মিল্টন বিশ্বাস ।।
‘ইনফার্নো’(২০১৩) ড্যান ব্রাউনের অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস। এটি তাঁর নায়ক রবার্ট ল্যাংডন সিরিজের চতুর্থ বই। ‘অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমনস’, ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ এবং ‘দ্য লস্ট সিম্বল’কে স্মরণে রেখে বলা যায় বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের বর্তমান ভয়াবহতার মধ্যে এই গ্রন্থটির প্রসঙ্গ বারবার মনে পড়ছে। ইনফার্নোকে সমালোচকরা কোড-বার্তা, শিল্প-ইতিহাস, বিজ্ঞান এবং আসন্ন সংকটের একটি অনবদ্য বই বলে অভিহিত করেছেন। ব্রাউন আখ্যানে জনকথার সাথে মিথ ও মানবরূপী দানবদের আকুল আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন এবং তাঁর উপন্যাসগুলিতে বিজ্ঞান ও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শিল্প-ইতিহাসকে বাস্তবতার নিরিখে তুলে ধরা হয়েছে। ‘ইনফার্নো’রেনেসাঁস শিল্পকলার সাথে সম্পর্কিত একটি উপন্যাস। আখ্যানে বলা হয়েছে ভেনিস হ’ল ‘বিশ্বের অন্যতম দর্শনীয় এবং অনন্য শহর’যদিও কাহিনি ফ্লোরেন্স এবং ইস্তাম্বুলে প্রসারিত। ব্রাউন লিখেছেন- ‘এই উপন্যাসের সমস্ত শিল্পকর্ম, সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং ঐতিহাসিক উল্লেখগুলি আসল।’ তাঁর সাক্ষাৎকাওর আছে- ‘আমার উপন্যাসে এত বেশি গবেষণা দরকার হয় যে আমি কাহিনি, জীবনী, প্রাচীন লিপির অনুবাদসহ যা পড়ি প্রায় সবই বাস্তব। যাই হোক, অল্প কয়েকজন সাহিত্যিক আমাকে অনুপ্রেরণা দেন, এরা হলেন জটিল পটভূমির জন্য লুডলাম, কাহিনি চিত্রণের জন্য স্টেইনবাক, এবং বুদ্ধিদীপ্ততার জন্য শেকসপীয়ার।’ প্রকৃতপক্ষে আলোচ্য উপন্যাসটির আখ্যানের একটি বড় অংশ ফ্লোরেন্সে সেট করা হয়েছে এবং ড্যান ব্রাউন ইতালির ইতিহাস ও ল্যান্ডমার্কগুলি খুব কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছেন। কাহিনির ভেতর একটি অনুসন্ধান আছে যে অনুসন্ধানটি নায়ককে অনেক উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্কগুলিতে নিয়ে যায়, যা মহাকবি দান্তের সাথে সম্পর্কিত। এই ল্যান্ডমার্কগুলির বিবরণ দীর্ঘ ও স্পষ্ট। লুকিয়ে রাখা ভাইরাসের ক্লু উদ্ধারের জন্য ল্যাংডনকে ভেনিস এবং ইস্তাম্বুলেও নিয়ে যাওয়া হয়। এই তিনটি শহরই, তাদের ইতিহাসের দিক থেকে খুব সমৃদ্ধ এবং অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। মূলত ইতালি এবং ইতিহাস- এই দু’টিই এই বইটিকে আরো বেশি জনপ্রিয় করেছে।
কাহিনি :
জটিল প্লটের কাহিনিতে রয়েছে একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী সত্তা- রবার্ট ল্যাংডন ও ডা সিয়েনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন একজন ছদ্মবেশী ঘাতক নারী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক ডা এলিজাবেথ এবং ছদ্মবেশী ব্যবসায়ী যিনি সাগরে ভাসমান বিশালাকার ইয়েটে দ্য কনসোর্টিয়াম নামে একটি সংস্থা পরিচালনা করেন যার ক্লায়েন্ট জোবরিস্ট যিনি বিজ্ঞানী এবং বিশিষ্ট ধনী প্রভৃতির সক্রিয় কর্মকাণ্ড লক্ষণীয়।
প্রারম্ভিক প্রদিপাদ্যে দেখা যায় হার্ভার্ডের অধ্যাপক রবার্ট ল্যাংডন আহত এবং অ্যামনেসিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের একটি হাসপাতালে ভর্তি। ঘাতক ভায়েন্থার ভয়ে সেখান থেকে ডা. সিয়েনা ব্রুকসের সহায়তায় পালিয়ে বাঁচেন তিনি। ল্যাংডন তার জ্যাকেটে বায়োহ্যাজার্ড চিহ্নসহ একটি সিলিন্ডার পান। তৈরি হয় রহস্যজনক পরিস্থিতি। সিলিন্ডারে একটি হাইটেক প্রজেক্টর লাগানো এবং তা দান্তের মহাকাব্য ‘ডিভাইন কমেডি’র প্রথম অংশ ‘ইনফার্নো’র নরক বর্ণনাকে ভিত্তি করে চিত্রিত বত্তিচেল্লির মানচিত্রের একটি পরিবর্তিত সংস্করণ প্রদর্শন করে। মানচিত্রটির রহস্য উন্মোচনে তারা বেরিয়ে পড়েন ফ্লোরেন্স শহরের প্রাচীন ইতিহাসের ভবনসমূহের মধ্যে। সেখানকার পালাজ্জো ভেচ্চিও এবং বোবোলি গার্ডেনের কাছে আত্মগোপন করে ‘নরকের মানচিত্রটি পরীক্ষা করেন। সিম্বোলজিস্ট ল্যাংডন পালাজ্জো ভেচ্চিওতে অবস্থিত ভাসারির ‘দ্য ব্যাটেল অফ মার্সিয়ানো’চিত্রকর্ম থেকে একটি বাক্যাংশ আবিষ্কার করেন। সেখান থেকে তারা তাদের পিছু নেওয়া গোপনবাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে ভাসারি করিডোর হয়ে ওল্ড সিটিতে প্রবেশ করেন।
পালাজ্জোতে আরো ঘটনা ঘটতে থাকে। জাদুঘরের ইগনাজিও বুসোনির সাথে দেখা করেন প্রফেসর। জাদুঘরের পরিচালক মার্থা আলভারেজ তাকে বলেছিলেন যে তিনি আগের রাতে তাদেরকে দান্তের ‘মৃত্যুর মুখোশ’ দেখিয়েছিলেন, যা হলটির নিচে একটি কক্ষে রাখা। সিকিউরিটি ফুটেজে দেখা যায় ল্যাংডন এবং বুসোনি মাস্কটি চুরি করেছেন। রহস্য জমাট বাধে মুখোশটি নিয়ে। সেটি এখন কোথায় আছে সেই বার্তাও পাওয়া যায় বুসোনির মরার আগে দেয়া প্রতীকী বর্ণনা থেকে।
ল্যাংডন এবং ব্রুকস প্রহরীদের হাত থেকে পালিয়ে যায় এবং উপস্থিত হয় ‘হল অব ফাইভ হান্ড্রেডের উপরে অর্থাৎ দ্য অ্যাপোথিওসিস অব কসিমোর(অর্ধ বৃত্তাকার ক্যানভাস) উপরে অ্যাটিক তথা চিলেকোঠাটিতে। তাদের আটক করতে গিয়ে সেখান থেকে পড়ে ভায়েন্থার মৃত্যু ঘটে।
বুসোনির বার্তা মোতাবেক দান্তের ‘প্যারাডাইজ ২৫’কান্তোর বাক্যটি ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর ব্যাপ্টিস্ট্রির সাথে সংযুক্ত করে, যেখানে ল্যাংডন ফ্লোরেন্সের পালাজ্জো ভেচ্চিওতে দান্তে আলিগিয়েরির মুখোশের বর্তমান মালিক ধনবান ও মেধাবী বিজ্ঞানী জোবরিস্ট নামে একজনের একটি ধাঁধার সাথে সম্পর্ক খুঁজে পান।
জোবরিস্ট একজন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার। যিনি মানুষের সংখ্যা বিকাশ বন্ধের পক্ষে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকায় ভাইরাস ছড়িয়ে তা কমাতে চান। ট্রান্সহিউম্যানিস্ট এই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী যিনি দান্তের ইনফার্নোসহ সকল সৃষ্টিকর্মের অন্ধ ভক্ত তিনি একটি ভাইরাস মুক্তি দিয়ে বিশ্বের অতিরিক্ত জনসংখ্যার সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে রয়েছেন। জীবদ্দশায় কনসোর্টিয়ামের(গোপন সংস্থা) মাধ্যমে ভাইরাসটির অবস্থান সুরক্ষিত করেন এবং আত্মহত্যার আগে একটি ভিডিও মিডিয়ায় প্রকাশের সময়সূচি দিয়ে যান। অনেক আগে থেকেই তাঁর গবেষণা, বিতর্কিত লেখালেখি ও বক্তৃতার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক জৈব-সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হন তিনি।
ল্যাংডন ফ্লোরেন্স থেকে ভেনিসের পথে জোবরিস্টের ধাঁধার উত্তর অন্বেষণ করতে রওনা দেন। ভেনিসের সেন্ট মার্কসের ব্যাসিলিকায় একদল কালো পোশাক পরিহিত সৈন্য তাকে ধরে ফেলে। সেখানে ল্যাংডনকে ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক ডা এলিজাবেথ সিনস্কির সাথে সাক্ষাৎ করানো হয়। কারণ প্রথম থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, একটি ছোট প্রজেক্টর যা দান্তের নরকের দর্শনীয় চিত্রের সিম্বল সম্বলিত ছিল- রবার্ট ল্যাংডন সেই প্রতীকগুলি ব্যাখ্যা করতে, সংকেতগুলি খুঁজে পেতে এবং একটি দুর্যোগ থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে সচেষ্ট। আর তার সাহায্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু- এর খুব প্রয়োজন।
আগেই লিখেছি, সপ্তাহখানেক আগে আত্মহত্যা করা জোবরিস্ট ছিলেন মানুষের বংশবিস্তার-বিদ্বেষী কিন্তু দান্তে প্রেমিক; যিনি ধারণা করেছিলেন একটি নতুন জৈবিক ‘প্লেগ’ ছড়ানোর যা বিশ্বের অতিরিক্ত জনসংখ্যার সমস্যাটি দ্রুত সমাধান করবে- জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশে বন্ধ্যাত্ব ঘটানো গেলে। ফ্লোরেন্সে সিনস্কি জোবরিস্টের সেফ ডিপোজিট বাক্সে অভিযান চালিয়ে ওই সিলিন্ডারটি খুঁজে পেয়েছিলেন এবং ক্লু অনুসরণ করার জন্য প্রফেসরকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে ঘটনা পরম্পরায় দেখা যায়, ল্যাংডন জোবরিস্টের সাথে কাজ করছেন এই সন্দেহ হওয়ায় তাকে ডা এলিজাবেথ পাকড়াও করেন।
জোবরিস্ট যেমন একটি নির্দিষ্ট তারিখ অবধি সিলিন্ডার রক্ষার জন্য কনসোর্টিয়াম নামে একটি পরামর্শদাতাকে অর্থ দিয়ে তার কাজ উদ্ধারে তৎপর ছিলেন তেমনি তিনি একটি আতঙ্কজনক ভিডিও রেখেছিলেন, যাতে দেখা যায় আস্তে আস্তে দ্রবীভূত জলের তলে ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে রাখা জীবাণুর চিত্র। ভিডিওটিতে দাবি করা হয়েছে যে একদিন সকালে বিশ্বকে পরিবর্তন করা হবে। এই ভিডিওটির ভয়ঙ্কর দিক বিবেচনা করে কনসোর্টিয়ামের প্রধান প্রভোস্ট ডা এলিজাবেথকে বিষয়টি জানান এবং তাদের সহযোগিতা প্রদান করতে সম্মত হন। সিনস্কির সাথে মিত্রতা হওয়ায় তারা যৌথভাবে ডা ব্রুকসকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ব্রুকস জোবরিস্টের একজন গোপন সমর্থক এবং প্রেমিকা যা ল্যাংডন নিজেও জানতেন না। ফলে ল্যাংডন, ডব্লিউএইচও এবং কনসোর্টিয়াম দল জোবরিস্টের ভিডিও অনুসারে প্লেগযুক্ত ব্যাগটির অবস্থান নির্ণয়ে সচেষ্ট হন। জানা যায়, ভিডিওতে নির্দিষ্ট করা তারিখের সাথে ভাইরাসটি পুরোপুরি দ্রবীভূত হয়ে যাবে এবং জীবাণু ছড়াবে। দান্তের কবিতার সূত্রগুলি অনুসরণ করে এনরিকো দানদোলোর সমাধি খুঁজে বের করতে ইস্তাম্বুলের হাজিয়া সোফিয়ায় উপস্থিত হয় পুরো টিম। জীবাণুর ব্যাগটি বাসিলিকা সিস্টার্নের অভ্যন্তরে জলের মধ্যে খুঁজে পান তারা। তবে পৌঁছানোর আগে দেখা যায় ইতোমধ্যে সেটি ফেটে গেছে, সম্ভবত পর্যটকদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে ‘জোবরিস্ট ভাইরাস’।
অর্থাৎ এক সপ্তাহ আগে জোবরিস্টের ভাইরাস পাতালের জলে দ্রবীভূত হয়েছে যার অর্থ পুরো বিশ্ব ইতোমধ্যে সংক্রামিত। জোবরিস্টের ভিডিওতে নির্দিষ্ট তারিখটি ছিল- কখন গোটা বিশ্ব সংক্রামিত হবে তার গাণিতিক গণনা। এটিও আবিষ্কার হয় ডা ব্রুকস নিজেই ভাইরাসটি বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন, তবে ডব্লিউএইচও তা বিশ্বাস করেনি কারণ ভাইরাসের নমুনাগুলি অবশ্যই অস্ত্র গবেষণা চালিয়ে যাওয়া সরকারগুলির হাতে পড়লে তারা তাদের জীবাণু অস্ত্রের পথ খুঁজে পাবে। ডা ব্রুকসের জোবরিস্টের গবেষণা এবং কাজের বিষয়ে বিস্তৃত জ্ঞান থাকার কারণে পৃথিবীর সংকট মোকাবিলার জন্য ডব্লিউএইচএও-র সাথে কাজ করার বিনিময়ে সাধারণ ক্ষমা পান। আসলে কনসোর্টিয়ামের হয়ে কাজ করেছিলেন এই চিকিৎসক জোবরিস্টের প্রাক্তন প্রেমিকা সিয়েনা। তিনি ল্যাংডনকে জোবরিস্টের তৈরি ভাইরাসটি খুঁজে পেতে সহায়তা করেছিলেন, তবে জোবরিস্টের সাথে তার অতীতের সম্পর্ক উপন্যাসে শেষ অবধি ল্যাংডনের প্রতি তার আনুগত্যকে সন্দেহজনক করে তুলেছে। তিনি জোবরিস্টের অনুগত শিষ্য ছিলেন যতক্ষণ না তিনি তার শেষ চিঠিটি পড়েছিলেন এবং তার নতুন প্রযুক্তিটি ভুল হাতে পড়ার আগেই তার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জোবরিস্টের নতুন ভাইরাসকে অস্ত্রের জন্য ব্যবহার করতে অন্যান্য সরকারি সংস্থাকে সহযোগিতা করবে। তিনি কনসোর্টিয়াম এবং ল্যাংডনের সাহচর্যে থেকে নরকের মানচিত্র অনুসরণ করে সবার আগে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন যে জোবরিস্ট আগে থেকেই তার ভাইরাসকে মুক্তি দেওয়ায় একটি নিরর্থক অনুসন্ধানে তারা নিয়োজিত।
জোবরিস্ট যে প্লেগটি তৈরি করেছিলেন তা ‘ভেক্টর ভাইরাস’ হিসেবে পরিচিত যা মানবদেহে এলোমেলোভাবে ডিএনএ সংশোধন কাজে নিযুক্ত করে। মানুষের এক তৃতীয়াংশের মধ্যে জীবাণু বজায় রাখার ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি আরও স্থিতিশীল স্তরে নিয়ে হ্রাস করে। সিনস্কি জোবরিস্টের গবেষণার ফলাফলকে ভয়ঙ্কর বলেই মনে করেন এবং ব্রুকসকে জোবরিস্টের অতিরিক্ত জনসংখ্যার ঝুঁকি সম্পর্কে ভাইরাস বিস্তার থেকে রক্ষা পাবার উপায় বের করার জন্য আহ্বান জানান।
উপন্যাসের কাহিনি স্থান-কাল আকর্ষণীয় বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষত চরিত্রগুলোর বিচরণ ক্ষেত্র ও অবিরাম প্যাসেজওয়েগুলি ইতিহাসের গ্রন্থি বিজড়িত করে এগিয়েছে। ল্যাংডন ও সিয়েনা চলতে চলতে যেমন একটি সেতুর ইতিহাস স্মরণ করেন তেমনি ফ্লোরেন্স কিংবা ভেনিসের সুন্দর স্থাপনাগুলোর বর্ণনা দেন। ইস্তাম্বুলেও সেই একই ইতিহাসের দিকে পাঠককে চোখ ফেরাতে বাধ্য করেন। বর্ণনা সত্ত্বেও উপন্যাসটি ইতালি কিংবা তুরস্কের শিল্প-ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত নয়, তবে বিজ্ঞানের ভবিষ্যতের সাথে- জনসংখ্যা বিস্ফোরণ এবং পৃথিবীর প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে খুব বাস্তব প্রশ্ন উপস্থাপিত। ইতালির রাস্তা কিংবা অলিতে-গলিতে নয় শেষ পর্যন্ত জেনেভায় জনস্বাস্থ্য সম্মেলনে কাহিনিটি শেষ হয়। অর্থাৎ এই উপন্যাসের সব ইতিহাস, চিত্রকর্ম, প্রাচীন দলিল, এবং গূঢ় আচারানুষ্ঠান বাস্তব। মধ্যযুগের কোডগুলোর একাডেমিক ইন্টারপ্রেটার রবার্ট ল্যাংডন ব্রাউনের পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলিতে প্যারিস, রোম এবং ওয়াশিংটনে ছুটে বেড়িয়েছেন। এই উপন্যাসে তাঁর যাত্রাপথ ফ্লোরেন্স পেরিয়ে ভেনিস পর্যন্ত, পরে ইস্তাম্বুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে।
চরিত্র :
উপন্যাসের কাহিনির বিশ্লেষণ থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিম্বলজিস্ট প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডনকে মোকাবেলা করতে হয় এক শয়তান সায়েন্টিফিক জিনিয়াস বারট্রান্ড জোবরিস্টকে, যিনি বিশ্বাস করেন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা থেকে সৃষ্ট সমস্যা দূর করার একমাত্র উপায় হল পৃথিবী থেকে একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। আখ্যানের এই দু’জনই ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করেন তিনিই পৃথিবীকে বাঁচাচ্ছেন। কিন্তু জোবরিস্ট যে ঠিক কাজটি ভ্রান্ত ফল লাভের জন্য করেন সে বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলা ড্যানের কিছু কথা এরকম- I find the most interesting villains [are] those who do the right things for the wrong reasons, or the wrong things for the right reasons- either one is interesting. I love the gray area between right and wrong. অথচ পৃথিবীর জনবহুলতা কমানোর জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে জোবরিস্ট ভেবেছেন তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিশ্বকে রক্ষা করতে পারেন। কাহিনিতে জোবরিস্ট ফ্ল্যাশব্যাকে চিত্রিত হয়েছেন যিনি বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতায় একটি খল চরিত্র হিসেবে কাজ করেছেন। জোবরিস্ট আশঙ্কা করেছিলেন অতিরিক্ত জনসংখ্যা মানবজাতির আসন্ন ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মানবপালকে পাতলা করার জন্য। উদ্দেশ্য সফল করার জন্য, এমন একটি জীবাণু স্থাপন করেন যাকে বলা যায় তার উদ্ভাবিত নতুন প্লেগ ভাইরাস। ভাইরাসটির উৎস সনাক্ত করতে এবং এটির ক্ষতি থেকে মানবজাতিকে রক্ষার জন্য জোবরিস্টের পিছনে ফেলে রাখা দান্তের ইনফের্নোভিত্তিক ক্লুগুলি অন্বেষণ করেছেন ল্যাংডন। লেখক ড্যান ব্রাউন বারবার বোঝান যে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা সঙ্কট সমাধানে তুলনামূলকভাবে কঠোর পদ্ধতির জন্য কিছু বলা দরকার, যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ব্যর্থ প্রচেষ্টার সাথে তুলনা করা হয়। যখন ভাটিকান চার্চের অস্বস্তিকর হস্তক্ষেপে পরিবার পরিকল্পনার কর্মসূচি ভেস্তে যায়। একদিকে ‘হু’-এর ব্যর্থতা অন্যদিকে জোবরিস্টের তৎপরতার মাঝে নায়ক ল্যাংডন তাঁর ত্রাণকর্তার ভূমিকা নিয়ে আবির্ভূত হন। উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে- জোবরিস্টের মাধ্যমে পৃথিবীতে এক মরণব্যাধির উদ্ভব ঘটেছে যার ফলে প্রায় অর্ধেক লোক মারা যেতে পারে। এ ভয়াবহ পরিণতি থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে পারে একমাত্র ল্যাংডন।
প্লেগ’ ও ‘কোয়ারান্টাইন’ :
একসময় ব্ল্যাক ডেথের কবলে পড়ে ইতালির ভেনিস ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। অথচ মধ্যযুগে ভেনিস ছিল পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর, সম্পদশালী এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ একটি শহর। এর সমক্ষক আর একটিও ছিল না। ‘ইনফার্নো’উপন্যাসে ইতালির ভেনিস শহরে ত্রয়োদশ শতাব্দীর ‘প্লেগ’ ও ‘কোয়ারান্টাইন’ সম্পর্কে ব্রাউন লিখেছেন- ‘এই শহরের অধিবাসীদের বিদেশপ্রীতিই এর সর্বনাশ ঘটিয়েছে- প্রাণঘাতি প্লেগ চীন থেকে ভেনিসে চলে আসে বাণিজ্যিক জাহাজের মালামালের সাথে জীবাণু আক্রান্ত ইঁদুরের মাধ্যমে। এই প্লেগের মরণ ছোবলেই চীনের এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা বিনাশ হয়ে গিয়েছিল। ইউরোপে আসামাত্র এই রোগের ছোবলে প্রতি তিনজনের একজন আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে- নারী-পুরুষ, যুবা-বৃদ্ধ, ধনী-গরিব কেউ বাদ যায় নি।…
একটা সময় এসেছিল যে মৃতদের কবর দেয়ার মতো শুকনো জায়গা পাওয়া যেতো না। উপয়ান্তর না দেখে লাশ ভাসিয়ে দেয়া হতো খাল-বিলে। কিছু কিছু খাল-বিলে এতো লাশ ভাসতো যে নৌকা চালাতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হতো। লগি-বৈঠা দিয়ে লাশ সরিয়ে মানুষকে চলাচল করতে হতো। কোনো প্রার্থনায় এই মহামারির প্রকোপ কমতো না।
শহরের শাসকরা যখন বুঝতে পারল ইঁদুরের মাধ্যমেই এই দুর্বিপাকের শুরু ততোক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তারপরও একটা নির্দেশ জারি করে তারা। বাইরে থেকে কোনো জাহাজ বন্দরে ঢুকতে পারবে না, বন্দর থেকে বেশ কিছুটা দূরে চল্লিশ দিন থাকার পর জাহাজগুলোকে মালামাল নামানোর অনুমতি দেয়া হতো- আজকের দিনে ইতালিয় ভাষায় চল্লিশ সংখ্যাটি ‘কোয়ারান্তা- খুব তিক্ত স্মৃতি বহন করে ‘কোয়ারান্টাইন’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।’ (অধ্যায় ৬৮)
জোবরিস্ট ভাইরাস :
ড্যান ব্রাউনের ‘ইনফার্নো’তে কেবল জোবরিস্ট ভাইরাস নয় বরং ভাইরাসের প্রাথমিক রূপ অনুপুঙ্খ বর্ণনায় উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন- ‘একটি ভাইরাস মানুষের মাঝে বিস্ময়কর গতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। পরজীবী হিসেবে ভাইরাসগুলো প্রাণিদেহে প্রবেশ করে কোনো কোষের মধ্যে আস্তানা গাড়ে। তারপর এগুলো নিজেদের আরএনএ কিংবা ডিএনএ প্রবেশ করায় হোস্ট কোষের মধ্যে। দখল করে নেয়া কোষকে বাধ্য করে জ্যামিতিক হারে তাদের প্রতিরূপ তৈরি করতে। যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিরূপ তৈরি হবার পর তারা সম্মিলিতভাবে কোষকে মেরে ফেলে, কোষের প্রাচীর ভেত করে ঢুকে পড়ে নতুন হোস্ট কোষে। এভাবে একই কাজ করে যেতে থাকে তারা।
আক্রান্ত ব্যক্তি তখন দুর্বল হয়ে পড়ে, শ্বাস-প্রশ্বাস কিংবা হাঁচির মাধ্যমে শরীরের ভেতরে থাকা ভাইরাস নির্গত করে দেয় বাইরে। এসব ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ায় যতোক্ষণ না অন্য কারোর নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকে পড়ে। একবার ঢুকতে পারলে সেই একই কাজ শুরু করে দেয় আবার।’(অধ্যায় ৯৮)
এই ভাইরাস নিয়ে গবেষণায় অগ্রগামী বিজ্ঞানীরা। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার জোবরিস্টের কাছে ‘মানবজাতি ক্যানসারের মতো।’ ফলে মানবজাতি নিশ্চিহ্ন হওয়া দরকার। তাই দান্তের ‘ইনফার্নো’কে মাথায় রেখে তিনি বানান ইনফার্নো-ভাইরাস। দান্তে তাঁর ‘ইনফার্নো’তে নরকের নয়টি ভাগ করেছেন, আলাদা স্তরে পাপীদের ‘শাস্তি’র বর্ণনা আছে সেখানে। তার সঙ্গে মিলিয়েই প্রাক-রেনেসাঁ যুগে বত্তিচেল্লি’র আঁকা ‘ম্যাপ অফ হেল’ ছবিটির ‘ইমপোজিশন’ তৈরি করেছিলেন তিনি। তার সেই ইঙ্গিতময় বক্তব্য উদ্ধার করার জন্য সচেষ্ট হন ল্যাংডন। তবে জোবরিস্টের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছিল একটি গুপ্ত সংস্থা। সংস্থাটি শক্তিশালী জোবরিস্টের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করা থেকে শুরু করে সবকিছু সামলায়। বিশ্বের অনেক দেশের রাজনীতি-অর্থনীতিও নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের ক্ষমতা অসীম। যে কোনও সরকারের উত্থান-পতন ঘটাতে পারে তারা। জোবরিস্টের মানবজাতির বিরুদ্ধে প্রচারিত ভিডিওটি দেখে সেই সংস্থার প্রধানের ভাবনা পাল্টে যায়। এলিজাবেথ ও ল্যাংডনদের দলে ভিড়ে জোবরিস্টের ভাইরাস অন্বেষণে ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের সঙ্গে কাজ করে। মানবসমাজের স্বাস্থ্য বাঁচাতে ভাইরাস নাশ করতে চায়।
আত্মহত্যা করার আগে বারট্রান্ড জোবরিস্ট ‘মেন্দাসিয়ামে’র অবস্থিত গুপ্ত সংস্থাটির প্রভোস্টকে যে ভিডিও দিয়ে গিয়েছিল তাতে দেখা যায় জোবরিস্ট প্লেগ ডাক্তারের পোশাক পরা আর কথার মধ্যে দান্তের ইনফার্নোর রেফারেন্স দিচ্ছেন। কালো আলখেল্লা আর পাখির ঠোঁটের মতো নাকওয়ালা মুখোশ নিয়ে তিনি বলে চলেন-‘নরকের সবচাইতে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গাটি তাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে যারা ভালো আর মন্দের সংঘাতের সময় নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখে।’জোবরিস্ট প্লেগ ভাইরাস ছড়ানোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন অন্ধকার কিন্তু জনসমাবেশ স্থল।
জোবরিস্ট ছিলেন ট্রান্সহিউম্যানিস্ট আন্দোলনে বিশ্বাসী। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে উদ্ভূত এই আন্দোলনের মূল বক্তব্য হলো মানুষের উচিত সব ধরনের প্রযুক্তি আর টেকনোলজি ব্যবহার করে নিজের প্রজাতিকে আরো বেশি উন্নত আর শক্তিশালী করা- যোগ্যতরদের টিকিয়ে রাখার জন্য। এই আন্দোলন এক ধরনের বিজ্ঞানী, ভবিষ্যদ্রষ্টা আর দূরদর্শী ব্যক্তিদের একত্রিত করে। তবে এই গোষ্ঠীর ভেতরও ক্ষুদ্র একটি মিলিট্যান্ট গোষ্ঠী আছে। যারা বিশ্বাস করেন খুব শীঘ্রই পৃধিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য কাউকে না কাউকে কঠিন একটি পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থাৎ উগ্রবাদিতার মধ্য দিয়ে জনবহুল পৃথিবীকে বাঁচানোর চেষ্টায় তারা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারের জ্ঞানকে ব্যবহার করেন। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং হলো মানুষের অগ্রগতির একটি ধাপ। ডা. সিয়েনা উপন্যাসের ১০২ অধ্যায়ে বলেছেন- ‘মূলধারার ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছে ট্রান্সহিউম্যানিস্ট আন্দোলন। এর মূল প্রতিপাদ্যগুলোর একটি হলো, নিজেদের বির্বতনে অংশগ্রহণ করা আমাদের মানব সম্প্রদায়ের একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা… প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের প্রজাতিটিকে উন্নত করা, আরো ভালো মানুষ সৃষ্টি করা- স্বাস্থ্যবান, শক্তিশালী এবং আরো বেশি কার্যকরী মস্তিষ্ক। এসবই খুব জলদি সম্ভব হয়ে উঠবে।’ এজন্যই জোবরিস্ট ভিন্নভাবে জনসংখ্যা কমিয়ে আনার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
আত্মহত্যার আগে ইস্তাম্বুলের হাজিয়া সোফিয়ার ভূগর্ভস্থে সপ্তাহব্যাপী দান্তের সিম্ফোনির ব্যবস্থা করে যান জোবরিস্ট। তার টার্গেট ছিল এক সপ্তাহের ফ্রি কনসার্ট দেখতে হাজার হাজার পর্যটক এসে মাটির নিচে গাদাগাদি করে কনসার্ট দেখবে, ওখানকার জীবাণুবাহিত বাতাস নেবে নিঃশ্বাসে, তারপর ফিরে যাবে যার যার দেশে। ফলে পানিতে থাকা ব্যাগটি যখন ফেটে যায় তখন তার ভেতরে থাকা প্রাণঘাতি জীবাণু মিশে যায় পানিতে। ক্রমান্বয়ে বুদবুদ হয়ে জলাধারের পানি থেকে উঠে আসে উপরে। জীবাণুগুলো এক সপ্তাহ ধরে ছড়িয়ে পড়ে ভূ-গর্ভের বিস্তৃত জায়গায়।
দেখা যায়, জোবরিস্ট ভাইরাসের জ্যামিতিক হারের বৃদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে জনসংখ্যার জ্যামিতিক হারের সাথে লড়াই করেছেন। কারণ পৃথিবীর বিপুল জনসংখ্যাকে দিগন্তের উপর ঝুঁকে থাকা দানবের সাথে তুলনা করতেন তিনি। বিশ্বাস করতেন, এই দানব আমাদের সবাইকে গিলে খাবার আগেই থামানো দরকার। আর সেটা করতে হবে এক্ষুণি। এজন্য জোবরিস্ট যে ভাইরাস ছড়িয়েছেন সেটা প্লেগ নয় বরং নতুন কিছু। আসলে জোবরিস্ট প্রজননবিনাশী একটি প্লেগ সৃষ্টি করেন; যা মারাত্মক ছোঁয়াচে। তার ভাইরাস সম্পর্কে ডা. সিয়েনা বলেছেন- ‘বারট্রান্ড যেটা সৃষ্টি করেছেন সেটাকে বলে ভাইরাল ভেক্টর। এটা এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যে কোষে এই ভাইরাস আক্রমণ করবে সেটাতে একটি জেনেটিক তথ্য ইন্সটল করে দেবে। ভেক্টর ভাইরাস কোনো কোষকে মেরে ফেলে না বরং সেই কোষে আগে থেকে ঠিক করে দেয়া ডিএনএ প্রবেশ করিয়ে দেয়, এভাবে পুরো কোষটার জেনোম রূপান্তর করে ফেলে। মানুষ টেরই পাবে না যে ওটা আমাদেরকে সংক্রমিত করেছে। কেউ এর জন্য অসুস্থ হবে না। ওটা যে আমাদেরকে জেনেটিক্যালি বদলে দিচ্ছে সেটা বোঝার কোনো উপায়ই থাকবে না। কোনো সিমটম ধরা পড়বে না পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। এই ভাইরাসটা আমাদের শরীরে ঢুকে আমাদের প্রজনন ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে দেয়।’ (অধ্যায় ৯৯)
প্লেগের চেয়ে এই ভাইরাসের ফলাফল অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। ব্ল্যাক ডেথ বা প্লেগ ইউরোপের এক তৃতীয়াংশের মতো জনসংখ্যা হ্রাস করেছিল। প্লেগের আক্রমণে প্রতি তিনজনের একজনের মৃত্যু হয় যা জনসংখ্যা কমিয়ে দেবার জন্য যথার্থ ছিল। জনসংখ্যার ঘনত্ব কমায় ১৩৫০ সালের পর রেনেসাঁস সম্ভব হয়েছিল ইউরোপে। পক্ষান্তরে ট্রান্সহিউম্যানিস্ট ব্ল্যাক ডেথ হলো কোনো প্রাণহানি না ঘটিয়ে শুধু প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ মানুষের উপর এর ক্রিয়া লক্ষ করা যাবে। বাকি দু’ভাগ আগের মতোই রয়ে যাবে। কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আবার তিন ভাগের এক ভাগ জন্ম নেবে প্রজনন ক্ষমতাহীন হয়ে। এভাবেই চলতে থাকবে ভবিষ্যৎ বিশ্ব। ফলে জনসংখ্যা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে একটা সময়।
এভাবে জোবরিস্ট জনসংখ্যা কমানোর দীর্ঘমেয়াদি একটি সমাধান দিয়েছেন। তিনি ছিলেন জার্ম-লাইন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু তার এই আবিষ্কার আমাদের বিশ্বকে ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। কারণ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসকে জেনেটিক ভেক্টর হিসেবে ব্যবহার করলে সেটা হয়ে উঠবে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচাইতে শক্তিশালী মারণাস্ত্র। এটা দিয়ে খুব সহজে টারগেটেড বায়োলজিক্যাল অস্ত্র বানানো সম্ভব। ফলে তা একটি নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর ওপর প্রয়োগ করে এথনিক ক্লিনজিং করা সম্ভব। কিন্তু এটি দিয়ে রোগপ্রতিরোধক ভ্যাকসিন বানানোও সম্ভব হতে পারে। তবে মানুষের জেনেটিক কোডে রয়েছে সীমাহীন রাসায়নিক পরিবর্তনের গোলকধাঁধা। একটি জিনে সামান্যতম পরিবর্তন দেহের মধ্যে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে- ক্যান্সার, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ফেইলিওর এবং রক্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তার ভাইরাস আমাদের ডিএনএ বদলে দেবে বলেই এই ভয় উপন্যাসের চরিত্র ডা. এলিজাবেথের। সিয়েনা যেহেতু জোবরিস্টের সৃষ্টি সম্পর্কে জানেন সেজন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যালয়ে। ‘জোবরিস্ট ভাইরাস’টিকে নিষ্ক্রিয় করা কিংবা আমাদের ডিএনএ আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার প্রত্যয় দিয়ে উপন্যাসটি শেষ হয়।
উপসংহার
ড্যান ব্রাউনের ‘ইনফার্নো’উপন্যাসে দেখা যায় ‘জোবরিস্টের ভাইরাস’-এর বাহক হলো নিরীহ মানবগোষ্ঠী। মানবদেহের কোষে অনুপ্রবিষ্ট এই ভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মেধাবী বিজ্ঞানীদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল তারও দৃষ্টান্ত কাহিনির শেষে লক্ষ করা যায়। অথচ উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখেছি, রবার্ট ল্যাংডন ইতালির ফ্লোরেন্সের একটি হাসপাতালের ঘরে জেগে উঠার পর আবিষ্কার করেছিলেন যে তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা- ‘দ্য কনসোর্টিয়াম’-এর লক্ষ্যবস্তু। তিনি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন ফ্লোরেন্সে তিনি কী করছেন? তিনি এখানে কীভাবে এলেন? কে তাকে হত্যার চেষ্টা করছে? ইত্যাদি। তাকে বত্তিচেল্লি ‘লা মাপা হেল’ ‘ইনফার্নো’ অবলম্বনে সৃষ্ট এই মানচিত্র বোঝাতে হবে। চিকিৎসক সিয়েনাসহ ক্লু উন্মোচন করার সাথে সাথে ল্যাংডন আবিষ্কার করলেন যে একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী বিশ্বের বেশি জনসংখ্যার সমস্যা সমাধানের জন্য ইউরোপের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মুছে ফেলার এক অন্যতম ধ্বংসাত্মক দুর্ঘটনা “ব্ল্যাক ডেথ”-এর মতন প্রচেষ্টা নিয়েছেন। তবে ধরা পড়ল যে বিজ্ঞানী আত্মহত্যা করেছেন এবং ভাইরাসটি অজানা স্থানে লুকিয়ে রেখে গেছেন। অবস্থানটির সংকেতগুলি দান্তে এবং ইনফার্নোর সাথে সম্পর্কিত সমস্ত চিহ্নগুলির অনুক্রমের মধ্যে এনক্রিপ্ট করা হয়েছে, যা ল্যাংডন ক্রমান্বয়ে উন্মোচন করেন। কিন্তু তার আগেই ‘জোবরিস্ট ভাইরাস’ছড়িয়ে যায় বিশ্বব্যাপী। করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ও নিরীহ মানুষের মৃত্যুর দিনে ‘ইনফার্নো’ আমাদের আশাবাদী করে তুলতে পারে।
(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)