১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, রাত ৯:১৫
প্রাচীন গীতিকবিতার ধারা : লুই পা থেকে লালন সাঁই
শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০২০

মিলনকান্তি বিশ্বাস।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ। বিশ্বভারতী।ভারত

ইংরেজি সাহিত্যে গীতিকবিতাকে Lyric poetry বলা হয় তার কারণ লায়ার নামক বাদ্যযন্ত্র সহযোগে এই শ্রেণির কবিতা গীত আকারে পরিবেশিত হতো। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘গীতিকাব্য’ প্রবন্ধে বলেছেন ‘অতএব গীতের যে উদ্দেশ্য, যে কাব্যের সেই উদ্দেশ্য, তাহাই গীতিকাব্য। বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটতামাত্র যাহার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য।’গীতিকবিতা মুখ্যত গীতধর্মী। গীতের মতই একটিমাত্র ভাবের স্ফুরণ। কবি কল্পনার দৃষ্টিতে জগতকে দেখেন।

  প্রাচীন গীতিকবিতার সঙ্গে আধুনিক গীতিকবিতার মৌলিক পার্থক্য হল প্রাচীন গীতিকবিতা গোষ্ঠীচেতনা প্রধান আর আধুনিক গীতিকবিতা ব্যক্তিচেতনা প্রধান। প্রাচীন গীতিকবিতায় কবির ব্যক্তি পুরুষটি ঢাকা পড়েছে কিন্তু আধুনিক গীতিকবিতায় কবির ব্যক্তিপুরুষের প্রকাশ ঘটেছে। আধুনিক গীতিকবিতা গীত হয় না ঠিকই কিন্তু গীতিকবিতার সঙ্গে সংগীতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। গীতিকবিতার ভাষা ও ছন্দ গীতিময়। 

  গীতিকবিতায় বক্তব্য নয়, ব্যঞ্জনাই অভীষ্ট। বাংলা গীতিকবিতা মূলত নিরালম্ব ভাবসৃজনে অনিচ্ছুক, সেকারণে চর্যাগীতি, বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্ত পদাবলি স্বতন্ত্র কাহিনি নির্ভর। এর কারণ মূলত গীতিকবিতা লোকসংগীতের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত। লোকায়ত সাহিত্য ভাব ও সুর অপেক্ষা কথার মধ্যে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে।

এক:

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাগীতি। আনুমানিক নবম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে এই চর্যাগীতিগুলি রচিত হয়। সেন রাজাদের রাজত্বকালে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকগণ রূপক আশ্রিত ভাষায় এই চর্যাগীতিগুলি রচনা করেন। এর কারণ হিসেবে মনে হয় বৌদ্ধ সহজিয়া সাধন-তত্ত্বের কথা গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন রাজাদের বুঝতে না দেওয়া। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের গ্রান্থাগার থেকে চর্যাগীতির পুঁথি আবিষ্কার করেন। পুঁথিটি খণ্ডিত (২৩সংখ্যক পদটির কিছু অংশ এবং ২৪, ২৫, এবং ৪৮ সংখ্যক পদ পাওয়া যায়নি) হওয়ায় সাড়ে ছেচল্লিশটি পদের পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়। অবশিষ্ট সাড়ে তিনটি পদ প্রবোধচন্দ্র বাগ্‌চী মহাশয় তিব্বতি অনুবাদ থেকে পাঠোদ্ধার করেন। বর্তমানে চর্যাগীতির মোট পদ সংখ্যা পঞ্চাশটি বলা হলেও আরও বহু পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। চর্যাগীতির পুঁথি ছাড়াও সরোহাচার্যের দোহা, কৃষ্ণাচার্যের দোহা এবং ডাকাণর্ব নামক আরও তিনটি পুঁথি একত্রে ১৯১৬ সালে (১৩২৩বঙ্গাব্দে) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’ নামে প্রকাশিত হয়। চব্বিশজন কবি এই পঞ্চাশটি পদ রচনা করেন। চর্যাগীতির সংস্কৃতে টীকা রচনা করেছেন মুনি দত্ত। এই পঞ্চাশজন কবির মধ্যে আদি কবি হলেন লুই পাদ বা লুই পা। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের উপাধি হল পা বা পাদ। এই আলোচনায় চর্যাগীতি থেকে লালন সাঁই পর্যন্ত প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রধান প্রধান কবিদের নির্বাচন করে নিয়েছি। তাই প্রবন্ধের শিরোনাম রেখেছি ‘প্রাচীন গীতিকবিতার ধারা : লুই পা থেকে লালন সাঁই’।

 আমরা জানি যে বুদ্ধদেবের প্রয়াণের পর, বৌদ্ধ সাধকরা দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যান। হীনযান ও মহাযান। হীনযানীগণ বিশ্বাস করেন বুদ্ধ নির্দেশিত পথে নির্বাণ লাভই ধর্মসাধনার মুখ্য উদ্দেশ্য। এর উপায় নৈতিক আচার প্রভৃতির দ্বারা অস্তিত্বকে শূন্যতায় পরিণত করা। আর মহাযানীগণ বিশ্বাস করেন ধর্মসাসাধনার মুখ্য উদ্দেশ্য নির্বাণলাভ হলেও সে নির্বাণ বন্ধুত্বেরই রূপান্তর। মহাযানীদের কাছে বন্ধুত্বের অর্থ শূন্যতা ও করুণার সমন্বয় স্বরূপ বোধিচিত্তের অধিকারলাভ।    

  মহাসুখ লাভই হল বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের মুখ্য উদ্দেশ্য। আমাদের বাম নাসারন্ধ্র থেকে বামগা নাড়ি অর্থাৎ ইড়া এবং ডান নাসারন্ধ্র থেকে দক্ষিণগা নাড়ি অর্থাৎ পিঙ্গলা এই দুই নাড়ির গতি নিম্নমুখী। এই দুই নাড়ির মাঝখানে

অবস্থান করছে সুষুম্না। ইড়া এবং পিঙ্গলার গতিকে যোগবলে রুদ্ধ করে সুষুম্নার মধ্য দিয়ে আমাদের কামনাকে উর্ধ্বমুখী করাই বৌদ্ধ সহজিয়া সাধনার মুখ্য উদ্দেশ্য।

   সাধকের নাভিদেশে আছে নির্মাণ চক্র অর্থাৎ আনন্দশূন্য, হৃদয়ে আছে ধর্মচক্র অর্থাৎ পরমানন্দ বা অতিশূন্য, কন্ঠে আছে সম্ভোগচক্র বা বিরামানন্দ বা সর্বশূন্য এবং মস্তিষ্কে আছে সহজচক্র বা মহাসুখচক্র বা আনন্দ বা মহাশূন্য। বোধিচিত্তকে কন্ঠস্থিত সম্ভোগচক্র থেকে মস্তিষ্কস্থিত মহাসুখ চক্রে প্রেরণ করলেই সাধক পারমার্থিক রূপের সন্ধান পান।

লুই পা বা পাদ :

 চর্যাগীতির আদি কবি হলেন লুই পাদ বা লুই পা। সেই জন্য আমরা লুই পাদকে নির্বাচন করেছি। লুই ১ ও ২৯ সংখ্যক চর্যার রচয়িতা। তাঁকে দশম শতাব্দীর কবি বলেছেন সুকুমার সেন। সুকুমারবাবুর অভিমত -‘… লুইয়ের জীবৎকাল দশম শতাব্দী বলিলে ভুল হইবার সম্ভাবনা কম হয়।’তিব্বতি অনুবাদ থেকে লুইয়ের তিনখানি গ্রন্থের নাম পাওয়া যায়, যথা ‘শ্রীভগবদভিসময়’,‘অভিসময়বিভঙ্গ’ও ‘তত্ত্বস্বভাবদোহা-কোষগীতিকাদৃষ্টি নাম’। ড.সেনের মতে লুই কথাটি এসেছে ‘রোহিত’ থেকে (ঐ, পৃ ২১)।  

  লুই পাদের প্রথম পদটিতে সাধন-তত্ত্বের যে কথা ব্যাখ্যাত হয়েছে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা যেতে পারে –

‘কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।

     চঞ্চল চীএ পইঠো কাল।। ধ্রু।।

  দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।

         লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ।। ধ্রু।।’

 মুনি দত্তের টীকা থেকে জানা যায় আমাদের এই দেহ পঞ্চশাখা বিশিষ্ট তরুর মতো, যথা রূপ – বেদনা – সংজ্ঞা – সংস্কার – বিজ্ঞান নামক পঞ্চকায়ের সমবায়ে গঠিত। আমাদের মন প্রকৃতি আভাস দোষে নিয়ত চঞ্চল। মনের এই চঞ্চল অবস্থা থেকেই আমাদের কাল-বোধ জন্মে। এই কাল-বোধ থেকেই প্রবৃত্তিমূলক সংসার বোধের উৎপত্তি। এই চঞ্চল চিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করতে হলে তাকে মহাসুখের মধ্যে বিলীন করতে হবে এবং এই সাধনায় গুরুর নির্দেশ গ্রহণ করা প্রয়োজন। লুই তাই বলছেন যে, তিনি ধমন অর্থাৎ নিঃশ্বাসবাহী নাড়ী ও চমন অর্থাৎ প্রশ্বাসবাহী নাড়ীদুটির স্বভাবিক নিম্নগা গতিকে নিয়ন্ত্রিত করে অবধূতী মার্গে আসীন হয়েছেন সেই অবস্থায় সহজস্বরূপের যুগনদ্ধ রূপ দর্শন করেছেন। 

দুই

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য মূলত দুটি ধারায় অগ্রসর হয়েছে – একটি হল আখ্যান কাব্যের ধারা অন্যটি হল গীতিকাব্যের ধারা। আখ্যান কাব্যের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যচরিতসাহিত্য, অনুবাদসাহিত্য ও ময়মনসিংহ গীতিকা উল্লেখযোগ্য। আর গীতিকাব্যের মধ্যে বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্ত পদাবলি অন্যতম। কাব্যোৎকর্ষের বিচারে বৈষ্ণব পদাবলিতে মধুর রস আর শাক্ত পদাবলিতে বাৎসল্য রসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশিত হয়েছে।  

  আদিমধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন বড়ুচণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্য। ১৯০৯ সালে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরের কাঁকিল্যা গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়াল ঘরের মাচা থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্যের পুঁথি আবিষ্কার করেন। ১৯১৬সালে (বাংলা ১৩২৩সালে) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ নামে প্রকাশিত হয়। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ ভাষাতাত্ত্বিকগণের মতে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্যের পুঁথির ভাষা আনুমানিক চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে লেখা।

  বাংলা সাহিত্যে একাধিক চণ্ডীদাসের কথা জানতে পারা যায়। প্রাক্‌চৈতন্য যুগে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্যের কবি বড়ুচণ্ডীদাস এবং পদাবলি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি চণ্ডীদাস ছাড়াও চৈতন্যোত্তরকালে দীনচণ্ডীদাস নামক

একজন কবির রচিত বৈষ্ণব পদাবলির পদ পাওয়া গেছে। এর পরেই আমাদের বিদ্যাপতির কথা বলতে হবে। বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস যে প্রাক্‌চৈতন্য যুগের কবি তা আমরা কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থ থেকে জানতে পারি –

‘চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি         রায়ের নাটক গীতি

কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ।

স্বরূপ রামানন্দ সনে        মহাপ্রভু রাত্রিদিনে

গায় শুনে পরম আনন্দ।’

   ভাগবত, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, জয়দেবের শ্রীগীতগোবিন্দম্‌’ এবং জনসাধারণের প্রচলিত কাহিনি অবলম্বন করে বড়ুচণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ কাব্য রচনা করেন। এটি আখ্যানকাব্য জাতীয় গ্রন্থ। কাব্যটি মোট তেরোটি খণ্ডে সম্পূর্ণ। জন্ম খণ্ড, তাম্বুল খণ্ড, দান খণ্ড, নৌকা খণ্ড, ভার খণ্ড, ছত্র খণ্ড, বৃন্দাবন খণ্ড, কালীয়দমন খণ্ড, যমুনা খণ্ড বা বস্ত্রহরণ খণ্ড, হার খণ্ড, বাণ খণ্ড, বংশী খণ্ড এবং রাধাবিরহ। কাব্যটি যখন শুরু হচ্ছে তখন দেখা যায় রাধার প্রতি কৃষ্ণ প্রবল তৃষ্ণ এবং কৃষ্ণের প্রতি রাধা প্রবল বিতৃষ্ণ। এবং কাব্যটি যখন শেষ হচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে কৃষ্ণের প্রতি রাধা প্রবল তৃষ্ণ এবং রাধার প্রতি কৃষ্ণ বিতৃষ্ণ। কৃষ্ণ গোলোক থেকে ভূলোকে এসেছেন বৃহত্তর কর্মসাধনের জন্য অর্থাৎ কংস দমনের জন্য। কাব্যের শেষে দেখা যায়, কৃষ্ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরায় চলে গেছেন এবং রাধা কৃষ্ণবিরহে কাতর। ‘বংশীখন্ড’এ রাধার বিরহ-বেদনা প্রবল হয়ে উঠেছে কৃষ্ণের বাঁশি শুনে –

‘কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।

কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।

আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন।

বাঁশির শবদেঁ মো আউলাইলো রান্ধন।।’

কাব্যে কৃষ্ণ চরিত্রকে গ্রামীণ অমার্জিত পুরুষ রূপে অঙ্কিত হয়ছে। কাব্যে রাধা চরিত্রের যে বিবর্তন লক্ষ করা যায় তা অত্যন্ত মনস্তত্ত্ব সম্মত। বড়াই কুট্টিনী জাতীয় চরিত্র। সুকুমার সেন এই কাব্যকে ‘নাটগীতি-ব্রতকথা পাঞ্চালী’ বলেছেন। কারণ এই কাব্য নাটকীয় সংলাপ ও উৎকণ্ঠায় ভরপুর। তেমনি রয়েছে গীতিময়তা এবং পাঁচালির ঢঙ্‌। বাংলা সাহিত্যে সবথেকে প্রাচীন কাহিনি এটি।    

তিন

মধ্যযুগে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদ গীত আকারে পরিবেশিত হওয়ার জন্য রচিত হয়েছিল তাকেই বৈষ্ণব পদাবলি বলা হয়। অপ্রাকৃত জগতে রাধাকৃষ্ণের প্রমলীলা বয়ে চলেছে, মানস নেত্রে যাঁরা সেই লীলা প্রত্যক্ষ করেন তাঁরাই বৈষ্ণব এবং তাঁদের রচিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদকে বৈষ্ণবপদাবলি নামে পরিচিত। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের আবির্ভাব মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। তাঁর আবির্ভাবে ষোড়শ শতাব্দীতে সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে নবজাগণের সূচনা হয়েছিল। এই নবজাগরণ চৈতন্য রেনেসাঁ বা চৈতন্য নবজাগরণ নামে পরিচিত। মধ্যযুগের বিপুল বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য-সম্ভারকে আমারা সময়গত দিক থেকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করতে পারি। 

                        ১. প্রাক্‌চৈতন্য যুগ – আগে কবি, পরে ভক্ত। কবিরা হলেন জয়দেব (সংস্কৃত),       বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রমুখ।

                       ২.  চৈতন্য যুগ – মুরারি গুপ্ত, নরহরি সরকার, বাসু ঘোষ, নন্দ ঘোষ, যাদবেন্দ্র প্রমুখ। 

                       ৩.  চৈতন্য পরবর্তী যুগ – আগে ভক্ত পরে কবি। কবিরা হলেন জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বলরাম দাস, গোবিন্দ চক্রবর্তী, রায় শেখর, জগদানন্দ, লোচনদাস প্রমুখ।

সাহিত্যে নয়টি রসের (শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত ও শান্ত) পরিচয় পাওয়া গেলেও বৈষ্ণব পদাবলিতে পাঁচটি রসের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। যেমন শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য এবং মধুর। তবে বৈষ্ণব পদাবলিতে মধুর রসের শ্রেষ্ঠত্বই প্রকাশিত হয়েছে।

বিদ্যাপতি :

বিদ্যাপতি মিথিলার মধুবনী পরগণার অন্তর্গত দ্বারভাঙা জেলার বিসফি গ্রামে জন্ম। আনুমানিক ১৩৮০ সাল নাগাদ আবির্ভাব। তিরোধান ১৪৬০ সাল। প্রায় আশি বছর বেঁচে ছিলেন। মাতৃভাষা মৈথিলি হলেও সংস্কৃত ও অবহট্‌ঠ ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেছেন। নানা শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। পূর্বপুরুষ শৈব ছিলেন। দীনেশ্চন্দ্র ভট্টাচার্য মনে করেন বিদ্যাপতি শাক্ত ছিলেন। কামেশ্বর রাজবংশের দশ বারোজন রাজার উত্থান-পতন তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তবে রাজা শিবসিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় সব থেকে বেশি পদ রচনা করেছেন। রাধার বয়ঃসন্ধি, কৃষ্ণের পূর্বরাগ, অভিসার, মাথুর, প্রার্থনা প্রভৃতি পর্যায়ের পদ রচনায় তাঁর কৃতিত্ব সর্বাধিক প্রকাশিত হয়েছে। বয়ঃসন্ধির পদ রচনায় বিদ্যাপতির শ্রেষ্ঠত্ব লক্ষ করা যায়। একটি পদের কিছুটা অংশ- 

‘ভল ভেল দম্পতি সৈসব গেল।

চরণ-চপলতা লোচন লেল।।’

 রাধা বালিকা থেকে কিশোরীতে পদার্পণ করেছেন তাই তাঁর দেহে ও মনে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। বাল্যের চরণের চঞ্চলতা কিশোরী রাধার দৃষ্টির চঞ্চলতায় রূপান্তরিত হয়েছে। একারণেই রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতির রাধা সম্পর্কে বলেছেন –বিদ্যাপতির রাধা অল্পে অল্পে  মুকলিত হইয়া বিকশিত হইয়া উঠিতেছে।’ রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্য খুবই সঙ্গত এবং তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। 

  রাধার পূর্বরাগ-এর পদ রচনায় চণ্ডীদাস শ্রেষ্ঠ হলেও কৃষ্ণের পূর্বরাগ-এর পদ রচনায় বিদ্যাপতি শ্রেষ্ঠ। দৃষ্টান্ত –

‘এ ধনি কর অবধান।

তো বিনে উনমত কান।।

কারণ বিনু খেনে হাস।

কি কহএ গদ গদ ভাস।।’

রাধার জন্য কৃষ্ণ উন্মত্ত। কারণবিনা হাসেন এবং আপন মনে কথা বলেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলি চণ্ডীদাসের পূর্বরাগের পদেও লক্ষ করা যায়।  

   অভিসার পর্যায়ের পদে বিদ্যাপতি শ্রেষ্ঠ না হলেও তাঁর হাতে অভিসার পর্যায়ের পদের যে নানা বৈচিত্র্য ধরা পড়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিদ্যাপতির অভিসারিকা রাধার শারীরিক সক্ষমতা, প্রবল সাহসিকতা ও দৃঢ় মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। অকৃত্রিম প্রেমই বিদ্যাপতির রাধা চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

  বিদ্যাপতির সর্বাধিক কৃতিত্ব প্রকাশিত হয়েছে মাথুর পর্যায়ের পদ রচনায়। মাথুর-প্রবাস হল বিরহেরই নামান্তর। পদাবলি সাহিত্যে নায়কের প্রবাস বর্ণিত হয়েছে। প্রবাস দুই প্রকার – বুদ্ধি পূর্বক আর অবুদ্ধি পূর্বক। বুদ্ধি পূর্বক প্রবাস আবার দুই প্রকার – অদূর প্রবাস আর সুদূর প্রবাস। বৈষ্ণব শাস্ত্রে রাধার প্রবাস সুদূর প্রবাস। এই সুদূর প্রবাস তিন ধারায় বিভক্ত, যথা  ভাবী প্রবাস, ভবন প্রবাস এবং ভূত প্রবাস। সাধারণ বিরহের সঙ্গে মাথুর বিরহের পার্থক্য হল সাধারণ বিরহ আপাত বিরহ বা ক্ষণিক বিরহ আর মাথুর বিরহ হল অসীম বিরহ বা অনন্ত বিরহ। বিদ্যাপতির একটি বিখ্যাত বিরহের পদ হল – 

‘সখি হে হামারি দুঃখের নাহি ওর।

এ ভর বাদর মাহ ভাদর

          শূন্য মন্দির মোর।।’ (ঐ, পদ সংখ্যা ৭২০)

প্রকৃতি রাধার বিরহ যন্ত্রণাকে আরও প্রবল থেকে প্রবলতর করে তুলেছে। বর্ষা প্রিয় মিলনের ঋতু। রাধার দয়িত কাছে নেই। তাঁর গৃহ শূন্য। ভাদ্র মাসের ভরা বর্ষা, মেঘের দাপাদাপি ও গর্জন, প্রবল বর্ষণ, বিদ্যুতের ঝলসানি অন্যদিকে তেমনি প্রাণিকুলের আনন্দ উল্লাস – মত্ত দাদুরি ডাক, ডাহুকির কোলাহল প্রভৃতি রাধার গৃহের শূন্যতা এবং হৃদয় যন্ত্রণাকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। 

   বিদ্যাপতির মাথুরের পদ কম। রাজনামাঙ্কিত ২২৫টির মধ্যে ৩০টির বেশি বিরহের পদ নেই। রাজসভার কবি বলে কিংবা বিরহের পদ কম বলে হয়তো রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতিকে বলেছেন ‘সুখের কবি’ আর চণ্ডীদাসকে বলেছেন ‘দুঃখের কবি’। তবে বিদ্যাপতি রাজসভার কবি হতে পারেন কিন্তু তাঁর অন্তরের মধ্যে যে গভীর দুঃখের ফল্গু স্রোত ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 

  প্রার্থনা পর্যায়ের পদ রচনায়ও বিদ্যাপতির অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। এই পর্যায়ে ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে আর রাধা নেই। এই পর্যায়ে কবির ব্যক্তি জীবনের ব্যর্থতা, হতাশা, নিঃসঙ্গতা ধরা পড়েছে। জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে প্রবল হতাশা কবিকে গ্রাস করেছে। কবি সরাসরি মাধবের চরণে নিজেকে নিবেদন করে বলেছেন –

‘মাধব, বহুত মিনতি করি তোয়।

দেই তুলসী তিল দেহ সমর্পিলুঁ

                 দয়া জনি ছাড়বি মোয়।।’ (ঐ, পদ সংখ্যা ৭৬৫)

কিংবা –

  ‘তাতল সৈকত বারিবিন্দু সম

সুত মিত রমনি সমাজে।

      তোহে বিসারি মন তাহে সমাপলু

                        অব মঝু হব কোন কাজে।।’(ঐ, পদ সংখ্যা ৭৬৩)

  বিদ্যাপতির পদে রাজসভার কবিসুলভ বৈশিষ্ট্য যেমন আলংকারিক প্রাচুর্য, রাধার দেহসৌন্দর্যের বর্ণনায় রূপপিপাসা, মার্জিত বর্ণনাভঙ্গী, মননশীলতা ও বক্র কটাক্ষ প্রভৃতি লক্ষ করা যায় তেমনি লৌকিক প্রেম ও সৌন্দর্য ভাবনাও ধরা পড়েছে। তাই অধ্যাপক শংকরীপ্রসাদ বসু বিদ্যাপতি সম্পর্কে বলেছেন – ‘… লৌকিক প্রেম ও সৌন্দর্যের কবি’

চণ্ডীদাস:

চণ্ডীদাস বীরভূমের নানুরে বসবাস করতেন। বিমানবিহারী মজুমদার ‘চণ্ডীদাসের পদাবলী’ গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন -‘শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের পূর্ব্বে একজন প্রতিভাবান চণ্ডীদাসের উদ্ভব হইয়াছিল। শ্রীচৈতন্য তাঁহারই পদ আস্বাদন করিয়া আনন্দলাভ করিতেন। ঐ চণ্ডীদাস বিদ্যাপতির ন্যায় সম্ভবতঃ পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি।…’ । রবীন্দ্রনাথ চণ্ডীদাসের পদ সম্পর্কে বলেছেন -‘আমাদের চণ্ডীদাস সহজ ভাষার সহজ ভাবের কবি, এই গুণে তিনি বঙ্গীয় প্রাচীন কবিদের মধ্যে প্রধান কবি।’১০চণ্ডীদাসের জীবনী সংক্ষিপ্ত। চণ্ডীদাসের জীবনই তাঁর কাব্য। ‘চণ্ডীদাসের রাধাকৃষ্ণ চণ্ডীদাস-রামীর পশ্চাৎপটে চিত্রিত।’১১ চণ্ডীদাসের পদে রাধার অন্তর্জ্বালা, কুলজ্বালা প্রসঙ্গে চণ্ডীদাস-রামীর পরকীয়া প্রেম, চণ্ডীদাসের সমাজচ্যুতি প্রভৃতি ঘটনার কথা স্মরণে রাখলে আলোচনা করতে সুবিধা হয়।

  চণ্ডীদাস পূর্বরাগ, আক্ষেপানুরাগ, নিবেদন, বিরহ, প্রভৃতি পর্যায়ে পদ রচনায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। চণ্ডীদাসের পদে শ্রীকৃষ্ণের উপর ঈশ্বরত্ব আরোপিত হয়নি যেটা দীনচণ্ডীদাসের পদে লক্ষ করা যায়। বাংলা গীতিকবিতার যথার্থ সূচনা চণ্ডীদাসের হাতে।

   ‘উজ্জ্বল নীলমণি’ গ্রন্থে রূপগোস্বামী পূর্বরাগের সংজ্ঞায় বলেছেন দৈহিক মিলনের পূর্বে নাম শ্রবণ, গুণ শ্রবণ, রূপ দর্শন ইত্যাদি-জনিত কারণে নায়ক-নায়িকার চিত্তে উদ্বুদ্ধ রতি বিভাবাদির সংযোগে আস্বাদনীয় হয়ে ওঠে, তখন তাকে পূর্বরাগ বলা হয়।   

   বৈষ্ণব পদাবলিতে চণ্ডীদাসের প্রথম পদার্পণ পূর্বরাগে। গৌরচন্দিকা বিষয়ক পদ রচনার কোনো প্রশ্নই নেই কারণ তিনি প্রাক্‌চৈতন্য যুগের কবি। বাল্যলীলা ও কালীয়দমনে তিনি সময় নষ্ট করেননি। পূর্বরাগ পর্যায়ের পদে চণ্ডীদাস অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। বিদ্যাপতির ন্যায় চণ্ডীদাসের রাধা চরিত্রের ক্রমবিকাশ লক্ষ করা যায় না। চণ্ডীদাসের রাধা প্রথম থেকেই যোগিনী এবং পূর্ণযৌবনা। কৃষ্ণের নাম শ্রবণে রাধার দেহ-মন আকূল হয়ে উঠেছে –

‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।

কানের ভিতর দিয়া    মরমে পশিল গো

আকুল করিল মোর প্রাণ।।’১২

এই পদটিকে অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু চণ্ডীদাসের সমগ্র কাব্যের ‘শ্রেষ্ঠ গৌরচন্দ্রিকা’ বলেছেন। মোহিতলাল মজুমদার এই পদটির মধ্যে স্ববিরোধিতা লক্ষ করলেও অধ্যাপক বসু তা খণ্ডন করেছেন। প্রেমের গভীরতায় এবং আন্তরিকতায় চণ্ডীদাসের পদের তুলনা মেলা ভার। বৈষ্ণব সাধনমার্গের সর্বপ্রধান অবলম্বনরাধাভাব’। চণ্ডীদাসের পদে সর্বত্রই এই ভাবটি প্রস্ফুটিত। চণ্ডীদাসের পূর্বরাগের পদ আত্মনিবেদন গ্রাস করেছে। 

  চণ্ডীদাসের মিলনের পদ নেই বললেই চলে। তাঁর পদে বিরহকে আক্ষেপানুরাগ গ্রাস করেছে। রাধার ক্ষণিক বিচ্ছেদ সহ্য হয় না। চণ্ডীদাসের সর্বাধিক কৃতিত্ব প্রকাশিত হয়েছে আক্ষেপানুরাগ পর্যায়ের পদে। রাধার আক্ষেপ আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে, দয়িত কৃষ্ণের বিরুদ্ধে, নিজের বিরুদ্ধে এবং কৃষ্ণের বাঁশির বিরুদ্ধে। একটি পদে ‘বঁধু’ কৃষ্ণের বিরুদ্ধে রাধা বলেছেন, কৃষ্ণ তাঁকে অল্প বয়সে ঘরছাড়া করেছেন –      

‘বঁধু, কি আর বলিব তোরে।

অল্প বয়সে       পিরীতি করিয়া

রহিতে না দিলি ঘরে।’

 অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাই বলেছেন –চণ্ডীদাসের সর্বস্ব আক্ষেপানুরাগ এবং আক্ষেপানুরাগের সর্বস্ব চণ্ডীদাস।’১৩ বিদ্যাপতি আর বিদ্যাপতির রাধা এক নন তাই বিদ্যাপতিকে প্রার্থনার পদ রচনা করতে হয়েছিল কিন্তু চণ্ডীদাস আর চণ্ডীদাসের রাধা এক, তাই রাধার নিবেদন চণ্ডীদাসেরও নিবেদন – 

‘বঁধু কি আর বলিব আমি।

জীবনে মরণে        জনমে জনমে

প্রাণনাথ হৈও তুমি।।’ ১৪

কিংবা

বঁধু তুমি সে আমার প্রাণ।

দেহ মন আদি   তোহারে সঁপেছি

কুল শীল জাতি মান।।’ ১৫

চণ্ডীদাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন -‘আমাদের চণ্ডীদাস সহজ ভাষার সহজ ভাবের কবি, এই গুণে তিনি প্রাচীন কবিদের মধ্যে প্রধান’ যথার্থ বলে মনে হয়। 

জ্ঞানদাস :

ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধের কবি হলেন জ্ঞানদাস। বর্ধমান জেলার কাঁদড়া-মাদড়া গ্রামে (বর্তমান কেতুগ্রাম) জন্ম গ্রহণ করেন। আনুমানিক জন্ম সাল ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ। খেতরির মহোৎসবে জ্ঞানদাস গিয়েছিলেন বলে অনুমান করা হয়। বিমানবিহারী মজুমদারের মতে জ্ঞানদাস বাল্যকালে প্রভু নিত্যানন্দকে দর্শন করেছিলেন এবং প্রভুর

তিরোধানের পর তাঁর পত্নী জাহ্নবাদেবীর বা জাহ্নাবীদেবীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অকৃতদার ছিলেন। রাধাকৃষ্ণের প্রেমে সারাক্ষণ বিভোর হয়ে থাকতেন।

  ‘জ্ঞানদাস ও তাঁহার পদাবলী’ গ্রন্থের ভূমিকায় বিমানবিহারী মজুমদার বলেছেন –বিদ্যাপতির অলঙ্কার-বৈচিত্র্য ও চণ্ডীদাসের ভাবোচ্ছ্বাসের অনুসরণ করিতে করিতে জ্ঞানদাস তাঁহার নিজস্ব প্রকাশভঙ্গী আবিষ্কার করিলেন। সেই ভঙ্গীর মধ্যে স্বল্পকথায় ভাবের সংহতরূপ ফুটাইয়া তোলাই বৈশিষ্ট্য।’১৬বাংলা এবং ব্রজবুলি উভয় ভাষাতেই পদ রচনা করেছেন। বাংলা তাঁর মাতৃভাষা। বাংলা ভাষার পদেই তাঁর অধিক কৃতিত্ব প্রকাশিত হয়েছে।

  জনানদাস শ্রীরাধার কয়েকটি বয়ঃসন্ধির পদ রচনা করেছেন। পদ্গুলিতে বিদ্যাপতির বয়ঃসন্ধির পদের প্রভাব লক্ষণীয়। কিন্তু শ্রীরাধিকার পূর্বরাগের কয়েকটি পদে কবি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তবে জ্ঞানদাস পূর্বরাগ থেকে সুদূর প্রবাস পর্যন্ত পদ রচনা করলেও তাঁর কবিপ্রতিভার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে রাধার অনুরাগ পর্যায়ের পদ রচনায়। জ্ঞানদাস ভাবের জগত থেকে রূপের জগতে প্রবেশ করেছেন।‘অনুরাগ’ প্রেমের দ্বিতীয় পর্যায় অর্থাৎ গাঢ় অবস্থা। আর রূপানুরাগ হল রূপজনিত কারণে প্রেমের গাঢ়তা প্রাপ্তি। জ্ঞানদাস রাধার রূপানুরাগের অবশ্যই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর বিখ্যাত রূপানুরাগের পদ হল –

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।’১৭

কিংবা –

‘রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল।

যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।।’১৮

স্বল্প কথায় জ্ঞানদাস যে মানসিক চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, তার তুলনা মেলা ভার! রূপানুরাগ ছাড়াও জ্ঞানদাস আরও একটি পর্যায়ে পদ রচনায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেনতা হল আক্ষেপানুরাগ। জ্ঞানদাসের আক্ষেপের মধ্যে অনুরাগই প্রবল হয়ে উঠেছে। আক্ষেপানুরাগ পর্যায়ের পদ রচনায় জ্ঞানদাস চণ্ডীদাসের সমকক্ষতা দাবি করতেই পারে। সেই একই সুর, একই ভাষা ও একই কাহিনি কিন্তু বলার ভঙ্গি জ্ঞানদাসের স্বতন্ত্র। চণ্ডীদাসের রাধা সখীদের বিরুদ্ধে আক্ষেপ করে বলেন -‘আমার পরাণ যেমতি করিছে তেমতি হউক সে।’ আর জ্ঞানদাসের রাধা কৃষ্ণের বিরুধে আক্ষেপ করে বলেন – ‘না দেখিলে যত হএ বুঝহ আপনি’। জ্ঞানদাসের একটি বিখ্যাত পদ –

‘সুখের লাগিয়া          এ ঘর বাঁধিনু

অনলে পুড়িয়া গেল।

অমিয়া-সাগরে          সিনান করিতে

সকলি গরল ভেল।।’১৯

সংসারে নিরবচ্ছিন্ন সুখ নেই। যা চাই তা পাই না, আবার যা পাই তা চাই না। কিন্তু  দুঃখের বিষয় হল যখন এক চাইতে গিয়ে অন্য পাই। রাধা চেয়েছিলেন লক্ষ্মী, দারিদ্র্য এসে গ্রাস করল, অচলে উঠতে গিয়ে অতলে পড়ে গেলেন। তৃষ্ণার্ত হয়ে জলদের সেবা করলেন কিন্তু বজ্র পড়ে গেল। জ্ঞানদাস বলছেন –কানুর পিরীতি / মরণ অধিক শেল।’ মাথুর বিরহের পদেও জ্ঞানদাসের বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয়। আত্মনিবেদনের পদেও জ্ঞানদাসের স্বাতন্ত্র্য আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর সঙ্গে সহমত পোষণ করে আমরা বলতে পারি  জ্ঞানদাস ‘বাংলাদেশের সর্ব্বযুগের একজন শ্রেষ্ঠ কবি’।

গোবিন্দদাস:

চৈতন্যোত্তরকালের বৈষ্ণব পদকর্তাদের মধ্যে গোবিন্দদাস অন্যতম। তাঁর আবির্ভাব ষোড়শ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এবং সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত বর্তমান ছিলেন। আদি নিবাস ছিল কুমার গ্রামে। পরে শ্রীখণ্ডেই বাস করতেন। প্রথমে শাক্ত ছিলেন পরে শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। সংস্কৃতে ‘সঙ্গীত

মাধব’ নাটক ও ‘কর্ণামৃত’ নামে কাব্য রচনা করেন। তাঁর ৫৫০টি বৈষ্ণব পদ আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রসিদ্ধ কবি হিসেবে তিনি ‘কবিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত হন। মিথিলায় গিয়ে তিনি বিদ্যাপতির পদ সংগ্রহ করেন। বিদ্যাপতির কবিধর্মের সঙ্গে তাঁর কবিধর্মের সাদৃশ্যের জন্য তাঁকে ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ রূপে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

   গৌরাঙ্গ বিষয়ক পূর্বরাগ, অভিসার ও মাথুর পর্যায়ের পদে তাঁর কৃতিত্ব প্রকাশিত হলেও তাঁর সর্বাধিক কৃতিত্ব প্রকাশিত হয়েছে গৌরাঙ্গ বিষয়ক ও অভিসার পর্যায়ের পদে। গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ রচনায় ভক্ত কবি-হৃদয়ের সকল আকূতি দিয়ে চৈতন্যদেবের অপূর্ব দিব্যভাবমূর্তি রচনা করেছেন। ‘রাধাভাবদ্যুতি’কৃষ্ণস্বরূপ শ্রীচৈতন্যদেবকে দেখে কবির মনে হয়েছে – ‘অভিনব হেম কল্পতরু সঞ্চরু/ সুরধুনী তীরে উজোর।।’ চৈতন্যদেবের অপরূপ ভাবসুষমার সঙ্গে আপন হৃদয় মাধুর্য মিশ্রিত করে গোবিন্দদাস যে পদ রচনা করেছেন তার তুলনা মেলা ভার।

  পূর্বরাগ পর্যায়ের পদ রচনাতেও তাঁর কৃতিত্ব প্রকাশিত হয়েছে। রূপসৌন্দর্য-সাধক কবি অন্তরের অসীম ব্যাকুলতা দিয়ে রাধার সৌন্দর্য উপলব্ধি করে বলেছেন –যাঁহা যাঁহা নিকসয়ে তনু তনু জ্যোতি।’ কিংবা ‘রূপে ভরল দিঠি সোঙরি পরশ মিঠি /পুলক না তেজই অঙ্গ।’    

  বিপ্রলম্ভ নায়িকার আট অবস্থার মধ্যে প্রথম হল অভিসারিকা। অভিসারের পদ রচনায় গোবিন্দদাস তুলনারোহিত। অলঙ্কার শাস্ত্রে জ্যোৎস্নাভিসার, দিবাভিসার, গ্রীষ্মাভিসার প্রভৃতি যে আটপ্রকার অভিসারের কথা বর্ণিত হয়েছে, গোবিন্দদাসের পদে তার সবগুলিই মূর্ত হয়ে উঠেছে। ভগবানের সঙ্গে ভক্তের মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে যে যাত্রা তাই হলো অভিসার। এরজন্য চাই কঠোর-কঠিন সাধনা। গোবিন্দদাসের একটি অভিসারের পদে তাই দেখা যায়, রাধা অভিসারে যাওয়ার পূর্বে পথের বাধাকে অতিক্রম করার জন্য দুঃসাহসিক প্রস্তুতিতে মগ্ন হয়েছেন – 

‘কণ্টক গাড়ী        কমল-সম পদতল

মঞ্জীর চীরহী ঝাঁপি।

গাগরি-বারি          ঢারি করি পীছল

চলতহি অঙ্গুলি চাপি।।’২০

কিংবাঅন্য একটি পদে শব্দ-ব্যঞ্জনার মধ্যে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বিশ্বপ্রকৃতির চিত্র সুন্দরভাবে অঙ্কিত হয়েছে –

‘ঘন ঘন ঝন ঝন বজর-নিপাত।

শুনইতে শ্রবণে মরম জরি যাত।।’২১

গোবিন্দদাস তাঁর অভিসারের পদে গভীর হৃদয়ানুভূতির সঙ্গে রূপসৌন্দর্য চেতনার যোগ ঘটিয়েছেন। তাঁর পদ্গুলি সুদক্ষ শিল্পীর হাতের অপরূপ কারুকার্য হয়ে উঠেছে।

  আবেগের সঙ্গে সংযমের অপূর্ব সমন্বয় লক্ষ করা যায় তাঁর পদে। শ্রীচৈতন্যের লোকোত্তর জীবনলীলার আলোকে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে দেখেছেন এবং সেই প্রাণাবেগ স্থির, সংযত ও সৌন্দর্য-শিল্পে রূপায়িত করেছেন। সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল, ফলে সেই অধীতবিদ্যা তাঁর পদাবলীতে একটি আভিজাত্য ও শিল্পশ্রী দান করেছে। দুচোখ ভরে তিনি যে সৌন্দর্যসুধা পান করেছেন, তিল তিল করে তা রূপায়িত করেছেন তাঁর পদাবলিতে। শুচিস্নিদ্ধ ভক্তিপ্রাণতা গোবিন্দদাসের পদাবলীর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।     

চার

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে শাক্তগীতিকবিতার উদ্ভব হয়। এর উদ্ভবের পিছনে সমকালীন বাংলা দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভক্তিরসের সহজ স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হয়ে এসেছিল এই সময়। তখনই শাক্ত ভক্তরা ভক্তিরসের আন্তরিকতা নিয়ে এলেন বাংলা সাহিত্যে। অধ্যাপক ক্ষেত্রগুপ্ত এক স্থানে বলেছেন – ‘বিশেষ করে শাক্ত পুরাণ আর তন্ত্রের দ্বারা বিশ্বাস ও সাধনভজনের ক্ষেত্রে তাঁরা আরও বেশি প্রভাবিত হয়েছেন। শাক্তপদাবলীর পেছনে ঐ দ্বিমুখী প্রেরণাই সবচেয়ে কাযর্কর ছিল।’২২ শাক্তসাধক বা সিদ্ধ পুরুষের রচিত

সাধন-সংগীতই শাক্তপদাবলি নামে পরিচিত। শাক্তপদালির দুটি শাখা – এক উমা সংগীত, দুই শ্যামাসংগীত। অষ্টাদশ শতাব্দীর সামাজিক অব্যবস্থা, দুঃখ-দারিদ্র্য, অন্নাভাবের ঘটনা শাক্তপদাবলির আগমনী, বিজয়া ও ভক্তের আকূতি পর্যায়ের মধ্যে চিত্রিত হয়েছে। অমরেন্দ্রনাথ রায় তাঁর শাক্ত পদাবলী’ গ্রন্থের ভূমিকায় বলেছেন – শাক্ত-সঙ্গীতের সূত্রপাত এদেশে কবে হইয়াছিল, তাহা নিশ্চিতরূপে নির্ধারণ করা অবশ্য কঠিন। তবে রামপ্রসাদই যে এক্ষেত্রে সর্ব্বাগ্রগণ্য, সে বিষয়ে সংশয় নেই।’২৩

রামপ্রসাদ :

যাঁর হাত ধরে শাক্তপদাবলির উদ্ভব ও বিকাশ লাভ করেছে তিনি হলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন (১৭২০-১৭৮১)। গঙ্গাতীরবর্তী হালি শহরে বৈদ্য বংশে জন্ম। তন্ত্রসাধক ছিলেন। শাস্ত্রসম্মত আচারনিষ্ঠ কর্মকাণ্ড পরিহার করে সাধারণ মানবজীবনের ব্যাকুলতাকে ভক্তিতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি এক নতুন সুর জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে। তাকে ‘প্রসাদী সুর’ বলা হয়। তিনি এক নতুন কাব্যভাষা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই কাব্যভাষার কোনো পূর্বসূত্র ছিল না। প্রথম যুগের তিনিই একমাত্র কবি। রামপ্রসাদ সাধক হলেও মায়ের প্রতি তাঁর অভাব অভিযোগ অভিমান প্রবল। কিন্তু কমলাকান্ত অনেকটা নির্লিপ্ত শান্ত মায়ের চরণপ্রার্থী। রামপ্রসাদের পদে আমরা এমন সব উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা পাই যা তৎকালীন বাংলার দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে যুক্ত, যেমন ‘কোন অবিচারে আমার পরে করলে দুখের ডিক্রীজারি’, ‘আমায় দেও মা তবিলদারী’, ‘মা আমায় ঘুরাবে কত, / কলুর চোখ-ঢাকা বলদের মত?,’ ‘আমি দিন-মজুরী নিত্য করি /পঞ্চভূতে খায়গো বেঁটে’ প্রভৃতি গ্রাম-জীবনের নিত্যদৃষ্ট বিষয়গুলি রামপ্রসাদের গানের অলংকার হিসেবে স্থান পেয়েছে। তিনি শাক্তপদাবলি ছাড়াও রচনা করেন ‘কালিকামঙ্গল’ বা ‘বিদ্যাসুন্দর’, ‘কালীকীর্ত্তন’, ‘কৃষ্ণকীর্ত্তন’।

    কলকাতার এক বিখ্যাত জমিদার বাড়িতে (গোকুল চন্দ্র ঘোষ বা দুর্গাচরণ মিত্র) মুহুরির অর্থাৎ হিসেব পত্র লেখা-লেখির কাজ করতেন। হিসেবের খাতায় ‘শ্রীদুর্গা’ নাম লিখে হিসেবের খাতা ভরিয়ে তোলেন। একদিন খাতায় লিখলেন –

‘আমায় দেও মা তবিলদারী,

         আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী।’২৪

‘আগমনী’ ও ‘বিজয়া’ পর্যায়ে বাৎসল্য রসের প্রকাশ ঘটেছে। জগজ্জনী মাতা উমা এখানে কন্যা। হিমালয় ও মেনকা এখানে পিতা-মাতা। এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য। ‘ভক্তের আকূতি’ পর্যায়ে জগজ্জনী মাতা এখানে নিজের মাতা এবং ভক্ত এখানে সন্তান। প্রতিবাৎসল্যে রসের প্রকাশ ঘটেছে। এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ পদকর্তা রামপ্রসাদ সেন। তাঁর বিখ্যাত একটি পদ হল – 

‘কেবল আসার আশা, ভবে আসা, আসা মাত্র হলো।

যেমন চিত্রের পদ্মেতে পড়ে, ভ্রমর ভুলে র’লো।।

মা, নিম খাওয়ালে চিনি বলে, কথায় করে ছলো।

ও মা, মিঠার লোভে, তিত মুখে সারাদিনটা গেল।।’২৫

দলবৃত্ত ছন্দে লেখা। ‘কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।’ চর্যাগীতির  সঙ্গে এই পদটি তুলনীয়। মায়ের প্রতি অভাব, অভিযোগ, অভিমান ও পরম নির্ভরতাই ধরা পড়েছে ‘ভক্তের আকূতি’ পর্যায়ের পদে।

কমলাকান্ত ভট্টাচার্য :

কমলাকান্তের জন্ম আনুমানিক ১১৭৫ বঙ্গাব্দ (ইং১৭৬৮) এবং প্রয়াণ আনুমানিক ১২৩১ বঙ্গাব্দে (ইং১৮২৪)। কবির জন্মস্থান বর্ধমান জেলার কালনায়। তিনি কেবলমাত্র শাক্তপদাবলি রচনা করেন নি, তিনি একাধারে পরম মাতৃসাধক, একনিষ্ঠ ভক্ত, তান্ত্রিক, যোগী এবং গৃহীসন্ন্যাসী। কালী বা শ্যামা মা রূপে জগজ্জননী দেবীকে পুজো করেছেন এবং শ্যামা মায়ের চরণকে সর্বসাধ্যসার বলে জ্ঞান করেছেন। একটি পদে পাই –

১০

‘আমার শ্যামা মায়ের যুগল পদে গয়া গঙ্গা বারানসী।’

নিজেকে ‘কালীর বেটা’ বলে পরিচয় দিতে ভালো বাসতেন। কমলাকান্তের জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ হল গান। তাঁর গানের পরম ভক্ত ছিলেন মহারাজা নন্দকুমার, দেওয়ান রঘুনাথ, মহারাজ বিজয়চাঁদ, ঠাকুর শ্রীরমকৃষ্ণ পরমহংসদেব প্রমুখ।

 শ্যামাসংগীত ও বৈষ্ণব পদাবলি ছাড়াও তিনি ‘সাধকরঞ্জন’ গ্রন্থ রচনা করেন। শ্যামাসংগীত-এর মধ্যে ‘আগমনী’ ও ‘বিজয়া’পর্যায়ের পদেই তাঁর অধিক কৃতিত্ব প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ‘আগমনী’ ও ‘বিজয়ার’ পদে কন্যাবিচ্ছেদকাতরা বঙ্গ-পিতা-মাতার সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথাই ব্যক্ত হয়েছে। এই পর্যায়ের গানে কৌলীন্য প্রথার মর্মান্তিক দিক ব্যক্ত হয়েছে। মেনকা উমাকে শ্বশুরালয় থেকে নিজে বাড়িতে আনবার জন্য স্বামী গিরিরাজকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছেন। মেনকা বলেছেন –

‘কবে যাবে বল গিরিরাজ, গৌরীরে আনিতে।

ব্যাকুল হৈয়েছে প্রাণ উমারে দেখিতে হে।’২৬

এই গানে কন্যা উমাকে দেখার জন্য মাতা মেনকার উৎকণ্ঠা ধরা পড়েছে। কমলাকান্তের গানে এভাবে দৈনন্দিন পারিবারিক জীবনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।

  ‘সাধকরঞ্জন’ তাঁর ‘যোগবিষয়ক নিবন্ধ’। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাগীতিতেও দেহকে আশ্রয় করে দেহাতীতের সন্ধান করার কথাই ব্যক্ত হয়েছে। বৈষ্ণব দর্শনে ও সাহিত্যে শাক্ততন্ত্রের প্রবেশ ঘটেছে। শ্রীরাধাকে শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি রূপে দেখানো হয়েছে। নাথ সাহিত্য এবং বাউল গানেও শক্তিতত্ত্বের প্রভাব লক্ষ করা যায়। নাথ যোগীদের আরাধ্য দেবতা শিব এবং বাউলদের আরাধ্য ‘মনের মানুষ’। এই উভয় সাধনার ধারায় দেহের মধ্যেই পরমাত্মার সন্ধান করা হয়েছে। কমলাকান্তও ‘মনোদীক্ষা’র একটি পদে বলেছেন –

আপনারে আপনি দেখ, যেও না মন কারু ঘরে।

      যা চাবে, এইখানে পাবে, খোঁজ নিজ-অন্তঃপুরে।’২৭

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কলানিপুণ ‘শিল্পীকবি’ রূপে কমলাকান্ত ভট্টাচার্যকে অভিহিত করা যায়।

লালন ফকির :

লালন ফকির (জন্ম ১৭.১০.১৭৭৪, মৃত্যু ১৭.১০.১৮৯০)-এর ব্যক্তি জীবন বিষয়ে খুব বেশি জানা যায় না। ভাঁড়ারা, কুষ্টিয়া, বাংলাদেশে জন্ম। ১১৬ বছর বেঁচে ছিলেন। ধর্ম বিষয়ে উদার সাধক। জন্মগতভাবে তিনি হিন্দু না মুসলিম তা নিয়ে সংশয় আছে। তিনি এবং তাঁর সমসাময়িক শিল্পী গগন হরকরা শিলাইদহে ঠাকুর পরিবারের প্রজা এবং ডাকহরকরা ছিলেন। গগনের বিখ্যাত গানআমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে’। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এঁদের গানের দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। লালন সহজ সরল কবিত্বময় গানের মধ্যে দিয়ে জীবনের আদর্শ, মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন-

‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে,

লালন ভাবে জেতের কি রূপ দেখলেম না এ নজরে।

যদি, শুন্নত দিলে হয় মুসলমান,

নারীর তবে কি হয় বিধান?

বামন চিনি- পৈতা প্রমাণ,

বামনী চিনি কিসে রে ?

কেউ মালা কেউ তস্‌বি গলায়,

তাইতে কি জাত ভিন্ন বলায়!

যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়

১১

জেতের চিহ্ন রয় কার রে!’২৮

তিনি কোনো জাতিভেদ মানতেন না। সকল ধর্মের প্রতি তাঁর ছিল সমান শ্রদ্ধা। বাউলদের সাধনা মনের মানুষের অন্বষণের সাধনা। এই মনের মানুষের কোনো জাত, ধর্ম, বর্ণ নেই। তিনি সমস্ত মানুষের মধ্যে ‘মনের মানুষ’টিকে দেখে আত্মহারা হতেন। সমস্ত মানুষই তাঁর চোখে এক। তাঁর কথা ‘এই মানুষে দেখ সেই মানুষ আছে।’ সাঁইজী আগে নিজেকে জানার কথা বলেছেন। ‘আপনারে চিনিলে পরে যায় অচেনার চেনা।’ সাংসারিক সুখ-দুঃখে তিনি বিচলিত হতেন না। স্ত্রী-পুরুষেও তিনি ভেদ মানতেন না। লালনের একমাত্র প্রতিকৃতি পাওয়া যায়, প্রতিকৃতিটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা।        

  সবশেষে বলা যায়, সমগ্র মধ্যযুগের কবিদের কাব্যপাঠের মধ্যদিয়ে আমরা দেখতে পেলাম ব্যক্তি চেতনা অপেক্ষা গোষ্ঠী চেতনাই বড় হয়ে উঠেছে এই পর্বের কাব্যে। সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে এক বিশেষ আঙ্গিকের মধ্যে অর্থাৎ কাব্য আঙ্গিকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেও কবিরা অসাধারণ কাব্য সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন। অনন্যসাধারণ কবি-প্রতিভার স্বাক্ষর কবিরা রেখে গেছেন। এজন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁরা চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।

সূত্র নির্দেশ:

১। বঙ্কিম রচনাবলী’(২য় খণ্ড), সাহিত্য সংসদ, কলকাতা ৭০০ ০০৯, চতুর্দশ মুদ্রণ, ফাল্গুন ১৪০৯, পৃ ১৬৫

২। মুনিদত্তের একটি জীবনী এবং তিব্বতের তেঞ্চুর সংগ্রহশালার ক্যাটালগ থেকে জানা যায়।

৩। চর্যাগীতি পদাবলী -সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা – ৭০০ ০০৯, তৃতীয় মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃ ২০

৪। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (১ম খণ্ড) – সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা – ৭০০ ০০৯, ষষ্ঠ সংস্করণ ১৯৭৮, পৃ ১৫১

৫। বিদ্যাপতির পদাবলি : খগেন্দ্র নাথ মিত্র ও বিমানবিহারী মজুমদার সম্পাদিত, পদ সংখ্যা – ১৭, নতুন সংস্করণ দোলপূর্ণিমা ১৩৫৯, পৃ

৬।  সাধনা, চৈত্র, ১২৯৮বঙ্গাব্দ

৭। পূর্বোক্ত, বিদ্যাপতির পদাবলি: খগেন্দ্র নাথ মিত্র ও বিমানবিহারী মজুমদার সম্পাদিত, পদ -৪৪

৮। চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি – শংকরীপ্রসাদ বসু, দে’জ পাবলিশিং, প্রথম প্রকাশ ১৩৬৭, প্রথম দে’জ সংস্করণ ১৪০৫, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৪১০

৯। চণ্ডীদাসের পদাবলী : বিমানবিহারী মজুমদার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, দ্বিতীয় মুদ্রণ রথযাত্রা ১৪০৩, পৃ ৩০

১০। চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি, ভারতী, ফাল্গুন ১২৮৮

১১। পূর্বোক্ত, চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি – শংকরীপ্রসাদ বসু

১২। বৈষ্ণব পদাবলী (চয়ন) : খগেন্দ্র নাথ মিত্র, সুকুমার সেন, বিশ্বপতি চৌধুরী ও শ্যামাপদ চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পুনর্মুদ্রণ ২০১১, পৃ ২৮

১৩। পূর্বোক্ত, চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি : শঙ্করীপ্রসাদ বসু , পৃ ৭৬

১৪। পূর্বোক্ত, বৈষ্ণব পদাবলী (চয়ন), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, নিবেদন, পদসংখ্যা -১,পৃ ৮২

১৫।  পূর্বোক্ত, বৈষ্ণব পদাবলী (চয়ন), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, নিবেদন, পদসংখ্যা -২,পৃ ৮৩

১৬। জ্ঞানদাস ও তাঁহার পদাবলী – বিমানবিহারী মজুমদার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ

১৭। পূর্বোক্ত, বৈষ্ণব পদাবলী (চয়ন), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, নিবেদন, পদসংখ্যা ১৬, পৃ ৪০

১৮। পূর্বোক্ত, বৈষ্ণব পদাবলী (চয়ন), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, নিবেদন, পদসংখ্যা -৭, পৃ ৩৩

১৯। পূর্বোক্ত, বৈষ্ণব পদাবলী (চয়ন), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, নিবেদন, পদসংখ্যা -৮, পৃ ৭৯

১২

২০। পূর্বোক্ত, বৈষ্ণব পদাবলী (চয়ন), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, অভিসার, পদসংখ্যা -১, পৃ ৫১

২১। পূর্বোক্ত, বৈষ্ণব পদাবলী (চয়ন), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, অভিসার, পদসংখ্যা -২, পৃ ৫৩

২২। বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস – ক্ষেত্র গুপ্ত, পুস্তক বিপণি, 

২৩। শাক্ত পদাবলী – অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১২শ সংস্করণ ২০১০, পৃ ভূমিকা

২৪। পূর্বোক্ত, শাক্ত পদাবলী – অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত, ভক্তের আকুতি, পদসংখ্যা – ২০০, পৃ ৮৮  

২৫। পূর্বোক্ত, শাক্ত পদাবলী – অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত, ভক্তের আকূতি, পদ ১৫৭, পৃ ৭২

২৬। পূর্বোক্ত, শাক্ত পদাবলী – অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত, আগমনী, পদ ১৮, পৃ ৯

২৭। পূর্বোক্ত, শাক্ত পদাবলী – অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত, মনোদীক্ষা, পদ ২৬৫, পৃ ১১৫

২৮। অথ বাউল কথা – ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদিত), সিসৃক্ষা, শ্রীরামপুর, হুগলী, প্রথম প্রকাশ অগ্রহায়ণ ১৪২৪, পৃ ৬৫ 

লেখক পরিচিতি :

শ্রীমিলনকান্তি বিশ্বাস : জন্ম ১৯৭৪। সেন্টপলস ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজ থেকে স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অদ্বৈত মল্লবর্মণ বিষয়ে গবেষণা। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ২০০৪ সালে অধ্যাপনার কাজে যোগদান। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ বাউল আকাদেমির সভাপতি। রচিত গ্রন্থ ‘প্রসঙ্গ :লোকসংস্কৃতি’ (২০১৪), ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও বাংলার লোকসংস্কৃতি’ (২০১৪)। যৌথ-সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘অগ্রন্থিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ’(২০১৬)। সাহিত্য অকাদেমি থেকে প্রকাশিত সম্পাদিত গ্রন্থ ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ : স্রষ্টা ও সৃষ্টি’ (২০১৭)। বিভিন্ন গ্রন্থে ও পত্র-পত্রিকায় ষাটের বেশি প্রবন্ধ প্রকাশিত।  

আপনার মতামত লিখুন :

৪ responses to “প্রাচীন গীতিকবিতার ধারা : লুই পা থেকে লালন সাঁই”

  1. Arghya Sarkar says:

    অসাধারণ তথ্যে সমৃদ্ধ লেখা পড়লাম। কিছু তথ্য আমরা আগেও পড়েছি, তবু বলতে হয় এই প্রবন্ধ পড়ে আরো সমৃদ্ধ হলাম এবং মধ্যযুগ নিয়ে আমার গবেষণার সুবাদে আমার মতো অনেক পাঠক পাঠিকা উপকৃত হবে।

  2. Arghya Sarkar says:

    অসাধারণ তথ্য সমৃদ্ধ লেখা পড়লাম। কিছু তথ্য আমরা আগেও পড়েছি, তবু বলতে হয় এই প্রবন্ধ পড়ে আরো সমৃদ্ধ হলাম এবং মধ্যযুগ নিয়ে আমার গবেষণার সুবাদে আমার মতো অনেক পাঠক পাঠিকা উপকৃত হবে।

  3. Sanjay Bhattacharjee says:

    চমৎকার একটি প্রবন্ধ পাঠ করলাম।

  4. Hafizur Rahman says:

    এমন সুন্দর প্রাণবন্ত আলোচনা ও বিশ্লেৃষণ ,খুব ভালো লাগলো

Leave a Reply to Hafizur Rahman Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *