১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার, সকাল ৯:৩৯
নজরুলের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা
বৃহস্পতিবার, ১ জুলাই, ২০২১

মো. হুমায়ূন কবির।।

দুই দশকের সামান্য কিছু বেশি সময় ধরে কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্যচর্চা করতে পেরেছিলেন (১৯১৯-১৯৪২)। নিশ্চিত ভাবে সেটা ২৫ বছরের কম। এই ঘটনাবহুল সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর, বাংলা সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় নজরুল ইসলাম সফল ভাবে তাঁর স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন। তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনের বিকাশকাল ছিলো দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়। তিনি বৃটিশপক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন ১৯১৭ সালে। ১৯২০ সালে তিনি যুদ্ধ থেকে ফিরে কলকাতার পত্র-পত্রিকায় কবিতা-গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। খুব দ্রুত তিনি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কবি হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। একমাত্র নজরুল ইসলামের সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতা ছিল যা তার লেখার মধ্যে স্পষ্টত প্রতিফলিত হতো। ধূমকেতুর মতো প্রবল ঝড়ের শক্তি নিয়ে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন। এবং মাত্র দুই দশক পরে হঠাৎ তাঁর বাকশক্তি রুদ্ধ হয়ে যায় (১৯৪২) এবং তিনি নিভে যান। এটা এই মহান বিদ্রোহী কবির জন্যে বেদনাদায়ক। বেদনাদায়ক বাংলা সাহিত্যের জন্যেও সর্বোপরি ।  পরবর্তী চৌত্রিশ বছর তিনি জীবিত ছিলেন, কিন্তু তাঁর কোন বোধগম্যতার শক্তি ছিলো না। বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করেন। ২৯ অগাস্ট ১৯৭৬, তিনি ইন্তেকাল করেন।

নজরুলের সাহিত্যচর্চার প্রায় সবটুকু সমকাল আশ্রিত। তাঁর উত্থানপর্বে রাজনীতি ও সমাজাঙ্গনে যা কিছু ঘটছিলো, তিনি তাতে বীরোচিত প্রতিক্রিয়া করেন। ‘সামাজিক প্রত্যাশা ও রাজনীতিকে শিল্পে রূপান্তরিত করে অপরিসীম জীবনচাঞ্চল্যে উন্মুখর হয়ে ওঠেন তিনি।’

বাংলা কবিতায় তাঁর আবির্ভাবের পটভূমিটা বেশ ঘটনাবহুল।বাংলা-ভারত তখন বৃটিশ-ঔপনিবেশিক শক্তি শাসিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৯) এই অঞ্চলে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলে। কংগ্রেস(১৮৮৫) ও মুসলিম লীগ(১৯০৬) অর্জন করে পরিণত সংগঠনের বৈশিষ্ট্য। প্রথম দশকের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন স্তমিত হলে দ্বিতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় দশকে শুরু হয় গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন। সেই সাথে বাড়তে থাকে বাংলা-সরকারের দমনপীড়ন। অন্যদিকে বহিঃবিশ্বে ১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ বিপ্লবের সাফল্যজনিত প্রতিক্রিয়ায় অবরুদ্ধ বাঙালি সমাজ-মানসে উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলনের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে নজরুলের কবিতাই প্রথম প্রত্যক্ষ ভাবে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে বাংলা তথা সমগ্র ভারত ভূ-খণ্ডের মুক্তির দাবি উচ্চারিত হয়।  মোট কথা, সময়ের তাগিদে, সমাজের প্রয়োজনে, সমকালের উত্তপ্ত ঘটনাবলির অভিঘাতে নজরুলের কাব্যশক্তি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।

উল্লেখ্য যে জাতির রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে প্রয়োজন ছিলো সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সংহতি যা বৃটিশদের চক্রান্তে সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছিল। নজরুল ইসলাম তা সচেতনভাবে অনুভব করেছিলেন। তিনি অনুসরণ করেন ধর্মনিরপেক্ষ অসম্প্রদায়িকতার পথ। সুগভীর ঐক্যচিন্তায় ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় তাঁর কাব্যসাধনা উৎসর্গিত হয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য তাঁর জীবনদর্শনের অন্যতম প্রার্থিত বিষয়।

নজরুলের কাব্যে প্রেম ও প্রকৃতির বন্দনা আছে, নারী জাগরণের কথা আছে, শ্রেণিহীন সমাজপ্রতিষ্ঠার কথা আছে, ধর্মীয় ভাবধারার উজ্জীবনের কথা আছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা। এই দুটো বিষয় গণমানুষের সাথে নজরুল প্রতিভার সম্পর্ককে তাৎপর্যবহ করেছে। নজরুলের কাব্যশক্তির উৎস সমাজ; সমাজে বিদ্যমান সংকটই তার কবিতায়-গানে-প্রবন্ধে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।

দুই.

সমকালের সমস্যা অঙ্গীকার করে তিনি নিজের আত্মপ্রকাশকে আগ্নয়গিরির উত্তপ্ত লাভার মতো চারদিকে ছড়িয়ে দিলেন। তার একটি মাত্র কবিতায় সেটা প্রকাশ পেলো ‘বিদ্রোহী’। যুদ্ধ প্রত্যাগত নজরুল বীর সেনানীর অজেয় দর্পে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। ঘোষণা করলেন নিজের পরিচয়।

‘‘বল  বীর

বল    উন্নত মমশির।

শির নেহারি, আমারি নত শির ঔই শিখর হিমাদ্রির।

আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস

আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।

আমি চির বিদ্রোহী বীর…

বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির।

…বিদ্রোহী। (অগ্নিবীণা)

আমিত্বের জয়গানে মুখরিত একমাত্র ‘বিদ্রোহী’ কবিতার দ্বারা তাঁর কবি সত্তার স্বরূপ চিহ্নিত হয়ে যায় এবং তাঁর ‘আত্মমুদ্রাচিহ্নিত’ এই বিদ্রোহী কবিতা তাঁকে এনে দেয় বিদ্রোহী কবির খেতাব। তিনি অসংখ্য পরিচয়ে নিজের সত্তার পরিচয় তুলে ধরেছেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যার প্রধান প্রতিপাদ্য সাম্রাজ্যবাদের প্রতিবাদ। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের ‘শাত-ইল আরব’, ‘কামালপাশা’, ‘আনোয়ার’ ও ‘আগমনী’ প্রভৃতি কবিতার বিষয়বস্তুর মৌলপ্রতিপাদ্য সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। বিশ্বের যেখানে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই চলেছে, সেখানকার প্রতিবাদী ব্যক্তিত্বকে তিনি কাব্যগত করেছেন।বৃটিশ বিরোধী মিশরের জগলুল পাশা, মরক্কোর রিপ সর্দার আব্দুল করিম যিনি স্পেনের কর্তৃত্বের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, রুশ-বিপ্লবের জনপ্রিয় ভ.ই লেনিন এবং আফগান বাদশা আমানুল্লাহর প্রশংসা করেন। ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে যেখানেই সাম্রাজ্যবাদ  ও উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রাম হয়েছে সেসব স্বাধীনতাকামী সংগ্রাম ও সংগ্রামী নেতাদের আদর্শায়িত করে তিনি কবিতা রচনা করেছেন, যা থেকে ভারতের মহাত্মা গান্ধী বা বাংলার দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশও বাদ পড়েন নি।’(আন্তর্জাতিক নজরুল, রফিকুল ইসলাম, ২৯ আগস্ট, ২০১৪ প্রথম আলো)

১৯২২ সালের ২৩ অক্টোবর ‘ধুমকেতু’ পত্রিকার এক সম্পাদকীয়তে কবি বলেন, সর্বপ্রথম ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজটরাজ বুঝি না। কেননা, এ কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম অর্থ করে থাকেন। ভারতের এক পরমাণু অংশও বিদেশিদের  অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে।’

মুজাফফর আহমদ তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন, ১৯২৩-২৪ সালে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন আবার যে মাথা তুললো তাতে নজরুলের অবদান ছিলো, একথা বললে বোধ হয় অন্যায় হবে না। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের দুটি বড় বিভাগের মধ্যে ‘যুগান্তর’ বিভাগের সভ্যরা তো বলেছিলেন যে ‘ধূমকেতু’ তাদেরই কাগজ।’ (কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা, পৃষ্ঠা-২৯১)

২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২, ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি কর্তৃপক্ষের কোপানলে পড়ে। ঐ কবিতায় কবি উমা আনন্দময়ীকে লক্ষ্য করে বলেন,

‘দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীরযুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?

এই বক্তব্যের রেশ ধরে সরকার কবিকে গ্রেফতার করে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ ধারায় এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করে। জেলখানায় সাধারণ কয়েদীদের সাথে তাঁকে রাখা হয়। তাঁর কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করার জন্যে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়; কিন্তু নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবি সত্তা সাম্রাজ্যবাদের দলন-পীড়নের বিরুদ্ধে কারাগারের মধ্যেও প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন।-এই শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল/এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো যে বিকল।

কর্তৃপক্ষ কয়েদীদের উপর কঠোর হয়। নজরুল বন্দী কয়েদীদের নিয়ে আরো তীব্র উচ্চকণ্ঠে গেছে ওঠেন- লাথি মার ভাঙরে তালা, যতসব বন্দী শালায়/ আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা ফেল উপাড়ি।

কারারুদ্ধ কবি নজরুলের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির লড়াইটা তখন মুখোমুখী রূপ নেয়। তিনি অনশন করলেন। জাতি তাঁর অনশনে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। নজরুল দমলেন না, ভাঙলেন না। কর্তৃপক্ষ তাঁর অনেক শর্ত মেনে নিলেন। পরাধীন জাতির বন্দীকণ্ঠস্বর হয়ে নজরুল রাজবন্দীর জবানবন্দী দিলেন কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। দণ্ডিত নজরুল ইসলাম তাঁর জবানবন্দীতে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী…। রাজার পেছনে ক্ষুদ্র, আমার পিছনে রুদ্র।…রাজার বাণী বুদবুদ, আমার বাণী সীমাহারা সমুদ্র।’ এই বক্তব্য ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর মধ্যে ভাবান্তর ঘটায় নি; বরং তার রায়ে রাজরোষের প্রতিফলন ঘটে। রায়ে নজরুলের এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

নজরুল শুধু নিজেই কারাবরণ করেননি; তাঁর একাধিক গ্রন্থও বাজেয়াপ্ত হয়। প্রবন্ধকার মঈন শেখ তার ‘কাজী নজরুল ইসলামঃ দণ্ডিত যুগ-মানস কবি’ প্রবেন্ধ বলেন, নজরুল ইসলামের প্রথম নিষিদ্ধ বই ‘যুগবাণী’ ১৯২২। যুগবাণীর পরে যে বইটি বাজেয়াপ্ত হয় তার নাম ‘বিষের বাঁশি’ (১৯২৪) বই দুটি বঙ্গ-সরকার নিষিদ্ধ করে ফৌজদারির বিধির ৯৯-এ ধারা অনুসারে। এরপর একের পর এক নিষিদ্ধ হতে থাকে ‘ভাঙার গান’(১৯২৪), ‘প্রলয়শিখা’ (১৯৩১), ‘চন্দ্রবিন্দু’ (১৯৩১)। এছাড়া ‘অগ্নিবীণা’, ‘রুদ্রমঙ্গল’কেও ব্রিটিশ রাজের নানা রোষের মুখে পড়তে হয়।’ (২৩ মে, ২০১৪, দৈনিক ইত্তেফাক)

নজরুলকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা সফল হলো না। তাঁর নিষিদ্ধ বইগুলো তরুণদের কাঙ্ক্ষিত সামগ্রী হয়ে দাঁড়ালো; বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যে চাঞ্চল্য ও অভিঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল, তার সার্থক রূপদান করে ঐ সময়ে নজরুল হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় কবি, হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রবক্তা, সাম্যবাদী শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রেষ্টা। বলশেভিক আন্দোলন(১৯১৭) দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি সর্বহারাদের পক্ষে দাঁড়ালেন।তিনি গাইলেন, ‘শোন অত্যাচারী, শোনরে সঞ্চয়ী/ ছিনু সর্বহারা, হবো সর্বজয়ী।’

তিন.

হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অনৈক্যই ছিলো বৃটিশদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রধান অন্তরায়। তাই তিনি সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ দখলদার শক্তিকে উৎখাত করার জন্যে দুই সম্প্রদায়ের ঐক্যসাধনের ব্রতী হয়েছেন। তিনি তাঁর সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আমার পথ’ প্রবন্ধে বলেন,

‘ধূমকেতু কোনো সাম্প্রদায়িক কাগজ নয়। মনুষ্য ধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষে মানুষে যেখানে প্রাণের মিল, আদত সত্যের মিল, সেখানে ধর্মের বৈষম্য, কোনো হিংসার দুশমনির ভাব আনে না। যার নিজের ধর্মে বিশ্বাস আছে, যে নিজের ধর্মের সত্যকে চিনেছে, সে কখনো অন্য ধর্মকে ঘৃণা করতে পারে না। …দেশের পক্ষে যা মঙ্গলকর বা সত্য, শুধুই তাই লক্ষ্য করে এই আগুনের ঝাণ্ডা দুলিয়ে বাহির হলাম।’(আমার পথ, রুদ্রমঙ্গল)

ব্যক্তিজীবনের বহু ঘটনায় তাঁর আদর্শ- অসাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টান্ত তিনি রেখেছেন। তিনি হিন্দুকন্যা প্রমীলাকে বিবাহ করেছেন। তাঁর প্রথম সন্তানের নামকরণ করেছিলেন রুদ্র-মুহম্মদ। তিনি তাঁর প্রথম কাব্য ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২) কাব্যে হিন্দু পুরাণ ও মুসলিম ঐতিহ্যকে একই সাথে ব্যবহার করেছেন। ‘ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার’ এর পরই তিনি বলেন, ‘আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড, আমি চক্র ও মহা শঙ্ঘ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড।’ (বিদ্রোহী)

সমালোচকদের অনেকে বলেন, নজরুল তাঁর সামাজিক দায়-দায়িত্ব পালনের জন্যে তাঁর অমিত তেজদীপ্ত প্রতিভাকে ব্যবহার করেছেন। ফলে বহুক্ষেত্রে আমরা তাঁর কবিতায় কবির সঙ্গে শিল্পীকে পাই না। তাতে কী? সামাজিক প্রয়োজনে সাড়া দিতে গিয়ে তিনি যে কাব্যসম্ভার সৃষ্টি করলেন তা গণবাদী সাহিত্য হয়ে উঠেছে। স্বভাবতই তিনি শিল্পের দাবি মেনে চলেন নি, চলার প্রয়োজনীয়তা তিনি স্বীকার করেননি। কেননা পরাধীন ভারতবর্ষে বাংলার জমিনে একটি বিশেষ যুগ তাঁকে সৃষ্টি করেছিল; আবেগের প্রাবল্যে তিনি ভেসে গিয়েছিলেন। সেই আবেগই তাঁর কাব্যের দোষ ও গুণ একই সাথে। এখানে তাঁর কাব্যাদর্শের প্রধান দুটি দিকের উপর যৎসামান্য দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। তাঁর কাব্যের আলংকারিক মূল্যবিচার অন্য প্রসঙ্গ।

নজরুল ইসলামের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি নিয়ে তখন সমালোচনা কম হয় নি। তিনি সমালোচকবৃন্দ সম্পর্কেও বেশ সচেতন ছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর, ১৯২৯ খ্রি: কলকাতার এলবার্ট হলে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের পক্ষ থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। উক্ত সভায় প্রতিভাষণে কবি নজরুল বলেন, কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ওদুটোর কিছুই নয়। আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’

একটা কবিতায় নজরুল স্পষ্ট উচ্চারণ করেন,

‘‘কাঁদিব না মোরা, যাও কারা-মাঝে যাও তবে বীর সঙ্ঘ হে, ঐ শৃংখলই করিবে মোদের, ত্রিশ কোটি ভ্রাতৃঅঙ্গহে।

মুক্তির লাগি, মিলনের লাগি আহুতি যাহারা দিয়াছে প্রাণ, হিন্দু-মুসলিম চলেছি আমরা গাহিয়া তাদের বিজয়গান।’’বন্দনা-গীতি(বিষের বাঁশী)

অথবা

‘‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ

কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ।’’

‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।’’ কাণ্ডারী হুশিয়ার (সর্বহারা)

অথবা

‘‘গাহি সাম্যের গান

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।

নাই দেশকাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,

সব দেশে সব কালে ঘরেঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’’ মানুষ (সাম্যবাদী)

সাম্প্রাদায়িকতার উর্ধ্বে উঠেই মানবতার জয়গান গাইতে হয়। এই মহৎ উপলব্ধির পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর কবিতায়। তাই নজরুল ইসলাম মানুষের কবি, মানবতার কবি। এটা তাঁর জীবনাদর্শের একটা বড় দিক যা বাদ দিয়ে নজরুলের সমগ্রতা সন্ধান সফল হয় না। তিনি মুসলিম কবি হিসেবে ইসলামের ধর্মীয় চেতনার উপর বহু কবিতা ও গান রচনা করেছেন, বহু গজল ও হাম-নাত লিখেছেন। আবার একই সাথে তিনি হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক বিষয়বস্তু নিয়ে কবিতা ও গান রচনা করেছেন, শ্যামা-সঙ্গীত ও শাক্ত সঙ্গীত রচনা করেছেন।তাই বলে তাকে কোনো একটি বিশেষ ধর্মের কবি হিসেবে বৃত্তাবদ্ধ করা যায় না। এটা লক্ষণীয় যে প্রচুর ধর্মীয় বিষয়াদিকে কাব্যগত করেও তিনি থেকে গেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক হয়ে। এ এক মহৎ দৃষ্টান্ত।

উপসংহার

কবি নজরুল ইসলাম ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় অমর কাব্য লিখতে না পারার কারণ ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন, যারা সুখে আছেন তারা অমর কাব্য লিখবেন।বড় ভাবের কাব্য লেখার অবসর পান নাই। এ সত্য মেনে নিয়েও প্রশ্ন জাগে, যুগের হুজুগে যতখানি লিখতে পেরেছেন তা কি সেই যুগের মধ্যেই হারিয়ে গেছে, না কি যুগোত্তীর্ণ কোন মহিমা রয়ে গেছে তাঁর কাব্যে, তাঁর জীবনদর্শনে? কালান্তরে নজরুল ইসলামকে নিয়ে ভাবতে গেলে এ কথা আমাদের চিন্তার মধ্যে ধরা দেয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, মানবসমাজে শুভচিন্তা ও সুন্দরের প্রকাশ যুগে যুগে অসুন্দর অসুরের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাই সুন্দর ও মুক্তির প্রশ্নে সবর্দাই প্রতিবাদমুখর থাকতে হয়েছে শুভবুদ্ধির মানুষকে। মানবমুক্তি মানে- ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে মানুষের জয়গান। অতএব যতদিন এ বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির  প্রতাপ চলবে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা সংঘটিত হবে ততদিন নজরুলের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষনীতি আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক থাকবে।

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *