২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার, দুপুর ২:৫১
আবু সয়ীদ আইয়ুবের অগ্রন্থিত প্রবন্ধ সংস্কৃতিসংকট না সংস্কৃতিসংঘাত
মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০২০

লেখক: ভূঁইয়া ইকবাল

বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যসমালোচক, দার্শনিক ও ভাবুক লেখক আবু সয়ীদ আইয়ুব (১৯০৬-৮২) খুব বেশি লেখেননি। মাত্র চারটি প্রবন্ধ-সম্ভার প্রকাশ পেয়েছে : আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৬৮), পান্থজনের সখা (১৯৭৩), পথের শেষ কোথায় (১৯৭৭) এবং ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক (১৯৯২)। সাময়িকপত্রে মুদ্রিত কয়েকটি প্রবন্ধের সন্ধান পাওয়া গেছে – সেগুলো কোনো গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ‘বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাভূমি ও দর্শন’ (পরিচয়, ১৩৪২); ‘সৌন্দর্য্যরে মূল্য কী সাশ্রয়ী?’ (পরিচয়, ১৩৪৩); ‘ইংলন্ডে স্বাধীনতা’ (পরিচয়, ১৩৪৩); ‘সমকালীন সাহিত্যের পথ’ (সত্যযুগ থেকে পুনর্মুদ্রণ, মাসিক মোহাম্মদী (ঢাকা, অগ্রহায়ণ, ১৩৫৬); ‘রবীন্দ্রনাথ ও পরবর্তী কাব্যধারা’ (মাসিক মোহাম্মদী, কলকাতা, ঈদ সংখ্যা, ১৯৪৬); ‘বাম থেকে দক্ষিণে’ (গোপাল হালদার-সম্পাদিত পরিচয়, ফাল্গুন ১৩৫৫) এবং ‘সংস্কৃতি সংকট না সংস্কৃতি সংঘাত? – এবং প্রসঙ্গত’ (জিজ্ঞাসা, বৈশাখ-আষাঢ়, ১৩৮৯)।
গত শতকের ত্রিশের দশকে তাঁর বাংলায় লেখার সূচনা। এখন পর্যন্ত তাঁর যেসব লেখা পাওয়া গেছে তার প্রথমটিকে বলা যায়, গদ্যকবিতা; ‘একটি না-বলা কথা’ (নাজিরুল ইসলাম মোহাম্মদ সুফিয়ান-সম্পাদিত ছায়াবীথি, কার্তিক, ১৩৪০)। পরের বছর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-সম্পাদিত সেকালের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যপত্র পরিচয়ে ‘বুদ্ধিবিভ্রাট ও অপরোক্ষানুভূতি’ (১৩৪১) প্রবন্ধ প্রকাশ পায়; লেখক রবীন্দ্রনাথসহ সাহিত্যিক মহলে সাদর অভ্যর্থনা লাভ করে। সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ লেখককে জানান : আমি নিজে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনালাম। শুনে তিনি খুব খুশি হলেন, বললেন একে দিয়ে আরও লেখাও। (উদ্ধৃত, ‘ভাষা শেখার তিন পর্ব এবং প্রসঙ্গত’, পথের শেষ কোথায়, দ্বি-স, ১৯৮০, পৃ ২০)। এক সাক্ষাৎকারে আইয়ুব জানিয়েছেন, আধুনিক বাংলা কাব্যের (১৯৪০) ভূমিকা পড়ে রবীন্দ্রনাথ খুব খুশি হয়ে আমাকে ডাকেন এবং বলেন, মনে হয় যেন তুমি আধুনিক কবিদের মনের কথাটি ধরতে পেরেছ, …। (আইয়ুব : স্মরণগ্রন্থ, মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম-সম্পাদিত, পৃ ১৮৬।) সাহিত্যচর্চা প্রসঙ্গে আবু সয়ীদ আইয়ুব জানান, তিরিশের দশকে পরিচয় এবং ষাট ও সত্তরের দশকের দেশ আমাকে লেখক করে তুললো। হুমায়ুন কবিরের চতুরঙ্গ এবং বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের পূর্ব্বাশায় তাঁর কিছু লেখা ছাপা হয়েছিল।
এখনো নানা সাময়িকপত্রে তাঁর কিছু রচনা অগ্রন্থিত থেকে যেতে পারে।
এখানে আমরা শিবনারায়ণ রায় সম্পাদিত জিজ্ঞাসা পত্রিকা থেকে ‘সংস্কৃতিসংকট না সংস্কৃতিসংঘাত’ প্রবন্ধটি উদ্ধার করছি। এটি আইয়ুবের কোনো বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পরিশেষে সংযোজন করলাম ‘একটি না-বলা কথা’। শিবনারায়ণ রায় বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়ে আইয়ুবের এই অপ্রকাশিত লেখাটি পান। সম্পাদকীয় নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন : [এটি] তাঁর যোগ দেবার আগে ‘সংস্কৃতিসংকট ও রবীন্দ্রনাথ’ বিষয়ে রবীন্দ্রভবনে অনুষ্ঠিত এক আলোচনাসভায় পঠিত হয়েছিল। সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয় :
আইয়ুব দীর্ঘকাল দুরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী; তাঁর লেখাটি পূর্ণাঙ্গ করা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হয় নি। … এই সংক্ষিপ্ত ও অসমাপ্ত রচনাটিকে তাঁর দীর্ঘকালব্যাপী রবীন্দ্রচর্চার সন্নিধিতেই দেখা সমীচীন।
আইয়ুবের পঠিত প্রবন্ধ সম্পর্কে ওই আলোচনাসভায় ‘সংস্কৃতির সংকট ও রবীন্দ্রনাথ’ বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন নবনীতা দেবসেন। জিজ্ঞাসা-সম্পাদকের মতে, [নবনীতার] ‘লেখাটিকে আইয়ুবের উতোর বলা যায়।’

সংস্কৃতিসংকট না সংস্কৃতিসংঘাত? – এবং প্রসঙ্গত
বিষয়টি হচ্ছে ‘সংস্কৃতি-সংকট এবং রবীন্দ্রনাথ’। একেবারে শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথ একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন, যার নাম সভ্যতার সংকট। আপনারা ইচ্ছাপূর্বক সভ্যতা শব্দটি বর্জন করে তার জায়গায় সংস্কৃতি শব্দটা ব্যবহার করেছেন। সেটা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। ‘সংকট’ শব্দটাও ভাববার মতো। তবে রবীন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত প্রবন্ধটির বিষয়ে ভালোমন্দ কিছু বলা আমার একেবারেই অনভিপ্রেত। ‘সংস্কৃতি’ ও ‘সংকট’ এই দুই বিষয়েই আমার নিজস্ব কিছু চিন্তা ভাবনা নিবেদন করছি।
কোনো একটি দেশে (সাধারণত প্রাকৃতিক সীমানা নির্দিষ্ট ভূখ-ে) বহুকালাগত প্রথাপদ্ধতি এবং জীবনযাত্রার আদর্শকে সেই দেশের সভ্যতা বলতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সংস্কৃতি সমাজের উপরিতলের ব্যাপার। অবশ্য বিত্তবান বলতে যাদের বোঝায় – টাটা বিড়লা, ডালমিয়া বাজাজ তাদের কথা ভাবছি না, ভাবছি সেই সব মধ্যবিত্তের কথা যাঁরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছেন এবং কোনো বিশেষ আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে – জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প-সাহিত্যের চর্চা সেই সব ক্ষেত্রে – সৃষ্টিশীল হবার সাধনা না করলেও যথোপযুক্ত ভাবে গুণ গ্রহণ করবার শক্তি অর্জন করেছেন। কেউ কেউ দেবদত্ত ক্ষমতা নিয়ে জন্মান। যাদের আমরা প্রতিভাবান বলি তাদের পক্ষে দীর্ঘকাল কঠোর সাধনার প্রয়োজন হয় না; কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিমান মানুষও আন্তরিক সাধনার ফলে সংস্কৃতিবান বলে গণ্য হতে পারেন। অবশ্য রসবোধ সম্পূর্ণত শিক্ষার দ্বারা তৈরি করতে পারা যায় কিনা সেটা তর্কসাপেক্ষ।
কাব্যসমালোচনার ভাষা যুক্তিবিরুদ্ধ অথবা আত্মবিরোধী হলে অবশ্যই দোষণীয় হবে। তবে সেটা সম্পূর্ণত যুক্তিনির্ভর হতে পারে না যেমন পারে বিজ্ঞানের ভাষা। আমি শুধু বলতে চাই যে সমালোচনার ভাষাকেও খানিকটা সৃজনী শক্তিসম্পন্ন হতে হবে। কাব্যের ভাষা বেদনা হতে বেদনে পৌঁছিয়ে দেবার মাধ্যম। তবে কবিরা মাঝে মাঝে তাঁদের ভাষাকে অতি সূক্ষ্ম ও শানানো করবার জন্য গদ্যের পরিচ্ছন্নতা থেকে সরে যান। সব রকমের বাহুল্য বর্জন করতে গিয়ে এতটাই বাড়াবাড়ি করেন যে ভাষা প্রায় ভাষাই থাকে না। কোনো কোনো কবিকে হৃদয়ঙ্গম করতে গিয়ে পাঠক একটু দিশেহারা বোধ করেন। আমি মনে করি যে কাব্যসমালোচনার (কাব্য-সমীক্ষকের বললে আরো সঠিক বলা হয়) কাজ হচ্ছে এমনতর বিঘœগুলিকে সরিয়ে দিয়ে কবির বেদনা হতে পাঠকের বেদনের পথটাকে অবিঘœসংকুল করে তোলা।
তবে উচ্চ পর্যায়ের দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক চিন্তা করবার ক্ষমতাও সম্পূর্ণরূপে শিক্ষণীয় নয়, খানিকটা দেবদত্ত। আধুনিকতম বিজ্ঞানের একটি শাখা আছে কস্মগনি বা বিশ্বসমীক্ষা। এডিংটন, শেরিংটন, নীডহ্যাম, হাইসেনবার্গ হয়েল, নারলিকর এবং সর্বোপরি আইনস্টাইন বিজ্ঞানের যে-প্রান্তভূমিতে বিচরণ করছেন সেখানে তাঁরা এক রোমাঞ্চকর এবং রহস্যময় যবনিকা আন্দোলিত দেখতে পান। তাঁদের অপারিভাষিক রচনাবলিতেও কাব্যের সুর শোনা যায়। আমি এখানে নিউটনের বহু উদ্ধৃতিজীর্ণ উক্তির কথা বলছি না যাতে তিনি নাকি বিনীতভাবে বলেছিলেন, ‘আমি সারাজীবন সমুদ্রতীরে নুড়ি কুড়িয়েছি মাত্র – জ্ঞানের অকুল সাগর এখনো সামনে রয়েছে।’ আমি উপরে যে কয়েকজন বিজ্ঞানীর কথা বলেছি তাঁরা অধুনালব্ধ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মধ্যেই জানা-অজানায় মেশা এমন কিছুর স্বাদ পাচ্ছেন যাকে রাহস্যিক বা মিস্টিক্যাল বলা যায়।
সংস্কৃতির সংকট বলতে বোঝায় যেন একটিমাত্র সংস্কৃতি রয়েছে এবং তা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে আজ বিপন্ন। কিন্তু আমরা চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি (আমি পশ্চিমবঙ্গের কথাই বলছি যার সংস্কৃতির সঙ্গে আমি অল্পবিস্তর পরিচিত) অন্তত দুটি বিবদমান সংস্কৃতি। একটির উদ্গাতা রামমোহন রায় এবং তাঁর অভ্রভেদী বিরাট স্বরূপ রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা ও সাধনার মধ্যে। এখনো তা মোটেই নিস্তেজ হয়ে যায়নি। পাশাপাশি আরেকটি সংস্কৃতি বলব না যার উদ্বোদ্ধা ছিলেন কার্ল মার্কস এবং যা হয়ে উঠল আক্ষরিক অর্থে বলবান রাশিয়ায় লেনিনের মধ্যে, চীনে মাও সে-তুংয়ের মধ্যে, এদেশে তেমন কোনো নেতৃত্বের স্বরূপ এখনো বিকশিত হয়ে ওঠেনি, অদূরভবিষ্যতে উঠবে কিনা তা কে বলতে পারে। ইতিহাসে দেখা গেছে যে প্রতিভাবান এবং নিষ্ঠাবান নেতা কখনো তাঁর নেতৃত্বের পক্ষে অনুকূল পরিস্থিতি করে তোলেন। উল্টোটাও যে কখনো হয়নি তা নয়। নানান কারণের যৌগিক ক্রিয়ায় উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতি যেন আপন অন্তরের মাঝখান থেকে উৎক্ষিপ্ত করে সেই পরিস্থিতির যথোপযুক্ত শক্তিশালী ব্যক্তিকে যাঁর বহু গুণের মধ্যে কিংবা সর্বোপরি একটি গুণ থাকা চাই যাকে খানিকটা রহস্যম-িত ভাষায় বলা হয় ক্যারিস্ম্যাটিক পার্সোনালিটি।
মার্কসবাদ একটি রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য সেøাগান এবং প্রোগ্রাম মাত্র নয়। আমার তো মনে হয় মার্কসবাদী দলকে দল না বলে সম্প্রদায় বলা অধিকতর সমীচীন। ধর্মসম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁদের তুলনা সহজে মনে আসে। প্রাণ দিতে এবং প্রাণ নিতে তাঁদেরই মতন তাঁরা সর্বদাই প্রস্তুত। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তাঁরা নিজেদের তহবিল রাতারাতি পরিস্ফীত করার জন্য তৎপর নন। বরঞ্চ এই-কাজকে তাঁরা ঘৃণার চোখেই দেখেন। তাঁদের অভিলাষ অনেক বড়। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে তাঁরা ব্যবহার করতে চান মার্কসবাদের ভিত্তিভূমিকে সর্বজনের মধ্যে বিশেষত শোষিত জনের মধ্যে সম্প্রসারিত এবং সুদৃঢ় করতে।
মার্কসবাদ একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কৃতি। মার্কস অনুবাদীদের দর্শন আলাদা, ইতিহাসতত্ত্ব আলাদা, সর্বোপরি সত্যাসত্য নির্ণয়ের প্রতিমান আলাদা।
গান্ধীবাদকেও এদেশের একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ভাবা যায়, যার মূল নীতি হচ্ছে সকল দীনদুঃখীর সেবা। গান্ধীবাদের সঙ্গে রামমোহন-নেহরু-রবীন্দ্রনাথের লিবারাল হিউম্যানিস্ট সংস্কৃতির সহ-অবস্থান সম্ভব, যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছিল। তার দৃষ্টান্ত নেহরুর আত্মজীবনীতে ছড়ানো রয়েছে। নেহরু বিশেষভাবে বিচ্ছেদবেদনা বোধ করেছিলেন যখন গান্ধী জমিদারি প্রথা সমর্থন করে বললেন যে জমিদাররা হবেন নিজ নিজ এলাকার অছি বা ট্রাস্টি, জমিদারির অর্থ ব্যয় করবেন সকল প্রকার কল্যাণ কর্মে অর্থাৎ যাঁরা ভক্ষক তাঁরাই হবেন রক্ষক।
রবীন্দ্রনাথও তাঁর ভাষায় প্রতিবাদ করেছিলেন যখন গান্ধী বলেছিলেন যে বিহারের প্রলয়ঙ্কর ভূমিকম্প পূর্বকৃত বা পূর্বজন্মের অস্পৃশ্যতা নামক পাপের ঈশ্বরপ্রদত্ত শাস্তি। কিন্তু নেহরু রবীন্দ্রনাথের লিবারাল-হিউম্যানিস্ট সংস্কৃতির সঙ্গে সহিংস এবং অগণতান্ত্রিক মার্কসিস্ট সংস্কৃতির সহ-অবস্থান সম্ভব নয়। তাদের মোকাবিলা হচ্ছে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘হেড অন্ ক্ল্যাশ’। বিশেষত রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতির রং এদেশের সংস্কৃতিবানদের হৃদয় মনের উপর অনেকখানি ছেয়ে আছে। পশ্চিমবঙ্গের চিত্তভূমি থেকে রবীন্দ্রনাথকে উচ্ছেদ না করলে এদেশে মার্কসবাদের কার্যকরী প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গের মার্কসবাদী সরকারের প্রাথমিক এবং অত্যন্ত সুবিবেচিত পদক্ষেপ হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথের অপূর্ব সুন্দর সহজপাঠ অপসারিত করে নতুন বর্ণ পরিচয় চালু করা যার লেখক হবেন অবশ্যই মার্কসবাদে পূর্ণ নিষ্ঠাবান কেউ। চারিদিক থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে দেখে তাঁরা আপাতত তাঁদের পদক্ষেপটাকে স্থগিত রেখেছেন। কিন্তু পরে এই চেষ্টাকে একটু মোলায়েম করে এবং সুচতুরভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন বলেই তো মনে হয়। মীর-এর একটি শের দিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করি :
অভি তো ইব্তিদা এ ইশক হ্যায়
রোতা হ্যায় কেয়া
দেখিয়ে আগে আগে হোতা হ্যায় কেয়া ॥
(সবে তো প্রেমের শুরু এখনই কাঁদছ, দেখো, ক্রমে ক্রমে আরো কত কী ঘটে।)

পুনশ্চ : এই ভাষণটি রবীন্দ্র-ভবন বিশ্বভারতী কর্তৃক অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারের জন্য লিখিত এবং সেখানে পঠিত হয়। তাই শেষের দিককার কথাগুলি একটু বেশি জোর দিয়ে বলা হয়েছে এই প্রত্যাশায় যে তার ফলে বিতর্কগুলি প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। নইলে আমি বিশ্বাস করতে চাই না যে মার্কসবাদ এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কোনোরূপ সমঝোতা ও সহঅবস্থান একেবারেই অসম্ভব। তবে তার জন্য উভয়পক্ষকে সূচ্যগ্র পরিমাণের চেয়ে অনেকখানি বেশি পরিমাণ জমি ছাড়তে হবে। মার্কসবাদীরা কি রাজি হবেন তাঁদের তত্ত্ব ও নীতি থেকে হিংসাবাদকে বর্জন করতে – অন্তত ভারতবর্ষের বর্তমান পরিস্থিতিতে? আমরা অর্থনৈতিক সাম্যের কথা বলে থাকি কিন্তু যথোপযুক্ত জোরের সঙ্গে বলি না। এখন আরো বেশি জোর দিয়ে বলা অত্যন্ত দরকার। অবশ্য সম্পূর্ণ আর্থিক সমতা সম্ভব নয়, কোনো দেশেই সম্ভব হয়নি। তবে তফাৎটা অনেকখানি কমানো যায়। মার্কসবাদীরা ক্ষমতার সমবণ্টনের কথাটা কি ভেবে দেখবেন? আমি বলতে চাই না যে কোনো দেশের সমস্ত বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষ সমান পরিমাণে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করবে। তবে চার-পাঁচ বছর অন্তর সবাইকে তাদের শাসকম-লী নির্বাচন করার অধিকার দেওয়া যায় ইন এ ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশান এবং তা দেওয়া অত্যাবশ্যক। আমি অর্জন ও বর্জনের যেসব কথা বলেছি তাকে, রাজনীতিশাস্ত্রে ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম্ আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। অথচ কমিউনিস্ট পার্টির উভয় শাখাই (সি পি আই এম ও সি পি আই) ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজমকে সমান অবজ্ঞার চোখে দেখে থাকেন। তাহলে উপায়? দেবাঃ ন জানন্তি।
পুনশ্চ ২ : মূল রচনাটির সঙ্গে ‘এবং প্রসঙ্গত’ যুক্ত হয়েছে এই কথা ভেবে যে ঐ অংশটি লিখে ‘জিজ্ঞাসা’র পরবর্তী কোনো সংখ্যায় প্রকাশের জন্য দেওয়া যাবে।

পরিশিষ্ট

একটি না-বলা কথা
তোমার যে কথাটি শুনব বলে আজ আমি এসেছি তার সময় কি এখনো আসেনি?
নারিকেল শ্রেণীর দীর্ঘ ছায়া মাঠের শ্যামলিমায় মিলিয়ে গেল। পশ্চিম প্রান্তে বনের আড়াল থেকে সূর্য্য তার শেষ তুলি দুলিয়ে দিল দিগন্তে এলায়িত খ- খ- মেঘের পটে পটে ওপারের গ্রামগুলিতে একটি একটি ক’রে মিট্মিটে আলো জ্ব’লে উঠ্ল। শেষ খেয়া ছেড়ে দিল পারের পানে। যাত্রীদের অস্পষ্ট কণ্ঠধ্বনি আর শোনা যায় না।
শুধু আমরা দুজন ঘাটে ব’সে রয়েছি। আকাশে শুধু সন্ধ্যাতারার নিষ্প্রভ দীপ্তি।
আমার অনেক কথা বলা হয়েছে, অনেক কথা বলি নি, অনেক কথা ভাষার আবরণে হারিয়ে গেছে। কিন্তু আমার সকল ব্যক্ত ও অব্যক্ত কথার উপরে পড়ে রয়েছে তোমার সেই না-বলা কথার গভীর ছায়া।
এই নিঃশব্দ সন্ধ্যায় এই ছোট নদীর নির্জ্জন ঘাটে ব’সে কোন্ দূর বনান্তের বীথি-মর্ম্মরে তুমি উন্মনা হয়েছ জানি নে জানি নে তোমার মনের যে কথাটি শুন্বার জন্যে আমার মন অধীর প্রতীক্ষায় দিনের অন্তিম মুহূর্তটিকে ধ’রে রাখ্তে চায় সে কথা বলা হবে কি না।
হয় ত আজো অন্ধকার নেমে আস্বে, তুমি উঠে চলে যাবে। আজো তোমার না-বলা কথাখানি ঘুমিয়ে রইবে তোমার বুকের গভীর জলে আর আমার ক্লান্ত প্রতীক্ষা জেগে থাকবে সারা প্রহর ধ’রে।
এমন ক’রে কতদিন ব্যর্থ হয়েছে, কত নিবিড় মুহূর্ত এসে চলে গেছে – যৌনতার রিক্ততার।
তবু ত আশা ছাড়তে পারি না – মনকে বোঝাতে পারি না। বারে বারে নারিকেলের পত্র মর্ম্মরে, নদীর পাড়ে ঢেউ ভাঙ্গার কলশব্দে বেজে ওঠে – আজো তোমার একটি কথা বলা হয়নি।

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *