আইল অব হোপ
নিরিবিলি বাইক-পাথ ধরে আইল অব হোপের দিকে মাউন্টেনবাইক হাঁকাচ্ছিলাম। আইল অব হোপ হচ্ছে সমুদ্র-সংলগ্ন নোনা-জলবাহী নদী ও সরোবরের মতো প্রশস্ত জলাভূমিবেষ্টিত ছোট্ট একটি দ্বীপ। তবে একাধিক ব্রিজের কল্যাণে এ আপস্কেল জনপদটি মেনল্যান্ড তথা সাভানা শহরের সঙ্গে সড়কপথে সংযুক্ত। বেশ কিছুদিন পর মাউন্টেনবাইক নামক অনেকগুলো গিয়ারওয়ালা দ্বিচক্রযানটি চালাচ্ছি, হাঁটু কিংবা কোমরে কোনো সমস্যা হচ্ছে না দেখে নিজেরই অবাক লাগে। অত্র এলাকায় অফিশিয়ালি লকডাউন সমাপ্ত হতে আরও সপ্তাহখানেক দেরি আছে। কিন্তু জর্জিয়া রাজ্যের গভর্নর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে খোশামোদ করার জন্য গতকাল হেয়ারকাটিং সেলুন, ট্যাটু পারলার ইত্যাদি খুলে দিয়েছেন। সমুদ্রসৈকতে স্নান, নেচার-ওয়াকের হাইকিং ট্রেইলে হাঁটাহাঁটি, গলফ কোর্সে খেলাধুলা এবং নোনাজলে বোট ভাসানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করছেন। এদিকে তামাম রাজ্যজুড়ে কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে, মৃত্যুর হারেও কোনো কমতি পড়েনি।
আরবি ক্যালিওগ্রাফিতে আঁকা আলিফ হরফটির মতো সরল-সিধা সড়কে মাউন্টেনবাইকটি স্মুথ গতিতে ঝরাপাতা মাড়িয়ে ছরছরিয়ে আগ বাড়ে। দুপাশের বুনো ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝি পোকারাও করোনা-ক্রান্তির ব্যাপক নীরবতায় দিনদুপুরে রীতিমতো মতোয়ারা হয়ে গুঞ্জন করছে। এদের সশব্দ উৎপাত আমলে না এনে আমি লকডাউনজনিত আমার হালহকিকত নিয়ে ভাবি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আরও দু-এক সপ্তাহের মধ্যে সঙ্গনিরোধপ্রথার ইতি ঘটবে, অনেকের মন ফের রুজু হবে সংসারের নানা কাজে। তবে যারা বয়োবৃদ্ধ এবং ভুগছেন আন্ডারলাইয়িং হেলথ কন্ডিশনস তথা নানা রোগশোকে, তাদের দিনযাপনে লকডাউনের অবরোধ বহাল থাকবে আরও অনেক দিন। আমি এ আন্ডারলাইয়িং কন্ডিশনসের ক্যাটাগরিতে পড়ি এবং আমার ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান টেক্সট পাঠিয়ে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন।
আইল অব হোপ সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে অনিদ্রার প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে। অনেকক্ষণ ধ্রুপদী সংগীতের রেকর্ড বাজিয়ে বা চিত্রকলার বইগুলোতে রঙিন তসবির ঘেঁটে রাত দেড়টা-দুইটার পর ঘুমাতে যাই, তারপর কেবলই মনে হয়, বালিশ যেন সিরিশ কাগজ দিয়ে মোড়া। ভোরেও করোটিতে পুঞ্জিভূত হতে থাকে, লাগাতার হ্যাংওভার। সিনিওর সেন্টারে ব্রিজ খেলার সূত্রে পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত সাইকিয়াট্রিস্টকে কল করি। মুফতে উপদেশ দেওয়ার মওকা পেয়ে তিনি আমাকে লাইনে থাকতে বলেন, তারপর খুঁজে পেতে মুখমণ্ডলে বাঁধানো দাঁত লাগিয়ে জোরেশোরে বলেন, ‘আই অ্যাম ড্যাম শিওর ইউ আর এক্সপেরিয়েন্সিং ডিপ্রেশন।’ আমি সহমত পোষণ করে ঝাঁটাপেটা খাওয়া মেকুরের মতো মিনমিনিয়ে জানতে চাই, কোনো দাওয়াই বা এলাজ তাঁর মনে আছে কি? জবাব দিতে সাইকিয়াট্রিস্ট প্রচুর সময় নেন। ভদ্রলোক সম্ভবত ভুগছেন মৃদু ডায়মেনশিয়ায়। হরতনের খেলায় ইনি কখনো–সখনো চিরতন বা রুহিতন দিয়ে ট্রাম করার চেষ্টা করেন। ভুল ধরিয়ে দিলে ঝাড়বাতির দিকে চেয়ে থাকেন, কখনো-বা ঝকঝকে দাঁতে খামোকা জেল্লা ছড়িয়ে হাসেন। লাইন কেটে গেল কি? ওপাশ থেকে কোনো জবাব আসে না, উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাই, ‘ডক্টর, আর ইউ স্টিল দেয়ার?’ ‘অহ ইয়েস…ইয়াপ’ বলে ভারি আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে এবার তিনি বেশ গুছিয়ে জবাব দেন, উপদেশের গুরুত্ব আমলে এনে আমি উডপেনসিলে নোট নিই। আমার মতো বয়োবৃদ্ধরা ‘অ্যাট রিস্ক অব ডিপ্রেশন’–এ এজ গ্রুপের মধ্যে ‘ইমোশনাল ডিসট্রেস’ বা মানসিক সংকট গেল দু মাসে বেড়েছে ১০০০ শতাংশ। অনেকেই আত্মহত্যা করছেন। আলোচনার পরিশেষে তিনি জানতে চান, ‘আত্মহত্যার সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান সম্পর্কে তুমি জানতে চাও কি? এ বিষয়ে লেখা কিছু স্টাডি রিপোর্ট তোমাকে পাঠাতে পারি?’ আমি তাঁকে সবিনয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে টেলিফোন থেকে নিস্তার পাই।
ভাবতে ভাবতে কখন যে প্যাডেলে জোরেশোরে চাপ দিচ্ছি, ঠিক বুঝতেও পারি না। দেখি, চলে এসেছি ওয়ার্মশ্লো নামে শত-একরী ফার্ম হাউসটির দোরগোড়ায়, যা আমেরিকার এ আত্রাফে তুলা চাষের জন্য প্ল্যান্টেশন হাউস নামে পরিচিত। দাঁড়িয়ে পড়ে একটু বিরতি নিই। জর্জিয়ার কলোনিয়েল আমলে বিলাত থেকে জাহাজ ভাসিয়ে আসা এক অভিবাসীর মেধা ও কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের মেহনতে গড়া ভিলার গেটহাউসটি নির্জন এক জগদ্দলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। আমি ম্যানশনের উদ্যানজুড়ে সারি দিয়ে লাগানো ঔকগাছগুলোর দিকে চুপচাপ তাকাই। শাখা–প্রশাখা থেকে ঝুলছে অজস্র স্প্যানিশ-মসের ধূসরিম ঝুরি। ঝলাঝুলি করছে ফিচেল প্রকৃতির কাঠবিড়ালি। বাতাবরণের শ্যামলিমায়ও প্রশান্তি নামে না মনে। স্পষ্টত অনুভব করি, ডিপ্রেশন ইজ রিয়েল। এ মানসিক অবস্থার মোকাবিলা আগেও করেছি বার কয়েক। যতটা মনে পড়ে, কাবুলে বোমা-বিস্ফোরণজনিত অবরোধে কয়েক দিনের জন্য ইন্টারনেটের কানেকশন বিলুপ্ত হয়ে গেলে বিষয়টা খতরনাক হয়ে উঠেছিল। মাত্র বছর কয়েক আগে ওয়েস্ট আফ্রিকায় ইবোলার দুর্বিপাকে ডিপ্রেশন পুরোনো একজিমার মতো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। চিকিৎসক-কবিরাজে ফায়দা হয়নি কিছু। তবে এ ব্যাধির যৎসামান্য টোটকা চিকিৎসা আমার জানা আছে। তার একটি হচ্ছে, ঘরের অন্ধকার খুপরিতে দিন-কে-দিন অন্তরীণ না থেকে খোলা হাওয়ায় ঘুরপাক করা। এ ধরনের ঘোরাঘুরিতে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটির পরিমাণ বাড়লে আখেরে হালকা হয়ে ওঠে মনমেজাজ।আজকাল সিনিওর সিটিজেনদের মধ্যে অনেকেই নতুন করে কোন পেশার ওপর দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। বলা হচ্ছে যে আনকোরা কিছু শিখতে পারলে মস্তিষ্কে তৈরি হয় নিত্যনতুন কোষ, তা সহায়ক হয় ডায়মেনশিয়া কিংবা আলঝেইমার প্রভৃতি রোগের প্রতিরোধে। যাদের দক্ষতা অর্জনে আগ্রহ নেই, তারাও কোন হবি যথা সংগীত, চিত্রকলা কিংবা বার্ড ওয়াচিং প্রভৃতির কলাকৌশল শিখতে শুরু করেছেন। ব্যাটেল পিটারসন নাকি কৈশরে একটু-আধটু ড্রাম পেটাতেন। তো নতুন কিছু শেখার জোয়ারে ভেসে হালফিল ইনি স্টিল-ড্রাম বাজাতে শুরু করেছেন। পাড়ার একটি পার্টিতে তিনি নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে স্টিল-ড্রাম বাজিয়ে আমোদ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
আমি ফের বাইকের প্যাডেলে চাপ দিই। আইল অব হোপের প্রান্তিকে এসে অনুভব করি, বাইক-পাথে আমি সম্পূর্ণ একা। স্পিড আপনা–আপনি বেড়ে যায়, হৃদয়-মনে বাল্যবন্ধু সিনেমার সংগীত গুনগুনিয়ে ওঠে। সড়কের দুপাশে দীর্ঘ গাছপালার স্যাঁতসেঁতে তলা গাঢ় সবুজ আন্ডারগ্রোথে ছায়াচ্ছন্ন। তবে মাঝেমধ্যে একটি-দুটি প্রশস্ত অপেনিং দিয়ে দেখা যায় ছাঁটা ঘাসের বিশাল লনওয়ালা ভিলা টাইপের বিরাট সব কাঠের ঘরবাড়ি। এ বাড়িগুলোর কোনো কোনোটি কটন প্ল্যান্টেশনের বিত্তবান শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের অবসর বিনোদনের ওয়াটারফ্রন্ট প্রপার্টি। শতখানেক বছর আগেও এগুলোর দেখভাল করত কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসেরা। হালফিল অবশ্য পরিস্থিতির বদল হয়েছে, এসব ম্যানশনের তত্ত্বাবধান করছে বহুলাংশে মেক্সিকো থেকে আগত অভিবাসী সম্প্রদায়।
ডকে দড়ি বাঁধা দুটি ভারী বোটএসব প্রসঙ্গ নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হয়, ধার করা ফেন্সি গিয়ার লাগানো মাউন্টেনবাইকখানা হয়ে উঠেছে আমার পছন্দসই বাহন। এটি যিনি আমাকে মাস সাতেক আগে ধার দিয়েছিলেন, সে প্রয়াত রুপালি চুলের বয়োবৃদ্ধ মানুষ হেরাল্ড গ্রিনবার্চ সাহেবের বসতবাড়িটিও আইল অব হোপের নোনা-জলবাহী লেগুনের কাছাকাছি। স্বেচ্ছাসেবার কাজকর্ম শিখতে আমি কেবল যেতে শুরু করেছি সিনিওর সেন্টারে। গ্রিনবার্চ সাহেব ওখানে হার্টের সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের জড়ো করে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটির তালিম দিতেন। এ অ্যাক্টিভিটিগুলোর একটি হচ্ছে, নিয়ম করে সপ্তাহে অন্তত দুদিন বাইসাইকেল চালানো। এতে যে উপকার হয়, তার প্রমাণ হিসেবে নিজের ফিটফাট দেহটি দেখিয়ে বলতেন, ৯ বছর আগে বাইপাস সার্জারি পর থেকে বাইসাইকেল চালিয়ে ও সাঁতার কেটে তিনি নীরোগ থাকতে পেরেছেন। আমার হৃৎপিণ্ডে মেরামতির প্রয়োজন আছে জানতে পেরে গ্রিনবার্চ উৎসাহ দিয়ে বলেন, ‘ইয়াংম্যান, কাম অলং অ্যান্ড বাইক আরাউন্ড আ বিট উইথ মি, আই অ্যাম টেলিং ইউ…থিংকস আর গোনা গেট ইমপ্রুভ।’ প্রস্তাবে আমি রাজি হই, কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় আমার নিজস্ব কোনো মাউন্টেনবাইক না থাকায়। কেবল সান্তা-ফে শহর ছেড়ে অত্র এলাকায় এসে থিতু হওয়ার কোশেশ করছি, জুতমতো ঘর জোটানোই জটিল হয়ে উঠছে, এ শহরে বাস করব কি না, তাও নিশ্চিত নই, এ পরিস্থিতিতে মাউন্টেনবাইক কেনা…। তিনি টোকা দিয়ে সিগারেটের ছাই ফেলে বলেন, ‘ড্রপ বাই মাই হাউস অ্যাট দ্য আইল অব হোপ। আমার গ্যারেজের লাগোয়া গুদামে পড়ে পড়ে জং ধরছে দু-তিনখানা বাইক, ধার নাও একখানা, পরে তোমার নিজের বাইক হলে নাহয় রিটার্ন করে দিয়ো।’
উইকেন্ডের অবসরে দু-একবার তাঁর সঙ্গে মাউন্টেনবাইকও হাঁকিয়েছি। নানা কারণে অন্তরঙ্গতা তেমন হয়নি। সিনিওর সেন্টারে স্বেচ্ছাসেবা করতে গিয়ে তাঁর ব্যাপারে গালগল্প শুনেছি বেশ কিছু। গাল্ফ স্ট্রিম নামে নগরীর একটি শৌখিন উড়োজাজাজ নির্মাণের কারখানায় খাটছে গ্রিনবার্চ সাহেবের বিপুল অঙ্কের বিত্ত। তাঁর তিন প্রজন্মের পুরোনো বসতবাড়ির স্টাডিতে নাকি আছে—ক্রীতদাস ব্যবসা–সংক্রান্ত নথিপত্র, যা হাল জামানার গবেষকেরা তাঁর দ্বারস্থ হয়ে অ্যাকসেস লাভে ব্যর্থ হয়েছেন। গেল বছরের শেষ দিকে তিনি স্থানীয় দুটি কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-আমেরিকান তরুণ-তরুণীকে ঘানার স্লেভ ক্যাসোল সরেজমিন দেখতে যাওয়ার স্টাডি-ট্যুরে বৃত্তি দিয়ে স্পনসর করেন। এতে গ্রিনবার্চ–সম্পর্কিত গুজবের বেলতা-চাকে যেন ঢিল পড়ে। আড়ালে-আবডালে বাতচিত হতে শোনা যায়, পূর্বপুরুষদের ক্রিতদাস ব্যবসার গিল্ট ফিলিং থেকে তিনি বৃত্তির কড়িতে গোনাগারি করলেন।
এসে পড়ি আইল অব হোপের নোনাজল–সংলগ্ন খাসমহলে। মেরিনার কাঠে তৈরি জেটির বিরাট প্ল্যাটফর্মটি সম্পূর্ণ নির্জন। কিন্তু বোট বাঁধা নেই তেমন। আন্দাজ করি, বেশ বেলা হয়েছে, যারা নাও ভাসাতে সক্ষম, তারা বাই দিস টাইম ভেসে গেছে দরিয়ার দিকে। এখানে গ্রিনবার্চ সাহেবের সেইলবোটটি নোঙর করে থাকার কথা, তা দেখতে না পেয়ে একটু অবাক হই। তাঁর সংসারে সন্তানাদি বা ওয়ারিশান কে আছেন, আমি ঠিক জানি না। বাড়িতে তিনি একাকীই বসবাস করতেন। হয়তো মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে কোনো নিকট আত্মীয় সৎকার করতে এসেছিলেন, তিনি কি সেইলবোটটি ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন অন্যদিকে? যাক, প্যাডেল মেরে আরেকটু আগাই। এদিকে ছোট ছোট কাঠের ডক বা প্রাইভেট জেটি। একটি ডকে দড়ি বাঁধা হয়ে ভাসছে দুটি ভারী বোট। আমি সাইকেল থেকে নেমে পড়ে আস্তে-ধীরে মাউন্টেনবাইকটি ঠেলে ঠেলে হাঁটি। তাবৎ পরিসরের তুমুল নীরবতায় চিড় কেটে বিপুল আওয়াজে যেন বিস্ফোরিত হয় একটি বাদ্যযন্ত্র। আমি নিরিখ করে চারদিকে তাকাই। একটি প্রাইভেট ডেকের ব্রিজে দাঁড়িয়ে স্থূলকায় একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, তিনি সোনালি রঙের টুবা নামে বিশাল একটি বাদ্যযন্ত্র জাপটে ধরে বাজানোর কসরত করতে করতে ফিরে তাকান। আমি প্রমাদ গুনি, মানুষটি আমার চেনা। এনার নাম আনসার ব্যাটেল পিটারসন। ইনিও সিনিওর সেন্টারের আরেক সাঙ্গাত। বছর কয়েক আগে ব্যাটেল পিটারসন কাঠমিস্ত্রী হিসাবে ডক নির্মাণ করতেন। এখনও সুযোগ পেলে জেটি মেরামতের ছোটা-কাজে হাত লাগান। মাইল্ড স্ট্রোকের পর অবসর নিয়ে ইনি ভলান্টিয়ার হিসাবে সিনিওর সেন্টারে মেনটেইন্যান্স জাতীয় কাজের তদারকি করেন।
শ্বেতশুভ্র ভিলার শানদার সিঁড়ি আজকাল সিনিওর সিটিজেনদের মধ্যে অনেকেই নতুন করে কোন পেশার ওপর দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। বলা হচ্ছে যে আনকোরা কিছু শিখতে পারলে মস্তিষ্কে তৈরি হয় নিত্যনতুন কোষ, তা সহায়ক হয় ডায়মেনশিয়া কিংবা আলঝেইমার প্রভৃতি রোগের প্রতিরোধে। যাদের দক্ষতা অর্জনে আগ্রহ নেই, তারাও কোন হবি যথা সংগীত, চিত্রকলা কিংবা বার্ড ওয়াচিং প্রভৃতির কলাকৌশল শিখতে শুরু করেছেন। ব্যাটেল পিটারসন নাকি কৈশরে একটু-আধটু ড্রাম পেটাতেন। তো নতুন কিছু শেখার জোয়ারে ভেসে হালফিল ইনি স্টিল-ড্রাম বাজাতে শুরু করেছেন। পাড়ার একটি পার্টিতে তিনি নিজে থেকে উদ্যোগ নিয়ে স্টিল-ড্রাম বাজিয়ে আমোদ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। যতটা শুনেছি, তাঁর অধীর বাদনে কোনো কোনো শ্রোতার বধির হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এতে নিরুৎসাহিত হয়ে ব্যাটেল পিটারসন ই-বে থেকে শস্তায় খরিদ করেছেন ঝলমলে একটি টুবা। তিনি ফের তাতে শিঙা ফোঁকার মতো জবরদস্ত আওয়াজ তোলেন, রাজ্যের সব সিগাল পাখি জল ছেড়ে পড়িমরি করে উড়ে যায় দিগন্তের দিকে। মিউজিকের ইমপ্যাক্টে আমিও শিউরে ওঠে অন্যদিকে তাকিয়ে দ্রুত বাইকটি ঠেলি। এ ভদ্রসন্তান ইউটিউবের কায়দা-কানুন করায়ত্ত করতে পারলে, তামাম অন্তর্জালজুড়ে ব্রাউজ করনেওয়ালাদের মধ্যে খবর হয়ে যাবে।
এসে পড়ি ওয়াটারফ্রন্টের কিনারা ঘেঁষে চলে যাওয়া বৃক্ষশোভিত সরণিতে। এদিককার পেল্লায় মাপের ভিলাগুলোর কোনো কোনোটায় বাস করছেন বিত্তবান সিনিওর সিটিজেনরা। সচরাচর তাঁরা গাল্ফকার্ট হাঁকিয়ে আস্তে-ধীরে হাওয়া বিধৌত সরণিতে ঘুরপাক করেন। আজ কোথাও আমি কোনো গাড়ি-ঘোড়ার লিমলেশও দেখতে পাই না। এসে পড়ি গ্রিনবার্চ সাহেবের ভিলাটির কোনায় ছায়া ছড়ানো বয়োবৃদ্ধ ঔকগাছটির তলায়। বাতাসে ঝুলে থাকা ধূসর বর্ণের স্প্যানিশ মসগুলো কিংবদন্তির দৈত্যের চুল-দাড়ির মতো দুলছে। আমি মাউন্টেনবাইক স্ট্যান্ডে দিয়ে একটু দাঁড়াই। এ ধরনের ঔকগাছ প্রাক-ঔপনিবেশিক জামানার, কোনো কোনোটার বয়স দুই-আড়াই শত বছরেরও ওপর। গ্রিনবার্চ সাহেব বৃক্ষগুলোর বয়স বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিরূপণ করে লেভেল লাগানোর কথা বলতেন। কাজটি তাঁর অসমাপ্ত হয়ে গেছে। মাত্র ১০ দিন আগে তিনি প্রয়াত হয়েছে। না, করোনা সংক্রমণে তাঁর মৃত্যু হয়নি। তবে লকডাউনের সামান্য দিন আগে—তাঁর বসতবাড়িতে সার্ভিস দিতে আসা মেইডকে কাজে আসতে মানা করে দিয়েছিলেন। শরীরে একটি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শহরের হাসপাতালগুলো করোনা সংক্রমণে রুগণ মানুষের জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজনে বাতিল করে দিয়েছিল সব ধরনের ইলেকটিভ সার্জারি। এমনকি শরীরী দুর্বিপাকে ইমার্জেন্সিতে যাওয়াও নিরুৎসাহিত করছিল। গ্রিনবার্চ সাহেবের অসুস্থতার সংবাদ প্রতিবেশীরা জানতে পারেনি। সম্ভবত রাতের বেলা অকস্মাৎ হার্ট অ্যাটাকে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা ছিল না, তবে একটি আনফিনিশড বিজনেস থেকে গেছে। মাইন্টেনবাইকটি তো তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা। তাঁর কোনো ওয়ারিশানকে আমি চিনি না, এ পরিস্থিতিতে কী করা যায়…?
নোনাজল ছোঁয়া লিলুয়া বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দেয়। কে যেন খোনা গালায় কথা বলে ওঠে। বারবার জপা বাক্যটির শব্দগুলো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আমি ঘাড় বাঁকিয়ে গাছের ডালপালায় নিরিখ করি, এবার স্পষ্ট শুনতে পাই, ‘ক্লারা—গেট মি আ ড্রিংক…উইল ইউ?’ কণ্ঠটি সম্ভবত টিয়া বা তোতা-জাতীয় কোনো পাখির। আমি খেচরটির সন্ধানে ফের তাকাই বৃক্ষের সবুজ ক্যানোপিতে, না তেমন কিছু দেখতে পাই না, তবে ফের শুনতে পাই, ‘ইয়াহ, গিভ মি সাম জিন অ্যান্ড টনিক…অ্যান্ড আ লিটিল লাইম…দ্যাট উড ডু।’ খেচরকণ্ঠে গ্রিনবার্চ সাহেবের কথা বলার ভঙ্গি সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। জানতে কৌতূহল হয়, ক্লারা নামের নারীটি কে, তার সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল গ্রিনবার্চের? পাখা ঝটপটানোর শব্দ শুনতে পাই, কিন্তু পত্রালির ঘন আড়াল আমার দৃষ্টিকে অবরুদ্ধ করে রাখে। আমি অবগত যে, হবি হিসাবে গ্রিনবার্চ সাহেব ম্যাকাও, আমাজন উপকূলের বর্ণাঢ্য টিয়া প্রভৃতি পুষতেন। পাখিগুলো নাকি তাঁর বসতবাড়ির অঙিনার খোলামেলা চরে বেড়াত। আমি গাছতলা ছেড়ে চলে আসি রোদে ঝলসে ওঠা শ্বেতশুভ্র ভিলাটির সামনে।
আঙিনায় মেনিকিওর করা সবুজ লন থেকে উঠে গেছে শানদার সিঁড়ি, কোথাও মানুষজন কেউ নেই, তুমুল এ নির্জনতায় দাঁড়িয়ে ভাবি, মাউন্টেনবাইকটি কি গেটে ফেলে রেখে ফিরে যাব? ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। মনে হয়, এ মুহূর্তে সিদ্ধান্তটি না নিলেও চলে। তো বাইকের প্যাডেলে চাপ দিতে যাই, চোখ আপনা–আপনি ফিরে যায় সফেদ ভিলাটির আঙিনায়। শৈশবে আমাদের গ্রামের বাড়িতে ভিখ মাগতে আসা এক বৃদ্ধের গলায় শোনা লোকগীতির একটি চরণ অনেক বছর পর ফিরে আসে মনে, ‘সাহেবের বাংলায় আছে ধুমধাম, সাহেব নাই-রে..।’ প্যাডেল মারতে মারতে সংগীতটির পরবর্তী চরণ নিয়ে ভাবি, কিন্তু কিছুতেই তা মনে পড়ে না। প্যাডেলে দ্রুত চাপ পড়ে, আর মনে হয়, প্রস্থান আসবে এভাবে, পেছনে পড়ে থাকবে বসতবাড়ি, জমিজিরত ও পোষা পাখি।
নেচার ওয়াক
দুপুর হয়নি, ভেষজ চায়ের মতো কবোষ্ণ রোদ ছলকাচ্ছে চতুরদিকে, এখনই ঘরে ফিরতে ইচ্ছা হয় না। অনেকক্ষণ মাউন্টেনবাইক হাঁকানো হলো। নেমে পড়ে, ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে ঘঁষটে বাহনটিকে নিয়ে আসি শহরতলির নেচার ওয়াকের ট্রেইলহেডে। পার্কিংলটে গোটা চারেক গাড়ি দেখতে পেয়ে বুঝতে পারি বনানীতে পদপরিক্রমার পথরেখা নির্জন নাও হতে পারে। আমি বাইক লক করে ঘুরে দাঁড়াই, চোখে পড়ে হরেক রকমের চিত্র তথা অক্টোপাস, মেডিটেশনের ম্যান্ডেলা,শঙ্খ, শান্তিচিহ্ন, কেনোবিসের প্রসূনশুদ্ধ পত্রালি প্রভৃতি আঁকা বিট-আপ টয়োটা কারটি। আন্দাজ করি, গাড়িটির মালিকিন ভায়োলেতা অলরেডি ঢুকে পড়েছে বনানীতে। হিপি চরিত্রের এ তরুণী শখের গ্লাস ব্লোয়ার, অর্থাৎ তীব্র তাপে কাচ গলিয়ে তাতে বর্ণের বিচ্ছুরণ মিশিয়ে নির্মাণ করে ছোটখাটো ভাস্কর্য ও নানা প্রতীক। এ ছাড়া পার্শব্যবসা হিসেবে সে নগরীর পার্কে পর্যটকদের কাছে চাপলিশে বিক্রি করে কেনোবিসের স্টিক ও কাচের কল্কে। হামেশা হাসিখুশি ভায়োলেতার শরীর-মনে আছে সহজাত চার্ম, উর্দ্দিষ্ট পুরুষদের সঙ্গে সে কখনো–সখনো ফ্লার্টি হতে পছন্দ করে। স্টিক বিক্রির জন্য ভায়োলেতা যাদের অ্যাপ্রোচ করে, তারা সহজে ফসকাতে পারে না। সুতরাং তার সান্নিধ্যের সম্ভাবনায় সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে।একটু সতর্ক হয়ে কাদামাটিতে ফেলে রাখা গাছের কাণ্ডে পা ফেলে সাবধানে সামনে বাড়ি। জলের রুপালি রেখা দৃশ্যমান হয়, সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাই, ভায়োলেতার হরেক রঙের উল্কিতে চিত্রিত বিকিনি পরা দেহ। সে ঘাসে বসে কাচের বাহারে কল্কে দিয়ে স্মোক করছে কেনোবিসের শুষ্ক প্রসূন, সামনে রাখা রাবারের ছোট্ট ডিঙি। আমি অন্য দিকে ফিরতে যাই, সে হাত তুলে বলে, ‘হেই…ওয়ান্ট আ লিটিল পাফ?’ জবাব দিই, ‘নট রিয়েলি…।’ বলেই ঢুকে পড়তে চাই জঙ্গলের ছায়াচ্ছন্ন পরিসরে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আর ইউ অ্যাভোয়ডিং মি?’
নেচার ওয়াকে আমি সচরাচর সেলফোন ক্যারি করি না, কিন্তু লক করতে গিয়ে বিজ্ঞাপনধর্মী ই–মেইলগুলো চোখে পড়ে। কবরের লট বিক্রি হচ্ছে বিপুল অঙ্কের ছাড়ে, আর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্যাকেজ আগেভাগে কিনে রাখলেও পাওয়া যাচ্ছে ব্যাপক রিডাকশন। আমি সেলফোন পুরোপুরি টার্নড অফ করতে করতে উল্লিখিত পণ্য দুটির অর্থনৈতিক দিক নিয়ে ভাবি, মৃত্যু ক্রমবর্ধমান হারের সঙ্গে কবরের ডিমান্ড সম্পর্কিত, তাই দাম কমে যাওয়ার বিষয়টা চট করে মাথায় ঢুকে না। তখনই হাইজাম্পের কায়দায় কংক্রিটের ব্যারিয়ার ক্রস করে পার্কিংলটে ঢুকে পড়ে গোটা চারেক হরিণ। তারা বেপরোয়া ভঙ্গিতে এদিক–ওদিক তাকায়, তারপর খুরে নুড়িপাথর ছিটকিয়ে ঢুকে পড়ে বনানীতে।
পত্রলতায় ছায়াচ্ছন্ন বেলেপাথরের মূর্তি কিছুক্ষণ আমি তাদের ট্রেইলে অনুসরণ করার চেষ্টা করি। ঢুকে পড়ি পাইন বনের বেশ গভীরে, আশপাশে খুরের আওয়াজ পাওয়া যায়, কিন্তু চলমান পা কিংবা লেজ কিছুই দেখা যায় না। যেতে যেতে বনভূমি অতঃপর ভরে ওঠে অদৃশ্য কিছু খেচরের কিচিরমিচিরে। তা ছাপিয়ে একটি পাখির আওয়াজে যেন কেবলই ধ্বনিত হতে থাকে ‘ট্রুটি ফ্রুটি…ফ্রুটি ট্রুটি’। একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম, দেখি চলে এসেছি গাছ কেটে বর্গক্ষেত্রের আকৃতিতে তৈরি ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে। আবহাওয়া চমৎকার, কিন্তু এখনো কেউ এদিকে তাঁবু খাটায়নি। কয়েক পা সামনে যেতেই জামাকাপড় খুলে এক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠি! সম্পূর্ণ দিগম্বর এ ভদ্রসন্তানের হাতে সেলফি স্টিক, তাতে আটকানো আইফোন। অত্র এলাকায় উলঙ্গ হওয়া অপরাধ কি না আমি ঠিক জানি না, তবে তিনি সম্পূর্ণ নিরাবরণ না, তার মাথায় জড়ানো চেককাটা ব্যান্ডেনা, বিড়বিড়িয়ে কিছু বলছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তাঁর বীজাণু করোটিতে চড়ে বসেছে, আমি ঘুরে দ্রুত সরে যেতে চাই, বিষয়টা তিনি লক্ষ করে আওয়াজ দেন ‘মাজুলটাফ’, জুইশ সংস্কৃতিতে চালু এ লবজটির মর্মার্থ হচ্ছে ‘গুডলাক’। বুঝতে পারি, স্রেফ কপালগুনে তার সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে, এখন অকুস্থল থেকে দ্রুত দূরে সরে যাওয়াটা হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
জঙ্গলের কিনারা ঘেঁষে বাদামি রঙের বুনোঘাস মাড়িয়ে হাঁটছিলাম। চামচের মতো কানঅলা খরগোশগুলো টপকি দিয়ে সরে যায়। উলুলঝুলুল হাওয়া বয়ে আনে আঁশটে নোনা গন্ধ। তা ছাপিয়ে নাসারন্ধ্রে ছোবল মারে কেনোবিসের পোড়া সৌরভ। একটু সতর্ক হয়ে কাদামাটিতে ফেলে রাখা গাছের কাণ্ডে পা ফেলে সাবধানে সামনে বাড়ি। জলের রুপালি রেখা দৃশ্যমান হয়, সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাই, ভায়োলেতার হরেক রঙের উল্কিতে চিত্রিত বিকিনি পরা দেহ। সে ঘাসে বসে কাচের বাহারে কল্কে দিয়ে স্মোক করছে কেনোবিসের শুষ্ক প্রসূন, সামনে রাখা রাবারের ছোট্ট ডিঙি। আমি অন্য দিকে ফিরতে যাই, সে হাত তুলে বলে, ‘হেই…ওয়ান্ট আ লিটিল পাফ?’ জবাব দিই, ‘নট রিয়েলি…।’ বলেই ঢুকে পড়তে চাই জঙ্গলের ছায়াচ্ছন্ন পরিসরে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আর ইউ অ্যাভোয়ডিং মি?’ আমি কোনো জবাব দিই না, তাতে শরীর বাঁকিয়ে বিদ্রূপের ভঙ্গিতে সে বলে, ‘লুক…ম্যান লাভ টু সি মি ইন দিস স্ট্রিং বিকিনিজ, ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দিস?’ না বোঝার কোনো কারণ নেই, তাই জবাব দিই, ‘আই অ্যাম অ্যান ওল্ডম্যান, তুমি যাদের ম্যান বলছ, আমি ঠিক সে ক্যাটাগরিতে পড়ি না, গুডবাই।’ বলে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়াই। পেছন থেকে ভায়োলেতা আওয়াজ দেয়, ‘স্ক্রু ইউ ওল্ডম্যান’।
গাছপালার ভেতর দিয়ে দ্রুত হেঁটে আমি চেষ্টা করি খোলা প্রান্তরে বেরিয়ে আসতে। ভোরবিহানে ইন্টারন্যাটে পড়া ডিপ্রেশন বিষয়ক একটি প্রবন্ধের কথা মনে ফিরে আসে। একটি ছত্র ‘মেন্টাল ব্রেকডাউন ইজ গ্রেজুয়েল অ্যান্ড রিকভারি কুড বি পেইনফুল…’, শীতনিদ্রার শেষে জাগ্রত সরীসৃপের মতো হিলহিলিয়ে ওঠে। খোলা মাঠের কিনারে আসতেই দেখতে পাই, আলু, কপি, মটরশুঁটি ও ট্যামেটোখেতের তাবৎ তাজা শাকসবজি এলোপাতাড়ি ট্র্যাকটার চালিয়ে নিসমার করে দেওয়ার দৃশ্য। বিনষ্ট খামারের আলপথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে হ্যারিকেন-ঝড়ে চুরমার হওয়া বার্ন বা গোলাঘরের ভাঙাচোরা কড়ি-বর্গা, মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা আবহাওয়া মোরগ ইত্যাদি দেখতে পেয়ে ফার্মটিকে এবার শনাক্ত করি। বছর দেড়েক আগে হারিকেন মাইকেলে ধ্বংসপ্রাপ্ত এ গোলাঘরের ছবি স্থানীয় পত্রিকায় ছেপেছিল। আমরা জেনেছিলাম যেÑহ্যারিকেন-উত্তর ত্রাণের অনুদান কৃষ্ণাঙ্গ চাষি ফিলিপ বার্টনের হাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় না পৌঁছানোর কথা। শেয়ারক্রপার বা বর্গাচাষির বংশধর ফার্মার ফিলিপ সার ও কীটনাশকের ব্যবহার না করে অর্গানিক পদ্ধতিতে মূলত সবজি চাষ করতেন। হ্যারিকেনের ক্ষয়ক্ষতিতে তাঁর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। ত্রাণ-ফান্ড না পেয়ে চেষ্টা করছিলেন ব্যাংক লোন পাওয়ার, কোনো কারণে তাও জোটেনি। তারপর অত্র এলাকায় শুরু হলো লকডাউন। ফার্মার ফিলিপ রেস্তোরাঁগুলোয় তাজা সবজি সরবরাহ করতেন, কিন্তু তাঁর পণ্য কেনার মতো কোনো রেস্তোরাঁ খোলা ছিল না। চেষ্টা করেছিলেন স্মল বিজনেস ফান্ড থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা পেতে, তা-ও সময়মতো তাঁর হাতে এসে পৌঁছেনি। আত্মহত্যার আগের দিন নাকি বিভ্রান্ত হয়ে এলোপাতাড়ি ট্র্যাকটার চালিয়ে নষ্ট করে দিয়েছিলেন নিজ হাতে বোনা শাকসবজি, আলু ও চিনাবাদাম।
ফার্মের বাওয়ান্ডারি ছাড়িয়ে চলে আসি বাদামি ঘাসে ছাওয়া নিম্নভূমিতে। এদিকে পায়ে-চলা ট্রেইল নেই, কিন্তু ঘাস মাড়িয়ে নোনাজলের লেগুনের দিকে যেতে কোনো অসুবিধা হয় না। কয়েকটি পাখি ডিগবাজি দিয়ে ঘাসে হুটোপুটি খায়। তাদের পালক থেকে সুদিন ফিরে আসার মতো ছড়ায় সোনালি দ্যুতি, আর মনে হয়, সামান্য দিন পর লকডাউনের বিষয়টা দুঃস্বপ্নের মতো উবে যাবে, মানুষ যেতে শুরু করবে রেস্তোরাঁয়, পানশালার টেলিভিশন স্ক্রিন ঘিরে জমে উঠবে বেসবলের বাসর, স্বাভাবিক হয়ে আসবে সবকিছু, শুধু জংধরা পিকাপ ট্রাকটি চালিয়ে রেস্তোরাঁয় রেস্তোরাঁয় সবজির সরবরাহ দিতে দেখা যাবে না ফার্মার ফিলিপকে। আরও কিছুদিন পর প্রকাশিত হবে করোনা সংক্রমণে প্রয়াত মানুষদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা, এ পরিসংখ্যানেও অন্তর্ভুক্ত হবে না কৃষ্ণাঙ্গ চাষি ফিলিপের উপাত্ত।
বিষাদগ্রস্ত হালতে হাঁটতে হাঁটতে সচেতনভাবে আমার ভেতরে বয়ে চলা ভাবনা-চিন্তার খতিয়ান নেই। প্রলম্বিত লকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, আমার দিনযাপন থেকে চিরতরে তিরোহিত হয়ে যাচ্ছে উড়োজাহাজ চড়ে অভারসিজ ট্র্যাভেলের সম্ভাবনা। যুক্তরাষ্ট্রের মফস্বল শহর থেকে ভিন্ন কোনো দেশে না যেতে পারার ব্যাপারটা যেন কারাপ্রাচীরবিহীন অদৃশ্য এক গারদের মতো চেপে বসছে আমার সত্তায়। সমস্যাটাকে আমি সরাসরি মোকাবিলা করার চেষ্টা করি। এপ্রিলে আমি কিছুদিনের জন্য এশিয়ায় ফিরতে চেয়েছিলাম। প্রথমে যেতে চেয়েছিলাম সাউথ কোরিয়ার বন্দরনগরী বুসানে, তারপর মালয়েশিয়ার পেনাঙ হয়ে বর্মার মান্দালয় ও কম্বোডিয়ার সায়াম রিপে। গেল বছরের নভেম্বরে টিকিট কেটে রেখেছিলাম। করোনা ক্রাইসিসের শুরুতে টেলিফোন করে তাবৎ কিছু বাতিল করি। ভেবেছিলাম, কিছু পয়সা ফেরত পাব। মাসখানেক নানা নম্বরে ফোনাফোনি করে দুদিন আগে বুঝতে পেরেছি, পয়সা জলে গেছে। হাল জামানার এয়ার ট্র্যাভেলে টিকিটের মূল্য ফেরত না পাওয়াটা জলচলের মতো হয়ে যাচ্ছে। এতে ক্ষতবিক্ষত হওয়া বুদ্ধিমত্তার পরিপন্থী।
আমার ডিপ্রেশনের কারণ অন্যত্র। আমি বছর কয়েক ধরে এশিয়ার হরেক দেশে ছড়ানো কয়েকটি বিখ্যাত বৌদ্ধমন্দিরে কিছুক্ষণ কাটানোর প্রেক্ষাপটে একটি ভ্রমণপুস্তক লেখার পরিকল্পনা করছিলাম। নিসর্গ-নিবিড় পরিবেশে স্থাপিত ঐতিহাসিক মন্দিরগুলোতে পূজারিরা কীভাবে তাঁদের উপাসনায় সম্পর্কিত হন প্রাকৃতিক প্রতিবেশের সঙ্গে, নিসর্গ কীভাবে তাঁদের ধ্যানমগ্নচেতনায় একাত্ম হয়ে যায়, মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার পর্যবেক্ষণভিত্তিক বয়ানকে করতে চেয়েছিলাম পুস্তকটির প্রধান থিম। সাউথ কোরিয়ার বুসান নগরের কাছাকাছি বেওমেওসা মন্দিরে আরেক দফা যাওয়াটা ছিল এ পুস্তকের জন্য ক্রিটিক্যাল। কারণ, এশিয়ার অন্য যে বৌদ্ধমন্দিরগুলো কথা লিখতে চেয়েছিলাম, সেগুলো আমি পরিদর্শন করেছি একাধিকবার। আমার পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে নোটবুকেও ধারণ করে রেখেছি ইন-ডিটেইল বর্ণনা। বেওমেওসা মন্দিরে আমি ছিলাম মাত্র ঘণ্টা দেড়েক সময়। অই ভ্রমণের তিনটি ফটোগ্রাফস এখনো আমার সংগ্রহে আছে, তবে বাক্সপেটরা-সিন্দুক তন্নতন্ন করে খুঁজেও ভ্রমণ-ডায়েরিটি পাইনি।
চলে আসি সবুজাভ-বাদামি ঘাসে ঘেরা নোনাজলের একটি খাড়ির কাছে। চরাচরে খেলছে রৌদ্রবিধুর হাওয়া। পুরো পরিসরকে জাদুঘরের কোনাকানচিতে অবহেলায় ফেলা রাখা অজানা চিত্রকরের ল্যান্ডস্ক্যাপ পেইনটিংয়ের মতো দেখায়। আমি বসে পড়ি ঘাসে। চোখ বন্ধ করে নির্জনতায় নিশ্বাস নিই। বেওমেওসা মন্দিরের ফটোগ্রাফস শৈশবের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিপটের মতো করোটিতে ভিড় জমায়।
বেওমেওসা মন্দির সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি সাউথ কোরিয়ার মেয়ে মি-কয়োংয়ের কাছ থেকে। ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসে আমি ইন্টারন্যাশনেল এডুকেশন শিরোনামে একটি কোর্স পড়াতাম। ওখানে ক্লাস প্রজেক্ট হিসেবে শিক্ষার্থীদের কোনো তীর্থস্থানে ভ্রমণের স্মৃতি—ফটোগ্রাফস ও তথ্যের সমবায়ে উপস্থাপন করতে বলা হয়েছিল। মি-কয়োং পাওয়ার পয়েন্টে প্রেজেন্ট করেছিল বেওমেওসা মন্দিরের বেশ কতগুলো চিত্তাকর্ষক ছবি। জানতে পেরেছিলাম, ৬৭৮ সালে যে পাহাড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মন্দিরটি, ওখানে আছে কূপের মতো প্রাকৃতিক এক প্রস্রাবণ, যাতে বাস করছে সোনালি একটি মাছ, যে কারণে মন্দিরটি পরিচিতি পেয়েছে ‘নির্বনা ফিস টেম্পোল’ নামে। এ ঘটনার অনেক বছর পর বুসান নগরীতে যাই তিন দিনের এক কনফারেন্সে। জানতাম, গ্র্যাজুয়েশনের পর মি-কয়োং বাস করছে বুসানে। আমার হাতে ব্যক্তিগতভাবে ঘোরাফেরার জন্য ছিল মাত্র একটি দিন। সম্পূর্ণ ফ্রি ছিল না মি-কয়োং, তবে কীভাবে যেন তার কাজ থেকে ঘণ্টা তিনেক সময় বের করে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল বেওমেওসা টেম্পোলে। মন্দিরের স্থাপত্যকলা আমাকে যতটা আশ্চর্য করেছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি মুগ্ধ হয়েছিলাম গুজিয়ংসান পাহাড়ের প্রাকৃতিক শোভায়।
সামান্য সময় আমরা কাটিয়েছিলাম মন্দিরের চত্বরে। চমকে ওঠার মতো একটি ব্যাপার ঘটেছিল। আঙিনায় ধ্যানস্থ হয়ে মি-কয়োং অর্পণ করছিল ধূপধুনার অর্ঘ। তাকে চক্রাকারে ঘিরে কিশোর-বয়সী কয়েকজন শ্রমণ তোড়জোড়ে উপস্থাপন করছিল মার্শাল আর্টের কৃৎকৌশল। এ ঘটনায় বিস্মিত না হয়ে আমার কৌতূহলের জবাবে মি-কয়োং বলেছিলেন, মন্দিরে হামেশা চর্চা হয় মার্শাল আর্টের, তবে কোনো পূজারিকে ঘিরে যখন শ্রমণেরা স্বতপ্রবৃত হয়ে পারফর্ম করে শরীরের এ সবল শিল্প, তখন ধরে নিতে হয় বিগত যুগের সিদ্ধকাম শ্রমণেরা জীবনযুদ্ধে তাকে জোগাচ্ছে প্রেরণা।
সবুজাভ-বাদামি ঘাসে ঘেরা নোনাজলের খাড়িঅতঃপর আঙিনা ছেড়ে আমরা সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়েছিলাম সম্পূর্ণ স্বর্ণালি বুদ্ধবিগ্রহের বেদিতে। মৃণ্ময় মূর্তিটিকে সম্বোধন করে মি-কয়োং কপিলাবস্তুর সংসারত্যাগী রাজকুমার যেন তার কতকালের চেনাজন, এমন অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলেছিল। জানতে পেরেছিলাম, শত শত বছর ধরে কোরিয়ার আম-আদমি থেকে শুরু করে রাজন্যরা এ বিগ্রহের কাছে তাঁদের অভিযোগ জানিয়ে আসছেন, তিনিও নাকি তীব্র সংবেদনের সাড়া দিচ্ছেন, কখনো পাথরের চোখে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে, আবার কখনোবা স্বপ্নে। সময়ের অনটন ছিল, তাই তাড়াহুড়া করে আমরা বাগিচার আলপনা-কাটা পথ ধরে ফিরছিলাম পার্কিংলটের দিকে। পত্র-লতা ও পুষ্পে ছায়াচ্ছন্ন একটি বেলেপাথরের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে মি-কয়োং বলেছিলেন, ‘ওয়ান মোর থিংগ আই মাস্ট টেল ইউ…এ মূর্তিটির ভেতরে প্রোথিত আছে নয় জন সিদ্ধকাম শ্রমণের দেহভস্ম।’ জেনেছিলাম, অনেকেই নাকি বিশ্বাস করে, প্রয়াত এ শ্রমণেরা পাষাণের আত্মা হয়ে এখনো বহাল রাখছেন তাঁদের ধ্যানমগ্নতা।
পার্কিংলটের কাছেই ছিল পাঁচ শ বছরের পুরোনো গিংকো প্রজাতির গাছটি। জেনেছিলাম, তরুবরটি কোরিয়ার সংস্কৃতিতে ‘সবুজ শ্রমণ’ হিসেবে সম্মানিত। সময় ছিল না, তাই তাঁকে দূর থেকে নতমস্তকে প্রণতি জানিয়ে মি-কয়োং গিয়ে উঠেছিল গাড়িতে। বুসান নগরীতে ফেরার পথে স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে সে জানতে চেয়েছিল, ‘উইল ইউ বি অ্যাবল টু কাম ব্যাক ফর আ কাপোল অব ডেইজ…সামটাইম ইন দ্য য়েন্ড অব এপ্রিল?’ জানতে পেরেছেলিাম, বেওমেওসা মন্দিরে আজ আমার যা দেখা হয়নি, তা কোরিয়ান সংস্কৃতিতে ‘ডিয়ুনগুনগক’ নামে পরিচিত। মন্দির–সংলগ্ন উপত্যকায় আছে ৬ হাজার ৫০০টি উইসটেরিয়া ফুলের লতানো কুঞ্জ। বছরের নির্দ্দিষ্ট সময়ে পুষ্পিত তরুগুলো ভরে ওঠে, নীলাভ-আসমানি পাপড়িতে। সে বারবার জোর দিয়ে বলছিল, ‘আই অ্যাম টেলিং ইউ…দ্য লেভেন্ডার কালার ব্লুম ক্রিয়েটস অ্যান এক্সট্রা অর্ডিনারি সাইট…।’ জানতে চেয়েছিলাম, ‘এ পুষ্পপট পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত আছে কি আধ্যাত্মিক কোনো ইন্টারপ্রিটেশন?’ মৃদু হেসে সে জবাব দিয়েছিল, ‘অবকোর্স দেয়ার ইজ আ স্পিরিচুয়াল ডাইমেনশন টু ভিউ দ্য উইসটেরিয়া ব্লুম, তুমি যদি তা দেখতে ফিরে আসো…আই উড বি হ্যাপি টু এক্সপ্লেইন দ্য ফেনোমেনা।’
লোহিত বর্ণের একটি স্কারলেট ট্যানাজার শরীর-মনে চমক দিয়ে উড়ে যায়। এ পাখিগুলো জলচর নয়, তবে কি ডগমগে লাল খেচরটি সমুদ্রের রেখা নিশানা করে পরিযায়ী হচ্ছে গাল্ফ অব মেক্সিকোর দিকে? না, দুনিয়াজোড়া এ সংকটে কিন্তু বিঘ্ন ঘটেনি এদের চলাচলে। পাখিটির সহজাত উড্ডয়নে মনে একটি প্রশ্ন তৈরি হয়, যে ধরনের ভ্রমণ আমি পরিকল্পনা করি, তা কিন্তু সহজাত নয়,আমি বুদ্ধিমত্তা ও বিত্ত দিয়ে তা ঘটানোর চেষ্টা করি। মন্দিরকেন্দ্রিক একটি বই লেখার পরিকল্পনা আদতে আমার অন্তর্গত মনের কামনাবিশেষ। এ ধরনের বাসনার সঙ্গে সচরাচর যুক্ত থাকে অপ্রাপ্তিজনিত স্ট্রেস, যার পরিণতিতে তৈরি হয় ডিপ্রেশন। ভাবি এ কামনার যদি অবসান ঘটানো যায়, তাহলে হয়তো আপনা–আপনি প্রশমিত হবে বিষণ্নতা। যাক, নাহয় না–ই লিখলাম, এতে পাওয়া যাবে যে অবসর, তা স্রেফ আকাশকুসুম চয়ন করে কিন্তু দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়।
লেখার আকাঙ্ক্ষা থেকে নিস্তার পেতেই বিমানবন্দরে অসাবধানে হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্টটি ফিরে পাওয়ার মতো নির্ভার লাগে। আমি উঠে পড়ে ইনল্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করি। মনে হয়, সচেতনভাবে বেওমেওসা মন্দিরে ঘুরে বেড়ানোর বাসনাকে আমি মুছে ফেলতে চাচ্ছি, তবে অবচেতন যেন যখের ধনের মতো মি-কয়োংয়ের স্মৃতিকে লালন করছে। করোনাক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যুর সংবাদটা আমি শুনেছি অন্তর্জালের যোগসূত্রে সপ্তাহ দিন আগে। অবাক লেগেছে, শোকের তীব্র অনুভূতি হয়নি দেখে। তবে কি একসঙ্গে জানাশোনা একাধিক মানুষের মৃত্যুতে ভোঁতা হয়ে গেছে আমার সংবেদন? জানতে পেরেছি, এবার সে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্সে বাসরত ছাত্রজীবনের এক বন্ধুর প্ররোচনায় ওখানে মার্ডি গ্রার পর্ব দেখতে এসেছিল। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা থেকে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারপর সপ্তা তিনেকের সাফারিংয়ের ভেতর দিয়ে কীভাবে তার জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে, খুঁটিনাটি কিছু আমি জানি না। শুনেছি সাউথ কোরিয়ায় সংক্রমণে মাত্র ২৫৬ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, সে তুলনায় নিউ অরলিন্সে প্রয়াত হয়েছেন ২ হাজার ১৩৫ জন মানুষ। ঠিক বুঝতে পারিনি, পরবাসে মি-কয়োংয়ের মৃত্যু কি এ উপাত্তের অংশবিশেষ?
বুসান নগরীতে ঘণ্টা তিনেক ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতিকে ধারণ করে আমি সামনে বাড়ি। ইনল্যান্ডের বনানীতে ঝেপে এসেছে হলুদ ফুল। দেখি, ট্রেইলে আওয়ারা ঘুরপাক করছে হুপিং ক্রেইন নামের দুই জোড়া সুদর্শন সারস। করোনা-ক্রান্তিতে আমাদের পথচলা স্থগিত হয়ে পড়েছে বটে, কিন্তু পরিব্রাজক এ পাখিদের ওড়াউড়িতে ভাটা পড়েনি। তারা দিব্যি ঘাসবীজ খুঁটে খাচ্ছে দেখে ভালো লাগে।
রচনায় ব্যবহৃত মানুষজনের নাম তাঁদের প্রাইভেসি রক্ষার প্রয়োজনে বদলে দেয়া হয়েছে।