‘বনের খবর’ বাংলা সাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রচিত এক অসামান্য স্মৃতিকথা। তাও বন-অরণ্যে ও মরুভূমি-প্রায় অঞ্চলে জরিপকালীন সময়ের। এ রকম লোমহর্ষক ও আনন্দ-বেদনা-দায়ক বই পড়ার সুখ কি ভোলা যায়! পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, বার্মা, আসামের বন ও নিবিড় অরণ্যের আলেখ্য ও তাদের জীবনাচরণ দিয়ে পাঠককে নেশাগ্রস্ত স্বপ্ননবিলাসী করে তোলার বই। সেই সঙ্গে ১৯০৪-১৯০৫ সাল পর্যন্ত বেলুচিস্তানের অরণ্যহীন বালি-পাথুরে ভূমিপুত্রদের কঠোর জীবন ও শীতের দেখা পাই। প্রমদারঞ্জন রায়ের সার্ভেয়ার জীবনে দেখা এই ১৮৯৯ থেকে ১৯২০ সালের রূপকথার মতো গভীর অরণ্য বাংলা সাহিত্যের কোনো বইতে আমার পড়ার সুযোগ হয়নি। সেই অরণ্যও মানুষের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে মাত্র একশ বছরে। অরণ্য দেখার সুযোগ আমার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হয় নি। যখন থেকে দেখা ও খোঁজা শুরু করেছি তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও তেমন অরণ্য আর নেই। বিখ্যাত সংরক্ষিত অরণ্য কাচলং, সাজেক, মাতামুহুরী ও সাঙ্গু উধাও। সিলেটে অরণ্য দেখি নি। সুন্দরবনেও যাওয়ার সুযোগ পাইনি তরুণ বয়সে। বনের খবর প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালের পরে পুস্তকাকারে। তার আগে উপন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে কিছু লেখা ছাপা হয়েছিল। ১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে ‘বনের খবর’ বইটি কিনে প্রায় এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলি। তার আগে থেকেই আমি মাতাল পাঠক। বইয়ের শুরু থেকে এক দানবীয় আকর্ষণ আমাকে পেয়ে বসে। দেরাদুন থেকে বার্মার শান প্রদেশের অরণ্য ও পশুপাখি আরো নিবিড়। নিচ্ছিদ্র গাছপালার রাজ্যে লেখক আমাদের প্রায় গ্রেফতার করে নিয়ে ছেড়ে দেন তাঁর পিছু পিছু। পথঘাট নেই। গাছপালা কেটে সেই অরণ্যে প্রবেশ করছেন দলবল নিয়ে সার্ভেয়ার প্রমদারঞ্জন রায় মহাশয়। সঙ্গে জন্তু-জানোয়ারের চলাফেরার রাস্তা আছে, সেই সঙ্গে তাদের ভয়াবহ উৎপাতের ও ধ্বংসের সাক্ষাৎ পাই। দলের মজুর দু-এক জন করে বাঘের পেটে চলে যাচ্ছে। হাতি-গা-র আরও বিপজ্জনক বুঝিরা। কিন্তু সার্ভেয়ারদের ব্রিটিশ রাজত্বের চাকরি বজায় রাখতে হবে। সে তো আর আজকের দিনের সরকারি চাকরি নয়!
আবার মানুষ খেকো মানুষ আছে শান প্রদেশে। নাত্ (Nat) ধর্মে বিশ্বাসী তারা। নাত্দের পরিচয় পাই ২০০১ সালে জুনে ইয়ান্দুন শহর থেকে কেনা ‘হার্প অফবার্মা’ বই পড়ার পর। জাপানি সাহিত্যিক মিচিও তাকেয়ামা রচিত। বইটি তরুণদের জন্য নামকরা কিশোর পত্রিকা ‘আকা তোমবো’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ছাপা শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় জাপানি বড়োদের কাছেও। শেষে বইটি বিশ্ব ক্লাসিক রূপে স্থান করে নেয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে একদল জাপানি সৈন্য বার্মায় আত্মসমর্পণ করে। তাদের এক সৈন্য এই নাত্দের হাতে পড়ে জীবন্ত খাদ্য হতে হতে নাত্ সর্দারের কৃপায় বেঁচে যায় ওই হার্প বাদ্যযন্ত্র বাজানোর গুণে। অথচ এই বইটি তোকিও ও ফুকুওয়াকা শহরে পেয়েও কিনি নি। জানতাম না বলে।
সেই ‘বনের খবর’ বই চুরি হয়ে যাওয়ার বহু বছর পর কোলকাতা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে খুঁজেও পাই নি। ২০১১ সালে কোলকাতায় প্রকাশিত হওয়ার বিজ্ঞাপন দেখে পেয়ে যাই হারানো কৈশোরের মতো। কিন্তু প্রথম প্রকাশের সন-তারিখ নেই। তবে সেই একই বই, প্রচ্ছদ-সত্যজিৎ রায়, অলঙ্করণ-শ্যামলকৃষ্ণ বসু। অসাধারণ স্কেচ ও প্রচ্ছদ। সেই সময়কার গদ্য বানান রীতির উজ্জ্বল নক্ষত্রসম দিনপঞ্জি। রোমহর্ষক যেমন, তেমনি আনন্দদায়ক। জনমানবহীন কিন্তু বুনো জীবনজন্তুতে ঠাসা বন, তেমনি ঘন গাছপালার জন্য আকাশ অদৃশ্য, গাছপালা-লতাপাতা কেটে পথ তৈরি করে চলা, বনজঙ্গলে তাঁবুতে রাত কাটানোর সময় বাঘের হানা, মত্ত মাতঙ্গের মুখোমুখি হয়েও বেঁচে যাওয়া, গন্ডার-ভালুক থেকে হনুমানও বাঁদরের বাঁদরামি, পাখির কথা, নদী ও স্রোতস্বিনীর কলগুঞ্জন থেকে শীত ও গ্রীষ্মের দাবদাহ কি নেই ‘বনের খবর’ বইতে!
আর বুনো বৃষ্টিতে নাকাল হওয়াও আছে। জোঁক-সাপতো তুচ্ছ। নস্যি। জিনিসপত্র বওয়ার জন্য হাতি,গরু, খচ্চর ও উট। এবং সঙ্গে আছে এক দঙ্গল কুলি। কখনো কখনো জিনিসপত্র ফেলে পালিয়ে যায় নাত্ দেবতার ভয়ে কিছু কুলি মজুর। কুসংস্কারে ভীষণ ভয়, আবার খাদ্যাখাদ্যের বেলায় একেবারে বেপরোয়া সর্বভূক। তেমনি শুধু লঙ্কা ও নুন দিয়েও দিনের পর দিন পেট পুরে খেয়ে নিতে পারে। কাজ করে যায়।
বার্মায় শান কুলিরা হাড়ি, কড়াই বা বাসন-কোসন ছাড়া ভাত রেধে খেত। লেখকের বর্ণনায় একটু শুনুন, ‘কী করে রান্না করে? একটা লম্বা কাঁচা বাঁশের চোঙার একটি বাদে সমস্ত গাঁটগুলিকে ফুটো করে, সেটাকে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে, তাতে আবশ্যক মতো চাল পুরে, জল ভরে, ঘাস-পাতা দিয়ে মুখটা বন্ধ করে একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে দেয়। তিন-চার ঘণ্টা অমনি থাকে, তারপর ওই চোঙাটা ধুনির আগুনে ঝলসায়। চারদিকে বেশ ঝলসানো হলে চোঙাটি জায়গায়-জায়গায় পুড়ে যায়- সেটাকে ধুনি থেকে বার করে রেখে দেয়। ঠান্ডা হলে পর দা দিয়ে আস্তে আস্তে বাঁশটাকে চিরে ফেলে আর তার ভিতর থেকে দিব্যি একটা ভাতের পাশ বালিশ বার হয়ে আসে। সেটা চাকা-চাকা করে কেটে সকলে ভাগ করে নেয়, আর নুন, লঙ্কা, শুকনো মাছ বা মাংস উপকরণ দিয়ে খায়। গরমের দিনে কখনো বা ঝিঁঝি পোকা ধরে, আগুনে পুড়িয়ে তার চাটনি করে খায়। ঝিঁঝি পোকা নাকি অতি উপাদেয়!’
‘বনের খবর’ এত রোমাঞ্চকর যে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা গড়িয়ে যায়, তবু বই ছাড়া যায় না। আর্জন সর্দার বা জিম করবেট অথবা পচাব্দী গাজী এঁরা সবাই শিশরী। আটঘাট বেঁধে শিকারে নামেন। কিন্তু ‘বনের খবর’ জরিপ কাজের বই। তার পদে পদে বাঘের যত বাহিনী আছে তারা কেউ পথ ছাড়ার পাত্র নয়। বাঘও ছাড়বার পাত্র নয়। আবার বিপদ দেখলে সেও দে ছুট। সবাই জানেন বনে বাঘের রাজত্ব, বাঘও তা জানে। ভয় পেলে তো তার পেট চলবে না। কিন্তু একা নিরস্ত্র মানুষকেও কখনোবা সে নিরাপদ নয় মনে করে হম্বিতম্বি হুমহাম গর্জনে ভয় দেখিয়ে নিজেই সটকে পড়ে। লেখক নিজে কত বার যে বাঘের পাল্লায় পড়েছেন! এবং প্রায় প্রত্যেক বার যেন অলৌকিক ভাবে বেঁচে গেছেন। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন এসব কথা অকপটে। অথবা শুধু সাহসের জোরে বিনা যুদ্ধে জিতে গেছেন নিশ্চিত মৃত্যুর গ্রাস থেকে। জিম করবেট, আর্জন সরদার বা পচাব্দী গাজী তো শিকারিই। আর ‘বনের খবর’ আমাদের বাড়ির কাছের পার্বত্য চট্টগ্রাম, বার্মা, আসামের বনজঙ্গলের লোমহর্ষক বর্ণিল কাহিনি। শিকারের বই না-হলে এটিকে রোমাঞ্চকর বই বলা যায়। বুনো হাতির মত্ততার একটু বর্ণনা তুলে ধরা যায় এই সূত্রে লোভাতুরের মতো, ‘অনেক রাত্রে খচ্চরগুলোর ছুটোছুটিতে সকলের কুম ভেঙে গেছে। ব্যাপারখানা কী? এই ভেবে যেমন একজন খালাসি তাবুর দরজা ফাঁক করে গলা বের করেছে, আর অমনি দেখে- ওরে বাবারে, এয়া বড়ো দাঁতওয়ালা হাতি, তার পিছনে আরও হাতি। সে আস্তে আস্তে সকলকে সাবধান করে দিয়ে যেমন তাঁবুর পিছন দিয়ে বেরোতে যাবে অমনি হাতিও তাবুর ওপর এসে পড়ল। তখন সকলে গড়িযে গড়িয়ে খাদের ভিতর ঢুকে কোনো রকমে প্রাণ বাঁচাল, আর হাতিগুলো সেই রাস্তায় চলে কাল । তাঁবু-টাবু যা কিছু তাদের সামনে পড়েছিল, সব তারা শুঁড় দিয়ে ছুড়ে ছুড়ে খাদের মধ্যে ফেলে দিয়ে গেল। খচ্চরগুলোও রাস্তার উপর বাঁধা ছিল তারা সকলে দড়ি-টড়ি ছিঁড়ে পালাল, শুধু একটা খচ্চর মজবুত নতুন দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল, সে বেচারা পালাতে পারেনি। হাতিরা সেটাক পা দিযে মাড়িয়ে একেবারে পিষে দিয়ে গেল।’
এ রকম অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী লেখক। অকপটে বর্ণাঢ্য অথচ সরল ভাষায় বলে গেছেন জীবন-কাহিনী। পড়তে পড়তে বন-জঙ্গল, বাঘ-হাতি ভালুক-গন্ডারহীন আমাদের দেশে বসে ভাবি, সত্যিই এসব কি ঘটেছিল? কক্সবাজার বা আসাম বা পাশের অরণ্যে? সে অরণ্য এখন কোথাও নেই। শুধু আছে বইপত্রে, স্মৃতিতে, গাথা-কাহিনিতে – ‘বনের খবর’ বইতে। আজ থেকে ১১৩ বছর আগে এই সব ঘটেছিল প্রমদারঞ্জন রায় মহাশয় আমাদের জন্য লিখে রাখবেন বলে?
এই বইয়ের প্রচার ও প্রসার না থাকলেও সত্তর-আশি বছরে মাত্র দু বার মুদ্রিত হলেও ‘বনের খবর’ বাংলা সাহিত্যে দিকচিহ্ন বই হিসাবে অমর হযে থাকবে। আর এবার প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তৃতীয় মুদ্রণ। কোলকাতা থেকে ২০১১ সালে প্রকাশিত বইটি সংগ্রহ করে অ্যাডর্নের স্বত্ত্বাধিকারী সৈয়দ জাকির হোসাইনকে দেখাতেই তিনি উৎসাহী হয়ে পড়েন। পাঠকেরাও এ বই পড়ে রসসিক্ত হবেন এই বিশ্বাস আমার দুর্মর বলতে দ্বিধা নেই। একটুও।
‘বনের খবর’ আমার পড়া বিখ্যাত বইয়ের তালিকার প্রথম সারিতে স্থান নিয়ে নক্ষত্র হয়ে থাকবে। কিশোর ও বড়ো সবার জন্য সমান উপভোগ্য ও সহজ পাঠ্য বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত রায় পরিবারের সাহিত্যিক বংশে সবার মধ্যে আছে ভাষায় এই আশ্চর্য সরলতা বা প্রসাদগুণ।
প্রমদারঞ্জন রায়ের জন্ম মসুয়া, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশে। পিতা কালীনাথ রায়। তিনি ছিলেন আরবি, ফারসি ও সংস্কৃতে সুপন্ডিত। আর সুদর্শন। তাঁর ডাকনাম ছিল শ্যাম সুন্দর মুন্সী। তাঁর আটটি সন্তানের মধ্যে উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন তৃতীয় পুত্র। তাঁর পৈতৃক নাম কামদারঞ্জন রায়। পাঁচ বছরেরও কম বয়সে তাঁর পিতার অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায় চৌধুরী তাঁকে দত্তক নেন। তখন তাঁর নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (১০ই মে ১৮৬৩-২০ শে ডিসেম্বর ১৯১৫)। প্রমদারঞ্জন রায় (১৯ শে জুন, ১৮৭৪-১৯৪৯) পিতার আট সন্তানের মধ্যে তিনি কততম তা জানা যায় নি। তিনি কোলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট থেকে এন্ট্রাস (বর্তমান দশন শ্রেণি), মেট্রোপলিটন কলেজ থেকে এম. এ এবং শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সার্ভে পাশ। সরকারি জরিপ বিভাগে চাকরি ও এই বিভাগে জরিপের কাজে বেলুচিস্তান, শ্যাম ও বার্মায় কাজের অভিজ্ঞতা বড়ো ও ছোটোদের উপযোগী সহজ সরল ভাষায় লেখেন। সম্ভবত ১৯১৩ সাল থেকে উপেন্দ্রকিশোর রায় সম্পাদিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় তিন বছর ধারাবাহিক লিখতে থাকেন। এছাড়াও সন্দেশ পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। পরে এই বিখ্যাত সন্দেশ পত্রিকা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর সন্তান সুকুমার রায় (৩০ শে অক্টোবর, ১৮৮৭-১৯২৩) কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে বহু বছর প্রকাশ পায়। তাঁর ‘আবোল তাবোল’ শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বরং বিশ্বসাহিত্যে নিজস্ব জায়গার দাবিদার। তাঁর ‘চলচ্চিত্ত চঞ্চরী’ সর্বযুগের সেরা ‘ননসেন্স’ ধরনের ব্যঙ্গত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম।
উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ব্রাহ্ম সমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখীকে বিবাহ করেন। তিনি নিজেও ছিলেন ব্রাহ্ম। তাঁর পুত্র সুকুমার রায় চৌধুরী প্রথম জীবনে এই নামে লিখলেও পরে সুকুমার রায় নামেই লিখে সুবিখ্যাত। উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও সৌখিন জ্যোতির্বিদ। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়া রায় পরিবারের সঙ্গে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের সম্পর্ক ছিল। উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন। এই নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ রয় এন্ড সন্স নামে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুকুমার রায় যুক্ত ছিলেন। সুকুমার রায় ১৯০৬ সালে পদার্থবিদ্যায় বি. এসসি (অনার্স) করার পর মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেত যান। সেখানে আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর পড়াশুনো এবং কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। পিতা উপেন্দ্রকিশোরের মৃতুর পর ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা ও ছাপাখানার দায়িত্ব পালন করেন আট বছর। তাঁর মায়ের নাম বিধুমুখী। ছোটো দুই ভাই সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায়। তাঁরা সন্দেশ পত্রিকা ও প্রেসের সঙ্গে সুকুমার রায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
উপেন্দ্রকিশোরের কন্যা সুখলতা রাত্ত বাংলার সমাজকর্মী ছিলেন। শিশুসাহিত্যিক হিসাবেও তিনি বিখ্যাত। বেথুন কলেজ থেকে তিনি বি.এ ডিগ্রি নেন। পরে তিনি শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেন। ড. জয়ন্ত রাত্তকে বিবাহ করে উড়িষার কটকে বাসিন্দা হন। তাঁর রচিত শিশুতোষ গ্রন্থের সংখ্যা বারোটি।
এই পরিবারেরই বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক লীলা মজুমদার (ফেব্রুয়ারি ১৯০৮-এপ্রিল ৫,২০০৭) প্রমদারঞ্জন রায় ও সুরমাদেবীর কন্যা। উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন লীলা রায়ের (বিবাহের পর মজুমদার) জেঠা। সেই সূত্রে লীলা হলেন সুকুমার রায়ের খুড়তুতো বোন এবং সত্যজিৎ রায়ের পিসি।
সত্যজিৎ রায় (২রা মে, ৯২১-২৩ শে এপ্রিল ১৯৯২) বিশ্ববিখ্যাত সিনেমা পরিচালক হয়েও সাহিত্যিক হিসাবে সমধিক পরিচিত ও জনপ্রিয় একথা সবাই জানেন। তাঁর ছেলে সন্দীপ রায় পিতার বিখ্যাত গোয়েন্দা বই চলচ্চিত্রে রূপায়িত করে যশস্বী।
প্রমদারঞ্জন রায় ‘বনের খবর’ রচনা করে এবং উপেন্দ্রকিশোর থেকে ভাষা শৈলীর যে ধারা রচনা করে গেছেন তা তাঁদের পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে প্রবলভাবে পুষ্পিত ও ফলভারনত হয়ে উঠেছে বলা যায়। শিশু ও শিশু কিশোরদের জন্য রচিত তাঁদের সৃষ্টি বড়োদেরও সমান আনন্দ ও বিস্ময় সৃষ্টিকারী। অভিনয়, চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি, চলচ্চিত্র নির্মাণ, নাটক রচনা থেকে বইমুদ্রণশিল্প ও বইয়ের প্রচ্ছদ ইত্যাদি যাবতীয় মাধ্যম নিয়ে এই রায় পরিবার বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে অনন্য।
‘বনের খবর’ বইয়ের সমাপ্তি শুনবেন? লেখক লিখেছেন, ‘খালাসিটার কাছে আগের দিনের সব ঘটনা শোনা গেল। ওরা চার জন অন্য কুলিদের ছেড়ে একজন পিছনে একজন লাইন বেঁধে রাস্তা ধরে তরকারি আনতে যাচ্ছিল। যেখানে হাবিলদারের প্রথম রক্ত দেখেছিল, সকলের পিছনের লোকটিকে ওইখানে বাঘে ধরে। বাকি তিন জন ওই রাস্তায়-রাস্তায় ছুটতে আরম্ভ করে আর বাঘটাও পিছনে পিছনে তাড়া করে, একজনের পর একজন করে আরও দুজনকে মেরে ফেলে। ততক্ষণে সকলের আগের লোকটি ছুটে গিয়ে একটা গাছে উঠে প্রাণ বাঁচায়।’
‘এর পরের বছর আমি কলকাতায় বদলি হয়ে গেলাম আর জঙ্গলের কাজের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ সম্পর্ক ঘুচে গেল। সুতরাং আমার বক্তব্যও এখানে শেষ হয়ে গেল।’