কার্ল মার্ক্সে’স ইকোসোশ্যালিজম: ক্যাপিটাল, নেচার, অ্যান্ড দ্য আনফিনিশড ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি—কোহেই সাইতো, মান্থলি রিভিউ প্রেস, নিউইয়র্ক, ২০১৭।
ভূমিকা
প্রকৃতি বিষয়ে কার্ল মার্ক্সের দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গ উঠলেই মোটামুটি তিনটি সমালোচনা হয়ে থাকে। প্রথম সমালোচনা হলো মার্ক্স একটি ‘উত্পাদনবাদী’ বা ‘প্রমিথীয়’ দৃষ্টিকল্পের শিকার। এর অর্থ হলো মার্ক্স মানব সংগঠনের উদ্দেশ্য হিসেবে পরিমাপযোগ্য অর্থনৈতিক উত্পাদনশীলতা ও প্রবৃদ্ধিকেই বিশ্লেষণের উপজীব্য হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। এই দৃষ্টিকল্পের অধীনে ভাবা হয় যে উত্পাদনশীল শক্তিগুলোর পুঁজিবাদী বিকাশের ফলে মানুষের উত্পাদনক্ষমতা প্রাকৃতিক বাধাগুলোকে সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করতে পারে। এখানে কমিউনিজম বা সাম্যবাদকে দেখা হয় প্রকৃতির ওপর সম্পূর্ণ মনুষ্য আধিপত্য বিস্তারের পুঁজিবাদী চেতনার সম্প্রসারণ ও তা জায়েজ করার অংশ হিসেবে। এ ছাড়া পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদ দুটোকেই মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে অনিবার্য বৈরিতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়।
দ্বিতীয় সমালোচনা হলো পুঁজিবাদের বিশ্লেষণে মার্ক্স উত্পাদনের ক্ষেত্রে প্রকৃতির ভূমিকাকে হয় বাতিল করে দিয়েছেন অথবা গুরুত্ব দেননি। মার্ক্স মূল্যের যে শ্রমতত্ত্ব দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আর তৃতীয় সমালোচনাটি হলো পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের যে সমালোচনা মার্ক্স করেছেন, সেখানে প্রকৃতি বা উত্পাদনের প্রাকৃতিক শর্তগুলোর কোনো ভূমিকা নেই।
পল বুর্কেট ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত মার্ক্স অ্যান্ড নেচার গ্রন্থে এই সমালোচনাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি মার্ক্স সম্পর্কে এই দাবিগুলোর সাধারণ অনুসিদ্ধান্তগুলোরও উত্তর দিয়েছেন খুবই পদ্ধতিগতভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে কার্যকর পদ্ধতিতে। তাঁর বক্তব্য ছিল এ রকম যে প্রকৃতি বিষয়ে মার্ক্সের অ্যাপ্রোচের একটি অন্তর্নিহিত যুক্তি যেমন আছে, তেমনি সাযুজ্য ও বিশ্লেষণী ক্ষমতাও রয়েছে। কিন্তু এই বিষয়টি এখনো স্বীকৃত নয়। এমনকি পরিবেশকেন্দ্রিক ইকোলজিক্যাল মার্ক্সবাদীরাও মার্ক্সের এই অ্যাপ্রোচটির স্বীকৃতি এখনো দেয়নি।
আরেকজন প্রথিতযশা সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং মান্থলি রিভিউ পত্রিকার সম্পাদক জন বেলামি ফস্টার এ বিষয়ে অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। বিশেষ করে ফস্টারের মার্ক্সে’স ইকোলজি: ম্যাটেরিয়েলিজম অ্যান্ড নেচার এই বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। অবশ্য ফস্টার মার্ক্সবাদের প্রথাগত ব্যাখাকে পরিবেশের সংকট মোকাবিলায় নতুন করে সামনে এনেছিলেন। পরিবেশের সংকটকে মাথায় রেখে তিনি আরও যুক্তিসংগত পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। পুঁজিবাদী কৃষি ও মাটির বাস্তুতন্ত্রের ওপর মার্ক্সের অনাদৃত লেখাজোখা, দার্শনিক প্রকৃতিবাদ ও বিবর্তনবাদী তত্ত্ব ঘেঁটে ফস্টার দেখিয়েছিলেন যে মার্ক্স পুঁজিবাদী সমাজের শক্তিশালী সমালোচক হিসেবে পরিচিত হলেও প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের পরিবর্তনশীল সম্পর্ক বিষয়ে মার্ক্স গভীরভাবে সজাগ ছিলেন।
অবশ্য কার্ল মার্ক্সের বিরুদ্ধে এসব সমালোচনার প্রথম জবাব আসে ষাট ও সত্তরের দশকেই। মার্ক্সীয় বিশ্লেষক রেমন্ড উইলিয়ামস ও ইস্তাভান মেসজারস যুক্তি দেখান যে মার্ক্সের রাজনৈতিক অর্থনীতি বুঝতে হলে পুঁজিবাদী সম্পর্কের সঙ্গে বাস্তুতন্ত্রের দ্বন্দ্ব ভালোভাবে বুঝতে হবে।
মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক পল বুর্কেট ও জন বেলামি ফস্টারের কাজের ওপর ভিত্তি করেই জাপানি মার্ক্সবাদী পণ্ডিত কোহেই সাইতো কার্ল মার্ক্সে’স ইকোসোশ্যালিজম: ক্যাপিটাল, নেচার, অ্যান্ড দ্য আনফিনিশড ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি গ্রন্থটি লিখেছেন। বইয়ের মূল কথা হলো পৃথিবী ধ্বংসের পেছনের মূল কারণ পুঁজিবাদী উত্পাদনের ধরন। আর এটা বুঝতে হলে মার্ক্সের চিন্তাকে কেন্দ্রীয় পদ্ধতি হিসেবে ধরতে হবে। এ ছাড়া প্রমিথীয় হিসেবে মার্ক্সের বিরুদ্ধে সমালোচনার অন্যতম জবাব হিসেবে বইটি গুরুত্বপূর্ণ। সাইতোর বইয়ে মার্ক্সের বিস্তৃত কাজকে তুলে আনা হয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো সম্প্রতি প্রকাশিত প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর মার্ক্সের নোটবুকগুলো।