২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার, সকাল ১০:৫৯
মনসামঙ্গলে দেবী মনসার লোক-সাংস্কৃতিক স্বরূপ ও আর্থ-সামাজিক চরিত্র
শুক্রবার, ২৮ আগস্ট, ২০২০

ড. সনৎকুমার নস্কর।।অধ্যাপক, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।পশ্চিমবঙ্গ। ভারত।

সর্পদেবী মনসার মাহাত্ম ও পূজা প্রচলনের কাহিনি নিয়ে বাংলায় মনসামঙ্গল কাব্যধারার প্রতিষ্ঠা। সৃষ্টির আদিকাল থেকে সর্প হিংস্র বিষধর এক প্রাণী। তার এক মোক্ষম ছোবলেই প্রাণীর প্রাণান্ত। এই আধিভৌতিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এককালে বিপন্ন মানুষ সর্পের অধিষ্ঠাত্রী এক দেবীর কল্পনা করেছিল, যিনি বঙ্গদেশে কালক্রমে মনসা নামে পরিচিত হয়েছেন।

পণ্ডিতগণের অভিমত, সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতে সর্পপূজা প্রচলিত থাকলেও সর্প-সংস্কৃতির (Snake cult বা Serpentlore) সূচনা ঘটেছিল প্রাচীন মিশরে আজ থেকে প্রায় ৬০০০ বছর আগে। পিরামিডের মধ্যে ও অন্যত্র মিশরের রাজা অর্থাৎ ফারাওদের ব্যবহৃত যে সব রাজকীয় সামগ্রী পাওয়া গেছে তার ভেতর তাদের যে শিরস্ত্রাণ মিলেছে, তাতে সর্পচিহ্নলাঞ্ছিত মুকুটও রয়েছে। উদ্যত ফণা সর্পের এই প্রতিকৃতি মুকুটে শোভিত হওয়ার ফলে ধারণা হয় যে, মিশরে সর্প-সংস্কৃতি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষণা পেয়েছিল। এছাড়া ‘মেডুসা’ নামী যে মিশরীয় দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় তার মূর্তিটি বিস্ময়কর ভাবে সর্প-শোভিত। তিনি গলায়, হাতে, বাজুতে, কোমরে, পায়ে যে সব অলংকার ধারণ করে আছেন, সেগুলি এক একটি সর্পের আকৃতি। মিশরীয় এই সর্পসংস্কৃতির প্রভাব পরবর্তীকালে প্রাচ্যের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে বলে প্রত্ন-গবেষকদের ধারণা।

অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করেন, সর্পকে দেবতা হিসেবে পুজো করার রীতি প্রথম চালু হয়েছিল ইউফ্রেটিস নদী-তীরবর্তী তুরানী জাতির মধ্যে। তারপর এই জাতির শাখা বিভিন্ন দেশে উপনিবিষ্ট হলে সেইসব অঞ্চলে সর্পপূজা বিস্তৃত হয়। পাশ্চাত্য পণ্ডিত জে. ফার্গুসন বলেন যে, তুরানী জাতি ভারতের উত্তর-পশ্চিম গিরিপথ দিয়ে এদেশে প্রবেশ করেছিল এবং তারাই ভারতে সর্পপূজার আদি প্রবর্তক-এর সঙ্গে আর্যজাতির কোনও মূলগত সম্পর্ক নেই। বরং আর্যরা ভারতে এসে তুরানীয়দের কাছ থেকে এই সংস্কৃতি গ্রহণ করে।

আর্যদের রচিত সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ ঋগ্বেদ। এ গ্রন্থেসর্পের উল্লেখ থাকলেও সর্পপূজার কোনও নিদর্শন নেই। অবশ্য ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৭৬ ও ৯৪ সংখ্যক সূক্তে কয়েকজন সর্পঋষির নাম পাওয়া যায়। ওই মণ্ডলের ১৮৯ সূক্তটির নামই সর্পরাজ্ঞী সূক্ত, রচয়িত্রীর নাম সর্পরাজ্ঞী। ঋষিকা-যদিও এ সূক্তে বাক্বিজ্ঞান আলোচিত হয়েছে। অথর্ববেদে বেশ কয়েকজন সর্পদেবতার উল্লেখ আছে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বজ, পৃড়াকু, কল্মাষগ্রীব ও তক্ষক। অথর্ববেদে সর্পের উদ্দেশে কতকগুলি মন্ত্র রচিত হওয়ার সূত্রে অনুমান করা যায় যে, এই সময় নাগাদ ভারতীয় আর্যসমাজে সর্পপূজা প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। ‘সর্পবিদ্যা’ নামক এক জ্ঞাতব্য বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে বেদপরবর্তী ব্রাহ্মণের যুগে। আর আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে সর্পপূজার প্রকরণ সমূহকে উল্লেখিত হতে দেখা যায়। শ্রাবণ পূর্ণিমা থেকে অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা পর্যন্ত বর্ষার চার মাসের প্রতিদিন সর্পভীতি নিবারণের জন্য সর্পের উদ্দেশে ভোজ্য বা ‘বলি’ নিবেদন করার বিধান পাওয়া যায় গৃহ্যসূত্রাদিতে। এ ছাড়া এই চার মাস গৃহস্থকে সপরিবারে উচ্চ শয্যায় শয়ন করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এই দৃষ্টান্তগুলি থেকে সহজেই প্রতীতি হয় যে, আর্যরা প্রথমে সর্পপূজা সম্পর্কে কিছু না জানলেও ধীরে ধীরে আর্যসংস্কৃতিতে এই হিংস্র প্রাণীটি সমীহ আদায় করে নিতে পেরেছিল এবং শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে এর পূজাও সর্বত্র প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল।

‘নাগ’ সর্পের আর এক প্রতিশব্দ। মহাকাব্যের যুগে ব্যাসরচিত মহাভারতে নাগজাতির প্রথম বিস্তৃত উল্লেখ মেলে। কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন, নাগ একটি জাতি বিশেষ এবং এরা হয়তো বিষধর সাপকেই টোটেম রূপে গ্রহণ করেছিল। যাইহোক, মহাভারতে নাগজাতির অধিপতিরূপে বাসুকী নাগকে গণ্য করা হয়েছে এবং তিনি ‘সর্পরাজ’ রূপে অর্চিত হন। মনসা বাসুকীর ভগিনী হিসাবে পরিচিত, যিনি কালক্রমে সর্পকুলের দেবীরূপে পূজিতা। মহামুনি কশ্যপের দুই পত্নীর প্রসঙ্গও মহাভারতে বিবৃত। এঁরা হলেন কদ্রু ও বিনতা। কদ্রুর গর্ভে বাসুকী প্রমুখ নাগগণের উৎপত্তি। আর অন্যদিকে বিনতার সন্তান গরুড়—যিনি বিষ্ণুর বাহন। বৈমাত্রেয় ভাই বলে নাগগণের সঙ্গে গরুড়ের বৈরি সম্পর্ক এই মহাকাব্যে দেখানো হয়েছে। মনসার আর এক নাম জরৎকারু। এই নামে এক ঋষিও ছিলেন, যিনি পিতৃপুরুষগণের কাতর মিনতিতে স্বীয় নামীয় কন্যা জরৎকারু তথা মনসাকে বিবাহ করেন। এই বিবাহের ফলে মনসার গর্ভে আস্তিক। প্রমুখ অষ্টনাগের জন্ম। জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে আস্তিক মুনি উপস্থিত হয়ে যজ্ঞবন্ধ করে সর্পকুলকে। বিনাশের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন বলে মহাভারতে উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। মহাকাব্যের পরবর্তী যুগে নাগ ও সর্প অভিন্ন হয়ে দেখা দেয়।

সর্পসংস্কৃতির সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সম্পর্ক ছিল। বৌদ্ধ গ্রন্থাদিতে অহিরাজ কুলের পরিচয় পাওয়া যায়। বুদ্ধকে নাগপ্রধানরা নাকি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিল। বিনয়পিটকে একটি নাগের মানুষের ছদ্মবেশে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের প্রসঙ্গ আছে। বৌদ্ধধর্মের মতো জৈনধর্মের সঙ্গেও কেউ কেউ সর্পসংস্কৃতির সম্পর্ক লক্ষ করেছেন। জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের যে প্রস্তর মূর্তি সর্বত্র দেখা যায় তার মাথার উপরে সপ্তফণা বিশিষ্ট একটি নাগের মূর্তি আছে। কথিত আছে যে, পার্শ্বনাথ যখন তপস্যা করছিলেন তখন তার শত্রু কমঠ বিপুল ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাত সৃষ্টি করে বিঘ্ন ঘটালে সর্পরাজ ধরণেন্দ্র ও তাঁর পত্নী পদ্মাবতী ছত্রাকারে ফণাবিস্তার করে জিনকে রক্ষা করেছিলেন। জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন এই পদ্মাবতীরই প্রতিরূপ হলেন মনসা। পদ্মা মনসার নামভেদও বটে।

সর্পদেবী মনসার পূজা প্রচলনের অনেক আগে থাকতে ভারতের নানা স্থানে জীবিত সর্পের পূজার রীতি চালু ছিল। জ্যান্ত সাপকে উইয়ের ঢিবিতে রক্ষণাবেক্ষণ করে ও তাকে উপযুক্ত আহার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার দৃষ্টান্ত ইংরেজ আমলেও দেখা গিয়েছে। ১৯৭২ সালে ‘দেশ’ পত্রিকার একটা সংখ্যায় (কার্তিক, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ) ক্ষেত্রসমীক্ষার ভিত্তিতে লেখা হয়েছিল যে মহারাষ্ট্রের শিরালা গ্রামের মেয়েরা জ্যান্ত সাপের মাথায় সিঁদুর পরিয়ে দেবতাজ্ঞানে পুজো করে থাকে। কেরালার একটি শিবমন্দিরে একটি জীবিত সাপকে প্রত্যেকদিন দুধ দিয়ে নাকি আপ্যায়ন করা হয়। অখণ্ড বঙ্গে আজও গ্রামাঞ্চলে ‘বাস্তুসাপ’-এর ধারণা বর্তমান। মনে করা হয়, এই সাপ বিষধর হলেও সে গৃহস্থের কোনও ক্ষতি করে না, বরং তার দ্বারা বাস্তুর মঙ্গল সাধিত হয়ে থাকে। ফলে বাস্তুসাপকে হত্যা করার কোনও রীতি নেই। অনেক গৃহস্থের ধারণা, বাস্তুসাপ আসলে পিতৃপুরুষগণের আত্মা, যাঁরা বংশধরের বাস্তুর রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন। জীবন্ত জীবজন্তুর পুজো করার রীতি অনার্য সংস্কৃতির অঙ্গ। এরই সূত্র ধরে কেউ কেউ সর্পকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকে অনার্য সংস্কৃতির অঙ্গ বলে গণ্য করেন। অনার্য সংস্কৃতির আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল বৃক্ষপূজা।সর্পপূজার একটি পরিবর্তিত রূপ খুঁজে পাওয়া যায় এই বৃক্ষপূজার ভিতরেও। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্য তার ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’-এ লিখেছেন, ‘বৃক্ষের সঙ্গে সর্পের সম্পর্ক অত্যন্ত প্রধান ও ব্যাপক। কারণ, উভয়ই উর্বরতাশক্তির প্রতীক। দাক্ষিণাত্যে অশ্বত্থ বৃক্ষের সঙ্গে সর্পের সম্পর্ক আছে বলিয়া মনে করা হয়। সেইজন্য অশ্বথ বৃক্ষের নিচে মৃৎ কিংবা প্রস্তর নির্মিত নাগমূর্তি উপহার দেওয়া হয়-অপুত্রক বা বন্ধ্যা নারীগণ সন্তান কামনা করিয়া অশ্বথতলে নাগমুর্তি উপহার দেয় কিংবা নাগপূজা করিয়া ১০৮ বার সেই বৃক্ষ প্রদক্ষিণ করিয়া থাকে।’ অশ্বথ গাছ ছাড়া বাংলা ও বাংলার বাইরে আর একটি গাছের সঙ্গে সর্প-সংস্কৃতির নিবিড় যোগ লক্ষ করা যায়। এ গাছটি হল ফণিমনসা বা সিজগাছ। সংস্কৃতে এর নাম স্নুহীবৃক্ষ। এ গাছকে সর্প তথা মনসার প্রতিরূপ হিসাবে গ্রহণ করে পূজা করবার রীতি বাংলায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এই গাছের অনেকগুলি রোগ প্রতিষেধক গুণ রয়েছে বলে আদিম সমাজে এ গাছটিকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হত। বিভিন্ন প্রদেশে এই গাছটির ভিন্ন ভিন্ন নাম। তেলুগু ভাষায় ফণিমনসাকে ‘চেংমুড়’ বলে। ক্ষিতিমোহন সেন ১৩২৯ বঙ্গাব্দের আষাঢ়ে প্রবাসী পত্রিকায় ‘বাংলায় মনসাপূজা’ শিরোনামে যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন সেখানে ‘চেংমুড়ি’ শব্দ আসতে পারে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। বাংলা মনসামঙ্গল কাব্যগুলিতে কবিরা চাঁদ সদাগরের মুখে মনসাকে ব্যঙ্গ করার উদ্দেশ্যে ‘চেংমুড়ি কানি’ শব্দগুচ্ছ বসিয়েছেন।

পাথরে খোদাই করা সর্পমূর্তির পূজা মনসাসিজ পূজার পরবর্তী ধাপ। আবার এর পরের ধাপে এসেছে কোনো মানবাকৃতি দেব কিংবা দেবীর পরিকল্পনা। পৌরাণিক যুগে বৈদিক নৈসর্গিক শক্তিগুলি যেমন পরিচিত দেবদেবীর মূর্তি লাভ করতে শুরু করেছিল, প্ৰাগাৰ্য সংস্কৃতি-লালিত পশুদেবতারাও.অনুরূপ পথে মূর্তিমান হয়ে উঠেছিল। কেউ কেউ মনে করেন মনসার মূর্তি কল্পনা তিনটি স্তরের পারম্পর্যের অন্তিম ফলশ্রুতি। মনসা আদতে সর্প বা সাপিনী, মধ্যপর্বে তিনি সর্পাভরণা দেবী, সবশেষে সর্পাধিষ্ঠাত্রী নারীদেবতা।

দেবী মনসার উৎস সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়ে বিভিন্ন পণ্ডিত ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য বৌদ্ধ সর্পদেবী জাঙ্গুলিকে মনসার ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেছেন। জাঙ্গুলি মহাযান তথা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের অন্তর্গত অত্যন্ত প্রাচীন এক দেবী। বৌদ্ধগ্রন্থে উল্লেখিত আছে যে, ভগবান বুদ্ধ তাঁর প্রধান শিষ্য আনন্দকে এই দেবীপূজার গোপন মন্ত্র-শিক্ষা দিয়েছিলেন। বৌদ্ধতান্ত্রিক দেবদেবীদের বিবরণসম্বলিত গ্রন্থ ‘সাধনমালা’য় এই দেবীর বিবরণে বলা হয়েছে ইনি শুক্লবর্ণা, একমুখী, শুক্ল সর্পবিভূষিতা ও চতুর্ভুজা। এর দুই হাতে দুটি সর্প, বাকি দুই হাতের একটিতে অভয়মুদ্রা ও অপর হাতে বীণা ধারণ করে আছেন। সাধনমালাতে এই দেবীর আর যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় কোথাও ইনি দ্বিভুজা, আবার কোথাও ষড়ভুজা, এমনকি ত্রিমুখাও বটে। সর্পের বিস্তৃত ফণার নিচে তিনি উপবিষ্ট। উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ থেকে যে মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, মূর্তিতত্ত্ববিদরা সেটিকে জাঙ্গুলিতারা বলে সনাক্ত করেছেন। জাঙ্গুলি যে সাপের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত একটি শব্দ এর প্রমাণ পাওয়া যায় বাণভট্টর ‘হর্ষচরিত’-এ ‘জাঙ্গলিক’ শব্দের ব্যবহারে। সাপুড়ে ৰা সর্পবৈদ্যকদের সেখানে জাঙ্গুলিক নামে অভিহিত করা হয়েছে। রামাই পণ্ডিতের ধর্মপূজাবিধানে মনসার আর এক নাম জাঙ্গুলি বা জাগুলি। কবি বিপ্রদাস পিপিলাই-ও ‘জাগুলি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং ইনি যে সিজবৃক্ষে অবস্থান করেন তারও উল্লেখ করেছেন। পণ্ডিতদের মতে, জাঙ্গুলী শব্দের অর্থ হল বিষবিদ্যা। প্রাচীন পুথি ও প্রত্নতত্ত্ব-বিশেষজ্ঞ ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিজাত মূর্তিতত্ত্ব বিচার করে জানিয়েছেন যে, জাঙ্গুলী আসলে জঙ্গলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। অরণ্যবাসী আদিম জাতির কন্যা বা শবরকুমারী হিসাবেও তিনি পরিগৃহীতা। ইনি সর্পকুলকে বশীভূত করেন এবং সর্পদংশন জনিত বিষক্রিয়া থেকে বাঁচাতে সক্ষম-এমন বিশ্বাস থেকে বৌদ্ধরা আদিম অরণ্যবাসী বর্বর জাতির আরাধ্য জঙ্গলের এই অধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে নিজেদের দেবগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। অথর্ববেদে বিষদূষণনাশিনী হিসেবে ঘৃতাচীর নাম পাওয়া যায়। ড. ভট্টশালীর মতে, ইনি ও সরস্বতী অভিন্ন। অতএব জাঙ্গুলির সঙ্গে সরস্বতীর আন্তঃসম্পর্ক বিষনাশনের সূত্র ধরে সংস্থাপিত। Folklore পত্রিকার প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্য এই মূর্তি ভাবনাটির একটি সহজ সমীকরণ এভাবে প্রকাশ করেছিলেন : It was in the age of Yajurveda that Serpent-lore was considered to be a special branch of study like the study of music. Naturally, therefore, the presiding deity of the Serpent-lore came to be identified with a form of the goddess of learning and Janguli and Saraswati came to be identified in that way… Thus through Janguli and Saraswati were originally one, Janguli resorted to the Buddhist Tantric school and Saraswati to the vedic Hindu Society and thus become gradually estranged from each other.’

মনসার অনার্য উৎস বিষয়ে প্রথম আলোকপাত করেছিলেন আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন। পূর্বে উল্লেখিত ১৩২৯ সালের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে তিনি জানান যে, দক্ষিণ ভারতে কর্ণাটক প্রদেশে নাগপঞ্চমীর দিন একটি স্ত্রী-সৰ্পকে পূজা করার রীতি দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত।এই সর্প সেখানে দেবতা হিসেবে মান্য। ও অঞ্চলের ভাষায় ইনি নাগমাতা মনে-মঞ্চী বা মঞ্চাম্মা। কর্ণাটদেশীয় রাজপুরুষ সেন বংশীয় রাজারা বাংলায় আগমনকালে তাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে মঞ্চাম্মাকে সংস্কার-স্মৃতিতে বহন করে এনেছিলেন, যিনি পরে বাংলার সর্পদেবী মনসাতে রূপান্তরিত হয়েছেন। শুধু ধ্বনিগত নাম-সাদৃশ্য কিংবা স্বরূপগত সাদৃশ্য নয়, অন্য ক্ষেত্রেও এই দুই প্রদেশের সর্পভাবনাতে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নৃত্যের মাধ্যমে দেবতাদের তুষ্ট করার রীতি তেলুগু দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। (স্মরণীয়, দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরে দেবদাসী নৃত্য) দেবসভায় বেহুলার নৃত্যপ্রদর্শন দক্ষিণ ভারতীয় এই প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মারক। এছাড়া দক্ষিণ ভারতের লৌকিক দেবী অম্বাবরুর কাহিনির সঙ্গে বাংলায় প্রচলিত মনসামঙ্গলের কাহিনির কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। এসব দিক বিবেচনা করে আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের সিদ্ধান্ত : বাংলার সর্পাধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসার আদি উৎস দক্ষিণ ভারতের সর্পপূজার মধ্যে নিহিত। তাঁর এই সিদ্ধান্তের প্রতিধ্বনি আছে ড. নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদিপর্ব’ গ্রন্থে। সেইসঙ্গে ড. রায়ের অতিরিক্ত সংযোজন : সাপ প্রজনন শক্তির প্রতীক এবং মূলতঃ কৌম সমাজের প্রজনন শক্তির পূজা হইতেই মনসা পূজার উদ্ভব, এ তথ্য নিঃসন্দেহ। মনসার অনার্য উৎসের কথা মেনে নেন ‘Historical Studies in the Cult of the Goddess Manasa’ গ্রন্থের লেখক ড. প্রদ্যোৎকুমার মাইতিও। তাঁর মতে, মনসা আদতে আঞ্চলিক দেবী, যিনি প্রথমাবধি অনার্যগোষ্ঠী কর্তৃক পূজিতা। গোপালক, কৃষক ও ধীবর সম্প্রদায়ের তিনি আরাধ্যা। এদের দ্বারা মনসা ক্রমশ লোকসমাজে সুপরিচিত হন এবং উচ্চবর্গের নারীদের দ্বারা পূজা পান। সবশেষে পরিগৃহীত হন উচ্চবর্গের সম্ভ্রান্ত পুরুষসমাজের কাছে-এমনকি তাকে অস্বীকার করতে পারেন না ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির শীর্ষে বসে থাকা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ও। বাংলায় প্রচলিত পদ্মাপুরাণের কাহিনিতে মনসার এই ক্রমিক পূজাপ্রাপ্তির ইতিহাস ছায়া ফেলেছে।

কিন্তু অধ্যাপক সুকুমার সেন উপরোক্ত দুই মতের বিরোধী। তাঁর অভিমত, দেবী মনসার উৎস তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম কিংবা দক্ষিণ ভারতীয় প্রাগার্য সংস্কৃতি নয়, ইনি এসেছেন ভারতীয় বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ভাবধারার মধ্য দিয়েই। ‘মনসা’ এই শব্দটি ঋগ্বেদ ও অন্যান্য বৈদিক গ্রন্থে পাওয়া যায়। সংস্কৃত ‘মনস’ শব্দ ‘মনসা’-র উৎসমুখে দাঁড়িয়ে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও দেবীভাগবতে মনসার ধ্যানমন্ত্র লিপিবদ্ধ আছে। পদ্মপুরাণে উল্লিখিত মনসার ধ্যানমন্ত্রটি স্মার্ত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য কর্তৃক তিথিতত্ত্বে উদ্ধৃত। রামাই পণ্ডিতের ধর্মপূজা বিধানেও বিষহরির দুটি ধ্যানমন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়। এইসব বিভিন্ন ধ্যানমন্ত্র থেকে মনসার যে মূর্তি-কল্পনা ফুটে উঠেছে তাতে কোথাও অনার্যত্বের কিংবা বৌদ্ধসংস্কৃতির গন্ধমাত্র নেই। ইনি দেহকান্তিতে স্বর্ণতুল্যা, পদ্মাসনা (কোথাও কোথাও হংসোপরি উপবিষ্টা) সর্পনির্মিত মুকুটশোভিতা, মহাজ্ঞানযুক্তা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিণী এবং সিদ্ধিদাত্রী। বিভিন্ন স্থানে এঁকে ‘শিবকন্যা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পিতা শিবের কাছ থেকে সিদ্ধি ও যোগ লাভ করেছেন, তাই তাঁর আর এক পরিচয় সিদ্ধযোগিনী। অখণ্ড বাংলার নানা প্রান্ত থেকে প্রস্তর নির্মিত যেসব মনসামূর্তি মিলেছে তাতেও দেখা যাচ্ছে যে তিনি ব্রাহ্মণ্যসংস্কৃতির রসে পুষ্ট। সমস্ত মূর্তির মধ্যে ঐকান্তিক মিল না থাকলেও দৃষ্টিগ্রাহ্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে : মনসা পদ্মাসনা, মাথায় সপ্তনাগের ছত্র, কোথাও তিনি দ্বিভুজা কোথাও চতুর্ভুজা, উপবিষ্ট অবস্থায় কখনো বামক্রোড়ে শিশু, হাতে জপমালা (আবার কোথাও পুস্তক)। একস্থানে তিনি হংসবাহিনী ও সর্পবিভূষিতা। অধিকাংশ মূর্তিতে বাম কিংবা ডান হাতে সর্পধারণ করে আছেন। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত একটি ব্রোঞ্জমূর্তির প্রসারিত বামহাতে লড্ডুক ও ডানহাতে গদা শোভমান। অর্থাৎ ইনি যে পৌরাণিক সংস্কৃতির অভ্যন্তরস্থ এক দেবী তার প্রমাণ এই মূর্তিশিল্পের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। অন্যদিকে, মনসার পিতৃ-পরিচয়ের একটি নতুন ভাবনার সন্ধান দিয়েছে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ। সেখানে বলা হয়েছে- ‘কন্যা সা চ ভগবতী কশ্যপস্য চ মানসী। তেনেয়ং মনসা দেবী মনসা যা চ দিব্যতি।।’ অর্থাৎ ইনি ইন্দ্রাদি দেবগণের জনক কশ্যপের মানস-কন্যা। এই পুরাণের সূত্র অনুসরণ করে হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের অভিমত, কশ্যপ বা কচ্ছপ (অথবা কূর্ম বা কূর্মাবতার) আসলে সূর্য্যই, সুতরাং কশ্যপ-কন্যা আর রুদ্রশিব-কন্যা বা রুদ্রতেজ একই কথা। অতএব বৈদিক সূর্যাগ্নির শুভ্র জ্যোতিঃপুঞ্জরূপা দিব্য সরস্বতী নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মনসায় রূপান্তরিত হয়েছেন এরূপ সিদ্ধান্ত সমীচীন বোধহয়। (দ্রঃ ‘হিন্দুদের দেবদেবী ও উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’ / তৃতীয় পর্ব) ঋগ্বেদে রুদ্রের ক্রোধকে বলা হয়েছে ‘মনা’। কেউ কেউ মনসার উৎস-সন্ধানে এই রুদ্রতেজ ‘মনা’তে এসে পৌঁছেছেন। বৈদিক ‘রুদ্র’ পুরাণে ‘শিব’-এ পরিণত। তাই শিব-কন্যা সরস্বতীর সঙ্গে মনসা কোথাও কোথাও একাত্ম হয়ে গেছেন। অধ্যাপক সুকুমার সেন ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’-এর প্রথম খণ্ডে এই দুই দেবীর অভ্যন্তরস্থ মিলগুলি উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক সেনের আলোচনা থেকে মনে হয়, বৈদিক ইলা সরস্বতী ও শ্ৰী, বৈদিক বাক, বৈদিক রুদ্রের মনা, বৈদিক সর্পরাজ্ঞী বা বসুন্ধরা, বৈদিক নৈঋতি ও অরায়ী অর্থাৎ অপঘাতিনী ও অলক্ষ্মী, পরবৈদিক কমলাসনা দেবী, নাগলাঞ্ছন দেবী, বিষনাশিনী মায়ুরী প্রভৃতির মিশ্রণে মনসার উৎপত্তি। ‘মনসা’ শব্দটি যে কোনওমতেই দ্রাবিড় শব্দজাত নয়, তার স্পষ্ট উল্লেখ করে অধ্যাপক সেন বলেছেন : “There is not the slightest reason to take it as a borrowing from Dravidian. The Masculine name Manasa occurs in RV-5.44.10 (according to Sayana) and Manasa-devi, the full form of the name of the goddess, is cited by Chandragomin as the illustration of an aphorism of his grammar. Manasa as the name of the poison-removing deity, occurs together with allied names, in the following incontation occuring in a Buddhist text the manuscript copy of which belongs to sixth century.’ (Vipradasa’s Manasavijaya-Introduction).

এই প্রসঙ্গে অখণ্ড বঙ্গে মনসাপুজোর ঐতিহ্য কত প্রাচীন সে প্রশ্নও বিচার্য। বাংলায় প্রাপ্ত প্রাচীন মূর্তি-ভাস্কর্য থেকে এর একটা সম্ভাব্য উত্তর পাওয়া যায়। কেবল বৃহত্তর বঙ্গ নয়, এর সংলগ্ন প্রদেশগুলি থেকেও বেশ কিছু মনসামূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, যাদের নির্মাণকাল দশম থেকে দ্বাদশ শতক বলে অনুমান করা হয়েছে। বীরভূমের পাইকর গ্রামে প্রাপ্ত মূর্তির পাদদেশে সেন রাজবংশের আদিপুরুষ বিজয়সেনের নাম উৎকীর্ণ থাকায় বোঝা যায় একাদশ শতকের বাংলায় দেবী মনসামূর্তিতে পূজিতা হতেন। উত্তরবঙ্গের পাহাড়পুরে যে ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে সেখানে প্রাপ্ত আর একটি মনসামূর্তি একাদশ শতকের বলে সিদ্ধান্ত করা হয়েছে। বীরভূমের ভাদীশ্বরে আবিষ্কৃত একটি পূর্ণাঙ্গ মনসামূর্তি, যা কিনা পাইকরে প্রাপ্ত ভাস্কর্যটির অনুরূপ, পণ্ডিতদের বিবেচনায় প্রায় অভিন্ন সময়ে গঠিত হয়েছিল। এই মূর্তিটিতে সাতটি সাপ দেবীর মাথার ওপরে ফণা বিস্তার করে আছে,তার বাম হাতে রয়েছে আর একটি সাপ,সর্পনির্মিত কাঁচুলিতে বক্ষ আচ্ছাদিত, একপাশে একজন সহচরী। রাজশাহী থেকে প্রাপ্ত ধাতুনির্মিত একটি মূর্তিতে দেখা যায় দেবী দ্বিভুজা, সপ্তসর্পের ফণার নিচে আসীনা, বামক্রোড়ে একটি শিশু, ডানহাতের পিছনে বৃক্ষশাখা দৃশ্যমান (সম্ভবত সিজগাছ)। মূর্তিটির নির্মাণকাল সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। কেউ কেউ বলেন এটি নাকি পালযুগের মূর্তি-ভাস্কর্য। যদি তা সত্য হয় তাহলে মনসাপূজার ঐতিহ্যকে ৮ম-৯ম শতকেও টেনে নিয়ে যাওয়া যায়। এই মূর্তিগুলি প্রমাণ করে যে, মনসার আরাধনা নারীকুলের ঘট-পটের ধর্মাচার ছেড়ে উচ্চবর্ণের মধ্যে একাদশ শতকের ভেতরেই হয়েছিল। যে অর্বাচীন পুরাণগুলিতে মনসার বিবরণ আছে, সেগুলিও পণ্ডিতদের মতে খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতকে রচিত। স্মৃতিগ্রস্থের সাহিত্যও কমবেশি তাই। রাজা ভোজের রাজত্বকালে (১০৪০-৬০ খ্রিস্টাব্দ) রচিত বলে স্থিরীকৃত ‘রাজমার্তণ্ড’গ্রন্থে দেবী মনসার পূজার তিথি নির্দিষ্ট রয়েছে। বিখ্যাত স্মৃতিকার জীমূতবাহন ছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীর লোক। তিনি তাঁর ‘কালবিবেক’-এ মনসাপূজার বিস্তারিত বিধান উল্লেখ করেছেন। কেবল বৃহৎবঙ্গ নয়, বাংলার বাইরেও মনসাপূজার যে ঐতিহ্য ছিল তার সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। বিহারের রাজগীরে খননকার্যের ফলে একটি মনসা মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। এই মন্দিরের অভ্যন্তরে নারীরূপা নাগিনীমূর্তি অক্ষতভাবে পাওয়া গিয়েছে। এমনই সর্পমন্দির ছিল পূর্ব পাঞ্জাবের আম্বালা ও গুরগাঁওয়ে। সেখানকার মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা নামেই পরিচিত। উত্তরাঞ্চলের হরিদ্বারের কাছে এখনও মনসাপাহাড়ে মনসামন্দির বিদ্যমান। উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জের খিচিং নামক স্থানে কিঞ্চিকেশ্বরী নামে এক সর্পদেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে। মিথিলার রাজসভাকবি বিদ্যাপতি ছিলেন পনেরো শতকের প্রথমার্ধের মানুষ। তিনি সংস্কৃত ভাষায় অন্যান্য অনেক বইপত্রের মধ্যে ‘ব্যাড়িভক্তিতরঙ্গিণী’ও লিখেছিলেন। এটি দেবী মনসা সম্পর্কিত স্মৃতিপুস্তক। বৃন্দাবন দাস ‘চৈতন্যভাগবত’-এ পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে শ্রীচৈতন্যের জন্ম-সমকালীন নবদ্বীপের ধর্মকর্মের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছিলেন- ‘দম্ভ করি বিষহরি পূজে কোনজন’। এই ‘বিষহরি’ যে মনসা তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। প্রায় একই সময়ে লেখা হয়েছিল বিজয় গুপ্তের ‘পদ্মাপুরাণ’, যেখানে এই কবি ‘কানা হরিদত্ত’ নামে তাঁর পূর্বজ এক মনসামঙ্গলকারের কথা উল্লেখ করেছেন, যাঁর লেখা গীতকালে লুপ্ত হয়েছিল। বোঝা যায়, বিজয়গুপ্তের প্রায় শতবর্ষপূর্বে মনসামঙ্গলের আদিকবি বলে স্বীকৃত হরিদত্তের আবির্ভাব ঘটেছিল—অর্থাৎ বাংলা ভাষায় মনসামঙ্গল কাব্যগুলির সূচনা হয়েছিল চতুর্দশ শতকের শেষদিকে। হয়তো তারও আগে ব্রতকথা কিংবা নিছক সংক্ষিপ্ত পাঁচালির আকারে প্রচলিত ছিল মনসামঙ্গলের কাহিনি- যা মনসাপূজার অঙ্গ হিসাবে একদা পঠিত কিংবা গীত হত।

|| ২||

 এবার আসা যাক দেবী মনসার আর্থ-সামাজিক চরিত্র বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে। কিন্তু তার আগে জেনে নেওয়া প্রয়োজন মধ্যযুগের কোন পটভূমিতে বাংলার মঙ্গলকাব্যগুলির আবির্ভাব ঘটেছিল। এ কথা অনেকেরই জানা যে, মঙ্গলকাব্যের বিষয় এসেছিল বাংলার নিজস্ব ভাণ্ডার থেকে; কোনও ধ্রুপদী পুরাণ নয়, লোকপুরাণই তার আশ্রয়। বাংলাদেশের মাটিতেই লালন পেয়েছে মঙ্গলকাব্যের গল্প ও চরিত্র। মনসা-চণ্ডী-ধর্ম—এই তিন প্রধান মঙ্গল দেবদেবীর উত্থানও সমাজের তথাকথিত নিম্নস্তর থেকে। তুর্কি আক্রমণোত্তর পরিস্থিতিকে সামাল দিতে গিয়ে যে সমাজের উচ্চকোটির মানুষ মঙ্গলকাব্যের জন্ম দিয়েছিল সে বিষয়ে গবেষকরা আজ একমত। ফলে একথা মনে করতে কোথাও বাধা নেই যে, মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীর ভাবনাতে ছোঁয়া লেগেছে তৎকালীন ইতিহাসের; তাদের স্বভাব-চরিত্রও নির্মিত হয়ে উঠেছে বিশেষ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে।

অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, বাংলা মঙ্গলকাব্যের সূচনা হয়েছিল খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতকে, যদিও এ সন-তারিখ যুক্ত লিখিত কাব্যের দৃষ্টান্ত মিলছে পনেরো শতকের শেষদিকটায়। ব্রতকথা কিংবা ছড়ার আকারে এইসব গল্প এর বহুপূর্ব থেকে সমাজে ছড়িয়ে থাকা অসম্ভব নয়। পণ্ডিতেরা তার প্রাচীনতম সীমা নির্ধারণ করেছেন মোটামুটি ভাবে নবম শতক। তাহলে কম-বেশি পাঁচশো বছর ধরে প্রচলিত গল্পগুলি কাব্যে গ্রন্থিত হতে এত সময় নিল কেন? গ্রন্থরচনার পিছনেই বা কী ধরনের সাংস্কৃতিক প্রণোদনা কাজ করেছে? এ দুটি প্রশ্ন অন্যোন্য-নির্ভর। এর সম্ভাব্য উত্তর এভাবে দেওয়া যেতে পারে : পাল আমলে জনসাধারণের মধ্যে বৌদ্ধধর্মানুসরণের প্রবণতা বেশি ছিল, যেহেতু ওই ধর্ম পেয়েছিল রাজশক্তির আনুকূল্য। তখন চণ্ডী-মনসারা পূজিতা হতেন অনার্যমণ্ডলীতে- অবশ্যই ভিন্ন নামে। এরপর সেন-বর্মণ যুগে বাংলার সংস্কৃতি তার চরিত্র বদল করে। সমাজ থেকে বৌদ্ধ ভাবধারা বিদায় নিয়ে ক্রমশ দেখা দেয় ব্রাহ্মণ্য সংস্কার। স্মৃতি, ন্যায়, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ ও সর্বোপরি পুরাণকেন্দ্রিক ধর্মাচার বিপুলভাবে চর্চিত হতে থাকে বাংলার মাটিতে। বাঙালি অনেকটাই এই সময়ে সর্বভারতীয় ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হয়ে ওঠে। আর ঠিক তার পরেই ঘটে তুর্কি আক্রমণের মতো যুগান্তকারী ঐতিহাসিক ঘটনা। যার প্রতিঘাত এসে পৌঁছায় বৃহত্তর হিন্দু সমাজে। এবার গৌড়ের সিংহাসনে কেবল প্রশাসকের নাম বদল হল না, হল তার গোত্র বদল। রঙিন কল্পনায় মোড়া আর দিবাস্বপ্নের ঘোরে ঢাকা অলৌকিক রাজ্য ছেড়ে বাস্তবের মাটিতে পা দিয়ে এতদিনের আত্মতুষ্ট বাঙালি হিন্দু দেখল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা গিয়ে পৌঁছেছে বিধর্মী শাসক মুসলমানের হাতে এবং তারা বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই হিন্দুর ধর্মকর্মের ওপর আঘাত হানার চেষ্টা করছে। এর থেকে পরিত্রাণ দিতে অপারগ ইট-কাঠ-পাথরের স্তূপের আড়ালে নিঃসঙ্গ বসে থাকা বহু বৎসর-সেবিত মৃন্ময় দেবতা। ফলে নিরবচ্ছিন্ন অত্যাচার, সন্ত্রাস আর আতঙ্কে কুঁকড়ে গেল উচ্চবর্ণের হিন্দু; নিম্নবর্গীয়রা সুযোগ বুঝে ইসলাম বরণ করল লোভে, ভয়ে, সমতালাভের আশায় এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক ফায়দা তোলার ধান্দায়। ধর্মান্তরীকরণের এই বিধ্বংসী স্রোতটাকে স্তব্ধ করে দিতে গেলে চাই ভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক লড়াই। আর সেই লড়াইয়ের একটা খোলা ময়দান হয়ে দাঁড়াল বাঙালির নিজস্ব উদ্ভাবনা মঙ্গলকাব্য।

বাংলা মঙ্গলকাব্যগুলি লেখা হয়েছিল দীর্ঘ সময়পর্ব জুড়ে। প্রায় চারশো বছরের একটা নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্যস্রোত হিসেবে এটি বহমান ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে। দীর্ঘ প্রবাহী হলেও এ ধারা অপরিবর্তনীয় ছিল না। কালের চাপে, যুগের তাপে রূপান্তরিত হয়েছে নানা মাত্রায়। তাই উন্মেষ পর্বের রচনার সঙ্গে সমাপ্তি পর্বের রচনার বেশ কিছু পার্থক্য ধরা পড়ে। সে পার্থক্য যেমন তার প্রকাশকলায় দৃশ্যমান, তেমনি তা অনুধাবনীয় দেবদেবীর চরিত্রচিত্রণে। সর্পদেবী মনসা বাঙালি হিন্দুর উচ্চ অভিজাত সমাজে প্রথমাবধি পূজিতা হননি। ‘যোষিতামিষ্ট’ দেবতার মতো তিনি আগে নারীকুলের অর্ঘ্য পেয়েছেন, পরে অভিজাত পুরুষসমাজে গৃহীত হয়েছেন। উপাস্যা দেবী হিসেবে মনসার এই স্বীকৃতির ইতিহাসটাই ধরা আছে মনসামঙ্গলের গল্পে। নিম্নবিত্ত রাখাল তথা গোপসমাজ এবং সমাজের প্রায় অন্ত্যেবাসী জেলে-মালো কর্তৃক বন্দিতা হওয়ার পর অপেক্ষাকৃত উচ্চতর সমাজে মনসার অনুপ্রবেশ ঘটে। বণিকরাই ছিল তখন সমাজের অন্যতম চালিকাশক্তি। মনসা তাই সচেষ্ট হয়েছেন শৈব বণিক চাঁদ সদাগরের হাতে পুজো পেতে। এজন্য তাঁকে অনেক কৌশল করতে হয়েছে, ষড়যন্ত্র করতে হয়েছে। দেবী হিসেবে তিনি অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেও নিজ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চেয়েছেন। প্রথমদিকে সকাতর অনুনয়, পরে বিরোধের সূত্রে ক্রোধ ও প্রতিহিংসার আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়েছে মনসার মনে। মনসা পর্যায়ক্রমে চন্দ্ৰধরের সর্বনাশ সাধন করেছেন। সেইসব ক্রূর প্রতিহিংসাপূর্ণ ঘটনার নিরিখে মনসাকে চরম সন্ত্রাসবাদিনী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

কিন্তু মনে রাখতে হবে তাঁর এই সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী ভয়ঙ্কর চেহারাটি সমকালীন সমাজ-পরিবেশের প্রত্যক্ষ ফসল। মনসাকে যদি আমরা নিষ্ঠুর নির্যাতনকারী হিসেবে দেখি তাহলে বলতে হয় কবিদের সমকালে এ ধরনের চরিত্র সমাজে যে বহুব্যাপ্ত হয়েছিল, কবিরা তারই আদলে মনসাকে এখানে চিত্রিত করেছেন। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তির নিজের কোনও অধিকার বা ইচ্ছাশক্তি ছিল না। সাধারণ সামাজিকের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে দুটি শক্তির দ্বারা। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা চালিত হত রাজা-ভূস্বামী-জমিদার বা ওই জাতীয় কোনও ধনী সামন্তপ্রভু কর্তৃক এবং তাদের ধর্মনৈতিক ও সামাজিক জীবন নিয়ন্ত্রিত হত পুরোহিততন্ত্রের দ্বারা। এই দুই সম্প্রদায়ের রক্তচক্ষুই তাদের সবসময় সন্ত্রস্ত করে রাখত। নিজেদের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য প্রশাসক কিংবা পুরোহিতকুল ক্রূর, ভয়ানক, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে দ্বিধা করতেন না। এঁদের কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে যারা বলদর্পিতা দেখাতে চেয়েছে তাদের পরিণাম হয়েছে শৈব বণিক চাঁদের মতো করুণ, বিধ্বংসী। মনসামঙ্গলে একা মনসাই উপরোক্ত দুটি ভূমিকা পালন করেন বলে মনে হয়। তাঁর উদ্দেশ্য যেনতেন প্রকারে উচ্চসমাজে পূজিতা হওয়া। এ ক্ষেত্রে তিনি নির্বিবেক। এই বিবেকহীনতাই মধ্যযুগের সমাজে যাঁরা চালিকাশক্তি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তাঁদেরও শ্রেণিচরিত্র। বিজয় গুপ্তের ‘পদ্মাপুরাণ’ খুঁটিয়ে পড়লে সমকালের রাজনৈতিক কূটকৌশলের একটা অনতিলক্ষ্য সংযোগ চোখে পড়বে। এ কাব্য লেখা হয়েছিল পাঠান রাজত্বের ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিবেষ্টনীর মধ্যে। সামন্তদের প্রতাপ, মুসলমান কাজির অত্যাচার, ধনীর বিলাসিতা, জমিদারি সংঘর্ষ, কুটিল ষড়যন্ত্র, উদ্দেশ্যমূলক গুপ্তহত্যা ইত্যাদি অনেক কিছুই বিজয় গুপ্তের কাব্যে ভিড় করে এসেছে। তাছাড়া কবি মনসাচরিত্রের ক্রূরতার পিছনে দেখেন দেবীর নানাবিধ অপ্রাপ্তি আর যন্ত্রণাকে। পরবর্তী সময়ের কবিরা মনসার এই মডেলটিকে কমবেশি অনুসরণ করেন। চৈতন্য-পরবর্তী যুগের দু’একজন কবির মধ্যে মনসা চরিত্রের চিত্রায়ণে আর একটি বিশেষত্ব লক্ষ করা যায়। সেখানে চাঁদ শৈব নন, শাক্ত। চাঁদের সঙ্গে দেবীর বিরোধ প্রথমেই তৈরি হয় না ওইসব কাহিনিতে, বরং চণ্ডীর সঙ্গে মনসার ঝগড়া ক্রমশ সঞ্চারিত হয়ে যায় চণ্ডীসেবক চাঁদের মধ্যে। সে সব কাব্যে বিষপানে শিবের অচেতন হওয়ার ঘটনায় উল্লসিত হয়ে ওঠেন মনসা। সেক্ষেত্রে পিতার মৃত্যুও কন্যা মনসার কাছে অভিপ্রেত, কেননা, ‘চণ্ডিকা রাণ্ডিকা হৈলে ঘুচিবে সন্তাপ’। মনসা যেন এখানে আর দেবী নন, রক্তমাংসে গড়া প্রতিহিংসাময়ী এক নারী। দেবতার মানবায়নে মঙ্গলকাব্যের কবিরাই অগ্রণী। আর সেই পথে প্রথম পা রেখেছে মনসামঙ্গল।

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *