অধ্যাপক ড. মনসুর মুসা।।ভাষাবিদ ও সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি।
১.০. আবিষ্কারের কথা ও তারপর
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কার করেছিলেন- হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা। নামটি প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপিতে ছিল না। তিনি বুদ্ধি খাটিয়ে নামটি দিয়েছিলেন। সেই ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে। তিনি দীর্ঘ ৯ বছর এই পাণ্ডুলিপির ভাববস্তু, বিষয়বস্তু ও কথাবস্তু নিয়ে সুবিস্তারিত গবেষণা করেছেন। এই পদাবলী যাঁরা রচনা করেছেন, তাঁদের নাম-ধাম ও পরিচিতি অনুসন্ধান করে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৯১৬ সালের পর এ পর্যন্ত দেশ-বিদেশের অনেক বিখ্যাত গবেষক, পণ্ডিত ও মনীষী এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন, সমালোচনা করেছেন, গবেষণা করেছেন। যে কয়জন গভীর আলোচনায় প্রবেশ করেছেন এবং যাঁদের নাম উচ্চারিত না হলে চর্যাপদ গবেষণার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকবে। তাঁদের কয়েকজন হচ্ছেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, সুকুমার সেন, সর্বশেষ তারাপদ মুখোপাধ্যায়।
বেশ কয়েকজন বিদেশী পণ্ডিতও চর্যাপদ তথা প্রাচীন বাংলার সাহিত্য নিদর্শন নিয়ে গবেষণা করেছেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চর্যার সমাজচিত্র নিয়ে লিখেছেন।..
১.১.চর্যাপদ পাঠ্যবস্তু হিসেবে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত
চর্যাপদকে পাঠ্যবস্তু হিসেবে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার প্রথম প্রয়াস মুহম্মদ শহীদুল্লাহর। তিনিই ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করে চর্যাকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অনুমোদনক্রমে তিনি তা পড়াতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি হাজার বছরের পুরাণ বৌদ্ধগান ও দোহার অংশ-বিশেষ নিয়ে গবেষণা করে পি এইচ ডি ডিগ্রী অর্জন করেন, প্যারিসের সোরবর্ণ থেকে। সেই গবেষণার পর তিনি পরবর্তীকালে Buddhist Mystic Songs শিরোনামে চর্যাপদগুলো সম্পাদনা করেন। এটি দীর্ঘদিন বাঙলা বিভাগে পাঠ্য ছিল। তবে যতদূর মনে হয় তখনকার দিনের Syllabus এ শুধু একজন কিংবা দুজন পদকর্তার পদ পাঠ্য ছিল। আমি ১৯৭২ সনে চর্যাপদ পড়াতে গিয়ে বিভিন্ন পদকর্তার পদ পাঠ্যবস্তু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ করেছিলাম। শহীদুল্লাহ র্তার চর্যাপদ গবেষণাকে পরিবর্ধিত করে অনেকগুলো প্রবন্ধ রচনা করেন এবং সেগুলো তাঁর বাংলা সাহিত্যের কথা প্রথম খণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
২.২.মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের বিষয়বস্তু
মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রাচীন বাংলা সাহিত্যালোচনার বিষয়বস্তু লক্ষ্য করলে তাঁর পরিবর্ধিত আগ্রহের পরিসীমার পরিচয় পাওয়া যাবে। তিনি ‘প্রাচীন যুগের বাঙ্গালা সাহিত্যের ধারা, মীননাথ ও কাহ্নপা, চৌরঙ্গীনাথ, নাথগীতিকা, বৌদ্ধতান্ত্রিক লেখক লুইপা, বিরূপা এবং শবরী পা ডোম্বীপা ভুসুক অবশিষ্ট চর্যাপদ কর্তৃগণ চর্যাগানের সাহিত্যিক মূল্য প্রাচীন বাঙ্গালাভাষার ব্যাকরণ, ধর্মমঙ্গল, লাউসেনের কাহিনী, ময়ুর ভট্ট, নাথপন্থা ও ধর্মপূজা, শূন্যপুরাণ ও তাঁহার লেখক এবং বৌদ্ধ-যুগে বাঙ্গালার সমাজচিত্র প্রভৃতি রচনা লিখেছেন। সেগুলো বাংলা সাহিত্যের কথা (১ম খণ্ড) এই শিরোনামে ১৯৫৩ সালে প্রকাশ করেন। অর্থাৎ ১৯২১ সাল থেকে শুরু করে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত শহীদুল্লাহ চর্যাপদ ও সম্পর্কিত বৌদ্ধ সাহিত্যের ও বাংলাভাষার স্বরূপ উপলব্ধির চেষ্টা করেছেন।
২.৩.শহীদুল্লাহর গবেষণা তাৎপর্য কি ?
তাৎপর্য হচ্ছে, বাংলাভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আগে যে কয়েকটি গবেষণা হয়েছে, বিশেষ করে রামগতি ন্যায়রত্ন ও দীনেশচন্দ্র সেন। তাঁদের ঐতিহাসিক দৃষ্টি প্রসারিত ছিল বিদ্যাপতি আর চণ্ডীদাসে। আদি-মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যিক নিদর্শন বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সম্বন্ধেও তাঁদের ধারণা ছিল না। কারণ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনও আবিষ্কৃত হয় চর্যার প্রায় সমসাময়িককালে। তাহলে ব্যাপার দাঁড়াল এই রকম : চর্যাপদের আবিষ্কার বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখার দিগন্তকে প্রসারিত করেছে, প্রায় পাঁচশত বছর। এক্ষেত্রে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রবোধচন্দ্র বাগচী প্রমুখের গবেষণা ও উপাত্ত-বিশ্লেষণ বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। সুকুমার সেন তাঁর বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রথম খণ্ডে এবং চর্যাগীতিকোষ সম্পাদনায় উপাত্ত-বিশ্লেষণে বিশেষ দক্ষতা দেখান।
২.৪.শহীদুল্লাহর ভাষা-চিন্তা
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক শব্দবিদ্যা বিভাগের প্রথম ছাত্র হিসেবে চর্যার ভাষাকে কিঞ্চিৎ নতুনভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন। পূর্বতন ধারণা ছিল, বাংলা সংস্কৃতজাত ভাষা। শহীদুল্লাহ একথা অস্বীকার করেন নি, তবে বলেছেন- বাংলা ঠিক সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন নহে, কিন্তু সংস্কৃতের সজাতীয় এক প্রাচীন ভারতীয় আর্য কথ্যভাষা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। বস্তুত সংস্কৃত শব্দ হইতেই আমরা বুঝিতে পারি যে ইহা কথ্যভাষার মার্জিত রূপ ছিল। ইহা ব্রাহ্মণদিগের শিষ্ট ভাষা ছিল, তাহা রামায়ণ, মহাভাষ্য প্রভৃতি হইতে প্রমাণ করা যায়। (পৃ. ১১) তাঁর এই ধারণা পরবর্তীকালে আরো দৃঢ় হয়েছে এবং তিনি এক পর্যায়ে বলেছেন যে বাংলা মাগধী প্রাকৃত থেকে মাগধী অপভ্রংশ হয়ে গৌড়ী প্রাকৃত ও গৌড়ী অপভ্রংশ হয়ে বাংলাভাষায় রূপায়িত হয়েছে। এ বির্তকের এখনও শেষ হয় নি।
২.৫.শহীদুল্লাহর প্রাচীন বাংলা গবেষণা
শহীদুল্লাহ তাঁর প্রাচীন বাংলার গবেষণার দ্বারা তৎকালীন বাঙলা সাহিত্য-গবেষণার দ্বিমাত্রিকতাকে ত্রিমাত্রিকতা দান করেন। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যানুসন্ধানে হিন্দু ও মুসলমান ব্যতীত বৌদ্ধদেরও যে একটি অবদান ছিল, বিশেষ করে ভাষা ও সাহিত্যের সূচনায় এই দিকটা শহীদুল্লাহর গবেষণায় বিশেষভাবে প্রতিপন্ন হয়। এটি তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে, তাঁর অগ্রজ গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বৌদ্ধ বাতিক বলে নিন্দিত কৌতূহল থেকেই লাভ করেছিলেন- বললে অত্যুক্তি করা হয় না। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ খাঁটি মুসলমান ছিলেন একথা যেমন সত্য, তিনি বিশুদ্ধ বৌদ্ধ গবেষকও ছিলেন তাও সত্য। তিনি নিরঞ্জন আর আল্লাকে চিনতে ভুল করেন নি। বাংলায় যে অল্লোপনিষেদ লেখা হয়েছিল তার মাজেজা তিনি জানতেন। তবে চর্যা নিয়ে, চর্যাপদ নিয়ে গবেষণায় পদ্ধতিগত কিছু ভ্রান্তি তাঁর ছিল- এমন কথা বলেছেন তাঁর পরবর্তী গবেষক তারাপদ মুখোপাধ্যায়।
২.৬.চর্যার পাঠোদ্ধারের সমস্যা
চর্যাপদের পাঠোদ্ধারের ক্ষেত্রে যাঁদের অবদান অবিস্মরণীয় তাঁদের মধ্যে সর্ব প্রধান মহামহোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি ৯ বছর এ নিয়ে গবেষণা করেছেন কিন্তু অর্থতাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি ষোলআনা সাফল্য অর্জন করেন নি। তাঁর পাঠের উন্নয়নে শহীদুল্লাহ ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর বিশেষ অবদান আছে। দু জনেই বহুভাষিক হওয়ার ফলে তিব্বতী অনুবাদ পাঠ করে অর্থ নির্ধারণে তাঁদের সাফল্য স্মরণযোগ্য। পাঠ-উদ্ধারের ক্ষেত্রে তিব্বতী অনুবাদ একটি সহায়ক উপকরণ, একান্তভাবে নির্ভরযোগ্য উপকরণ নয়। কারণ বঙ্গীয় ভাষায় লিখিত কঠিন ভাববস্তুকে তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে অনেক সময় অনুবাদক আক্ষরিক অনুবাদের আশ্রয় নিয়েছেন বলে অনুমান করেছেন পরবর্তী গবেষকগণ, বিশেষ করে তারাপদ মুখোপাধ্যায়।
২.৭.অসামান্য গবেষকের সবকিছু মান্য নয়
চর্যাপদ নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন, তাঁদেরই অনেকেই ছিলেন অসামান্য গবেষক। অসামান্য গবেষক হলেও তাঁদের প্রত্যেকেই সামান্য সামান্য ভুল করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী করেছেন, শহীদুল্লাহ করেছেন, প্রবোধচন্দ্র বাগচী করেছেন। এসব ভুল নির্দেশ করেছেন তারাপদ মুখোপাধ্যায়। তিনিও সামান্য ভুল করেছেন। গবেষণার ক্ষেত্রে এরকম ভুল করা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
২.৮.ভ্রান্তি-বিশ্লেষণ
গবেষণায় বিশেষ করে ভাষা ও লিপি বিষয়ক গবেষণায় যখন ভুল হয়, সে ভুলগুলো নানাবিধ ভাষা সংশ্লিষ্ট সমস্যার খবরাখবর দেয়। সে কারণে ভ্রান্তি-বিশ্লেষণ বা Error Analysis বলে একটি শৃঙ্খলা গড়ে উঠেছে। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ভ্রান্তি-বিশ্লেষণ করলে ভ্রান্তি পরিচিহ্নিত করে তা নির্ধারণ করা সম্ভবপর হয়। চর্যাপদের ভ্রান্তি-বিশ্লেষণ নিয়ে গবেষণা হতে পারে। কারণ মান্য সব অসামান্য গবেষকের ভাষিক প্রবণতাগুলো সমকালীন উৎকণ্ঠার পরিচয় দেয়। পাঠ-গবেষণা অর্থাৎ Textual Research এর আধুনিক ছকটি বেশ পাকাপোক্ত হয়েছে। এই ছকে যে কোনো উক্তি বা পাঠকে বিশ্লেষণ করার জন্য Text , তার Context এবং রচককে জানতে হয়। আর জানতে হয় তার অভীপ্সাকে। অভীপ্সা অনেকেই না বুঝতে পারেন, তবে ইংরেজীতে Intention বললে বোঝা যায়। চর্যার ক্ষেত্রে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী জ্ঞাতসারে হোক, অজ্ঞাতসারে হোক মোটামুটি একটি ছক অনুসরণ করেছেন। তারপরও তাঁর ভুল হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রবোধচন্দ্র বাগচীর এ ধরনের ভুলগুলো তুলে ধরেছেন তারাপদ মুখোপাধ্যায় তাঁর চর্যাগীতি শীর্ষক ১০০ পৃষ্ঠার চটি বইটিতে। এই বইটি লিখেছেন তিনি তাঁর Old Bengali Language and Text – সম্পাদনার পরে, ১৯৬৫ সালে।
২.৯.চর্যাগীতির উপহার
চর্যাগীতি এই চটি বইটি আমাকে উপহার দেন সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী মুহম্মদ জাহাঙ্গীর, ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে। তখন বইটি আমার পড়া হয় নি। হয় নি, দুটো কারণে ১৯৭৫ সালে আগষ্টে বাঙলাদেশের ইতিহাসে যে মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে তাতে এক ধরনের চিত্ত-বৈকল্য ঘটেছিল। দ্বিতীয়ত: তখন তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার একটি একাডেমিক বিতণ্ডা চলছিল। সেই বিতণ্ডার জন্মের পেছনে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশী তিনি হচ্ছেন ভূঁইয়া ইকবাল। তাও একটি বই উপহারকে কেন্দ্র করে। ইকবাল কলকাতা গিয়ে প্রথম বাংলা ব্যাকরণ বলে একটি বই আমার জন্য কিনে এনে উপহার দেন। আমি দেখি বইটির শিরোনাম ও লেখক পরিচিতিতে গণ্ডগোল আছে। তারাপদ মুখোপাধ্যায় মনে করেছিলেন, প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেছেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। এদিকে ঢাকায় অধ্যাপক আহমদ শরীফ ভাষাকথাক্রম শীর্ষক যে ব্যাকরণটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকায় প্রকাশ করেন, তাতে লেখা আছে লেখক ইউলিয়ম কেরী। আমি ভাষা-কথাক্রম নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখে তারাপদ মুখোপাধ্যায়কে বিপর্যন্ত করার চেষ্টা করি। ফলে ১৯৭৬ সালে যখন তাঁর সঙ্গে আমার SOAS গ্রন্থাগারে দেখা হয়, তিনি হয়তো বা মনের দুঃখে কিংবা অন্যমনস্ক থাকার কারণে আমার সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করেন নি। ফলে তাঁর চর্যাগীতি পড়া মুলতবী থাকে আমার।
৩.১.চর্যাগীতি ও উইপোকার কাহিনি
এদিকে তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের অন্য একটি বই আমার হাতে আসে, সেটি হচ্ছে ইতিহাসে উপেক্ষিত। বইটি পড়ে আমি মুগ্ধ হই, এই অসাধারণ গবেষকের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সত্য-উদঘাটনে শ্রম-নিয়োগের পরিমাণ দেখে। এবার চর্যাগীতি পাঠ করার জন্য উদ্ধুব্ধ হই। ততদিনে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গবেষণা বিধ্বংসী উইপোকা চর্যাগীতিতে প্রবেশ করে। সম্পূর্ণ নিঃশেষ করতে পারে নি, তার আগেই আমি চর্যাগীতি পাঠ করি এবং এই অসামান্য গবেষকের কৃতি দেখে মুগ্ধ হই।
৩.২. তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের চর্যাগীতি
তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের চর্যাগীতি গ্রন্থে কোনো সূচীপত্রও নেই, নির্ঘণ্টও নেই। ফলে বইটি পুরো না পড়লে বোঝা যায় না, এর ১৭টি পর্যায়ে তিনি অসাধারণ কাজ করেছেন। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বই বিশ্বভারতী এত উদাসীনভাবে প্রকাশ করেছেন, ভাবতেই অবাক লাগে। বইটি (৯৫+৪) মোট ৯৯ পৃষ্ঠার। শেষ চার পৃষ্ঠায় আছে চর্যাচর্য বিনিশ্চয় এক পৃষ্ঠার পুথিচিত্র, পঞ্চাকার (১১৯৯ খ্রী) পুথির আর একটি পুথিচিত্র, কালচক্রতন্ত্রের (১৪৪৬ খ্রীষ্টাব্দ) ধর্মরত্ন (১৪৮৯ খ্রীষ্টাব্দ) ও মিতাক্ষরা (১৫০৬ খ্রীষ্টাব্দ) পুথির নমুনা, আর সর্বশেষ পৃষ্ঠায় আছে শিশুপালবধ(১৫১১ খ্রীষ্টাব্দ) শুদ্র পদ্ধতি(১৫১৪) শকুন্তলা (১৫৭১ খ্রীষ্টাব্দ) পুথিচিত্র।
৩.৩. ইতিহাস বিতর্ক ও অনুধ্যান
তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের চটি বইটিতে চর্যাগীতি তথা বৌদ্ধ সভ্যতা অনুসন্ধানী বিদেশী পণ্ডিত বিশেষ করে Brian Hodgson, Daniel Wright, Cecil Bendall, Wassiliew Louis de la, A. Esomade koros প্রভৃতি অনুসন্ধানের কালানুক্রমিক বিবরণী দিয়েছেন। তারাপদ মুখোপাধ্যায় তাঁর গবেষণায় তাঁর পূর্ববর্তী গবেষক বিশেষ করে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রবোধচন্দ্র বাগচীর গবেষণায় অনেক গোলমাল আবিষ্কার করে পরবর্তী গবেষকদের যাত্রাপথকে কিছুটা সুগম করে তুলেছেন।
৩.৩.১ পর্যায়
তারাপদ মুখোপাধ্যায় চর্যা-গবেষণার বিভিন্ন পর্যায়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রবোধচন্দ্র বাগচীর অবদান স্বীকার করে নিয়ে তাঁদের গবেষণা কর্মের সিংহাবলোকন করতে গিয়ে অনেক খুঁটিনাটি অথচ গভীর তাৎপর্যবহ নির্দেশনা ও প্রস্তাবনা উপস্থিত করেছেন। চর্যাগবেষণাকে তিনি অনুমানের ভিত্তি থেকে তথ্য-উপাত্ত ও নবতর যুক্তির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেছেন।
৩.৩.২ চর্যার ভাষা-বৈশিষ্ট্য
চর্যার ভাষা সম্বন্ধে তিনি যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে আমরা জানতে পারি চর্যা শব্দটিই একটি অনেকার্থক শব্দ, দ্ব্যর্থক তো বটেই। তার সাধারণ অর্থ আছে, বাচ্যার্থ আছে, আছে ব্যঙ্গার্থ। তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তিনি চর্যা শব্দটির অর্থ নির্ধারণ করেছেন। তাতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আলো আঁধারি তত্ত্বটি বিশেষভাবে পরিশীলিত হয়ে সন্ধ্যা অর্থাৎ অভিসন্ধির ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। এটি একটি অগ্রগতি, বিশেষ করে চর্যার গবেষণার ক্ষেত্রে।
৩.৩.৩ তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের টীকার পাঠান্তর ও গানের পাঠ
তারাপদ মুখোপাধ্যায় টীকার পাঠান্তর ও গানের পাঠ নিয়ে দীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করেছেন। সেই তালিকা চর্যার ভাষাংশ অর্থাৎ কিনা চর্যা সংক্রান্ত ভাষিক অবয়ব যাকে Corpus linguistics বলে তাতে খুব কাজ দেবে।
৩.৩.৪.চর্যার রচনার কাল
চর্যা রচনার কাল নিয়েও তিনি নানাবিধ ভাষিক নমুনা উপস্থাপন করে, মূল চর্যার মৌখিক রীতি, লিপিধৃত করার সংকট, সংকটের নিরসনে টীকা-ভাষ্যের ভূমিকা, টীকার পাঠ ও মূলপাঠের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য, তার সম্ভাব্য লিপিতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ সম্বন্ধে অনুমান করেছেন।
৩.৩.৫.চর্যার ব্যবহৃত বর্ণমালা
চর্যায় ব্যবহৃত বর্ণমালার অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করে বাংলা বর্ণমালার গঠন ও নাগরী, নেওয়ারী ও বাংলা বর্ণমালার বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে তিনি সুচিন্তিত বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তাঁর (১৫) সংখ্যক অধ্যায়টি বাংলা অক্ষর তথা বাংলা বর্ণমালার বাংলা বর্ণমালা হওয়ার ইঙ্গিত দিযে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে বাঙলা বর্ণ বাঙলা হওয়ার আবিষ্কারটি তাঁর নয়, এটি A. C Burnell, তাঁর Elements of South Indian Paleography (1878) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাঁর সহজ কথাটি হচ্ছে বাঙলা ব্যঞ্জনে এ-কার আর ও-কার ( ে, ো ) এলো যখন, তখনই নাগরী থেকে বাঙলা অক্ষর আলাদা বৈশিষ্ট্য অর্জন করলো। কে এই কাজটি করেছিল তা কিন্তু এখনও অনুদঘাটিত আছে।
৩.৩.৬. উপসংহার
তারাপদ মুখোপাধ্যায় গ্রন্থ-শেষে যে কথা বলেছেন তা উদ্ধৃতি করে তাঁর চর্যাগীতির আলোচনা শেষ করা যায়। পঞ্চাকার পুথির লিপিকাল যদি যথার্থই ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে হয়, তা হলে আমার অনুমান চর্যার পুথির লিপিকাল দ্বাদশ শতকের শেষার্ধ। মনে রাখতে বলি, এ অনুমান এক জোড়া চোখের সাক্ষ্যে এবং স্বল্পসংখ্যক পুথির ভিত্তিতে।( পৃ. ৯৬)
৩.৩.৭. সংযোজন
তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের এই অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষুদ্র বইটির দুটো ক্ষুদ্র ত্রুটি তাঁর চোখে পড়ে নি, একটি হচ্ছে এতে কোন সূচীপত্র নেই, অর্থাৎ কিনা সূচনায় গোলমাল, আর সমাপ্তিতেও গোলমাল। কিন্তু মাঝখানে যা আছে তা দীর্ঘদিন চর্যা-গবেষকের চিন্তার উদ্রেক করবে। চর্যাগীতি চর্যা গবেষণার একটি মাইলফলক।
৪.০.চর্যার ভাষায় অভিসন্ধিতা
চর্যার ভাষায় যে অভিসন্ধিতা আছে তা আমরা জেনেছি। চর্যাকারদের কেউ কেউ শিষ্যদের এক কথা বলেছেন, অন্যদের অন্য কথা বলেছেন। আধুনিককালের পরিভাষায়, যাঁরা Truth Conditional Semantics বা সত্য-শর্তায়িত অর্থতত্ত্ব নিয়ে ভাবেন, তাঁদের কথায় সহজ ভাষ্য হবে- “ইহা এক ধরনের ভাষিক দুর্নীতি।প্রশ্ন হচ্ছে এ রকম ভাষিক দুর্নীতি বা অভিসন্ধির ভাষা মানুষ কখন, কেন, কি ফললাভের জন্য ব্যবহার করেন। দু একটি কথা ব্যাখ্যা করা যাক;
যো সো বুধী, সো নিবুধী
যো সো চোর সোহী সাধী কথাটার মানে কি?
যে বুদ্ধিমান সেই নির্বোধ, যে চোর সেই সাধু- এই উক্তিতে রচকের অভিসন্ধি কি গোপন থাকে?
কিংবা ধরুন- বলদ বিয়াএল গবীআ বাঁঝে
কথাটার আপাত অর্থভেদ করে আসল অর্থ কি বেরিয়ে যায় না? কিংবা ধরুন
আপনা মাসেঁ হরিণা বৈরী
আপনার মাংসে হরিণ নিজের শত্রু,
এ কথার গূঢ়ার্থ কি অভিসন্ধিকে ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়ে না? চর্যার অর্থতত্ত্ব সন্ধান করার জন্য ভিটগেনস্টাইনের এমবিহগুইটি বা দ্ব্যর্থকতার তত্ত্ব প্রয়োগ করা যায়, করা যায় জন সার্লির ÔIntentionality’ সম্পর্কিত অর্থতত্ত্বের অন্তর্দৃষ্টি।
রবীন্দ্রনাথের হিং টিং ছট কবিতায় উপস্থাপিত উক্তি বা বচন, তার আপাত-অর্থ ও গূঢ়ার্থ তাঁর কবিতার অভিসন্ধি, যাকে সাদামাটা ভাষায় অভীপ্সা বলা যায় তা কি আমাদের কাছে অস্পষ্ট থাকে? চর্যার ভাববস্তুতে প্রাচীন বাংলার মননের, স্বননের ও সমাজমনস্তত্ত্বের অনেক সংবাদ একই পাত্রে পরিবেশিত হয়েছে Ñ একথা আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন।
৪.১. নামায়ন বৈচিত্র্য
চর্যাপদ একটি ব্যবহার-উপযোগী নাম, যিনি চর্যাপদ আবিষ্কার করেছেন তাঁর দেওয়া নাম নয়। তাঁর দেওয়া নামটি ছিল হাজার বছরের পুরনো বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ-গান ও দোহা। পরবর্তী গবেষকরা এই নামের যাথার্থ্য নিয়ে অনেক মতামত প্রকাশ করেছেন; এবং তাঁদের দেওয়া নামকরণের পক্ষে নানা যুক্তি, তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। কেউ এটাকে আশ্চর্য চর্যাচয় বলেছেন, কেউ বলেছেন চর্যাচর্য বিনিশ্চয়, কেউ বলেছেন চর্যাগীতি-কোষ। গবেষকদের দেওয়া নাম যাই হোক না কেন চর্যাপদ নামেই এই পাঠ-উপকরণগুলো পণ্ডিতমহলে পরিচিতি লাভ করেছে। চর্যাপদ হাজারো বছরের পুরনো বাংলাভাষার পুরো অংশ নয়, খণ্ডিত অংশ। পুরো সংকলনে কি কি আছে তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভূমিকায় বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করেছেন। সাধারণত চর্যাপদ বলতে আমরা ২৩ জন কবির রচিত সাড়ে ছেচল্লিশটি পদকে বুঝে থাকি।
৪.২. ভাষিক বিতর্ক : পাঠ-উপকরণ নাকি গীত-উপকরণ
এ পদগুলোর ভাষা নিয়ে বহুবিধ ভাষিক বিতর্ক আছে। বিতর্ক যাই থাক এই পদগুলো যে পাঠ-উপকরণ তাতে কোন সন্দেহ নেই। পাঠ-উপকরণে যে বিষয়বস্তু আছে তার অর্থোদ্ধার প্রায় কারও পক্ষেই সম্ভব হয় নি বলে গবেষকেরা উল্লেখ করেছেন, এবং চর্যার ভাষাকে সন্ধার ভাষা নামে অভিহিত করা হয়েছে, এবং এ সন্ধা ভাষার কিছু সহজবোধ্য ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। এ সহজবোধ্য ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কেউ তিব্বতী অনুবাদের আশ্রয় নিয়েছেন, কেউ বা তার বাহ্যিক অর্থ (Surface meaning) বিশ্লেষণ করে তৎকালীন জীবনের নানা উৎকণ্ঠা, নানা চিন্তা, নানা বর্গ এবং নানা খতিয়ান দিয়েছেন।
৪.৩. গুরুমুখিতার প্রশ্ন
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন চর্যার ভাববস্তু হচ্ছে গুরুমুখী জ্ঞান-বিস্তারের একটি প্রচলিত পদ্ধতি। এবং সেখানে নিহিতার্থ জানা থাকে গুরুর কাছে। তিনি সে নিহিতার্থটি সংজ্ঞাপন করেন শিষ্যের কাছে। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় এ নিহিতার্থের যে পরিসীমা তার বাইরে এর অর্থ প্রবাহিত হতে পারে নি। সেজন্য চর্যায় দ্ব্যর্থকতার একমাত্রা কিঞ্চিৎ উদঘাটিত হয়েছে, কিন্তু অপর মাত্রা একেবারেই উদঘাটিত হয়নি; কিংবা অর্থতাত্ত্বিক কৃৎকৌশল প্রয়োগ করে গুরু-শিষ্যের সংজ্ঞাপনের মধ্যে প্রবাহিত যে অর্থ তার গূঢ় অভীপ্সা অনুসন্ধানের কোন চেষ্টা হয় নি। সুতরাং বলা চলে, চর্যা আবিষ্কার একশ বছর পূর্ণ হলেও তার দ্ব্যর্থকতার তাৎপর্য অনুধাবনের কোন চেষ্টা কিংবা অনুধাবনের কোন কৃৎকৌশল উদ্ভাবন করা যায় নি।
আমরা অনুমান করতে পারি : উদ্ভাবন করা যায় নি, তার কারণ ভিটগেনস্টাইন প্রমুখ দার্শনিকেরা দ্ব্যর্থকতা নিয়ে যে গভীরতর অনুসন্ধানের পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, সে রকম কোন প্রচেষ্টা চর্যা গবেষকদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় নি। এমনকি দ্ব্যর্থকতার উদ্ভব সংক্রান্ত প্রাথমিক প্রশ্নগুলোরও অনুপস্থিত রয়েছে।
৪.৪. দ্ব্যর্থকতা : পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট নির্ভর
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দ্ব্যর্থকতা ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে যখন আমরা ভাষা-প্রবাহে লক্ষ্য করি, তখন দেখা যায় ব্যক্তি-জীবনে কিংবা সমাজ-জীবনে নানা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। যখন মানুষ দ্ব্যর্থকতাকে কৌশল হিসেবে গ্রহণ করে। দ্ব্যর্থকতার অভীপ্সা অভিব্যক্তির প্রতিবন্ধকতা উত্তরণের চেষ্টা এ কথা বলতে আপত্তি নেই। গুরু-শিষ্য পরম্পরা কিংবা মন্ত্রগুপ্তি কিংবা অপরাধজগতের ভাষা কিংবা ইঙ্গিতের ভাষা এক ধরনের দ্ব্যর্থকতার প্রতিচ্ছবি। প্রশ্ন হচ্ছে কি কি কারণে মানুষ দ্ব্যর্থকতার আশ্রয় গ্রহণ করে, যেখানে ভাষার প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে অভীপ্সার অভিব্যক্তি। প্রশ্নটিকে সহজ করা যাক। আমাদের পরিচিত সাহিত্যের নানা নমুনায় সচেতন দ্ব্যর্থকতার কৌশল অবলম্বন আমরা লক্ষ্য করি। এ ক্ষেত্রে প্রাচীনকালের রামচরিতের কথা উল্লেখ করা যায়, ইউসুফ জোলেখার কথা উল্লেখ করা যায়, পদ্মাবতীর কথাও বলা যায়। ভারতচন্দ্র যেসব দ্ব্যর্থকতার আশ্রয় নিয়েছেন সেগুলো এখন বহু কথিত উক্তি। যেহেতু তিনি এমন একটি ঐতিহাসিক কালে এই সব দ্ব্যর্থকতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, তার প্রেক্ষাপট আমরা জানি বলে তার দ্ব্যর্থকতার দুটি অর্থ আমরা অনুধাবন করতে পারি। তিনি বলেছেন Ñ
অতি বড় বৃদ্ধপতি সিদ্ধিতে নিপুণ
কোন গুণ নাই তার কপালে আগুন।
এই দ্ব্যর্থকতার অভীপ্সা ও প্রেক্ষাপট আমরা জানি, আমরা নজরুল ইসলামের প্রলয়োল্লাসের কিংবা আগমনী কবিতার দ্ব্যর্থকতার অভীপ্সা ও প্রেক্ষাপট জানি। অভীপ্সা ও প্রেক্ষাপটের এই ফর্মূলা চর্যাপদের অর্থ-উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে কি? যদি না হয়ে থাকে তাহলে তার সন্ধা-ভাষার নিহিতার্থ অনুধাবনও অধরা রয়ে গেছে। অথচ এখন চর্যাগীতি আবিষ্কারের একশ বছর পূর্ণ হয়েছে, আমরা এখনো ২৩ জন পদকর্তার সাড়ে ছেচল্লিশটি পদের একটিরও অর্থ পরিপূর্ণ ও সন্তোষজনকভাবে অনুধাবনের চেষ্টাা করি নি। এ কথা অবশ্য ঠিক, চর্যার সব পদ কি দ্ব্যর্থক? অথবা পদগুলোতে দ্ব্যর্থকতার গুণগত ও পরিমাণগত ভিন্নতা আছে কি ?
৪.৫.চর্যার অর্থতত্ত্ব
চর্যার অর্থতত্ত্ব নির্ধারণ করা অর্থাৎ তার বাহ্যিক অর্থের সঙ্গে তার নিহিত অর্থের সম্পর্ক নির্ধারণ একটি জরুরি কর্ম। চর্যার কোনো কোনো পদে দ্ব্যর্থকতার পরিমাণ অতি সামান্য কিংবা দ্ব্যর্থকতার মাত্রা এতোটা স্বচ্ছ যে তার নিহিতার্থের চেয়ে বাহ্যিক অর্থটাই প্রাথমিক অর্থ বলে বিবেচিত হয়। যেমন, যো সো বুধী সো নিবুধি যো সো চোর, সো হি সাধী অর্থাৎ যে বুদ্ধিমান সে হচ্ছে নির্বোধ আর যে চোর সেই হচ্ছে সাধু। এই উক্তির মধ্যে দ্ব্যর্থকতা দ্বিমাত্রিকতার প্রায় অনুপস্থিত বলা চলে। এর পরেও আমরা অনুধাবন করি কবির অভীপ্সা কি ছিল।
ইংরেজি : প্রসঙ্গসূত্র
Chatterjee, Suniti Kumar ( 1926 ) Origin and Development of the Bengali Language, Calcutta : University of Calcutta, 2nd Edition
Bagchi, Probodh, Dohakosa Part 1 Calculla Sanskrit Series No 25G, Calcutta
Bagchi, Probodh (1938) Materials for a Critical Edition of the Old Bengali
Caryapadas (A comparative study of the text and the Tibetan translation) Part 1, Journal of the Department of Letter, Vol xxx, Calcutta : University of Calcutta.
Shahidullah, Muhammad, Buddhist Mystic Songs, Dacca University Studies, Dacca.
Sen, Subhadra Kumar (1973) Proto-New Indo-Aryan, Calcutta : Estern Publishers
Sen, Sukumar (1947) Index Verborum of the Old Bengali Carya Songs and Fragments, Indian Linguistics Vol IX, Calcutta
Sen, Sukumar (1948) Old Bengali Texts of Caryagitikosa, Indian Linguistics, Vol. x, Calcutta :
Sen, Sukumar (1971) An Etymological Dictionary of Bengali : G. 1000-1800 A.D., Calcutta : Estern Publishers
Mukhapadyaya, Tarapada (1063) The Old Bengali Language and Text, Calcutta : University of Calcutta,
Majumdar, Bijay Chandra (1920) The History of the Bengali Language Calcutta :
Bhattacharja, Vidhusekhara (1975) “Sandha bhahsa and Sandhauacana” Studies in Tantras, Part 1, Calcutta : 1975, p. 27
Bhattacharja, Vidhusekhara Is it Carya Carya viniseaya or Ascaryacaryacaya. Indian Historical Quarterly, vol-vi, p. 170 Vol. xxx, Calcutta : University of Calcutta.
বাংলা প্রসঙ্গসূত্র
শাস্ত্রী, হরপ্রসাদ (১৩২৩) হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা, কলিকাতা : বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষৎ
সেন, সুকুমার (১৯৭৩ বর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ) চর্যাগীতি-পদাবলী : কলিকাতা : ইস্টার্ন পাবলিশার্স
মুখোপাধ্যায়, ব্রতীন্দ্রনাথ (১৪০৭) প্রথম যুগের চর্যাগীতি-পদাবলী ও প্রাচীন বাঙ্গালা লেখমালা” হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা, কলিকাতা : মহাবোধি বুক এজেন্সী
সাংস্কৃত্যায়ন, রাহুল (১৯৫৭) দোহাকোশ, পাটনা : বিহার রাষ্ট্রভাষা পরিষদ
দাশগুপ্ত, শশিভূষণ (১৩৯০) চর্যাপদের সন্ধ্যা বা সন্ধাভাষা, বৌদ্ধধর্ম ও চর্যাগীতি। কলিকাতা :
সেন, নীলরতন (২০০১) চর্যাগীতিকোষ, কলিকাতা :
আলী, সৈয়দ মুর্তাজা (১৩৭০) চর্যাপদের ভাষা, সাহিত্য পত্রিকা ৭ম বর্ষ : ২য় সংখ্যা (শীত সংখ্যা) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : বাংলা বিভাগ।