেই পাবো না।

(নিজের গলা দুই হাতে সজোরে টিপিয়া ধরিয়া)

গ…লা টিপে ধরে রাখবো। যাতে বুকের মধ্যে ভয় কিছুতেই ঢুকতে না পারে। আরেকটু দেবেন স্যার? বুকে সাহস আসবে। কেমন জানিইয়ে করছে।

(ততক্ষণে পার্টিশনের ঐ পাশ হইতে সকলের অলক্ষ্যে ক্রমোজ্জলিত আলোক শিখার কম্পিত গোলকের মধ্যে একটি ভয়াবহ মুখ ভাসিয়া উঠিয়াছে। সমস্ত বদনমণ্ডল পরিবেষ্টিত করিয়া রক্তাক্ত ব্যাণ্ডেজ। মূর্তি নিশ্চল। নেতা যখন শেষ বারের মতো ইন্সপেক্টরকে পানীয় দিবার জন্য গ্লাসে বোতল উপুড় করিয়া ধরিয়াছেন তখন ঐ স্তব্ধ মূর্তির একটি প্রায় অদৃশ্য হাত অন্ধকার হইতে কি যেন ছুঁড়িয়া মারিল। কাঁচের গ্লাসে ঝন্‌ ঝন্ শব্দ। নেতা ও হাফিজের ভয়ার্ত অস্কুট চিৎকার!)

হাফিজ : গুলি। গুলি স্যার! শুয়ে পড়ুন শীগগীর! গুলি!

(দুইজনে উপুড় হইয়া শুইয়া পড়ে। পশ্চাতে কম্পিত শিখায় নিস্পন্দন মুখ! কয়েক মুহূর্তের সুতীব্র স্তব্ধতা।)

নেতা : (চাপা স্বরে) গুলি যে বুঝলে কি করে?

হাফিজ : দেখেছি!

 নেতা : কে ছুঁড়েছে তুমি দেখেছো?

 হাফিজ : না। তবে কি ছুঁড়েছে দেখেছি।

নেতা : কোথায়?

হাফিজ : বেশি নড়বেন না। খুঁজে দেখছি পাই কি না? (উপুড় হইয়া একটু চারদিকে হাতড়ায়। হঠাৎ কি তুলিয়া দেখে) ধরুন, পেয়েছি।

নেতা : (হাতে লইয়া) এ কি? এ যে বুলেট। রক্তমাখা।

হাফিজ : কুললী! কুললী ভয় পাবেন না স্যার। ভয় পেলেই সব গেল। এ নিশ্চয়ই ঐ মুর্দা ফকিরের কাণ্ড। ট্রাকের ভিতর ঢুকে লাশের গা থেকে হয়ত খুলে নিয়ে এসেছে। সেগুলোই ছুঁড়ে মেরে এখন আমাদের ভয় দেখাচ্ছে।

 নেতা : ও! তাহলে বলো কিছু না। মুর্দা ফকির- সে তো জ্যান্ত আদমী। বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

 হাফিজ : এখন উঠে পড়া যাগ স্যার! মিছেমিছি ভয় পেয়ে লাভ কি!

নেতা : ইন্সপেক্টর!

হাফিজ : জী!

নেতা : আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে- যে মেরেছে, সে এখনও আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

হাফিজ : তুমি একটু ঘুরে একবার দেখ তো। আমিও তাকাচ্ছি।

(ধীরে মাথা ঘুরাইয়া দেখে সর্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠে। আপ্রাণ চেষ্টায় অস্বাভাবিক স্থির কণ্ঠে) উঠে এসেছে।

 নেতা : কে?

হাফিজ : সেই লাশটা!

নেতা : লাশ? কোন লাশটা।

হাফিজ : বুলেট খাওয়া। ছাত্র খুলি নেই!

নেতা : ওহ্! কি চায়?

 হাফিজ : চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করে দেখব?

নেতা : কি জিজ্ঞেস করবে?

হাফিজ : এ, কি চায়, কেন উঠে এসেছে, ঠাণ্ডা লাগছে নাকি- এই সব?

নেতা : আমাদের কথা বুঝবে?

হাফিজ : ট্রাই করতে হবে। সব লাইনই ট্রাই করতে হবে। এটা একটা নতুন সিচুয়েশান স্যার। কলি অগ্রসর হতে হবে। ঘটনা হিসেবে এটা অবাস্তব হতে বাধ্য। কিন্তু অন্যরকম হলেও আমাদের ভয় পেলে চলবে না। ফেইস করতেই হবে।

(উঠিয়া দাঁড়াইবে। বেশ কষ্ট। নাটুকে মাতালের টলায়মান অবস্থা নয়, তবে নেশা যে উভয়েরই খুব গাঢ় হইয়াছে তাহা স্পষ্ট।)।

নেতা : আপনি কিন্তু ভয় পাবেন না। আমি পেছনে রয়েছি। পিস্তলের টিপ আমার পাক্কা।

 হাফিজ : খবরদার অমন কাজও করবেন না। (ফিস্ ফিস্ করিয়া) পিস্তলের কেশ এটা নয় স্যার! বুঝতে পারছেন না- এটা-ঠিক মানে, অন্য জিনিস, মানুষ নয়। পিস্তল রেখে দিন। লক্ষ্য করুন আমি কি রকম সামলে নিচ্ছি। একটু আলাপ করতে পারলেই পোষ মানিয়ে নেবো। ধীরে ধীরে আগাইয়া মূর্তির। নিকট আসে! বাতাসে টানিয়া টানিয়া স্পর্শ করতে চেষ্টা করে।) এই।–এই! আমার কথা শুনতে পাচ্ছ! এই! হেই। (মূর্তি নীরব! নিশ্চল) (ঘুরিয়া) স্যার, কোন সাড়া দিচ্ছে না যে?

নেতা : বোধ হয় আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। আমাদের সঙ্গে হয়ত কোন কাজ নেই। ভালো। তা ভালো। ও থাকুক। চলো আমরা আমাদের কাজে যাই।

হাফিজ : তা হয় না স্যার। ওকে এখানে দাঁড় করিয়ে আমরা চলে যাবো? তা হয় না স্যার। আমার ডিউটি আমাকে করতেই হবে। ওকে ফেরৎ না পাঠিয়ে আমরা চলে যেতে পারি না, স্যার!

 মূর্তি : আমি যাবো না। আমি থাকবো। (দু’জনে হতবাক। ধীরে ধীরে হাফিজ আগাইয়া যায়)। কোথায় যাবে। কোথায় থাকবে?

মূর্তি : কবরে যাবো ন। এখানে থাকবো।

হাফিজ : অবুঝের মতো কথা বলো না। তোমাদের এখন এখানে আর থাকতে নেই। তোমরা মরে গেছ। অন্যখানে তোমাদের জন্য নতুন জায়গা ঠিক হয়ে গেছে। সেখানেই এখন তোমাদের চলে যাওয়া উচিত।

মূর্তি : মিথ্যে কথা। আমরা মরিনি। আমরা মরতে চাইনি। আমরা মরবো না।

হাফিজ : (নেতার কাছে আসিয়া) বড় একগুয়ে স্যার। আলাপ করে সুবিধে হবে, মনে হচ্ছে না। একটা বক্তৃতা দিয়ে দেখবেন স্যার? যদি কিছু আছর হয়! পারবেন না স্যার? আপনি তো বলেছিলেন- যাই হোক- বক্তৃতা দিতে আপনার কোন কষ্ট হবে না। একবার ট্রাই করুন না!

 নেতা : (ভাল করিয়া শুনিয়া) দেখ ছেলে, আমার বয়স হয়েছে। তোমার মোরব্বিরাও আমাকে মানে। বহুকাল থেকে এদেশের রাজনীতি আঙ্গুলে টিপে টিপে গড়েছি, শেপ, দিয়েছি! কওমের বৃহত্তম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বলতে পার, আমিই একচ্ছত্র মালিক! কোটি কোটি লোক আমার হুকুমে ওঠে বসে

মূর্তি : কবরে যাব না।

 নেতা : আগে কথাটা ভাল করে শোন। তুমি বুদ্ধিমান ছেলে শিক্ষিত ছেলে। চেষ্টা করলেই আমার কথা বুঝতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে উঁচু ক্লাসে উঠেছ। অনেক কেতাব পড়েছ। তোমার মাথা আছে।

মূর্তি : ছিল। এখন নেই। খুলিই নেই। উড়ে গেছে। ভেতরে যা ছিল রাস্তায় ছিটকে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।

নেতা : জীবিত থাকতে তুমি দেশের আইন মানতে চাও নি। মরে গিয়ে তুমি এখন পরপারের কানুনকেও অবজ্ঞা করতে চাও। ক্যুনিজমের প্রেতাত্মা তোমাকে ভয় করেছে, তাই মরে গিয়েও এখন তুমি কবরে যেতে চাও না। তোমার মতো ছেলেরা দেশের মরণ ডেকে আনবে। সকল সর্বনাশ না দেখে তুমি বুঝি কবরে গিয়েও শান্ত থাকতে পারছে না। তোমাকে দেশের নামে কওমের নামে দীনের নামে, যারা এখনও মরেনি- তাদের নামে মিনতি করছি– তুমি যাও, যাও, যাও!

মূর্তি : আমি বাঁচবো।

নেতা : কি লাভ তোমার বেঁচে? অশান্তি ডেকে আনা ছাড়া তোমার বেঁচে কি লাভ? তুমি বেঁচে থাকলে বারবার দেশে আগুন জ্বলে উঠবে, সবকিছু পুরিয়ে ছারখার না করে সে আগুন নিভবে না! তার চেয়ে তুমি লক্ষ্মী ছেলের মতো কবরে চলে যাও। দেখবে দু’দিন সব শান্ত হয়ে যাবে। দেশে সুখ ফিরে আসবে।

 (মূর্তি মাথা নাড়ে)

আমি ওয়াদা করছি তোমাদের দাবি অক্ষরে অক্ষরে আমরা মিটিয়ে দেবো। তোমার নামে মনুমেন্ট গড়ে দেবো। তোমার দাবি এ্যাসেম্বলীতে পাশ করিয়ে নেবো। দেশজোড়া তার জন্য প্রচারের ব্যবস্থা করবো। যা বলবে তাই করবো। দোহাই তোমার তবু অমন স্তব্ধ পাথরের মূর্তির মতো আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকো না। মরে যাও, চলে যাও, অদৃশ্য হয়ে যাও।

(সর্বাঙ্গে কাফনের কাপড় জড়াইয়া আর একটি মূর্তি নিঃশব্দে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়াছে। চুলে রক্ত-মাখা। মুখে আঘাতের চিহ্ন। ঠোঁটের দুই পাশে বিশুষ্ক রক্তরেখা।)।

কে? তুমি কে?

 মূর্তি (২) : নাম বললে চিনতে পারবেন না। হাইকোর্টের কেরানী ছিলাম। তখন টের পাইনি। ফুসফুসের ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছিল। এপিঠ এপিঠ। বোকা ডাক্তার খামাকো কেটেকুটে গুলিটা খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছে। জমাট রক্তের মধ্যে ফুটো নজরেই পড়েনি প্রথমে।

 নেতা : তুমিও এই দলে এসে জুটেছো নাকি?

মূর্তি (২) : গুলি দিয়ে গেঁথে দিয়েছেন। ইচ্ছে করলেও আলগা হতে পারবো না।

নেতা : তুমি আমাকে চেন?

মূর্তি (২) : চশমাটা আর খুঁজে পাইনি। অন্ধকারে আপনাকে চেনা যাচ্ছে না। তবে আপনার গলা চিনি।

 নেতা : আমার কথা শুনেছ? এইমাত্র যা বলছিলাম?

মূর্তি (২) : আপনি মিথ্যাবাদী। কথা দিয়ে আপনি কথা রাখেন না। আপনি অনেক ওয়াদা করে সেবার আমাদের দেড় মাস লম্বা ধর্মঘট ভেঙ্গে দিয়েছেন। আমার ছোট ছেলেটা তখন মারা যায়। আপনার কথা শুনেছি। আপনার কথা ভুলিনি। আপনি মিথ্যেবাদী।

মূর্তি : আমরা কবরে যাবো না।

মূর্তি (২) : আমরা বাঁচবো। (বিড়বিড় করতে করতে পশ্চাতে গিয়া উপুড় হইয়া বসিবে। আর দেখা যাইবে না।)

 (নেতা মাথা নিচু করিয়া সরিয়া আসে। হাফিজ অগ্রসর হইয়া কানের কাছে বেশ জোরে ফিস্ ফিস্ করিয়া।)

হাফিজ : হবে না। এই লাইনে ঠিক কাজ হবে না স্যার। অন্য রাস্তা ধরতে হবে। আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। দেখবেন ঠিক কাবু করে ফেলবো। একটু বোল বদলাতে হবে। সবই আমাদের করতে হয় স্যার। আপনি চুপ করে বসে দেখুন।

 (হাফিজ চাদরটা খুলিয়া এক প্যাঁচ গায়ের উপর জড়াইয়া বাকি অংশ ঘোমটার মতো মাথার উপর তুলিয়া দিল।)

 নেতা : ঢং ছাড়ো। মেয়েলোকের মতো ঘোমটা দিয়েছো কেন?

হাফিজ : (ফিস্ ফিস্ করিয়া) চুপ। আমি এখন স্ত্রীলোক। ঐ ছোকরার মা। কথা বলবেন না। দেখে যান। বুঝতে পারছেন না সবই একটু ঘোরের মধ্যে আছি, কিছু ধরতে পারবে না।

(আঁচল টানিয়া, ঘোমটা উঠাইয়া সামনে আসিয়া দাঁড়ায়। কণ্ঠ স্বরকে অনাবশ্যকভাবে স্ত্রীলোকের মতো করিয়া তুলিবার চেষ্টা নাই। তবে যথোপযুক্ত আবেগে ভরপুর।) খোকা! খোকা!

মূর্তি : (চঞ্চল। বেদনাহত!) কে? কে ডাকে?

হাফিজ : খোকা কোথায় গেলি তুই? খো-কা!

মূর্তি : কে? মা? মা। তুই কোথায় মা! (শূন্যে হাতড়ায়)

হাফিজ : এই যে যাদু, আমি এখানে।

মূর্তি : তুমি আমার ওপর খুব রাগ করেছ না মা? তুমি বারণ করলে, তবু আমি শুনলাম না। রাস্তা থেকে ওরা ডাকলো। আমি ছুটে বেরিয়ে গেলাম। তোমার কাছে বলতে গেলে পাছে তুমি বাধা দাও- সেই জন্য তোমাকে কিছু না বলেই চুপে চুপে চলে গেছি। আজ যে ওরকম গোলমাল হবে তুমি আগে থেকে কি করে জানলে মা?

হাফিজ : মা হলে সব জানতে হয়। মা হলে জানতি, মার কষ্ট কি! মার বুক খালি হলে, মার কেমন লাগে, তুই দস্যু ছেলে বুঝবি না।

মূর্তি : তোমার সব কষ্ট বুঝি মা। নাক-মুখ বেয়ে আমার কেবল রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। সমস্ত দুনিয়াটা ঝাঁপসা হয়ে এল। আমার তখন খালি কি মনে হচ্ছিল জান মা? মনে হচ্ছিল তুমি বুঝি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছো। সেই সেবার টাইফয়েড জ্বরের ঘোরে যখন খালি প্রলাপ বকতাম, তখন যেমন আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ঠিক তেমনি। আর আমার নাক মুখ গড়িয়ে তোমার চোখের গরম নোনা পানি কেবল ঝরছে। ঝরছে।

হাফিজ : তবু তো কোন কথা শুনিস্ না। কেবল মার দুঃখ বাড়াতেই জন্মেছিস। এ তোদের কি নেশা! এত মরণ-পাগল কেন তোরা?

মূর্তি : মিছে কথা মা! আমরা কেউ মরতে চাই নি মা। তোমার কাছে থাকতে কি আমার ইচ্ছে করে না? হারিকেনের লণ্ঠন জ্বেলে অনেক রাত পর্যন্ত পড়ব। তেল কমে এলে সলতে উস্কে দিয়ে পড়ব, আর তুমি বারবার এসে বকবে কেবল বকবে। তারপর লণ্ঠন জোর করে কেড়ে নিয়ে যাবে। টেনে বিছানায় শুইয়ে দেবে। অন্ধকারে মশারীর ফাঁক দিয়ে ছায়া-মূর্তির মতো ঘুমে জড়ানো তোমার ছোট্ট এলোমেলো শরীরটা দেখবো- দেখবে- মা, চলে যেও না- মা! তোমায় আমি দেখবো-তোমায় আমি আদর করবো।

মা-তুমি কোথায় মা?-মা!

 হাফিজ : ঘুমের ঘোরে কি বকছিস? স্বপ্ন দেখছিলি বুঝি? অনেক রাত হয়েছে লক্ষ্মী বাবা, আর রাত জেগে পড়ে কাজ নেই। বিছানা করে রেখেছি। যাদু আমার শুতে যা।

 মূর্তি : আমাকে শুতে যেতে বলছো মা? না। না। আমি শোব না। আমি এখন শোব না মা। আমি আর কোনদিন শোব না। একবার ঘুমিয়ে পড়লে ওরা আমাকে আর জাগতে দেবে না। তুমি বুঝতে পারছ না মা- না, না আমি শোব না। আমি যাব না। আমি থাকব। আমি উঠে আসব!

 নেতা : ইন্সপেক্টর! তোমার এ ভূতুড়ে নাটক আর কতক্ষণ চলবে?

হাফিজ : ছিঃ বাবা! জিদ করো না। লক্ষ্মীটি শুতে যাও। মার কথা শোন।

(দ্বিতীয় মূর্তি আচমকা চঞ্চল হইয়া উঠিয়া দাঁড়ায়)

 মূর্তি (২) : (অস্পষ্টভাবে হাফিজের দিকে হাত বাড়াইয়া) মিন্টু। মিন্টু। মিন্টু ঘুমায়নি এখনও।

হাফিজ : (সুর পাল্টাইয়া) তোমার কোলে আসার জন্য কাঁদছে।

 মূর্তি (২) : (দাও, আমার কোলে দাও। বাচ্চা কোলে লইবার ভঙ্গি করে) ইস! জ্বরে যে গা পুড়ে যাচ্ছে গো!

 নেতা : খবরদার! ফেলে দাও। ওটাকে ফেলে দাও কোল থেকে। এই শেষবারের মতো বলছি এখনও ভালো চাও তো সরে পড়। চলে যাও সব।

মূর্তি : আমি যাবো না। আমি বাঁচবো মা। বৃষ্টিতে ভেজা নরম ঘাসের ওপর দিয়ে খালি পায়ে আমি আরো হাঁটবো মা। ঠাণ্ডা রূপোর মতো পানি চিরে হাত পা ছুঁড়ে সাঁতার কাটবো মা!

 মূর্তি (২) : কাঁদিসনে মিন্টু! তোর বাপ কি কম চেষ্টা করেছে? দুষ্টু মুদী কিছুতেই মাসের শেষ বলে এক রত্তি বার্লি বাকি দিল না। বেতন নেই দেড় মাস, দেবে কেন? তুই কাদিসনে মিন্টু। তুই কাঁদলে তোর মাও কেবল কাঁদবে। এখন চুপ করে ঘুমিয়ে থাক। দেখবি, কাল ভোরে সব জ্বর কোথায় চলে গেছে।

 নেতা : কাল পর্যন্ত তোমাদের নিয়ে এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে নাকি? না আমি তা পারবো না। এতসব আবদার আমার সঙ্গে চলবে না। গেট আউট! ডেভিলস! যাও বলছি।

হাফিজ : উত্তেজিত হবেন না স্যার! কুলি! কুউললি!

মূর্তি : তুমি একটুও ভয় পেয়ো না। কিছু ভেবো না মা। আমি কিছুতেই মরব না। ছায়া মূর্তির মতো বার বার আসবো। তুমি যদি আমার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ো, দরজায় এসে টোকা দেবো। চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে হাতখানি দিয়ে তোমায় ইশারা করবো। তোমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বো মা।

মূর্তি (৩) : (কোলের কল্পিত সন্তানকে) দূর বোকা! তুই স্বপ্ন দেখছিস। ভয়ের কি আছে? তুই তো আমার কোলে! আমি থাকতে তোকে মারে এমন দৈত্য দুনিয়ায় নেই। (সামনের দিকে ইশারা করিয়া) ওগুলো কিছু না। সব সং সেজে তোকে ভয় দেখাতে চায়। তুই ঘুমো। ঘুমো।

 নেতা : ইন্সপেক্টর! আমি এসব মানি না। আমি সব পুঁতে ফেলব। একটা একটা করে গুলি করে আমি সব মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবো। হাজার হাজার হাত মাটির নিচে সব পুঁতে ফেলবো। যাতে কোনদিন আর উঠতে না পারে। ভয় দেখাতে না পারে। গুলি, সবগুলোকে আবার গুলি করো। গার্ড! (হস্তদন্ত হইয়া প্রবেশ করে মুর্দা ফকির।)

 ফকির : জ্বী হুজুর।

নেতা : (লক্ষ্য না করিয়া) গুলি করো।

ফকির : গুলি ওহ্! হা! আছে। আমার কাছে আরো কয়েকটা আছে। এই নিন বুলেট। খুব তাজা। টাকা! এখনও খুন লেগে রয়েছে। হাত পাতুন। ধরুন!

(স্তম্ভিত ভয়ার্ত বিমূঢ় নেতা হাত বাড়াইয়া গ্রহণ করিবে) লোড আপনি করুণ। আমি ওদেরকে ডেকে নিয়ে আসি। যাই। আমি মিছিলটা এই দিকে ডেকে নিয়ে আসি।

 (হস্তদন্ত হইয়া ফকিরের প্রস্থান। সেই গমন পথের দিকে তাকাইয়া নেতা একবার নিজের বুক চাপিয়া ধরে। হাফিজ পিছন হইতে আগাইয়া তাহাকে ধরে।)

নেপথ্যে মুর্দা ফকির চিৎকার করিতেছে : তোরা কোথায় গেলি? সব ঘুমিয়ে নাকি? উঠে আয়। তাড়াতাড়ি উঠে আয়। সব মিছিল করে উঠে আয়। গুলি। গুলি হবে ফুর্তি করে উঠে আয় সব! কোথায় গেলি? সব উঠে আয়। মিছিল করে আয় এদিকে। আজ গুলি-গুলি হবে আজ! কবর খালি করে সব উঠে আয়!)

(মঞ্চের উপরের লাল মূর্তিদ্বয় মুর্দা ফকিরের ডাক কান পাতিয়া শুনিতেছিল। ক্রমে একটু চঞ্চল হইয়া উঠিল। তারপর ধীরে ধীরে একজনের পিছনে আরেকজন- ক্রমে আরও অনেক সারি দিয়া চলিয়া যাইবে এবং তাহাদের উপর প্রতিফলিত আলোর রেখাও ক্রমে বিলীন হইয়া যাইবে।)

(হাফিজ ও নেতা লক্ষ্য করে নাই যে মঞ্চ খালি হইয়া গিয়াছে।)

 নেতা : (বিবর্ণ মুখে) ইন্সপেক্টর! হার্টটা জানি কেমন করছে। বড় ভয় পেয়ে গেছি! একটু ধরে রেখো আমাকে! আর আর একটু ঢেলে দিতে পারবে?

হাফিজ : না! আপনার এখনও হুঁস নেই! আমার নিজেরও হয়ত নেই। ঠিক বুঝতে পারছি না!

(পিছন হইতে গার্ড হঠাৎ লণ্ঠন হাতে ঢুকিয়া পড়িয়া প্রচণ্ড শব্দে বুট ঠুকিয়া স্যালুট করে।)

নেতা : (চমকিয়া) কে? এটা কি আবার?

হাফিজ : (দেখিয়া) ইডিয়ট! এটা কি তোমার প্যারেড গ্রাউণ্ড নাকি? বন্দুকের গুলির মতো স্যালুট করতে শিখেছ দেখছি। কি চাও?

গার্ড : গাড়ীতে উইড্যা হগলে আপনাগো লাইগা এন্তেজার করতাছে। সব কাম খতম। কারফিও শেষ হইতেও আর দেরী নাই।

 হাফিজ : (প্রথম লক্ষ্য করিল যে, মঞ্চ খালি! ভাল করে কয়েকবার চোখ কচলায়)

গুড! সব কাজ খতম তো? গুড! সব কাজ খতম স্যার। নীট জব। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি স্যার। ভাল করে দেখুন না নিজেই।

নেতা : (ধীরে ধীরে চোখ ঘুরাইয়া দেখে, তারপর সামনের দিকে অর্থহীন বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলিয়া চুপ করিয়া থাকে) হুম!

গার্ড : কিছু তালাশ করতেছেন হুজুর? খুইজা দেখুম?

নেতা : না চলো।

হাফিজ : কিছু না স্যার! এসব কিছু না। গোরস্থানে এরকম কত কিছু হয়। তার ওপর আবার স্যার …. মানে….

 নেতা : হুম। চলো! আর দ্যাখো মূর্দা ফকিরটাকে সঙ্গে নিতে হবে। কিছুদিন থাকুক। (বুকে হাত চাপিয়া ধরে।)।

 হাফিজ : এ্যা? মূর্দা ফকির? ওহ! নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! ইয়েজ স্যার! (সকলেই ধীরে ধীরে চলিয়া যাইবে। গার্ড গ্লাস বোতল ইত্যাদি গুছাইয়া লইবে।)

য ব নি কা

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *