২০শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার, দুপুর ১২:৩২
নেমেসিস
রবিবার, ৯ আগস্ট, ২০২০

শারমিন মুস্তারী।। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আধুনিক বাংলা নাটকের ইতিহাসে নুরুল মোমেন ( ১৯০৮ – ১৯৮৯ ) ব্যতিক্রমধর্মী একজন। নাটকের প্রথাগত রীতিনীতি এড়িয়ে গিয়ে বিষয় ও আঙ্গিকগত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে বাংলা নাটকে তিনি একটি  স্বতন্ত্র স্থানের অধিকারী। তিনি বাংলা নাটকের গতানুগতিক পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক পটভূমির পরিবর্তে  সমকালীন যুগযন্ত্রণা, দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানব জীবন, বস্তুবাদী সমাজের নানা অবক্ষয় প্রভৃতি বিষয়কে নাটকের পটভূমিতে জায়গা করে দিয়েছেন।

১৯৪৪ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত রূপান্তর নাটকের মাধ্যমে নাট্যকার হিসেবে নুরুল মোমেন আত্মপ্রকাশ করেন।  নেমেসিস (১৯৪৮) তাঁর দ্বিতীয় নাটক।  নাটকটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে ‘শনিবারের চিঠি’তে। তার অন্যান্য নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘যদি এমন হোত’ (১৯৬০), ‘নয়া খান্দান’ ( ১৯৬১ )  ‘আলোছায়া’ (১৯৬২), ‘আইনের অন্তরালে’ (১৯৬৭)।  তাঁর প্রকাশিত নাটক মোট বারটি। বাকি নাটক অপ্রকাশিত।(১) নুরুল মোমেনের নাট্যরচনার সময়কাল মোটামুটিভাবে ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।(২)

২.

নাটক সমাজ ও জীবনঘনিষ্ঠ এক যৌথ শিল্পকর্ম।  তাই আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রভাব নাট্যসাহিত্যে পড়া অসঙ্গত নয়। (৩) সাম্য মৈত্রী ও স্বাধীনতার চেতনায় ফরাসি বিপ্লব, ইউরোপের শিল্প বিপ্লব ও ইউরোপীয় রেনেসাঁস উনিশ শতকের বাঙালি চিন্তা-নায়কদের অন্তর চৈতন্যকে মথিত করেছিল। যা মধ্যযুগীয় মানসিকতা পরিহার করে বাঙালি জীবনের সব রকমের কুসংস্কার ও অন্ধকারময়তা থেকে ব্যক্তিসত্তাকে মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল। মানুষের মধ্যে উন্মেষ ঘটল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের।  মানুষ তুচ্ছ, ক্ষুদ্র কিংবা দেবতার হাতের নিছক ক্রীড়নক নয়, এই বোধ শিক্ষিত সচেতন মানুষের মনে দৃঢ় হলো।(৪)  শিল্পের অন্যান্য শাখার মতো নাটকেও দেখা গেল এর প্রভাব।  অভিজাত শ্রেণির চরিত্র কিংবা দেব-দেবীর পরিবর্তে নাটকে চলে এল সাধারণ মানুষ। তাদের সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যবোধের বিষয়টি সঙ্গতকারণে গুরুত্ব পেল নাটকে । এরই সূত্রে রাজনৈতিক বিশ্বাস ও তার রূপায়ণের ঘাত-প্রতিঘাত জায়গা করে নিল নাটকে।(৫)  

এরই প্রেক্ষাপটে চল্লিশের দশকে বাংলা নাটকে একটা পালাবদল লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বিক্ষুব্ধ সামাজিক পরিবেশ, দুঃখ-যন্ত্রণা এই পালাবদলকে ত্বরান্বিত করেছিল। বিশ্বযুদ্ধকালীন ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়’আন্দোলনের বর্বরতম অত্যাচার, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও নিপীড়নের বীভৎসতা, শাসকগোষ্ঠীর খাদ্য সংগ্রহের নীতি, মজুতদার ও কালোবাজারিদের সীমাহীন অর্থতৃষ্ণা, মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদির প্রত্যক্ষ ফল স্বরূপ ১৯৪৩ সালের দেশব্যাপী  মন্বন্তর ও লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ইত্যাদি এমন এক  পরিস্থিতি সৃষ্টি করল যার বাস্তব ধাক্কা লেগে পুরাতন নাট্যচর্চার আদর্শ ভেঙ্গে চুরমার হলো। বাস্তবের তাড়নায় বাংলা নাটকে এল নতুন যুগ, নতুন মানুষ।(৬) মূলত ভারতীয় গণনাট্য সংঘের নাট্য আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা নাটকের এ নতুন ধারাটির সূত্রপাত।  বাংলাদেশে নতুন এ নাট্যধারাটি গড়ে ওঠে নুরুল মোমেন, শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরী, আসকার ইবনে শাইখ প্রমুখ পাশ্চাত্য ভাবধারাপুষ্ট নাট্যজনদের হাতে। তবে নতুন এ নাট্যধারার সূত্রপাত মূলত নুরুল মোমেনের ‘নেমেসিস একাঙ্কিকা নাট্য দিয়ে।

৩.

‘নেমেসিস’ নুরুল মোমেন তথা আধুনিক বাংলা নাটকের ইতিহাসে একটি বিশেষ নাটক। এর নাটকীয় ঘটনার সময়কাল ১৯৪৩ সাল, পটভূমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট সামাজিক অবক্ষয়কে অবলম্বন করে নাটকটি রচিত। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়।  ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চরমে পৌঁছায়।  এ সময় সরকার যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য সাধারণ মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে খাদ্যের মজুদ গড়ে তোলে।  এ ঘটনার সুযোগ নিয়ে কালোবাজারি, মুনাফাখোর মজুতদারেরা দেশের চরম সংকটের দিনে  নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য খাদ্যপণ্য মজুদ করে কৃত্রিম খাদ্যসংকট সৃষ্টি করে। “বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ও অমানবিকতা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় মানুষের অসহায়তা ও চরম দুর্গতির সুযোগ নিয়ে মানবতাবিরোধী শোষক, কালোবাজারি, মুনাফাখোর ও মজুতদাররা নিজেদের হীন স্বার্থ সিদ্ধ করার ফলে ১৯৪৩ সালে সারা বাংলার বুকে নেমে এল দুর্ভিক্ষ ও মহামারী।  এরই প্রেক্ষাপটে  রচিত হলো নেমেসিস।’’(৭)

নাটকটির  প্রধান চরিত্র সুরজিত নন্দী।  দরিদ্র ও আদর্শ স্কুল শিক্ষক।  স্যোসালিস্ট। সে ভালোবাসে বুর্জোয়া সমাজের নৃপেন বোসের কন্যা সুলতাকে। প্রিয়তমাকে পাবার জন্য সে শ্বশুর নৃপেন বোসের নির্দেশে অসীম ও মনুরমলের সহায়তায় যুদ্ধকালীন দুর্ভিক্ষের বাজারে কালোবাজারি মজুতদারি ব্যবসা শুরু করে। ভালোবাসার জন্য বিবেক বিসর্জন দিয়ে শ্বশুরের নির্দেশ মত অবৈধ উপায়ে কালোটাকা উপার্জন করলেও বাংলার দুর্ভিক্ষ পীড়িত ক্ষুধার্ত অসহায় মানুষের হাহাকার ও মানবতার চরম বিপর্যয়ে শিক্ষক সুরজিতের মধ্যে শুভবোধ জেগে উঠে। স্যোসালিজমের মুখোশ পরে কালোবাজারি করতে করতে তার মনে একসময় ঘৃণা জন্মে। বিবেকের দংশন তাকে পর্যুদস্ত করে। শুরু হয় তার অন্তর্দহন। ক্ষত-বিক্ষত ও বিপন্ন হৃদয়ে সে তার কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করে। এই অনুশোচনা থেকে সে তার সকল সম্পত্তি  দরিদ্রের নামে  উইল করে যায়।  এভাবে সুরজিত অভিশাপগ্রস্ত অর্থের  রাহুগ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত করে, মুক্ত করে তার উত্তরসূরিকেও।  ফলে নাটকে সুরজিতের  মৃত্যু ঘটলেও  এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে সত্যের পক্ষে মানবতার জয় ঘোষিত হয়।  গরিবদের  বঞ্চিত করে যে অর্থ সে সঞ্চয় করে, বিবেকের  দংশনে তা দরিদ্রদের কল্যাণের জন্য উইল করে সে পুনর্জন্ম লাভ করে। ফলে নৃপেন বোসের লোকজনের কাছ থেকে মৃত্যুর হুমকি পেয়েও  সে তার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেনি। বরং তাকে যেন সে অনেকটা স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেয়। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার আত্মদহনের সমাপ্তি ঘটে। ফলে নাটক শেষে সুরজিত বলছে, “আমার সঙ্গে সুলতার দেখা হলো না। সে আমার সৌভাগ্য। আমি জীবিত থাকলে সে এসে দেখতো তার সুরজিত মরে গেছে।  আমি মরে যাওয়ায় সুরজিত জীবিতই রইল। সুলতার প্রার্থনা বৃথা যায় নি- আমার হীন অর্থ আমার বংশকে কলংকিত করবেনা ! Paid the Penalty with my life and saved my generation.( ৮)  

৪.

আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যের কারণে নেমেসিস আধুনিক বাংলা নাটকে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। নাটকটির কলাকৌশল অভিনব। এটি একক চরিত্র বিশিষ্ট নাটক। নাটকে কোন অংক বিভাগ বা দৃশ্য সংযোজন নেই। নাটকের অন্যান্য চরিত্রের সঙ্গে কেন্দ্রীয় চরিত্রের কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত নেই। কেবল কেন্দ্রীয় চরিত্র সুরজিতের অন্তর্দ্বন্দ্বের শিল্পভাষ্য নেমেসিস। তবে চরিত্রের এককত্বের কারণে নাটকে একঘেয়েমি তৈরি হয় নি বা কাহিনির অগ্রগতিও ব্যাহত হয় নি, কিংবা সংঘাতহীনতার কারণে নাটকের আখ্যানভাগ দুর্বল হয়ে পড়ে নি।  বরং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কাহিনির গতি বজায় ছিল। যুদ্ধকালীন সমস্যাপীড়িত নায়কের মানস-দ্বন্দ্বে আদি-মধ্য-অন্ত্যযুক্ত আখ্যানটি উত্তাল-চঞ্চল ছিল। ফলে দর্শক বা পাঠক আগা-গোড়াই নাটকীয় সাসপেন্সের মধ্যে ছিল।  নাটকটিতে একটি মাত্র চরিত্র সুরজিতকে দেখা গেলেও টেলিফোনে স্যোসালিস্ট অফিসের অমলবাবু, সহপাঠী অসীম, অজিত, রঞ্জিত, মাস্টার মশাই, অপরিচিতা প্রভৃতি জনের সঙ্গে কথা বলিয়ে স্নেহলতা সবিতা পীসিমা, কল্যাণ, ডাটা রায়ের, সুলতার পত্র পাঠ করিয়ে কিংবা জানালায় দাড়িয়ে এয়াকুবের সঙ্গে কথা বলিয়ে (যদি তা দর্শক শুনতে পায় না) নাট্যকার চরিত্রের অভাবকে পূরণ করেছেন। যেহেতু একটি মাত্র চরিত্র, যাকে সংলাপের মাধ্যমে নাটকের গতি ধরে রেখেছেন নাট্যকার। ফলে নাটকে সুরজিতের দীর্ঘ সংলাপে ক্লান্তি তো আসেইনি বরং তার অন্তঃসংকট নাটকের গতি ত্বরান্বিত করেছে। তার জীবনের পরাজয় নাটকীয় অবয়ব পেয়েছে।  বিবেকবান শিক্ষক সুরজিতের সঙ্গে বিবেক বিসর্জিত কালোবাজারি সুরজিতের অন্তর্দ্বন্দ্বটি নাটকটিকে শেষ পর্যন্ত ট্র্যাজিক পরিণতিতে পৌঁছে দেয়। এই নাটকে সুরজিত নন্দীর মনোজগতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যুদ্ধকালীন সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্রটি ফুটে উঠেছে। অতীত ঘটনার কুশলী উপস্থাপনা প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চেয়ে হৃদয়ের রক্তক্ষরণই এখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে। ধ্রুপদী ট্র্যাজিক নাটকের ত্রিমাত্রিক ঐক্যের সঙ্গে নতুনতর ঐক্য সূত্র সংযোজন, নবশৈলী নির্মাণ এ নাটকে পরীক্ষা প্রবণতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।(৯)  

নেমেসিস এ যুগপৎ গ্রিক ট্র্যাজেডি ও শেক্সপীয়রীয় ট্র্যাজেডির প্রভাব রয়েছে। সফোক্লিসের ইডিপাস নাটকের নায়ক ইডিপাসের যন্ত্রণা ও হাহাকারের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায় সুরজিত নন্দীর অন্তর্দহনের মধ্যে। ‘ইডিপাস’ যেমন এ্যাপোলোর দৈববাণীকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য থিবি নগর থেকে পরিত্যক্ত হয়েও নিয়তির অঙ্গুলি হেলনে আবার থিবিতে এসে উপস্থিত হয়। নিয়তির নির্দেশে ইডিপাস স্ফিংস-এর ধাঁধাঁর উত্তর দিতে সক্ষম হয়। নিয়তির নির্দেশে সে পিতাকে হত্যা করে এবং থিবির রাজা হয়ে মাতার স্বামীতে পরিণত হয়। ‘নেমেসিস’ নাটকেও নৃপেন বোসের অভিসন্ধির ইঙ্গিতবাহী সুলতার চিঠিটি তাই নিয়তির কারণে তিন মাস পরে এসে পৌঁছায় সুরজিতের কাছে।  ঠিক সময়ে পৌঁছালে সুরজিতকে হয়ত নৃপেন বোসের হাতের ক্রীড়নক হতে হতো না। নিয়তির কারণে সুরজিতকে অসীমের হত্যা চেষ্টার খবরটি ঠিক সময়ে সুরজিতের কাছে পৌঁছাতে পারে না। ‘মৃত্যুর হদিস বয়ে আনা কোনটিকে একবার সে সুলতার স্তাবকদের ফোন ভেবে এড়িয়ে যায়। অন্যবার জীবন  সাবধানী বাণীটি সে এড়িয়ে যায় আধুনিকতার হাত থেকে  রক্ষা পেয়ে ভগবানকে প্রণাম করার মধ্য দিয়ে।  ইডিপাসের মতো সুরজিতকে নিয়েও নিয়তি বারবার খেলা করে। সুরজিতের একটি সংলাপে নিয়তির বিধান স্পষ্ট হয়েছে এভাবে- ‘এই তো জীবন ? প্রাক্তন স্কুল মাস্টার, বর্তমান লক্ষপতি, আগত কালের দানবীর।  এর কিছুই সে হতে চায়নি, অথচ ভাগ্যচক্রের বিবর্তন মাঝে অসহায় মানব-সন্তান।(১০) 

নাট্যকার সমকালীন সামাজিক সমস্যার পটভূমিতে এভাবে গ্রিক ট্র্যাজেডিকে অনুকরণ করেছেন। ফলে চোরাকারবার করে রাতারাতি লক্ষপতি হলেও ভাগ্যদেবীর ক্রূর অভিশাপ থেকে সুরজিত মুক্তি পায়নি। গ্রিক ট্র্যাজেডির নিয়তিবাদের পাশাপাশি শেক্সপীয়রীয় ট্র্যাজেডির প্রভাবও রয়েছে ‘নেমেসিস’- এ। শেক্সপীয়রীয় ট্র্যাজেডিতে ঘটনার চেয়ে চরিত্রের প্রাধান্য থাকে বেশি।  এখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রের মহত্বের পাশাপাশি তার ত্রুটি-বিচ্যুতি, অন্তর্দ্বন্দ্ব তুলে ধরে তার পতন দেখানো হয়। ‘নেমেসিস’ নাটকে নায়ক যুদ্ধপীড়িত। তার অন্তর্দহন হৃদয়ের হাহাকার নাটকটির ট্র্যাজিক পরিণতি সূচিত করে। শেক্সপীয়রীয় ট্র্যাজেডিতে মৃত্যু থাকলেও গ্রিক ট্র্যাজেডিতে মৃত্যু অবধারিত নয়। নাটকে সুরজিতের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে নাট্যকার শেক্সপীয়রীয় ট্র্যাজেডিকে অনুমান করেছেন। গ্রিক ট্র্যাজেডিতে কোরাসের প্রয়োগ থাকলেও শেক্সপীয়রীয় ট্র্যাজেডিতে থাকে গান। ‘নেমেসিস’-এ  একটি গান রয়েছে।  কোন কোরাস নেই।  তবে শেক্সপীয়রীয় ট্র্যাজেডির নায়ক শক্তিমান ও প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও সুরজিত নন্দী  দরিদ্র সাধারণ স্কুল শিক্ষক। নায়ক চরিত্র সৃষ্টিতে নুরুল মোমেন গতানুগতিকতার অনুবর্তন না করে এখানে বৈচিত্র্য এনেছেন।  সুরজিত এখানে ক্ষমতাসম্পন্ন, প্রভাবশালী বুর্জোয়া সমাজের একজন নৃপেন বোসের হাতের ক্রীড়নক।

আধুনিক যুগ-পরিবেশের জটিলতায় ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা প্রকাশের বাহন হিসেবে কাব্যনাটকের উদ্ভব। চরিত্রের অন্তর্রহস্য উদ্ঘাটন করাই এ জাতীয় নাটকের লক্ষ্য। বহির্বাস্তবতার চেয়ে অন্তর্বাস্তবতাই এখানে মুখ্য। এসব বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে ‘নেমেসিস’একটি কাব্যনাটক। কেননা এখানে নাট্যকার সুরজিতের অন্তর্রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। সুরজিতের স্বগত সংলাপে তার অন্তর্দহন এবং তা থেকে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা উচ্চারিত হয়েছে তাতে ব্যক্তির অন্তর্গত রহস্য উন্মোচনের দিকটিই প্রতিফলিত।  নাটকের আখ্যানভাগ যুদ্ধকালীন অবক্ষয়কে উপজীব্য করে গড়ে উঠলেও তার অভ্যন্তরে রয়েছে ব্যক্তি মানুষের রহস্য উন্মোচনের প্রয়াস।  যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে চোরাকারবারকে কেন্দ্র করে নাটকটি রচিত হলেও এই বিষয়বস্তুর মধ্যে মানব চরিত্রের কুৎসিত চেহারা, নির্মমতার চিত্র রয়েছে নৃপেন বোসের ষড়যন্ত্র ও অসীমের বিশ্বাসঘাতকতার  মধ্যে।  নাটকটিতে একটি গান ও অনেকগুলো কবিতার ব্যবহার রয়েছে যা তাকে কাব্যময়তা দান করেছে, আবহ সৃষ্টি করেছে কবিতার সুর, ছন্দ ও রূপক চিত্রকল্পের। কাব্যনাটকের বৈশিষ্ট্যই হলো এখানে নাটক ও কবিতা থাকবে।  তবে তা পরস্পর সম্পৃক্তভাবে। নাটকে কাব্যগুণ নাট্যগুণের অনুসারী হবে। ‘নেমেসিস’-এ বৈশিষ্ট্যটি রক্ষিত হয়েছে।  নাটকের সংলাপ প্রায় পদ্যগন্ধী ও অলংকারবহুল। বিশেষত স্নেহলতার সংলাপ এবং অনুতার নিয়ে সুরজিতের জীবনদর্শন কেন্দ্রীয় সংলাপ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।

‘‘আপনার আর দেখা পেলাম না, দেখা হল দুর্ভিক্ষ রাক্ষুসীর সঙ্গে। ইনটেলেক্টের  মুল্য তার কাছে কয়েক টুকরো হাড়ের বেষ্টনীতে ছটাক খানেক … মাত্র। তার নড়বড়ে দাঁতের প্রথম কামড়েই বাবা প্রাণ দিলেন। ফোঁকলার মাঝে পড়ে অর্দ্ধ-চিবানো অবস্থায় মা আর আমি রইলাম বেঁচে। ঘটনার  ঘূর্ণাবর্তে দেখতে না দেখতে অতীত আমাদের তলিয়ে গেল।  মার জীবিকা হয়ে দাঁড়াল দাসীবৃত্তি। আমি হলাম দাসীর মেয়ে।’’(১১)

৫.

দুই বিশ্বযুদ্ধ ও মন্বন্তরের অভিঘাতে বাংলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়।  এসময় শিল্প ও সাহিত্যের প্রকৃতিও পাল্টে যায়।  সাহিত্যের অন্য শাখাগুলির মতো নাটকও এ পরিবর্তনকে স্বীকার করে নেয়। যুদ্ধকালীন যে সর্বনাশ মানব জীবনকে আলোড়িত ও বিধ্বস্ত করেছিল তাকে কেবল চিত্রিত করে নাট্যকারগণ সন্তুষ্ট থাকতে পারেন নি। বরং এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্পদৃষ্টি নিয়ে তারা সে সত্যকে আরো সম্প্রসারিত করে। অতিশোষিত করে দেখালেন।  সমকালীন নানা সমস্যা-সংকট, দুর্নীতি-মিথ্যাচারকে এভাবে নাট্যকারগণ নিজেদের বিশিষ্ট আঙ্গিকে তুলে ধরেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের নতুন জীবন জিজ্ঞাসা ও পাশ্চাত্য কলাকৌশল সমৃদ্ধ শিল্পবোধ প্রথম লক্ষ করা যায় নুরুল মোমেনের ‘নেমেসিস’নাটকে। নব-নাট্যাঙ্গন সম্পর্কে গভীর ধ্যান-ধারণা থাকায় ‘নেমেসিস’-এ তিনি গতানুগতিক উনিশ শতকী আবহ ত্যাগ করে বিষয় ও আঙ্গিকে এনেছেন নতুনত্ব।  অভিজ্ঞতা ও মননশীলতার জোরে নাটকে তার নিরীক্ষাটি সফল হয়েছে। নাটকটির আঙ্গিকগত অভিনবত্বের কারণে নুরুল মোমেন বাংলা নাটকের ইতিহাসে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেন।

তথ্যনির্দেশ

১. সৈয়দা খালেদা জাহান, নুরুল মোমেন ও তাঁর নাটক, পৃ. ১৯

২. পূর্বোক্ত, পৃ. ২০।

৩. মো: জাকিরুল হক, দুই বাংলার নাটকে প্রতিবাদী চেতনা, পৃ. ১

৪. পূর্বোক্ত, পৃ. ২

৫. পূর্বোক্ত , পৃ. ২

৬. পূর্বোক্ত , পৃ. ৮

৭. পূর্বোক্ত , পৃ. ১৮

৮. নুরুল মোমেন, নেমেসিস, পৃ. ৫২

৯. সৈয়দা খালেদা জাহান, নুরুল মোমেন ও তাঁর নাটক, পৃ. ৪৬

১০. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৬

১১. পূর্বোক্ত, পৃ ৪০

আপনার মতামত লিখুন :

One response to “নেমেসিস”

  1. আরাফাত হোসাইন says:

    ম্যাম, সুন্দর ও সাবলীলভাবে আর্কাইভে উপস্থাপন করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা রইল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *