১. ।।মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী।।
।।কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।।
এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার উর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়
যেখানে আগুনের ফুলকির মতো
এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।
আজ আমি শোকে বিহ্বল নই
আজ আমি ক্রোধে উন্মত্ত নই
আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল।
যে শিশু আর কোনোদিন তার
পিতার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার
সুযোগ পাবে না
যে গৃহবধূ আর কোনোদিন তার
স্বামীর প্রতিক্ষায় আঁচলে প্রদীপ
ঢেকে দুয়ারে আর দাঁড়িয়ে থাকবে না
যে জননী খোকা এসেছে বলে
উদ্দাম আনন্দে সন্তানকে আর
বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না
যে তরুণ মাটির কোলে লুটিয়ে
পড়ার আগে বারবার একটি
প্রিয়তমার ছবি চোখে আনতে
চেষ্টা করেছিলো
সে অসংখ্য ভাইবোনদের নামে
আমার হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত
যে ভাষায় আমি মাকে সম্বোধনে অভ্যস্ত
সেই ভাষা ও স্বদেশের নামে
এখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে
আমি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি
যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে
নির্বিচারে হত্যা করেছে।
ওরা চল্লিশজন কিম্বা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে রমনার রৌদ্রদগ্ধ
কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য মাতৃভাষার জন্য বাংলার জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
একটি দেশের মহান সংস্কৃতির মর্যাদার জন্য
আলাওলের ঐতিহ্য
রবীন্দ্রনাথ, কায়কোবাদ, নজরুলের
সাহিত্য ও কবিতার জন্য
(যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে
পলাশপুরের মকবুল আহমদের
পুঁথির জন্য
রমেশ শীলের গাথার জন্য,
জসীমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটের’ জন্য।
যারা প্রাণ দিয়েছে
ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন, গজল
নজরুলের “খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি
আমার দেশের মাটি।”
এ দুটি লাইনের জন্য
দেশের মাটির জন্য,
রমনার মাঠের সেই মাটিতে
কৃষ্ণচূড়ার অসংখ্য ঝরা পাপড়ির মতো
চল্লিশটি তাজা প্রাণ আর
অঙ্কুরিত বীজের খোসার মধ্যে
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের অসংখ্য বুকের রক্ত।
রামেশ্বর, আবদুস সালামের কচি বুকের রক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সেরা কোনো
ছেলের বুকের রক্ত।
আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের প্রতিটি রক্তকণা
রমনার সবুজ ঘাসের উপর
আগুনের মতো জ্বলছে, জ্বলছে আর জ্বলছে
এক একটি হীরের টুকরোর মতো
বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছেলে চল্লিশটি রত্ন
বেঁচে থাকলে যারা হতো
পাকিস্তানের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ
যাদের মধ্যে লিংকন, রঁল্যা,
আরাগঁ, আইনস্টাইন আশ্রয় পেয়েছিল
যাদের মধ্যে আশ্রয় পেয়েছিল
শতাব্দীর সভ্যতার
সবচেয়ে প্রগতিশীল কয়েকটি মতবাদ,
সেই চল্লিশটি রত্ন যেখানে প্রাণ দিয়েছে
আমরা সেখানে কাঁদতে আসিনি।
যারা গুলি ভরতি রাইফেল নিয়ে এসেছিল ওখানে
যারা এসেছিল নির্দয়ভাবে হত্যা করার আদেশ নিয়ে
আমরা তাদের কাছে
ভাষার জন্য আবেদন জানাতেও আসিনি আজ।
আমরা এসেছি খুনি জালিমের ফাঁসির দাবি নিয়ে।
আমরা জানি তাদের হত্যা করা হয়েছে
নির্দয়ভাবে ওদের গুলি করা হয়েছে
ওদের কারো নাম তোমারই মতো ‘ওসমান’
কারো বাবা তোমারই বাবার মতো
হয়তো কেরানি, কিংবা পূর্ব বাংলার
নিভৃত কোনো গাঁয়ে কারো বাবা
মাটির বুক থেকে সোনা ফলায়
হয়তো কারো বাবা কোনো
সরকারি চাকুরে।
তোমারই আমারই মতো,
যারা হয়তো আজকে বেঁচে থাকতে পারতো,
আমারই মতো তাদের কোনো একজনের
হয়তো বিয়ের দিনটি পর্যন্ত ধার্য হয়ে গিয়েছিল,
তোমারই মতো তাদের কোনো একজন হয়তো
মায়ের সদ্যপ্রাপ্ত চিঠিখানা এসে পড়বার আশায়
টেবিলে রেখে মিছিলে যোগ দিতে গিয়েছিল।
এমন এক একটি মূর্তিমান স্বপ্নকে বুকে চেপে
জালিমের গুলিতে যারা প্রাণ দিল
সেইসব মৃত্যুর নামে
আমি ফাঁসি দাবি করছি।
যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে
চেয়েছে তাদের জন্যে
আমি ফাঁসির দাবি করছি।
যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্য
ফাঁসি দাবি করছি
যারা এই মৃতদেহের উপর দিয়ে
ক্ষমতার আসনে আরোহণ করেছে
সেই বিশ্বাসঘাতকদের জন্য।
আমি ওদের বিচার দেখতে চাই
খোলা ময়দানে সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে
শাস্তিপ্রাপ্তদের গুলিবিদ্ধ অবস্থায়
আমার দেশের মানুষ দেখতে চায়।
পাকিস্তানের প্রথম শহীদ
এই চল্লিশটি রত্ন,
দেশের চল্লিশ জন সেরা ছেলে
মা, বাবা, বৌ, আর ছেলে নিয়ে
এই পৃথিবীর কোলে এক একটি
সংসার গড়ে তোলা যাদের স্বপ্ন ছিলো।
যাদের স্বপ্ন ছিল আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে
আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার,
যাদের স্বপ্ন ছিল আণবিক শক্তিকে
কীভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায়
শান্তির কাজে লাগানো যায়।
তার সাধনা করার।
যাদের স্বপ্ন ছিল-রবীন্দ্রনাথের
‘বাঁশিওয়ালার’ চেয়েও সুন্দর
একটি কবিতা রচনা করার,
সেই সব শহীদ ভাইয়েরা আমার
যেখানে তোমরা প্রাণ দিয়েছ
সেখানে হাজার বছর পরেও
সেই মাটি থেকে তোমাদের রক্তাক্ত চিহ্ন
মুছে দিতে পারবে না সভ্যতার কোনো পদক্ষেপ।
যদিও অসংখ্য মিছিল অস্পষ্ট নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করবে একদিন
তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ঘণ্টা ধ্বনি
প্রতিদিন তোমাদের ঐতিহাসিক মৃত্যুক্ষণ ঘোষণা করবে।
যদিও আগামীতে কোন ঝড়-ঝঞ্ঝা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভিত্তি পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারে
তবুও তোমাদের শহীদ নামের ঔজ্জ্বল্য
কিছুতেই মুছে যাবে না।
খুনী জালিমের নিপীড়নকারী কঠিন হাত
কোনোদিনও চেপে দিতে পারবে না
তোমাদের সেই লক্ষদিনের আশাকে,
যেদিন আমরা লড়াই করে জিতে নেবো
ন্যায়-নীতির দিন
হে আমার মৃত ভায়েরা,
সেই দিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে
তোমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকারে
ভেসে আসবে
সেই দিন আমার দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।
২. ।।হাসান হাফিজুর রহমান।।
।।অমর একুশে।।
আম্মা তাঁর নামটি ধরে একবারও ডাকবে না তবে আর?
র্ঘূণি ঝড়ের মতো সেই নাম উম্মথিত মনের প্রান্তরে
ঘুরে ঘুরে জাগবে, ডাকবে,
দুটি ঠোঁটের ভেতর থেকে মুক্তোর মতো গড়িয়ে এসে
একবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না, সারাটি জীবনেও না? তবে হার?
কি করে এই গুরুভার সইবে তুমি, কতোদিন?
আবুল বরকত নেই: সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা
বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো যে
তাঁকে ডেকো না;
আর একবারও ডাকলে ঘৃণায় তুমি কুঁচকে উঠবে-
সালাম, রফিক উদ্দিন, জব্বার-কি বিষণ্ন থোকা থোকা নাম;
এই এক সারি বর্শার তীক্ষ ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে
বিচ্ছেদের জন্য তৈরী হওয়ার আগেই
আমরা ওদেরকে হারিয়েছি-
কেননা, প্রতিক্রিয়ার গ্রাস জীবন ও মনুষ্যত্বকে সমীহ করে না;
ভেবে ওঠার আগেই আমরা ওদেরকে হারিয়েছি
কেননা, প্রতিক্রিয়ার কৌশল এক মৃত্যু দিয়ে হাজার মৃত্যুকে ডেকে আনে।
আর এবার আমরা হারিয়েছি এমন কয়েকজনকে
যাঁরা কোনদিন মন থেকে মুছবে না,
কোনদিন কাউকে শান্ত হতে দিবে না;
যাঁদের হারালাম তাঁরা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল
দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, কথা কণা করে ছড়িয়ে দিয়ে গেল
দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতরে মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে।
৩. ।।শামসুর রাহমান।।
।।অভিশাপ দিচ্ছি।।
না আমি আসিনি ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে,
দুর্বাশাও নই, তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে
এই রক্ত গোধূলিতে অভিশাপ দিচ্ছি।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে
মগজের কোষে কোষে যারা পুঁতেছিল
আমাদেরই আপন জনেরই লাশ দগ্ধ, রক্তাপ্লুত
যারা গণহত্যা করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু সেই সব পশুদের।
ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে
নিমেষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকে বুকে যাবে তা আমি মানি না।
হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।
আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে যেতে
ভাসতে নদীতে আর বনেবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে,
অভিশাপ দিচ্ছি, আমি সেইসব দজ্জালদের।
অভিশাপ দিচ্ছি ওরা চিরদিন বিশীর্ণ গলায়
নিয়ত বেড়াক বয়ে গলিত নাছোড় মৃতদেহ,
অভিশাপ দিচ্ছি প্রত্যহ দিনের শেষে ওরা
হাঁটু মুড়ে এক টুকরো শুকনো রুটি চাইবে ব্যাকুল
কিন্তু রুটি প্রসারিত থাবা থেকে রইবে দশ হাত দূরে সর্বদাই।
অভিশাপ দিচ্ছি ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার
কানায় কানায় রক্তে উঠবে ভরে, যে রক্ত বাংলায়
বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র জোয়ারের মত।
অভিশাপ দিচ্ছি আকণ্ঠ বিষ্ঠায় ডুবে ওরা অধীর চাইবে ত্রাণ
অথচ ওদের দিকে কেউ দেবে না কখনো ছুঁড়ে একখন্ড দড়ি।
অভিশাপ দিচ্ছি স্নেহের কাঙ্গাল হয়ে ওরা
ঘুরবে ক্ষ্যাপার মতো এ পাড়া ওপাড়া,
নিজেরি সন্তান প্রখর ফিরিয়ে নেবে মুখ, পারবে না চিনতে কখনো;
অভিশাপ দিচ্ছি এতোটুকু আশ্রয়ের জন্য,
বিশ্রামের কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে দ্বারে দ্বারে ঘুরবে ওরা।
প্রেতায়িত সেই সব মুখের উপর
দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীর প্রতিটি কপাট,
অভিশাপ দিচ্ছি…
অভিশাপ দিচ্ছি…
অভিশাপ দিচ্ছি…
৪. ।।আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ।।
।।কোন এক মাকে।।
“কুমড়ো ফুলে ফুলে
নুয়ে পরেছে লতাটা,
সজনে ডাঁটায়
ভরে গেছে গাছটা,
আর আমি
ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।
খোকা তুই কবে আসবি ?
কবে ছুটি?”
চিঠিটা তার পকেটে ছিল
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।
“মাগো, ওরা বলে
সবার কথা কেড়ে নেবে।
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না।
বলো, মা,
তাই কি হয়?
তাইতো আমার দেরি হচ্ছে।
তোমার জন্যে
কথার ঝুরি নিয়ে
তবেই না বাড়ি ফিরবো।
লহ্মী মা,
রাগ করো না,
মাত্রতো আর কটা দিন।”
“পাগল ছেলে,”
মা পড়ে আর হাসে,
“তোর ওপরে রাগ করতে পারি !”
নারিকেলের চিড়ে কোটে,
উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে,
এটা-সেটা
আর কত কী !
তার খোকা যে বাড়ি ফিরবে
ক্লান্ত খোকা।
কুমড়ো ফুল
শুকিয়ে গেছে,
ঝ’রে পড়েছে ডাঁটা,
পুঁই লতাটা নেতানো
“খোকা এলি ?”
ঝাপসা চোখে মা তাকায়
উঠানে উঠানে
যেখানে খোকার শব
শকুনীরা ব্যবচ্ছেদ করে।
এখন
মার চোখে চৈত্রের রোদ
পুরিয়ে দেয় শকুনীদের।
তারপর
দাওয়ায় বসে
মা আবার ধান ভানে,
বিন্নি ধানের খই ভাজে,
খোকা তার
কখন আসে কখন আসে!
এখন
মার চোখে শিশির-ভোর
স্নেহের রোদে ভিটে ভরেছে।
.
৫. ।।শহীদ কাদরী।।
।।একুশের স্বীকারোক্তি।।
যখন শত্রুকে গাল-মন্দ পাড়ি
কিম্বা অযথা চেঁচাই,
আহ্লাদে লাফিয়ে উঠে
বিছানায় গাড়াই; মধ্য-রাতে তেরাস্তায় দাঁড়িয়ে
সম্মিলিত কণ্ঠে চীৎকারে দিনে দিনে জমে ওঠা উষ্মাকে
অশুভ পেঁচক ভেবে উদ্বিগ্ন গৃহস্থের মতো
সখেদে তাড়াই আর সাঁতার কাটতে গিয়ে
সখের প্রতিযোগিতায় নেমে মাঝ-নদীতে হঠ্যাৎ
শবে-বরাতের শস্তা হাউই-এর মতো দম খরচ হয়ে গেলে
উপকূলবাসীদের সাহায্যের আশায়
যখনই প্রাণপণে ডাকি,
অথবা বক্তৃতামঞ্চে (কদাচ সুযোগ পেলে) অমৃত ভাষণে
জনতাকে সংযত রেখে অনভ্যস্ত জিহ্বা আমার
নিষ্ঠীবনের ফোয়ারা ছোটায়
অথবা কখনো রঙ্গোমঞ্চের আলো নিভে গেলে
আঁধারের আড়াল থেকে যেসব অশ্লীল শব্দ ছুঁড়ে মারি,
এবং উজ্জ্বলমুখো বন্ধুদের ম্লান করে দেয়ার মতো কোনো
নিদারুণ দুঃসংবাদ জানিয়ে
সশব্দে গান ধরি,
মিছিল প্রত্যাগত কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে শাসাই,
উর্ধ্বশ্বাসে ট্যাক্সির মুখে ছিটকে-পড়া
উর্ধ্বশ্বাস ট্যাক্সির মুখে ছিটকে-পড়া
দিকভ্রান্ত গ্রাম্যজনের চকিত, উদ্বেল মুখ দেখে
টিটকারিতে ফেটে পড়ি
অর্থাৎ যখনই চীৎকার করি
দেখি, আমারিই কণ্ঠ থেকে
অনবরত
ঝরে পড়ছে অ, আ, ক, খ
যদিও আজীবন আমি অচেনা ঝোড়ো সমুদ্রে
নীল পোষাক পরা নাবিক হতে চেয়ে
আপাদমস্তক মুড়ে শার্ট-পাৎলুন
দিনের পর দিন
ঘুরেছি পরিচিত শহরের আশেপাশে,
স্বদেশের বিহ্বল জনস্রোতে
অথচ নিশ্চিত জানি
আমার আবাল্য-চেনা ভূগোলের পরপারে
অন্য সব সমৃদ্ধতর শহর রয়েছে,
রয়েছে অজানা লাবণ্যভরা তৃণের বিস্তার
উপত্যকার উজ্জ্বল আভাস,
বিদেশের ফুটপাথে বর্ণোজ্জ্বল দোকানের বৈভব,
মধ্যরাত পেরুনো আলো-জ্বলা কাফের জটলা,
সান্টাক্লজের মতো এভিনিউর দুধারে
তুষারমোড়া শাদা-বৃক্ষের সারি
নিত্য নতুন ছাঁদের জামা-জুতো,
রেস্তোরাঁর কাঁচের ওপারে বসে থাকা বেদনার স্ফুরিত অধর
আর মানুষের বাসনার মতো উর্ধ্বগামী
স্কাইস্ক্রেপারের কাতার-
কিন্তু তবু
চরুট ধরিয়ে মুখে
তিন বোতামের চেক-কাটা ব্রাউনরঙা সুট পরে,
বতাসে উড়েয়ে টাই
ব্রিফকেস হাতে ‘গুডবাই’ বলে দাঁড়াবো না
টিকিট কেনার কাউন্টারে কোনোদিন-
ভুলেও যাবো না আমি এয়ারপোর্টের দিকে
দৌড়ুতে- দৌড়ুতে, জানি, ধরবো না
মেঘ- ছোঁয়া ভিন্নদেশগামী কোনো প্লেন।
.
৬. ।।সৈয়দ শামসুল হক।।
।।একুশের কবিতা।।
সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল–
তপ্তশ্বাস হাহুতাশ পাতাঝরা বিদীর্ণ বৈশাখীর জ্বালাকর দিগন্তে
আষাঢ়ের পুঞ্জীভূত কালো মেঘ আসবেই ঠিক।
সাগরের লোনাজলে স্নিগ্ধ মাটীর দ্বীপ
শ্যামলী স্বপ্নের গান বুকে পুষে
নবীন সূর্য্যেরে তার দৃঢ় অঙ্গীকার জানাবেই।
সংখ্যাহীন প্রতিবাদ ঢেউয়েরা আসুক, তুমি স্থির থেকো।
প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝাবাত অবহেলা করি
সঞ্চয় করে যাও মুঠো মুঠো গৈরিক মাটী:
সবুজ গন্ধবাহী সোনালী সূর্য্যের দিশা
অকস্মাৎ উদ্ভাসিত কোরে দেবে তোমার চলার পথ।
সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল–
পৃথিবীর জিজীবিষু আত্মার আছে। ঘনীভূত জনতার হৃদয়ে হৃদয়ে
উজ্জ্বল শিখা সেই অমর সংবাদে ঢেউ তুলে দিয়ে গেল।
৭. ।।রফিক আজাদ।।
।।পঞ্চানন কর্মকার।।
যুগ-পরম্পরাক্রমে প্রাগৈতিহাসিক উৎস থেকে
উৎসারিত হতে-থাকা নিরন্তর মনুষ্য-জীবন;
মুদ্রিত গ্রন্থের মূল্যে ইতিহাস: মানব-সভ্যতা
দীর্ঘকালব্যাপী অগ্রযাত্রা আর মনন-প্রবাহ।
বাঙালির দীর্ঘ ইতিহাসে সমৃদ্ধির সূত্রে এই
গ্রথিত হয়েছে গ্রন্থ; তোমাকেই ঘিরে চলে জানি
অন্বেষণ: আধুনিক বাঙালির অন্বিষ্ট মনন;
হরফ ঢালাই কাজে সার্বভৌম পাঁচটি আঙুল,
সমগ্র শতাব্দী ব্যেপে চলে দ্রুত মনন-মুদ্রণ;
প্রকাশন-শিল্প ইতিহাসে অনন্য তোমার নাম,
মুদ্রণের সৌকর্য-বর্ধনহেতু চলে বিবিধ নিরীক্ষা,
হরফ চলনশীলে প্রবর্তিত হয় আধুনিক
মুদ্রণপদ্ধতি- বিদেশী বান্ধব, ভাই, অকৃত্রিম
অদম্য উদ্যোগী আর ব্যগ্র পর্তুগিজ অগ্রদূত
প্রাচ্য-ভাষাবিশারদ আরো কিছু বিদেশী সুহৃদ
দিয়েছে সুদৃঢ় ভিত্তি মুদ্রাক্ষর-নির্মাণ শিল্পটি;
টাইপ-কর্তন কাজে নিয়োজিত তোমার পেশি ও
মেধা অবহেলে সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করেছিলো!
ভাষা-সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র তোমার কামারশালা,
পঞ্চাশ বছর ধরে ত্রিবেণী গ্রামের কর্মকার
পরিবারে পরিচর্যা পায় বাঙালির মাতৃভাষা;
প্রকৃত প্রস্তাবে এই ‘পাইকা’ হরফে বাঙালির
নিজস্ব সভ্যতা, কৃষ্টি যথাযোগ্য সমাদর পায়।
তোমার আঙুল থেকে উৎসারিত অন্তহীন নদী
উনিশ শতকে রুগ্ন বাঙালির পুনর্জাগরণে
বিরাট ভূমিকা রেখেছিলো। আধুনিক বাঙালির
রক্তে আজো ঢেউ তোলে আরক্তিম পাইকা টাইপ।
তোমার ছেনির ঘায়ে তৈরি হলো প্রিয় বর্ণমালা।
৮. ।।নির্মলেন্দু গুণ।।
।।আমাকে কী মাল্য দেবে দাও।।
তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হবো
আমাকে কী মাল্য দেবে দাও।
এই নাও আমার যৌতুক, এক বুক রক্তের প্রতিজ্ঞা
ধুয়েছি অস্থির আত্মা শ্রাবণের জলে, আমিও প্লাবন হবো
শুধু চন্দনচর্চিত হাত একবার বুলাও কপালে
আমি জলে স্থলে
অন্তরীক্ষে উড়াবো গাণ্ডীব,
তোমার পায়ের কাছে নামাবো পাহাড়
আমিও অমর হবো, আমাকে কী মাল্য দেবে দাও।
পায়ের আঙ্গুল হয়ে সারাক্ষণ লেগে আছি পায়ে
চন্দনের ঘ্রাণ হয়ে বেঁচে আছি কাঠের ভিতরে
আমার কিসের ভয়?
কবরের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই কবর
শহীদের পাশে থেকে হয়ে গেছি নিজেই শহীদ
আমার আঙ্গুল যেন শহীদের অজস্র মিনার হয়ে
জনতার হাতে হাতে গিয়েছে ছড়িয়ে
আমার কিসের ভয়?
আমিও অমর হবো, আমাকে কী মাল্য দেবে দাও।
এই দেখো অন্তরাত্মা মৃত্যুর গর্বে ভরপুর
ভোরের শেফালি হয়ে পড়ে আছে ঘাসে
আকন্দ ধুন্দুল নয় রফিক বরকত আমি
আমারই আত্মার প্রতিভাসে
এই দেখো আগ্নেয়াস্ত্র, কোমরে কার্তুজ
অস্থি ও মজ্জার মধ্যে আমার বিদ্রোহ
আমাকে কী মাল্য দেবে দাও।
উদ্ধত কপাল জুড়ে যুদ্ধের রক্তজয়টিকা
আমার কিসের ভয়?
তোমার পায়ের নিচে আমিও অমর হবো
আমাকে কী মাল্য দেবে দাও।
৯. ।।মহাদেব সাহা।।
।।একুশের কবিতা।।
ভিতরমহলে খুব চুনকাম, কৃষ্ণচূড়া
এই তো ফোটার আয়োজন
বাড়িঘর কী রকম যেন তাকে হলুদ অভ্যাসবশে চিনি,
হাওয়া একে তোলপাড় করে বলে, একুশের ঋতু!
ধীরে ধীরে সন্ধ্যার সময় সমস্ত রঙ মনে পড়ে, সূর্যাস্তের
লীন সরলতা
হঠাৎ আমারই জামা সূর্যাস্তের রঙে ছেয়ে যায়,
আর আমার অজ্ঞাতে কারা আর্তনাদ করে ওঠে রক্তাক্ত রক্তিম
বলে তাকে!আমি পুনরায় আকাশখানিরে চেয়ে দেখি
নক্ষত্রপুঞ্জের মৌনমেলা,
মনে হয় এঁকেবেঁকে উঠে যাবে আমাদের
ছিন্নভিন্ন পরাস্ত জীবন,
অবশেষে বহুদূরে দিগন্তের দিকচিহ্ন মুছে দিয়ে
ডাক দেবে আমরাই জয়ী!