২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার, দুপুর ১২:৫৮
আমার কাব্যভাবনায় বঙ্গবন্ধু
শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২০

উনিশ’শ একাত্তর সাল। আমি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। আমাদের বাড়ির সামনের বাড়িতে মাটির দেয়ালে সাঁটা পোস্টার। একজন মানুষের ছবি ডানহাতের তর্জনী আকাশের দিকে। পোস্টারে লেখা ‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ! এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’’ বড়দের মুখে শুনি ঐ মানুষটির নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি অনেক বড় নেতা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বড়দের সাথে বসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতাম প্রতিদিন। চরমপত্র, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের দরাজকণ্ঠে সংবাদ আর রক্তে আগুন লাগানো গান। দুটি গানে শেখ মুজিবের নাম ছিল। মোহাম্মদ আবদুল জাব্বারের গাওয়া “মুজিব বাইয়া যাও রে ’’ এবং অংশুমান রায়ের গাওয়া “ শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের ধ্বনি” । হাইস্কুল-জীবন, ভার্সিটি-জীবন গেছে; কবিতা লিখেছি, গান লিখেছি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখা হয়নি। পরবর্তীতে কর্মজীবনে প্রবেশ করে যখন সাহিত্যচর্চার প্রতি মনোনিবেশ করলাম বেশি বেশি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কবিতা হয়ে উঠতে থাকলো আমার কলমে। আমি আমার ‘বালকের দেখা মুক্তিযুদ্ধ’ স্মৃতিকথাকে কবিতায় রূপান্তর করে নাম দিলাম ‘আমার মুক্তিযোদ্ধা হতে পারা না পারার গল্প’। ৮১ চরণের দীর্ঘ কবিতাটি দৈনিক ভোরের কাগজ এর সাহিত্যপাতায় প্রথম ছাপা হলো। তারপর কবিতাটি অন্যান্য সাহিত্যপত্রিকায় পুনর্মুর্দ্রিত হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধ কবিতা সংকলনে স্থান লাভ করেছে। কবিতটি আমার ‘জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার’ কাব্যগ্রন্থভুক্ত হয়েছে পরে। কবিতাটির শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের সেই পোস্টারের প্রসঙ্গ দিয়ে।

মাটির দেয়ালে সাঁটা- আসমানী সেই পোস্টারে-

মেঘের মিনারছোঁয়া আঙুলের ইশারা দেখেছিলাম;

‘…এবারের সংগ্রাম-স্বাধীনতার সংগ্রাম-’

অস্তিত্বের সবটুকু দিয়ে শুনেছিলাম এই ডাকও;

কিন্তু সে-ডাকে সাড়া দিয়ে যোদ্ধার খাতায় নিজের নামটা

লেখাতে পারিনি। আমি তখন সাড়ে ন’বছরের শিশু;

হাত ধরে কেউ আমাকে নিয়ে যায়নি ওপারে-

যেখানে আগুন-পানি সহযোগে শেখানো হতো

দুরন্ত তর্জনী ও ট্রিগারের মধ্যে অব্যর্থ সহবাসের সূত্র।

আমার বয়সকেই আমি দোষি। আমার মুক্তিযোদ্ধা

হওয়ার পথে সে-ই হয়ে উঠেছিল অলংঘনীয় বাধা।

(আমার মুক্তিযোদ্ধা হতে পারা না পারার গল্প / জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার)

কিন্তু সেটি আমার আরও পরে লেখা একটি কবিতা। দেশে সামরিক শাসনের অবসানের পর নব্বই দশকের শুরুতে যখন গণতন্ত্র এলো, দেশের প্রধান চেয়ারে আসীন হলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার নিয়ে সরকারের টালবাহানা। উচ্চ আদালতের বিচারকদের অদ্ভুত ও অভূতপূর্ব ‘বিব্রত বোধকরণ’ এবং বিচার বন্ধ বা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত থাকা। আমি মাঠ পর্যায়ে ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলাম অনেক বছর। কোনো মামালার বিচার বিষয়ক শুনানী নিয়ে বিচারকগণ একর পর এক ‘বিব্রত’ বোধ করতে পারেন এবং তার ফলে সেই মামলার বিচার বছরের পর বন্ধ বা স্থগিত থাকে, এমনটি কখনো দেখিনি বা শুনিনি। অন্যদিকে  পিতৃহত্যার বিচার চাওয়ায় বঙ্গবন্ধু কন্যাদের আরেকটি ১৫ই অগাস্ট ঘটানোর হুমকি প্রদান। আর এসব দেখে-শুনে খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধারাও নীরব। যে-মুক্তিযোদ্ধরা বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে পাকিস্তানী বাহিনীকে পরাস্ত করত স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলেন, অনেকেই পেয়েছিলেন বীরত্বসূচক রাষ্ট্রীয় খেতাব, স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের নৈতিক পরাজয় দেখে মর্মাহত হয়েছিলাম গভীরভাবে। তখন আমি সরকারি চাকরিতে এসে গেছি। সবকিছু দেখে-শুনে মনটা ভীষণ খারাপ । কিন্তু সরকারি চাকরি। প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চাকরি হারানোর ভয়। তারচেয়ে বেশি আদালত অবমাননার অভিযোগের ভয়। এ যেন সেই রানারের অবস্থা ,“দস্যুর ভয়, তার চেয়ে ভয়-কখন সূর্য উঠে !’’  তথাপি থামতে পারলাম না। লিখলাম ‘মুক্তিযোদ্ধার সামনে’ শীর্ষক কবিতা। ঐ কবিতায় বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ এলো প্রবলভাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার নিয়ে ষড়যন্ত্র এবং বিচারকদের ভূমিকার প্রসঙ্গটিও প্রচণ্ড তীর্যকতায় উপস্থাপিত হলো। রংপুর থেকে এম এ বাশার সম্পাদিত ‘উত্তরের একাত্তর কবিতায় স্বদেশ’কাব্য-সংকলনে কবিতাটি ছাপা হলো। আমি ঐ সংকলনের ২০০ কপি সংগ্রহ করে আমার কর্মস্থলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করলাম। একদিন রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলো। আমি ৫ বছরের ৪ বছর অঘোষিত শাস্তিমূলক পোস্টিং-এ চাকরি করলাম। কবিতাটির প্রথমাংশ নিম্নরূপ:

তিরিশ বছর যায়

স্বাধীনতার স্বাদ চেটে খায় লুটেরার দল

বাতাসে স্মৃতির গন্ধ

কেঁদে যায় একাত্তর, ভাষাহীন

পা দোলায় রাজাকার

নতশির বীরোত্তম, পথভ্রষ্ট, যুদ্ধাবসানে

পরাজিত অন্তরে-বাহিরে।

খুনের বিচার চেয়ে বিড়ম্বিতা বোন

ঘাতকের হুংকারে কাঁপে তার বুকের আঁচল

বিব্রত বিচারক-ঈশ্বরের প্রতিনিধি

হতভম্ব সংসার, আল্লাহর আরশ! (উত্তরের একাত্তর কবিতায় স্বদেশ / সম্পাদনা: এম এ বাশার)

একথা বলতেই হয় যে আমার কাছে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ সর্বশ্রেষ্ঠ একটি বিষয়। এই ভাষণে মহাকালজয়ী ভাষণের সব উপাদানই রয়েছে । পাকিস্তান আমলে আমাদের অর্থনৈতিকভাবে শোষণ, রাজনৈতিকভাবে নিষ্পেষণ, প্রশাসনিকভাবে পীড়ন এবং সাংস্কৃতিকভাবে দমনের সব অপচেষ্টা করা হয়েছে। বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তাদের সহ্য করতে হয়েছে সংখ্যালঘিষ্ঠের দুঃশাসন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিরা সংগ্রাম করে গেছে স্বাধিকার অর্জনের। বঙ্গবন্ধুকে জেল-জুলুম-মামলা সহ্য করতে হয়েছে বছরের পর বছর। কিন্তু তিনি কোনো ভয় বা লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দল নয়, কবি কাজী নজরুল ইসলাম সর্বপ্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেছিলেন ।  তিনি ব্রিটিশরাজের জেল খেটেছেন, তাঁর বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে, প্রহসনমূলক বিচার করে তাকে সাজা দেয়া হয়েছে; কিন্তু তাঁর কণ্ঠ রোধ করা সম্ভব হয়নি। একারণে তিনিই আজকের ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ মিলিয়ে যে-ভারতবর্ষ, সেই পূর্ণভারতবর্ষের স্বাধীনতার কবি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ন্যায্য দাবিদার। কিন্তু ধর্মীয় ও রাজনৈতিক হীনমন্যতার কারণে বৃহত্তর ভারতবর্ষ আজও তাঁকে সেই স্বীকৃতি দিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু আমার কাছে বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক সংস্করণ। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন হাজার বছরের বাঙালির জন্য প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়া মাহমানব। তিনি পাকিস্তানী শাসকদের হাতে জেলজুলুম-নির্যাতন ভোগ করেছেন, বারবার তাঁর প্রাণের উপর হুমকি এসেছে; কিন্তু তিনি কোনো ব্যক্তিলোভ বা লাভ কিংবা রাষ্ট্রীয় ভয়-ভীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেননি।  নজরুল তাঁর চিরবিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’কবিতায় যে-আগুন-ঝরানো প্রত্যয়দীপ্ত বক্তব্য এবং ঘোষণা দিয়ে ‘ভেতো-ভীরু-অলস এবং সেনাবাহিনীতে চাকরি করার অনুপযুক্ত ’ বলে বৃটিশ-ভারতে বহুনিন্দিত বাঙালি জাতিকে বীরের জাতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন,  বঙ্গুবন্ধুর সাতই মার্চের অগ্নি-ঝরা ভাষণ সেই বিদ্রোহী কবিতারই আরেক রূপ। বিদ্রোহী কবিতায় বাঙালির বা মানুষের শির হিমালয়কে নিচে ফেলে খোদার আসন আরশ ছাড়িয়ে সবার উপরে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের সেই ‘আঙুল’ বা ‘তর্জনী’ বাঙালির ভীরুতার-কাপুরুষতার-ঘরকুনোপনার সকল বদনাম ঘুঁচিয়ে ছুঁয়েছিল আকাশ-যে আকাশ ছিল পরাধীনতার মেঘে মেঘে আচ্ছন্ন । সাতই মার্চের সেই আঙুল সেই মেঘে আঘাত করে নামিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার বৃষ্টি। কাব নির্মলেন্দু গুণ তাঁর ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো’ নামক সুবিখ্যাত কবিতায় সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুকে “রবীন্দ্রনাথের মতো দীপ্ত পায়ে হেঁটে,  অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন ’’ বলে বর্ণনা করেছেন। আমার বিবেচনায় এই তুলনা হওয়া উচিত বিদ্রোহী কবি নজরুলের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ কোনোদিনও ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতার দাবি করেননি। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জীবনের তেমন কোনো মিল নেই বললেই চলে। আসলে সব মিল নজরুল আর বঙ্গবন্ধুর মধ্যে। এমনকি ‘জয় বাংলা’ শব্দটি পর্যন্ত আমরা নজরুলের কাছ থেকে পেয়েছি। ব্রিটিশরাজ যখন স্বাধীনতাকামী রাজনীতিকদের জেলে পুরে রাখছিলো, নজরুল লিখেছিলেন ‘কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট’’ এর মতো আগুন-ঝরানো গান যা পৃথিবীতেই এই ধরনের প্রথম গান। বঙ্গবন্ধুকে যখন জেলে আটকিয়ে রেখেছিল পাকিস্তানী স্বৈরাচারী সরকার, তখন নজরুলের সেই গানই বাঙালির প্রেরণা হয়েছিল, তারা স্লোগান দিয়েছিলো, ‘‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মজিবকে আনবো’’ । তাই আমি বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ঘটনা নিয়ে লেখা আমার কবিতার নাম দিয়েছিলাম ‘আঙুল ছুঁয়েছে আকাশ’যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং কবি প্রত্যয় জসীম সম্পাদিত ‘দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু’ নামক সংকলনে ঠাঁই লাভ করেছিল । ঐ কবিতায় আমি বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণকে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী  কবিতার অসমাপ্ত উপশেষ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলাম। কারণ, নজরুল বলেছিলেন, তিনি সেইদিন শান্ত হবেন যেদিন উৎপীড়নকারীর অত্যাচার বন্ধ হবে; যেদিন  ‘অধীন বিশ্ব’ উৎপাটিত হবে। শাসিতরা পেয়ে যাবে স্বশাসনের অধিকার অর্থাৎ স্বাধীনতা। সাতই মার্চের ভাষণও বলা হয়েছে যে, বাঙালি যখন মরতে শিখেছে…তখন কেউ তাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আর ফাইনাল কথা হচ্ছে , “এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্ !’’ কবিতাটি আমার ‘প্রণয়ী নদীর কাছে’ কাব্যগ্রন্থে স্থান লাভ করেছে। ‘আঙুল ছুঁয়েছে আকাশ’ কবিতাটি এখানে তুলে দিচ্ছি।

উৎকণ্ঠিত দিন-বাতাসের ইঙ্গিতে শিহরিত

আহ্নিকগতির পথ-বিকেলের রোদ-

শিরিষের শাখা-তালগাছে ঝুলে থাকা

বাবুইয়ের নীড়! কত নম্বর বিপদ-সঙ্কেত

ভাই? কত নম্বর? জানা নেই-জানা নেই-

জানা নেই! পথেঘাটে শুধু গুঞ্জরিত অনুমান।

তবে সকলেই জানেন-সকলেরই বৃষ্টি চায়।

বৃষ্টি চায়-রাজবাড়ীর সোনালী আঁশের চাষী

বৃষ্টি চায়- মঙ্গাপীড়িত তিস্তাপাড়ের জেলে

বৃষ্টি চায়Ñ প্রাইমারীর বেতনবিহীন মাস্টার

বৃষ্টি চায়- সুন্দরবনের বৃক্ষ-হরিণ-ময়ূর

বৃষ্টি চায়- শুকিয়ে আসা ভাওয়াইয়া গানের গলা।

কিন্তু হায়, বৃষ্টি কোথায়? পশ্চিমে ফুটে ওঠে

অগ্নিঝড়ের রঙ! কী হবে! কী হবে! তুঙ্গে

এই ব্যাকুলতা। এমন সময় অগ্নিবাণী

বিদ্রোহী কবিতার অসমাপ্ত উপশেষ-

‘কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না’

আবৃত্তিসহযোগে লাফিয়ে ওঠে তর্জনী

আর পড় প্রতিশব্দে গর্জে ওঠে ভীড়!

কিন্তু কোথায় গিয়ে থামবে ঐ আঙুল?

কোন্ উঁচুতে! কোন্ সে মেঘের মিনারে!

দেখতে দেখতে ঝঞ্ঝা-বজ্র-বিদ্যুৎ ভেদ করে

মহামতি আঙুল ছুঁয়ে ফেলে ঝুঁকে আসা

আকাশের গা! অমনি জমাটবন্দী মেঘ ভেঙে শুরু

বজ্রের তালে তালে মহাবৃষ্টির গান-

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম!

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!’(আঙুল ছুঁয়েছে আকাশ / প্রণয়ী নদীর কাছে)

এই কবিতাটিতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অবাধ সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং সর্বশ্রেণির মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা চিত্রকল্পের সমাহারে উপস্থাপিত হয়েছে। এসব বিষয় কবিতার অভিজ্ঞ পাঠকেরা বুঝবেন। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল নতুন প্রজন্মের মাঝে বিষয়টি আরও সহজ করে উপস্থাপন। কারণ নতুন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকে দেখেনি, বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রাম দেখেনি, অধিকন্তু নানাভাবে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে। আর নতুন প্রজন্ম সত্য ইতিহাস না জানলে জাতির ভবিষ্যৎ পথচলা আবারও অগন্তব্যে পথ হারাতে পারে। তাই একই বিষয় নিয়ে আমি লিখেছি কিশোর কবিতা ‘তর্জনী’ যা দৈনিক সংবাদসহ একাধিক পত্র-পত্রিকায় বহুবার ছাপা হয়েছে । এই কিশোর-কবিতাটি কিশোরদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতো। উল্লেখ্য, বাল্যে-কৈশোরে মগজে বিশ্বাসে যা প্রবেশ করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অপরিবর্তিতত থাকে আমৃত্যু। সেজন্য প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্কুলের পাঠ্যবিষয় নির্বাচনের ব্যাপারটি তুলনামূলকভাবে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কবিতাটি নিম্নরূপ :

জনে জনে প্রাণের সাগর রেসকোর্সের ঐ মাঠ!

সেই সাগরে মিললো নদী-মিললো পথ ও ঘাট।

আশেপাশের মিছিলগুলোয় উপচে-পড়া ভীড়

যোগ দিয়েছে সেই মিছিলে ফিঙ্গে ফেলে নীড়!

বজ্রধ্বনির ঢেউয়ে ভাঙে ভীড়-সাগরের পাড়

ঢেউয়ের টুঁটি ধরবে টিপে সাধ্য এমন কার!

ঝড় দেখি না…তবুও ওঠে উথালপাথাল ঢেউ

ঝড় ওঠেনি- ঝড়ের চেয়েও শক্তিশালী কেউ!

তর্জনীটার ডগায় দ্যাখো তেলেসমাতির বাও

তার দোলাতে দোলে সাগর- তার নাচনে নাও।

তুঙ্গে যখন জনজোয়ার উদ্বেলিত কান

তর্জনী ওই শুনিয়ে দিলো স্বাধীনতার গান।(তর্জনী/ প্রণয়ী নদীর কাছে)

এটি অপ্রিয় সত্য যে বাঙালি জাতির একটা বড় অংশই অকৃতজ্ঞ। বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তার ভীরুতা-কাপুরুষতা-কূপমণ্ডুকতা-ঘরকুনোপনা দূর করেছেন সাহিত্যে-সংগীতে-বাস্তবজীবনে কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আর  নজরুলের স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছেন : ‘‘আমরা আগামী সংগ্রামে কবি নজরুলের সঙ্গীত কণ্ঠে ধারণ করিয়া শ্রীমান সুভাষের মতো তরুণ নেতাদের অনুসরণ করব। ফরাসী বিপ্লবের সময়কার কথা একখানি বইতে সেদিন পড়েছিলাম। তাহাতে লেখা দেখিলাম  সে সময় প্রত্যেক মানুষ অতি মানুষে পরিণত হইয়াছিলেন। আমার বিশ্বাস, নজরুল ইসলামের কবিতাপাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতি মানুষে পরিণত হইবে।’’ বঙ্গবন্ধু হলেন সেই ‘অতি মানুষ’দের একজন এবং তাদের শিরোমণি বা দলনেতা। এই ‘অতি মানুষ’ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের পথ বেয়ে এসেছে বাঙালির স্বাধীনতা। হাজার বছরের বাঙালি, লাখো বছরের বাঙালি প্রথমবারের মতো পেয়েছে তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু নজরুলের যথাযথ মূল্যায়ন করেনি একশ্রেণির তথাকথিত পণ্ডিত-বুদ্ধিজীবীর দল। তাঁকে উপেক্ষা করে, এমনকি নানা অপবাদ দিয়ে বিস্মৃতির অতল গর্ভে ফেলে দিতে চেয়েছে। বঙ্গবন্ধুকেও হত্যা করা হয়েছে। তাঁকে নানা অপবাদে বিদ্ধ করা হয়েছে। আবার নজরুল-বিরোধীরা যেমন বাংলা শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে রাজত্ব করেছে, উভয় বাংলায় পুরস্কৃত হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরাও রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করেছে, নানাভাবে পুরস্কৃত হয়েছে। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রশংসিত হওয়ার অপ-সুযোগ লাভ করেছে। এই নিয়ে আমি (১) ‘কল্পচিত্র’, এবং (২) ‘এই দৃশ্য আর দেখতে চাই না’ শিরোনামে দুটি প্রতীকী কবিতা রচনা করেছিলাম যা একাধিক জাতীয় পত্রিকায় এবং সাহিত্য-ম্যাগাজিনে বিভিন্ন সময় ছাপা হয়েছে।  কবিতা দুটি আমার দুটি কাব্যগ্রন্থেও ঠাঁই লাভ করেছে। যারা পড়েননি, তাদের জন্য কবিতা দুটি এখানে তুলে দিচ্ছি।

১. কল্পচিত্র

বটের রক্ত সুন্দরীর আঁচল রাঙিয়ে

গড়িয়ে চলেছে অর্পণগাছিয়ার জলে;

সবুজের জলসাঘরে

শ্যামার আহত কণ্ঠে বেগম আখতারের ঠুংরী;

সেখানে আকবরের পোশাকে

সপারিষদ তন্দ্রাচ্ছন্ন কুড়োল।

আর ভেন্নাচারা নিয়ে বনের পথে পথে

বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে উচ্চকণ্ঠ

আঁরি ও করাত;

তাদের চারপাশে নেকড়ে প্রটেকশন।(কুয়াশার বর্ণমালা / আমিনুল ইসলাম)

২.

এই দৃশ্য আর দেখতে চাই না

বটের রক্তে রঞ্জিত লেকের জলে চোখ রেখে

রাজপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন কুড়াল ও করাত;

কুড়াল-করাতের শাণিত দাঁতের হাসি রৌদ্র-

কণার ঝলক মেখে বিদ্যুৎ-স্পর্শের মতো

ছড়িয়ে পড়ছে বৃক্ষের বাকলে। অদূরে ওসমানী

মিলনায়তনে যে আয়োজন-সেখান থেকে

ভেসে আসে লোলিত কণ্ঠের বিশেষণমাখা ঘোষণা:

‘প্রাজ্ঞ উপস্থিতি, আমরা আনন্দের সাথে জানাচ্ছি-

এ বছর নিসর্গ-পদক পাচ্ছেন সবুজ ভূগোলের গর্ব-

বৃক্ষপ্রেমিক কুড়াল এবং  করাত।’

                                  -এই ঘোষণায়

ওসমানী উদ্যানের বৃক্ষের দল সালোকসংশ্লেষণ

থামিয়ে চেয়ে আছে মেঘহীন আকাশের দিকে;

ঘোষিকা বা অভ্যাগত- সেদিকে চোখ নেই কারো। (স্বপ্নের হালখাতা / আমিনুল ইসলাম)

স্বাধীনতার ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে আমি লিখেছি ‘যেভাবে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ’ নামের কিশোর কবিতা যা বহুবার বহু পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। উক্ত কিশোর-কবিতার শেষের চার লাইন ছিল ‘‘সাতই মার্চের ডাক / কোথাও নেই ফাঁক / যার হাতে যা আছে / তাই করুন তাক্!’’ এই কবিতাটি আমার দ্বিতীয় ছড়ার  বই ‘ফাগুন এলো শহরে’-এ  গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষক কে, এই নিয়ে আমি লিখেছি ‘চাঁদ-সূরুজের দেশে’ নামক পরিহাসধর্মী কবিতা। কবিতাটি একাধিক সাহিত্যপত্রিকায় ছাপানোর পর আমার ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’ নামক কাব্যগ্রন্থে সূচিভুক্ত হয়। ঐ কবিতায় আমি বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য হিসাবে প্রতীকায়িত করেছি। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে  কেউ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এবং বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাতে করেও বঙ্গবন্ধুর মহিমা এতটুকু ম্লান হয় না। তিনি স্বাধীনতার সূর্য; যিনি তাঁর নামে বা তাঁর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারণ করবেন, তিনি হবেন সূর্যের আলোয় আলোকিত চাঁদের মতো। সূর্যকে বাদ দিলে তো চাঁদের কোনো অস্তিত্বই থাকে না! কারণ তার নিজের কোনো আলো নেই। সূর্যের অলোই তার আলো। ফলে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক বিতর্ক চলে আসেছে, সেটা আমার কাছে মূল্যহীন এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন বলেই মনে হয়েছে। আমার ‘চাঁদ-সূরুজের দেশে’ কবিতাটি সেই অযৌক্তিকতা ও অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে মানুষের মাতামাতিকে ভাষার চাবুকে আঘাত করে উপস্থাপন করেছে।

বঙ্গবন্ধুকে যারা জাতির পিতা হিসাবে স্বীকার করতে চায় না, এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। জর্জ ওয়াশিংটন যদি মার্কিনীদের জাতির পিতা হন, গান্ধী যদি ভারতীয়দের জাতির পিতা হন, জিন্নাহ যদি পাকিস্তানীদের জাতির পিতা হন, তবে বঙ্গবন্ধু কেন বাঙালির জাতির পিতা হতে পারবেন না? জাতির পিতা মানে এই নয় যে আগে ঐ জাতির অস্তিত্ব ছিল না অথবা ঐ জাতির জন্মগ্রহণ করেছে ঐ একক ব্যক্তির ঔরস থেকে। একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যার অবদান এবং ত্যাগ অতুলনীয়ভাবে সর্বোচ্চ, তাকেই সেই জাতির পিতা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এটা কোনো জাতির মহত্তম / সফলতম ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনের একটি প্রতীকী প্রথামাত্র। এটা সত্য যে শেখ মুজিবর রহমানের আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কাজী নজরুল ইসলাম-সুভাষচন্দ্র বসু- হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী-এ কে ফজলুল হক-মাওলানা ভাসানী ছিলেন। তাঁদের অবদান স্বস্ব মহিমায় উজ্জ্বল যা কখনো ম্লান হওয়ার নয়। কিন্তু বাঙালিকে একটি স্বাধীন জাতিতে উন্নীতকরণ এবং তাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়ার কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমান আর কারও নয়। এ ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে অন্য কেউই তুলনীয় নন। তাই শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির পিতা। এটা যারা স্বীকার করে না, তাদের বিষয়ে আমার কবিতা ‘অকৃতজ্ঞ হাওয়া’ ২০০৩ সালে লেখা যা ২০০৪ সালে প্রকাশিত আমার ‘মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম’ কাব্যগ্রন্থে গ্রন্থভুক্ত হয়। কবিতাটি নিম্নরূপ:

অকৃতজ্ঞ হাওয়া

আমাদের চারপাশে অকৃতজ্ঞ হাওয়া;

এ হাওয়া ছুঁয়ে গেছে প্রান্তরেরও বুক;

সেদিক নজর দেয় নি কেউ;

ফলে গোড়াবৈরী মন নিয়ে দিনেদিনে হয়েছে স্থায়ী ।

পুরোনো ক’টি আমগাছ- দালানছোঁয়া নত ফলভারে-

নিয়ত শংকিত: অপবাদে কখন যে ছুটে আসে করাত!

আর এত যে ভোজনপর্ব-

নগরীর সরু বারান্দায়, এখানে-ওখানে,

তবু কোনোখানেই ঢেঁকুরের ধ্বনি নেই।

আর কী করেই বা থাকে!

রীতির খেলাফ হলে কলংকিত হয়

আমাদের উদ্ভাসিত অহম এবং জীবনের শীর্ষবিন্দু দুই-ই!

তাই আজ কদলিবৃক্ষের পায়ে সমানত নমস্কার!

কেননা যে ওষধিদর্শন সারস্বতজ্ঞানে সবিশেষ বিবেচনায় শাশ্বত হয়েছে!

তাই হয়তো বটবৃক্ষ ছাড়ে জনপদ, প্রান্তরের নিরাশ্রয়বিন্দু!

আর এক অদ্ভুত নীরবতার সায় পেয়ে অশ্বত্থের ডালে বসে গোড়া কাটে

অদ্ভুত করাতি; অথবা ভাগ্যবান শাখামৃগের পুচ্ছখোয়া গর্বিত প্রজন্ম!

অধিকন্তু, বিজ্ঞাপিত আবিস্কারে অধিগত এই যে

অস্তিত্বের চূড়ান্ত ত্রিলোকে প্রতিটি মানুষ স্বয়ম্ভূ আপনঈশ্বর।

আর কেন যেন শাখামৃগের হিমযুগীয় যোগসূত্রে সায় নেই অনেকেরই আজ।

তাই তো গতকাল ছিলোই না; এবং আগামীকাল শূন্যতার মহাগর্ভ।

তবে আর থাকে কী বলুন-অসম্বদ্ধ আমি এবং উল্লসিত আজ ছাড়া!

তাই কেন যে মহাপুরুষ নির্বংশের অপবাদে শুধু শুধু মন ভেঙেছিলেন!

এহেন প্রেক্ষিত যখন তবে আর খোঁড়াখুড়ি কেন

উৎকণ্ঠিত কে ছিল গতকাল-

আমার বা আমাদের আঁতুড়ের দ্বারপাশে, আদৌ ছিল কিনা!(অকৃতজ্ঞ হাওয়া/ মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম)

বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি। হাজার বছরের শীর্ষস্থানীয় তিনজন বাঙালির একজন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন এবং কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মিল রয়েছে বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং কর্মকাণ্ডের। বঙ্গবন্ধু ঠিকই চিনেছিলেন নজরুলকে। তাঁদেন দুজনের মন-মানসিকতাও সাদৃশ্যপূর্ণ। তাই পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফেরার পরপরই তিনি কবিকে বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করেন এবং তাঁকে জাতীয় মর্যাদায় রাখার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা করেন। নজরুল চেয়েছিলেন বাংলা বাঙালির হোক এবং হবে একদিন। নজরুলের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন বঙ্গবন্ধু। নজরুলের মতোই বিরাট হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন বঙ্গবন্ধু।  ভারত উপমহাদশে নজরুলের চেয়ে বড় কবি জন্মেছেন, বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বড় রাজনৈতিক নেতাও জন্মেছেন । কিন্তু নজরুল এবং বঙ্গবন্ধুর মতো এত বিশাল হৃদয়ের মানুষ জন্মগ্রহণ করেননি। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-ভূগোল-নির্বিশেষে মানুষের জন্য এত গভীর-নিবিড়-ব্যাপক ভালোবাসা নিয়ে আবির্ভাব ঘটেনি আর কোনো কবি বা রাজনৈতিক নেতার। দেশের জন্য, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-নির্বিশেষে মানুষের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার আর কে করেছেন এই উপমহাদেশে! রতনে রতন চেনে। তাই বঙ্গবন্ধু চিনেছিলেন নজরুলকে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি, নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে কবিতা লেখা হয়েছে অনেক। আমি এই দুই মহান মানবকে একাকার করে লিখেছি আমার ‘কথা বলে ওঠে জাতীয় কবির মাজার’ নামের কবিতা। এই কবিতায় বাঙালির উদ্দেশ্যে কথা বলেছেন জাতীয় কবির মাজারের প্রতীকে জাতীয় কবি স্বয়ং। কবিতাটি প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত ‘বেতার বাংলা’ ম্যাগাজিনে ছাপানো হয়। অতঃপর বহুস্থানে পুনর্মুদ্রণ। অবশেষে আমার ‘জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার’ নামক কাব্যগ্রন্থে স্থান লাভ। কবিতাটি দিয়ে শেষ করছি এই লেখার।

কথা বলে ওঠে জাতীয় কবির মাজার

(দোয়েলচত্বরে সুবেহসাদেকের হাওয়া মেখে শাহবাগমুখী হেঁটে যেতে থাকা

পথিককে মাঝপথে ইশারায় ডাক দিয়ে কথা বলে ওঠে জাতীয় কবির মাজার)        

ভোরের হাওয়া অনেক খেয়েছো-এবার একটা অনুরোধ শুনে যাও-

আমি তো আপনাকে ছাড়া কাউকে কখনো কুর্নিশ করিনি; কিন্তু এই

নাও আমার মরণোত্তর সালাম-এটি পৌঁছে দিও সবুজের স্নেহমাখা

টুঙ্গিপাড়ায়-যেখানে ঘুমিয়ে আছে আমার স্বপ্নের রূপকার শেখ মুজিব;

সে-ই আমার হৃদয়ের ডাকটা ষোলআনা শুনতে পেয়েছিল; তোমরা

তাকে ভালমতো বোঝোনি-যেমন বোঝোনি আমাকে। বাংলা বাঙালির

হয়েছে- দেখে খুউব খুশি হয়েছি-যদিও বিভাজনে আমার সায় ছিল না;

কোলকাতায় ওরা কেমন আছে জানি না। তবে লালসবুজের এই

অর্জনকে ছোট করে দেখি না আমি। হে পথিক! ঘুমোত্তর হাওয়ায়

গা ভাসিয়ে চলছো তুমি পা দিয়ে স্বাধীন সড়কের বুকে। আমি ঘুমুতে

পারিনি আজো; হানাহানির শব্দে বন্ধচোখেও আমার ঘুম আসে না;

আমি তো চেয়েছি মানুষের মাথা ছাড়িয়ে যাক্ বিধাতার আরশের ছাদ;

কিন্তু তোমরা এখনো ডিঙাতে পারোনি বিভেদ-বঞ্চনার বামন পাহাড়।

হে বাঙালি! বাংলা তো তোমাদের হলো; এবার গড়ে তোলো- আমি

যাকে বলেছি ‘ধুলায় তাজমহল’। তাহলেই ঝটপট ঘুমিয়ে পড়বো আমি।

মানুষ তো কতকিছুই ভুলে যায়; স্মরণের ধূসর পথ বেয়ে- সেদিন

যদি ফুল দিতে আর নাও আসো,- আমার কোনো দুঃখ থাকবে না।

আমিনুল ইসলাম, কবি ও প্রাবন্ধিক এবং নিবন্ধক ও মহাপরিচালক সমবায় অধিদপ্তর, ঢাকা।

আপনার মতামত লিখুন :

One response to “আমার কাব্যভাবনায় বঙ্গবন্ধু”

  1. জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এতো সাহসী ও দরদ নিয়ে লেখা পূর্বে পড়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কাব্য রচনা করার ক্ষেত্রে বড় হৃদয় ও আবেগ থাকা একান্ত দরকার। সাহিত্যে হাজারো বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে নিয়ে কাব্য রচনা করা কবি, প্রাবন্ধিকের সংখ্যা খুবই নগণ্য! কবি আমিনুল ইসলাম একজন প্রতীকী প্রতিবাদের কবি হিসেবে খুব দক্ষতা ও সাহসিকতার সহিত কাব্য রচনা করে যাচ্ছেন সিদ্ধহস্তে। এ প্রবন্ধে কবির কাব্য ভাবনায় বঙ্গবন্ধুকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরেছেন। জাতীয় কবি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতিসত্তা বিকাশে যে অনন্য মিল সাদৃশ্যতার ভূমিকা রয়েছে তা যথার্থভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন কবি এ প্রবন্ধে। জাতির মহান স্থপতি ও কাণ্ডারিকে নিয়ে কবির “আমার মুক্তিযোদ্ধা হতে পারা না পারার গল্প”,”মুক্তিযোদ্ধার সামনে”, “তর্জনী, “আঙুল ছুঁয়েছে আকাশ”, “কল্পচিত্র”,”এই দৃশ্য আর দেখতে চাইনা”,”অকৃতজ্ঞ হাওয়া” কবিতাগুলো অনন্য কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ইতোমধ্যে। এ কবিতাগুলোর অনেকগুলো পড়া রয়েছে। কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে কখনও শরীরে শিহরণ জেগেছে, কখনও উত্তেজনা, কখনও আবেগ, কখনও প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, কখনওবা সাহসীকতার চেতনা সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধু একটি চেতনা, একটি দর্শন, একটি আদর্শ, একটি প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর, একটি ভালোবাসার মুগ্ধমন্ত্রের প্রতীক। যা কবি তাঁর বিভিন্ন দীর্ঘ কাব্য ও এ প্রবন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষন করেছেন। এ প্রবন্ধটি কাব্যভাবনায় বঙ্গবন্ধুর স্বরূপ সস্পর্কে সম্যক ধারণা সৃষ্টি করতে সহায়ক করেছে। যা পাঠক কর্তৃক সমাদৃত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মাঝে একজন মহাকবির দর্শন রচিত হয়েছে কবি তাও বর্ণনা করেছেন কাব্যভাষায়। যেকোনো বিবেচনায় প্রবন্ধটি কবির অনন্য প্রবন্ধ। ধন্যবাদ বাংলা সাহিত্য গবেষণা কেন্দ্র-এর কর্তৃপক্ষকে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি প্রকাশ করার জন্য। শ্রদ্ধেয় কবিকে অনেক ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *