২০২০ সালের ১৪ জুন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ৭৪তম জন্মদিন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জলোচ্ছ্বাস’(১৯৭২), প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’(১৯৬৯)। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘বিষণ্ন শহরের দহন’ এবং ‘সময়ের ফুলে বিষপিঁপড়া তাঁর ৪৫ ও ৪৬তম উপন্যাস। আর ২০১৮ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ হলো ‘রক্তফুলের বরণডালা’। তাঁর ‘আগস্টের এক রাত’ (২০১৩) ও ‘সাতই মার্চের বিকেল’ (২০১৮) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে রচিত আবেগী কথামালার বিন্যাস। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’(১৯৭৬), ‘যুদ্ধ’(১৯৯৮), ‘গেরিলা ও বীরাঙ্গনা’(২০১৪) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অন্যতম উপন্যাস। অখণ্ড ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’তেও বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ উপস্থাপিত হয়েছে। প্রকাশিত গল্প-উপন্যাসগুলোর অধিকাংশ পাঠ করলে এই ঔপন্যাসিকের জীবনদৃষ্টিতে ইতিবাচক প্রত্যয় লক্ষ করা যায়; উজ্জীবিত হওয়া যায় তাঁর বাঙালির প্রতি মমত্ববোধ দেখে। তিনি আমাদের জাতীয় জীবনের সকল শুভ প্রয়াসের পূজারি। বিষয় ও চরিত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের জগৎ ছুঁয়ে তিনি আমাদের আধুনিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গহীনে প্রবেশ করেছেন অবলীলায়। ব্রিটিশ ভারতের সন্ত্রাসবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন ও দেশভাগ, পূর্ব পাকিস্তানের তেভাগা এবং ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বৃহৎ কালপর্বে তিনি ব্যক্তিক ঐতিহ্য স্মরণ করেছেন। এজন্য কাহ্নু পা, চাঁদ সওদাগর, কালকেতু-ফুল্লরা যেমন তাঁর উপন্যাসের চরিত্র তেমনি ইলা মিত্র, প্রীতিলতা, মুনীর চৌধুরী, সোমেন চন্দ, রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্যে উদ্ভাসিত পাত্রপাত্রী। মিথ-ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাইরে তিনি গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে সাধারণ মানুষের কথাও লিখেছেন। আবার নাগরিক জীবনের মনস্তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ করেছেন কাহিনির বিচিত্র গতিসূত্রে। উপরন্তু ব্যবচ্ছেদ হওয়া বেদনার কথাও তাঁর শৈল্পিক নির্মিতিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে তিনি ব্যক্তিগত শোকের স্নিগ্ধ সরোবরে অবগাহন করেছেন আবার বিএনপি-জামায়াত জোটের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে অপদস্ত মানুষ ও নারী নির্যাতনের কাহিনি কুশলি বিন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। বিষয় বৈচিত্র্য তাঁর কথাসাহিত্যের একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রান্ত। আর কেন্দ্রীয় চরিত্র কিংবা কেন্দ্রীয় ঘটনার বক্তব্যে তিনি সদর্থক জীবনের জয় ঘোষণায় অকুণ্ঠ। কথাসাহিত্যে তিনি দেখিয়েছেন মানুষের মর্মান্তিক ক্ষরণ ও যন্ত্রণা; অপমৃত্যু ও অসীম বেদনা; সকল শুভ প্রয়াসের অন্তর্ধান তবে এসবই তাঁর উপন্যাস কিংবা গল্পের শেষ পরিণতি নয় বরং তা থেকে উত্তরণের পথ উজ্জ্বল শিখায় বর্ণময় হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি শেষ পর্যন্ত জীবনের কথাই বলেন; জীবন থেকে পলায়নের নয়। বর্তমানে স্বপ্ন দেখানোর মানুষ কমে গেছে; হতাশার জয় ঘোষিত হচ্ছে চারিদিকে। এ পরিস্থিতিতে সেলিনা হোসেনের কথাসাহিত্য মানব জীবনের ইতি-নেতির গল্পের ধারায় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিজয় হিসেবে বিশিষ্ট। উল্লেখ্য, দুই বাংলায় তিনিই প্রথম মির্জা গালিবকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন; বঙ্গবন্ধুকে উপন্যাসের আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন। উভয় বাংলায় ছিটমহল নিয়ে প্রথম উপন্যাস রচনার কৃতিত্বও তাঁর। পূর্ববঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথকে আখ্যানে উপস্থাপনও তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম। ‘পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলাদেশ : রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু’ একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।তাঁর জন্ম ১৪ জুন ১৯৪৭; রাজশাহী শহরে।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, কবি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস।
মিল্টন বিশ্বাস : কেমন আছেন এই ৭৪ বছর বয়সে?
সেলিনা হোসেন : করোনা মহামারির আতঙ্কের মধ্যে অস্টোইওরেসিস রোগে ভুগছি; হাড়ের ক্ষয় হচ্ছে। ডাক্তারের নিষেধ আছে একটানা বসে কাজ করার। তবু লিখতে হচ্ছে। সুস্থ থাকার সব নিয়ম মেনে চলতে পারছি না। তবে ব্যাধির সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই গৃহবন্দি জীবন। নতুন উপন্যাস লেখার কাজ করছি।
মিল্টন বিশ্বাস : লেখক হওয়ার প্রস্তুতি পর্বটা কেমন ছিল?
সেলিনা হোসেন : প্রত্যেক লেখকের তো একটা প্রস্তুতি পর্ব থাকে, আমারও ছিল। তবে আমি লেখালেখির সূচনায় গাদা গাদা বই পড়ে লিখতে বসেনি। বাড়িতে বিচিত্র বিষয়ের বই থাকলেও আমার ঝোঁকটা ছিল প্রকৃতি দেখা, ঘুরে বেড়ানো এবং মানুষ দেখা। এই প্রকৃতি দেখা ও মানুষ দেখাকে আমি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। সেইজন্য পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আমার তেমন কিছু পড়ার সুযোগ হয় নি, ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগ পর্যন্ত। অভিজ্ঞতা থেকেই আমার লেখালেখির ভিতটা শুরু। তারপর কলেজে ঢুকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে, উইমেন্স কলেজে পড়ার সময় ৬৩-৬৪ সালের দিকে অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ নানাভাবে আমাকে গাইড করেছেন। মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন পড়া থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্যের নানা কিছু আত্মস্থ করেছি সেই সময়ে। আবার দেশীয় সাহিত্য পড়ার সূচনা তখন। আমার এখনও মনে আছে, ঠিক ছোটবেলায় নয়, কলেজে ওঠার পর রাবেয়া খাতুনের ‘মধুমতি’ বেগম পত্রিকায় ছাপা হতো। পত্রিকাটি বাসায় আসতো, আম্মা রাখতেন। রাজশাহীতে আমরা আসার পরে পত্রিকা রাখা শুরু হয়, বাবার চাকরিসূত্রে বগুড়ায় থাকার সময় সেটা সম্ভব হতো না, কারণ ওটা একদম গ্রাম ছিল। তাই বইপত্র পড়ে লেখক হওয়ার প্রস্তুতি আমার হয় নি। কিন্তু আমি মনে করি আমার শৈশবটি ছিল একটি আশ্চর্য সোনালি শৈশব। এই শৈশবে আমি প্রকৃতি এবং মানুষ দেখেছি। মাঠেঘাটে, নদীতে, বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর এক অবাধ স্বাধীনতা ছিল আমার। আর মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক দেখার সুযোগ হয়েছিল। এই সব কিছুই আমাকে লেখালেখিতে আসার প্রেরণা দিয়েছে।
মিল্টন বিশ্বাস : আপনার পিতামাতা আর পারিবারিক পরিমণ্ডল নিজের মতো করে বেড়ে ওঠার পক্ষে উপযোগী ছিল কি?
সেলিনা হোসেন : আমার বাবা ছিলেন সিল্ক ইন্ড্রাস্ট্রিতে। বগুড়ার সেরিকালচার নার্সারিতে তাঁকে ‘বড় বাবু’ বলা হতো। পরবর্তীকালে তিনি রিটায়ার্ড করার আগে ডিরেক্টর হয়েছিলেন। তবে শখের বশে তিনি বিচিত্র কাজে উৎসাহী ছিলেন। মাছ ধরা, তাস ও দাবা খেলা আর শিকারের পাশাপাশি তিনি হোমিওপ্যাথ চর্চা করতেন। আমি ছিলাম তাঁর হোমিওপ্যাথ চর্চার কম্পাউন্ডার। তিনি যখন শিকারে যেতেন, আমি যেতাম, বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো দারুণ চমক ছিল। আমার নানা ছিলেন সেই সময়ের রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার, তারপরও তিনি তাঁর মেয়েকে অতো বেশি লেখাপড়া শিখান নি। কিন্তু অসম্ভব বুদ্ধিমতি ছিলেন আমার মা। আমার বাবা বলতেন তোর মাকে লেখাপড়া শেখালে সে ব্যারিস্টার হতে পারতো। বাবা তাঁর বেতনটা মায়ের হাতে দিয়ে সেই যে সংসার থেকে উধাও হয়ে যেতেন, আর কোনো খোঁজ-খবর নিতেন না। আমরা কী খাচ্ছি, আমরা কে কোন ক্লাশে পড়ছি, আমার বাবা সেটাও জানতেন না। আমার মা এমনভাবে সবকিছু ম্যানেজ করতেন, তাঁকে কখনোই কোনো সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় নি। তবে আমার বাবা প্রচ- রাগী ছিলেন। রাগ করে মার সামনে ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলতে দেখেছি। বড় ভাইকে নিষ্ঠুরভাবে মারতে দেখেছি। কিন্তু আমার ছোট বোনের অকাল প্রয়াণের পরে তিনি একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলেন। ছোটবোনকে কবর দেওয়ার পরে আমি আর কাউকে মারতে দেখে নি। আমার নাম ছিল ‘খায়রুন্নেসা’। আমার বড় বোন স্কুলের খাতায় সেই নাম পাল্টে রাখল ‘সেলিনা হোসেন’। আমাদের কবি সাহিত্যিকরা কেউ কেউ বিশ্বাস করতে পারেন না প্রথম থেকেই আমার নাম ‘সেলিনা হোসেন’। কারণ, অনেকেই মনে করেন আমি পরবর্তী সময়ে এই নাম নিয়েছি, পেন নেম হিসেবে। আসলে এটি করেছিলেন আমার বড় বোন। এভাবে আমি পরিবার থেকে আধুনিক ধারণা পেয়েছিলাম। আকিকা করা নাম পরিবর্তন করার মধ্যে ধর্মীয়প্রথার বিরুদ্ধে ও নান্দনিক সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ রয়েছে। তবে ৫০-এর দশকে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্যে আমার আব্বা-আম্মা দু’জনেই সমানভাবে আগ্রহী ছিলেন। ৬০-এর দশকে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রাজনীতি করেছি। সাহিত্য প্রতিযোগিতায় চার বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। রাকসুতে এবং ছাত্রী হলে নির্বাচন করে জিতেছি। বাবা-মার উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এটা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বাবা-মা রাজশাহীতে ছিলেন। লুটপাট হয়ে গিয়েছিল বাড়িঘর। তারপর তাঁরা চলে এলেন ঢাকাতে, আমার কাছে। যুদ্ধ শেষে বাবা রাজশাহী ফিরে গেলেন, মা থেকে গেলেন ঢাকাতে। ১৯৭৩ সালে আমার মা মারা গেলেন। আমাদের পারিবারিক পরিমণ্ডল আমার সাহিত্যে কোন না কোনভাবে প্রভাব রেখেছে।
মিল্টন বিশ্বাস : আপনার সাহিত্যচর্চার প্রেরণার কথা আমরা জানলাম। তবে দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের বেশি সময় সাহিত্যচর্চায় এই প্রেরণার কি কোন রূপান্তর ঘটেছে?
সেলিনা হোসেন : আসলে আমি অনেক সময় বলেছি আমার সাহিত্য রচনার প্রেরণা ছিল শৈশব-কৈশোরের এক ধরনের অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি প্রেরণাটা নিয়েছিলাম। যেমন আমার প্রকৃতি দেখা, মানুষে মানুষে সম্পর্ক দেখা। বিষয়গুলো আমার মাথায় অনেকদিন ধরে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিষয়গুলোকে দেখতে শুরু করি। তারও আগে কবিতা লিখে খাতা ভরতাম; সেই প্রকৃতি ও মানুষকে দেখার দৃষ্টি ছিল মুখ্য। এরপর আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি আমি যা করতে চাই তা কবিতায় নয় গদ্যে করতে চাই। বিষয় নির্ধারণের জায়গাগুলো নানাভাবে সামনে আসে এভাবে। এটা এক ধরনের প্রেরণাতো বটেই। জীবন অভিজ্ঞতা থেকে সাহিত্যে প্রবেশ করা। শৈশব-কৈশোর থেকে ষাটোর্ধ্ব বয়সে প্রেরণার সূত্রগুলো রূপান্তরিত হয়েছে অনেক। ক্রমাগত দেখার ভেতরে সূত্রগুলো পাল্টে গেছে। ক্রমাগত বিস্তার লাভ করেছে। গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের ভেতরে এসেছে অভিজ্ঞতা। প্রেরণার পরিবর্তন ঘটে স্বাভাবিকভাবে। কোন কারণে হয়তো কম লিখেছি, কোন কারণে বেশি, তবে কখনও ভাটা পড়ে নি। কাজ করার উপাদান সংগ্রহ করে রেখেছি। সবকিছুরই পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘ সময়ের নানা অভিজ্ঞতার কারণেই ঘটে। কোন লেখকের ক্ষেত্রে তা না ঘটলে সৃষ্টির জায়গায় বৃত্তাবদ্ধ হয়ে যাবেন তিনি। লেখকের উচিত প্রেরণার রূপান্তর গভীরভাবে উপলব্ধি করা।
মিল্টন বিশ্বাস : একইভাবে সাহিত্যিকের সামাজিক দায়বদ্ধতার রূপান্তর ঘটে কি? আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি আপনার প্রেরণা ও সামাজিক দায়বদ্ধতায় কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
সেলিনা হোসেন : একজন সাহিত্যিকের জীবনের মৌল বিষয়গুলো অর্থাৎ মানবতার পক্ষে থাকা মানুষের অধিকারের পক্ষে থাকা এবং এসবই তার সৃষ্টিকর্মে তুলে ধরলে সামাজিক দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার পরিবর্তনের সুযোগ কম। তবে পরিবর্তন আসতে পারে ভিন্নভাবে। যেমন, একজন সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচয় দিতে পারেন দরিদ্র শিশুদের শিক্ষা ক্ষেত্রে সহায়তা দিয়ে। তবে অনেক বড় লেখকই বলে গেছেন নানা কথা এবং তাদের দায়বদ্ধতা সৃজনশীল কর্মের প্রকাশের মধ্যে দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন। অর্থাৎ শিল্পিত প্রকাশই সামাজিক দায়বদ্ধতার অন্য নাম। আবার ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্বের কারণে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, প্রতিবাদ করা এসব অনেক লেখকের লেখায় প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এমনকি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস রচনায় দায়বদ্ধতা চিহ্নিত করা যায়। কারণ একজন ব্যক্তির সংকট কেবল তার একার নয়, তা এক জায়গায় থাকেও না। অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে যায়। কোন কোন লেখক একক ব্যক্তি অভিজ্ঞতা নিজেই উপলব্ধি করেন; নিজেই মগ্ন থাকেন তার ভেতর। কিন্তু যোগাযোগ, জীবন-জীবিকার জায়গাগুলো কি নির্দ্বন্দ্ব থাকে? দ্বন্দ্বের সময় অন্যেরা প্রবেশ করে। লেখক যদি বলেন কেবল নিজের মতো করে লিখব সামাজিক দায়বদ্ধতার তোয়াক্কা করব না তবে তিনি ব্যর্থ হতে পারেন। দেখার সূত্রগুলোকে বিশ্লেষণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। যেমন, নদীর ধারে বসে জেলে জীবন পর্যবেক্ষণ করতে গেলে দৃষ্টি নানাদিকে সম্প্রসারিত হবে। লেখকের দায় থাকে বলেই জেলে, মহাজন, নৌকা প্রভৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ হবে। আবার ব্যক্তির চিন্তা বড় হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতাকে লেখক কখনও অস্বীকার করতে পারেন না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতিতে আমিও পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দ্রুত পরিভ্রমণ করতে পারছি। তবে বিস্ময়কর আবিষ্কারের পটভূমিতে আমরা গ্লোবাল চরিত্র নির্মাণ করতে পারি। আন্তর্জাতিক জায়গায় বড় পরিপ্রেক্ষিতে চমৎকারভাবে চরিত্র ও ঘটনার সমাবেশ ঘটাতে পারি। তবে এসবই তরুণ লেখকদের জন্য রেখে দিচ্ছি। আমার উপর এর প্রভাব নেই। আমার জীবনে সেই সময়ও নেই।
মিল্টন বিশ্বাস : কবিতা দিয়ে খাতা ভরিয়ে কথাসাহিত্যে কেন এলেন?
সেলিনা হোসেন : আমার মনে হয় একজন লেখক তাঁর সাহিত্যে রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ এবং দেশজ প্রকৃতির মধ্যে চাপিয়ে দিয়ে থাকেন। সে শেকড় চলে যায় গভীর থেকে গভীরে। কথাসাহিত্যে সেই শেকড় প্রোথিত করা সহজ। কারণ উপন্যাসের ক্যানভাসটা অনেক বড়। তাছাড়া সামাজিক যে বৃহৎ পটভূমির জন্য আমার উপন্যাসের পটভূমি নির্মাণ করি সেই নির্মাণের জন্য একটা বড় ক্যানভাস দরকার। কবিতায় এত বড় ক্যানভাস পাওয়া সম্ভব নয়। কবিতা প্রচ- তীক্ষ্ণ, তীব্র এবং দীপ্যমান। উপন্যাস ছড়ানো ছিটানো কিছুটা শিথিল। প্রচুর বর্ণনা, অসংখ্য চরিত্র নিয়ে গঠিত একটি শিল্প মাধ্যম। তাই আমার কবিতা ছেড়ে গল্প-উপন্যাসে আসা। আমি যাদের কথা বলতে চাই কবিতায় বলা সম্ভব ছিল না।
মিল্টন বিশ্বাস : আপনার জীবন ও সাহিত্যে প্রেমের কোন প্রভাব আছে কি?
সেলিনা হোসেন : ব্যক্তি জীবনের প্রেম আমার লেখায় সেভাবে জায়গা জুড়ে বসেনি। একটা উপাদান হিসেবে যুক্ত হয়েছে মাত্র। এ বিষয়টা আমাকে তেমন করে টানেওনি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বয়সে এই বিষয়টা আমার জীবনে এসেছে। তবে লেখালেখির ক্ষেত্রে বিষয় হিসেবে এটাকে আমি ভাবিনি। অথচ আনা যেতো, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বান্ধবীদের দেখেছি ছাত্রদের সঙ্গে প্রেম করতে। অথচ এটা আমার কাছে একটা অসম্ভব চিন্তা ছিল। অনার্স পড়ার সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রেম হলো। তার সঙ্গে আমার বয়সের ব্যবধান ছিল বাইশ বছর। বিয়েও হলো। বিয়ের আগে অভিভাবকরা বাধা দিলেন। ভাবলাম সবাইতো গতানুগতিক বিয়ে করে, আমি অন্যরকম বিয়ে করব। এ বিয়ে হবার চার বছর পর তিনি মারা গেলেন, এর তিন বছর পর আবার প্রেম হলো। এটিও অন্যরকম প্রেম। আমার দু’টি শিশু মেয়েসহ আমি তাকে বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না। তিনি ছিলেন ব্যাচেলর। বললেন, এ বিয়ে হতেই হবে। বিয়ে হলো, মেয়ে দু’টি ভালোবাসার বাবা পেলো। দেখলাম উল্টো নিয়মে শুরু হলো আমার জীবন। এসব দিয়ে উপন্যাস হয় কিনা ভেবে দেখিনি। তবে আত্মজীবনী তো হবেই।
মিল্টন বিশ্বাস : প্রচলিত ধারণা সাহিত্যচর্চায় নারীর সামর্থ কম। এটি অবশ্যই সনাতন অভিমত। কিন্তু বেগম রোকেয়া অথবা সুফিয়া কামাল তাঁদের সৃষ্টিকর্মের জন্য এখনও স্মরণীয়। সাম্প্রতিককালে নারী বোদ্ধাদের মধ্যে আপনি একজন। আপনি কীভাবে অতিক্রম করলেন সকল প্রতিবন্ধকতা; সমাজের প্রচলিত ধারণা ভেঙে সাহিত্যচর্চায় অগ্রণী হলেন?
সেলিনা হোসেন : বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল বৃত্তাবদ্ধ সমাজের গণ্ডি থেকে বের হয়ে এসে প্রবল প্রতিরোধের মধ্যেও সাহিত্য চর্চা করেছেন। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। তবে সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তন হলেও সংকট রয়ে গেছে। এখন যাদের দেখি তাদের সময়ও গণ্ডিবদ্ধ। ছেলেরা সংসার-সন্তান সামলায় না বরং মেয়েদের সেই কাজ করতে হয়। চাকরি শেষে বাসায় এসে সব সামলে সৃজনশীল কাজ করা সত্যিই কঠিন। তবে আমাদের দেশে পরিবার থেকে আমরা অনেক সহযোগিতা পাই। আমি নিজে লেখালেখিকে একটি কাজ মনে করেছি। সব কাজের মধ্যে সময় বের করার চেষ্টায় থেকেছি। বাচ্চাদের বাইরে খেলতে পাঠিয়ে সেই সময়টুকু লেখার কাজে ব্যয় করেছি। আমি দীর্ঘ সময় চাকরি করেছি। সেই সময়েও আমি কোন প্লটের মধ্যে প্রবেশ করলে তা থেকে আর বিচ্ছিন্ন হইনি। নিজের প্রেরণাতে মাথার ভেতর উপাদান নিয়ে ঘুরেছি। বর্তমানে মেয়েদের অনেক দরজা খুলেছে তবে তাদের জায়গা ধরতে পেরেছে কি? অনেক মেয়ে এগিয়ে আসছে না কেন? সাহিত্যচর্চা করতে হলে একা হতে হবে। নিজের স্বামী-সন্তানকে দূরে রেখে লিখতে বসতে হবে। সবকিছুর ভেতরই একা হতে হবে এটা জরুরি। অভিজ্ঞতার জায়গাটি ধরে রেখে লিখতে হবে। তবে এটা সত্যি নারী বা পুরুষ যেই হোন না কেন সকলেই সত্যিকার অর্থে লেখক নন। যে লেখকের গুণগত মান শিল্পসম্মত তিনিই লেখক। তবে এটা সত্যি লেখালেখির ক্ষেত্রে আমাদের নারী লেখকরা খানিকটা পিছিয়ে আছে। কারণ তাদের জীবনে সীমাবদ্ধতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা প্রতিকূলতায় তৈরি হয়েছে। এই সীমাবদ্ধ দরজাটা খুলে গেলে নারী লেখকরা তাদের স্বকীয়তা নিয়ে এগিয়ে আসবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে আমি বিশ্বাস করি নারী পুরুষ লেখক মিলিয়ে আমাদের যে সাহিত্য তা একটা নির্দিষ্ট মানদণ্ডে উন্নীত হয়েছে।
মিল্টন বিশ্বাস : পত্রপত্রিকায় জেন্ডার বৈষম্য হচ্ছে কি? নারী লেখকরা এতে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন?
সেলিনা হোসেন : আমার মনে হয় আমাদের তরুণ যারা লেখক আছে সেসব নারী লেখকরা জেন্ডার বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আমাদের দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য-সাময়িকীর পাতায় তাদের সবার লেখাই ঠিকমত ছাপা হয় না, আমি ব্যক্তিগতভাবে দু’একজনের লেখা পত্রিকার সাহিত্য-সাময়িকীতে পাঠিয়েছিলাম, তাদের লেখা ছাপা হয় নি। সম্পাদককে অনুরোধ করা সত্ত্বেও এবং আমার বিবেচনায় লেখাটি ভালো হওয়া সত্ত্বেও কেন ছাপা হলো না এটা আমারই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় আমার কাছে। যারা তরুণ নারী তাদের কাছ থেকেই নানা কথা শুনতে পাই। সবটা বিশ্বাস করি এমন নয়, তবে লেখালেখির বিবেচনায় অনেক ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য নারী লেখকদের অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
মিল্টন বিশ্বাস : কেউ কেউ বলে থাকেন স্বাধীনতার আগে নারী লেখকদের যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এখনও তাঁরা সেই পর্যায়ে রয়েছেন? নারীর যে ক্ষমতায়ন হচ্ছে সেই পরিবর্তন তাদের সাহিত্যে দেখা যায় না এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
সেলিনা হোসেন : নারী লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর নিয়ে এই মতামতের বিরুদ্ধে আমার অভিমত। কারণ মুক্তিযুদ্ধের আগে নারী লেখকরা যে সময়ে, যে সমাজে বাস করতেন, যে গণ্ডিতে জীবনযাপন করতেন তাই তাদের সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারী লেখকদের শিক্ষা, সাংস্কৃতিকবোধ, সচেতনতা, সামাজিক বেড়ি ভাঙা, রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা, নারী পুরুষ সম্পর্কের গভীর তাৎপর্য অনুধাবন করা, মনোজাগতিক ধারণা সম্পর্কে অবহিত হওয়া ইত্যাদি অসংখ্য বিষয় তাদের লেখার ধরন পাল্টে দিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন, নারী লেখকদের চিন্তার জড়তা ভেঙেছে। এদের অনেককেই যদি মূল্যায়ন করা না যায়, তবে এ ব্যর্থতা নারী লেখকদের নয়। সে ব্যর্থতা সহযোগী পুরুষ লেখকদের, পুরুষ সম্পাদকের, পুরুষ প্রকাশকের এবং পুরুষ পাঠকেরও। তবে সাহিত্য জগতে বিচরণের জন্য নারী লেখকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিত্ব অর্জন খুবই জরুরি বিষয়।
মিল্টন বিশ্বাস : আপনার গল্প-উপন্যাসে নারী একটি বিশেষ ভূমিকা নিয়ে আসে- এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
সেলিনা হোসেন : আমি আমার গল্প-উপন্যাসে নারী ভাবনাকে অনেক বেশি খেলামেলা দৃষ্টিতে দেখেছি। আমার গল্প-উপন্যাসের নারীচরিত্রগুলো পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসা, সমাজবৃত্তের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য লড়াই করা নারী। আমার প্রথম দিককার উপন্যাস ‘পদশব্দ’। এই উপন্যাসে দুটি নারী চরিত্র আছে। প্রথম চরিত্রটি সালমা- যে বাবাকে স্টাবলিশমেন্টের প্রতিনিধি মনে করেছে এবং বাবার সততা ও নৈতিকতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। অন্যদিকে আর একটি চরিত্র নাসিমা- যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। গণ্ডিকে চ্যালেঞ্জ করে লিভ-টুগেদার করে। ১৯৭৪ সালে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল। ৬০-এর দশকের মধ্যভাগে আমার লেখার গুরুত্বে আমি নারীর ব্যক্তিক সংকট, মনস্তাত্ত্বিক সংকট ইত্যাদি বিষয়গুলোকে তুলে এনেছি নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে।
মিল্টন বিশ্বাস : আপনার সৃজনকর্মে রাজনীতি-ঐতিহ্য-সমাজ-সংস্কৃতি মিলেমিশে আছে? সাহিত্যে রাজনীতির শিল্পায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।
সেলিনা হোসেন : আমার একটি উপন্যাসের নাম ‘ভূমি ও কুসুম’। এটি ছিটমহল নিয়ে লেখা। আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের পটভূমিতে লিখিত। ভারতের অংশের মধ্যে আমাদের ছিটমহল পাটগ্রাম-দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা। মাঝে বড় রাস্তা জলপাইগুড়ি-কোচবিহারকে যুক্ত করেছে। আন্তঃরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত এখানকার বাসিন্দাদের জীবন। আমি দেখেছি ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা ছিটমহলের মেয়েদের তুলে নিয়ে যায়। তিস্তা নদীতে চর জাগলে এপারে দাঁড়িয়ে জমির মালিকানা পাওয়ার আনন্দ অনুভব করতে পারে না এখানকার জনগোষ্ঠী। কারণ সেখানে যেতে চাইলে বাসিন্দারা ভারতীয় রক্ষীর বন্দুকের নলের সামনে পড়ে। ফলে মানুষের মধ্যে ক্রোধ জাগতে থাকে। ক্রোধ ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংক্রামিত হয়। কাহিনিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উপন্যাসের পরিণতিতে আমি দেখিয়েছি, দহগ্রামের একজন মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে শহীদ হয়; যাকে কবর দেওয়া হয় রংপুরের ভুরুঙ্গমারিতে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস সীমান্ত ওপেন ছিল। কিন্তু একবছর পরে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার প্রিয়তমা স্ত্রী; স্বামী হারানোর বেদনায় কিছুটা অ্যাবনরমাল; সে লাউ-কুমড়ো থেকে শুরু করে অনেক প্রকারের বনফুল দিয়ে ডালি সাজিয়ে নিয়ে কবরে ফুল দিতে যাবার সময় দেখে অনুমতি নেই সেখানে পৌঁছানোর। সীমান্তে তার বুকের কাছে বন্দুকের নল উঁচিয়ে আছে ভারতীয়রা। এই বন্দুকের নল আন্তঃরাষ্ট্রর সম্পর্ককে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। একদিকে শহীদের প্রতি সম্মান জানানো, অন্যদিকে স্বাধীন দেশ বলেই যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি- এ উভয় দিক বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাই দুই রাষ্ট্র এ জনজীবনের চলাচলের নির্দেশাবলি তখনও নির্ধারণ করতে পারেনি। ফলে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। জীবনের সঙ্গে এভাবে আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক নতুন মাত্রা দিয়েছে উপন্যাসটিকে। যোগাযোগের নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠিত হলে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হত না। স্বাধীন রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগের নিয়মরীতি রক্ষা করার তাগিদ থেকে রাজনৈতিক বাস্তবতা উপন্যাসটিতে অভিব্যক্ত। বড় উপন্যাসটিতে এভাবে আমি নানাকিছু ব্যাখ্যা করেছি।
‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ তিন খণ্ডে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ধারাবাহিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। কোনকিছু বাদ দিইনি। এখানে সমকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট স্পষ্ট। স্বাধীনতার পরে জাসদের প্রতিষ্ঠার কথাও আছে। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী প্রগতি আন্দোলন থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বিপর্যয়-দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, ১৯৪৭-এর দেশবিভাগ, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ৬ দফা, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শোষণ, নির্যাতন, যুদ্ধ, হত্যা প্রভৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে যে সংকট, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা, তা থেকে উত্তরণ এবং পুনরায় এ-ভূখণ্ডে যে নৈরাজ্য, হতাশা, সম্ভাবনাহীনতা ও আতঙ্কের ছায়া পড়েছিল তা সচেতন শিল্পবোধ ও আবেগায়িত উপস্থাপনায় ফুটে উঠেছে ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ ত্রয়ী এবং ‘যাপিত জীবন’, ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’সহ অনেক উপন্যাসে। মূলত আমি মনে করি জনজীবনের কথাগুলো শিল্পের মধ্যে দিয়ে আনলে পাঠকরা পড়ে জানতে পারে তার নিজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অবস্থান।
মিল্টন বিশ্বাস : মুক্তিযুদ্ধের একাধিক উপন্যাস-গল্পের রচয়িতা আপনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার আরও অবকাশ আছে কি? থাকলে সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
সেলিনা হোসেন : একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ আমাদের জীবনের একটা প্রান্তসীমা। এ যুদ্ধ আমাদের অস্ত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে এবং অনেক মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। খুব বড় নয়, ছোট পরিসরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ২০১৪ সালে লিখেছি একটি নতুন উপন্যাস। ঢাকাকে কেন্দ্র করে এর পটভূমি নির্মিত। ‘গেরিলা ও বীরাঙ্গনা’ এর মূল উপজীব্য। বীরাঙ্গনা নারীর অবহেলিত, বঞ্চিত জীবনের কথা আছে এখানে। গেরিলাদের নারীরা কীভাবে সহযোগিতা দিয়েছিল তার কথাও। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ বহুল আলোচিত হলেও আমার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপন্যাসের মধ্যে ‘যুদ্ধ’ কম আলোচিত হয়েছে। ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর সঙ্গে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধের ঐতিহাসিক বিবরণ রয়েছে। কিন্তু কাহিনীতে তারামন বিবির জীবনের কাহিনি ও মুক্তিযুদ্ধ, তার তালাক প্রাপ্তি, স্বামী থেকে বিচ্ছেদ পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রতীকী কাহিনি। তালাকের পরে পিতার সঙ্গে কাপড় উড়িয়ে উৎফুল্ল হয়ে তার রৌমারি যাবার দৃশ্যটিতে আমি সেই সবই তুলে ধরেছি। এ উপন্যাসে কেবল হানাদার পাকিস্তানিদের ট্রেন কিলিং-এর নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার চিত্রই তুলে ধরা হয় নি, বাঙালির প্রতিরোধ-সংগ্রামের চিত্রও আছে। উপন্যাসের একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র ‘লোকটি’ এমনভাবে তৈরি করেছি যে সমস্ত দেশে ঘুরছে। আবার উপন্যাসের সব জায়গায় তার বিচরণ। কি হচ্ছে সে দেখছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে, তাদের সাহস জোগায়, দেশের মধ্যে বিচরণ করে স্বাধীনতার স্বপ্ন নির্মাণ করে সে। তবে উপন্যাসের শেষে মুক্তিযোদ্ধা মাখনকে উদ্দেশ্য করে পাকিস্তানিদের দ্বারা ধর্ষিতা ও গর্ভবতী বেনু’র উচ্চারণই আমার মুখ্য প্রতিপাদ্য: ‘ভালো কইরে দেখো হামাক। তুমিই দেছো পা। হামি দিছি জরায়ু। তোমার পায়ের ঘা শুকায়ে গেছে। কয়দিন পর হামারও জরায়ুর ঘা শুকায়ে যাবে। আমি ভালো হয়ে যাবো।’
মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছে শুধুই চেতন-অবচেতনের ব্যাপার নয়। এটি একটি প্রত্যক্ষ সত্য। তাই মুক্তিযুদ্ধে প্রাধান্য আমার কাছে যুক্তি এবং আবেগের- এখানে দ্বিমতের অবকাশ নেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার এখনও অবকাশ আছে। ৬০/৭০ বছর পরে তরুণরা হয়ত অন্যভাবে অন্য পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস রচনা করবে। নেপোলিয়নের রাশিয়া আক্রমণের ৫০ বছর পরে যেমন টলস্টয় ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ লিখেছেন তেমনি বড় পরিসরে, অন্যরকম চিন্তায় মুক্তিযুদ্ধকে আনবে কেউ; আনতেই হবে। যারা যুদ্ধ দেখেনি; তারা সেসব থেকে ডি-টাচড হয়ে বিষয় হিসেবে দেখবে, তখন নতুনভাবে উপন্যাস লিখিত হবে। এভাবে অনেক উপাদান নতুন করে সামনে আসবে।
মিল্টন বিশ্বাস : প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যকে ভেঙে উপন্যাস লিখেছেন একাধিক। সেসব রচনায় উৎসাহী হলেন কীভাবে। আজকে তার প্রাসঙ্গিকতা কোথায়?
সেলিনা হোসেন : আমি যেটা করেছি তা প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য বলে না আমি আমার ঐতিহ্য থেকে, লোকউপাদান থেকে উপন্যাসের কাহিনি সংগ্রহ করেছি। প্রাসঙ্গিকতা আছে কিনা সে প্রসঙ্গে বলতে চাই, লোক উপাদান দিয়ে Contemporary Parallel করে এঁকেছি ‘নীল মযূরের যৌবন’, ‘চাঁদবেনে’, ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’। মাতৃভাষার জন্য লড়াই আছে ‘নীল ময়ূরের যৌবনে’। রাজার মিথ্যা প্রশস্তি রচনায় অস্বীকৃতি জানানোর জন্য কাহ্নুপার হাত কেটে ফেলা এবং সংস্কৃত ভাষায় গীত রচনার নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করা ভাষা আন্দোলনের প্রতীকী উপস্থাপনা। প্রতীকী রূপায়ণ দেখতে পাওয়া যাবে শেষ দৃশ্যেও। ২৫ মার্চের কালরাতের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাবে কাহ্নুপাদের জনবসতি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায়। তাদের স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন তুলে ধরা হয়েছে এভাবে-‘তোরা কেউ দুঃখ করিস না দেশাখ। আমাদের তেমন একটা জায়গা একদিন হবে। আমরাই রাজা হব। রাজা প্রজা সমান হবে। আমাদের ভাষা রাজদরবারের ভাষা হবে। তেমন দিনের জন্যে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে দেশাখ।…কাহ্নুপাদ দম নিয়ে আবার বলে, একটা ছোট ভূখণ্ড আমাদের দরকার। যে ভূখণ্ডটুকু সবুজ, শ্যামল আর পলিমাটি ভরা হলেই হয়। সে ভূখণ্ডের দক্ষিণে থাকবে একটা সুন্দর বিরাট বন আর তার পাশ দিয়ে বয়ে যাবে সাগর।’
অর্থাৎ ঐতিহ্য থেকে উপাদান নিয়ে Contemporary Parallel করা হয়েছে সর্বত্রই। ‘চাঁদবেনে’র লড়াই অন্যায় ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে। মনসামঙ্গল থেকে গৃহীত উপাদান হিসেবে নামটি একই কিন্তু জোতদারের বিরুদ্ধে আমার চাঁদের লড়াই শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হয়নি। বরং প্রতিরোধের জায়গাটি তৈরি করার জন্য Contemporary Parallel তৈরি করা হয়েছে। এমনকি তার স্ত্রী ছমিরণ সুস্থ সন্তানের মা হতে পারবে না জেনেও তার প্রত্যয় ঘোষিত হয় সরবে-‘এক ছমিরণের ব্যর্থতায় আমি ফুরিয়ে যাবো না, এক ছমিরণ জীবনের শেষ কথা নয়। ছমিরণ ব্যর্থ হয়েছে। প্রকৃতি আমাকে মার দিয়েছে। আমিও প্রকৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি। রুখবোই। সন্তানও নেবো, ভিটেও নেবো। আমার পৃথিবী আমিই গড়বো। আপাতদৃষ্টিতে যতই আমি পরাজিত হইনা কেনো কিছু এসে যায় না। এক ছমিরণ না পারলে কি হবে আমার জন্যে কি আর কোনো ছমিরণ নেই।’ এসব রচনার প্রাসঙ্গিকতা আজও আছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে আহ্বান করা হয়েছে প্লটের অন্তঃশীলায়। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য আছে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। অন্যদিকে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-সংগ্রাম নিঃশেষ হবার নয়। এদিক থেকেও রচনাগুলোর প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।
মিল্টন বিশ্বাস : আপনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ‘পূর্ণ ছবির মগ্নতা’ লিখেছেন। এটি একটি কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল। এটি সম্পর্কে কিছু বলুন।
সেলিনা হোসেন : রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা অনেকদিনের। বিশেষত পূর্ববঙ্গের শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসরে তাঁর অবস্থানের বিভিন্ন ঘটনা আমাকে আকর্ষণ করে এসেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবারকে উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। এদিক থেকে পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কর্মকাণ্ড এতদিন উপেক্ষিত ছিল। ‘পূর্ণ ছবির মগ্নতা’ শিলাইদহ-পতিসরের পটভূমিতে লেখা। রবীন্দ্রনাথের গল্পের চরিত্রগুলোকে আমি ভেঙে নতুন করে তুলেছি; ছিন্নপত্র ব্যবহার করেছি; নাটকের উদাহরণ এনেছি। বাউল-বোষ্টমীও বাদ যায়নি। যদিও বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ পুনঃপ্রকাশের রেওয়াজ নেই তবু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এবং ভাল হয়েছে বলেই কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স বইটি ছাপিয়েছে। সেখানে গ্রন্থটি অনেক বিক্রয় হয়েছে। তিন বছর আগে আগস্ট মাসে একটি পুরস্কার আনতে কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন এবং আমি সেখানে গিয়েছিলাম। আসার সময় কলকাতা বিমানবন্দরের বুকশপে আমার ‘পূর্ণ ছবির মগ্নতা’ দেখে ভাল লেগেছে। এ উপন্যাসেও Contemporary Parallel তৈরি করেছি। ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন শেষ বিদায় নিচ্ছেন আত্রাই স্টেশন থেকে তখন তাঁর প্রজারা পায়ে হেঁটে স্টেশনে উপস্থিত হয়। সেখানে তিনি ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি এদেশবাসীর উদ্দেশে দিয়ে যান। আমাদের দেশ একদিন স্বাধীন হবে; এই গানটি একদিন জাতীয় সংগীত হবে তারই প্রতীকী বিন্যাস রয়েছে এখানে। পোস্টমাস্টার গল্পের রতন চরিত্রটি খুব গুরুত্ব পেয়েছে। রতনের আমি মৃত্যু দেখিয়েছি। তাকে কবি গান শেখাবেন বলে কাছে ডেকেছিলেন; তখন তার সময় হয়নি কারণ সে জানিয়েছিল পোস্টমাস্টারের জন্য তাকে রুটি বানাতে হবে। কিন্তু শেষে তার কণ্ঠেই গান দিয়েছি আমি। এভাবে গল্পের চরিত্রগুলোকে পুনঃসৃজন করেছি আমি।
মিল্টন বিশ্বাস : কেবল রবীন্দ্রনাথকে কেন এর আগে ইলা মিত্র, মুনীর চৌধুরী, সোমেন চন্দ প্রমুখ চরিত্র আপনার উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখার পরিকল্পনা আছে কি?
সেলিনা হোসেন : বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখার পরিকল্পনা আমার অনেকদিনের। ২০ বছর ধরে মাথায় ঘুরছিল। হত্যাকাণ্ডের বিচারের সমস্ত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। প্রতিবছর ১৫ আগস্টে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার লেখাগুলো সংগ্রহে রেখেছি। তবে ২০০৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বরে একটি অনুষ্ঠানে দেখা হয় বর্তমান এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে। তিনি আমাকে তাঁর অফিসে যেতে বলেন কিছু জিনিস দেবেন বলে। একদিন সেখানে উপস্থিত হলে তিনি আমাকে ৬৯৫ পৃষ্ঠার একটি ফাইল দেন। ফাইলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ৬১ আসামির জবানবন্দি আছে। জবানবন্দি পড়েছি আর উপন্যাসের উপাদান সংগ্রহ করেছি। এখানে বলা দরকার আমি উপন্যাসের থিম চিন্তায় পরিবর্তন এনেছি। যেমন রবীন্দ্রনাথের পুরো জীবন নয় কেবল পূর্ববঙ্গকে বেছে নিয়েছিলাম তেমনি বঙ্গবন্ধুর সম্পূর্ণ জীবন নয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাতের পরিসরটুকু আমার কাহিনির সময়। এক রাতের ঘটনা একটি মুহূর্ত অনন্ত কালের পরিচয় বহন করেছে। ‘আগস্টের এক রাত’-এর কাহিনিতে সময়কে থামিয়ে দিয়েছি আমি। প্রথম চ্যাপ্টারে বঙ্গবন্ধুর গল্প পরের চ্যাপ্টারে সাক্ষীদের গল্প হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে। অথেনটিসিটি বজায় রেখেছি। বানানো নয়। সাক্ষীদের উপাত্ত থেকে বঙ্গবন্ধুর সাহসী চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছি। তাঁর সংসার জীবন; স্ত্রী রেণুর স্মৃতি এসেছে। কাজের ছেলের অনুভূতি তুলে ধরেছি। শেখ রাসেলের মর্মবিদারক সংলাপ রয়েছে। পরিবারের প্রত্যেকের জন্য একটি করে চ্যাপ্টার দিয়েছি। হাসিনা-রেহানার কথাও আছে। কর্নেল জামিলকে এনেছি। স্বাধীন দেশে তাঁর পরিবারের কান্নার অধিকার কেড়ে নেওয়ার ঘটনা লিখেছি। শেষ করেছি ৩২ নম্বর বাড়িতে পড়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর কফিনের সামনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে উপস্থিত করে। প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান জানাতে এসেছেন পৃথিবীর অপর সব মহান নেতারা। সেখানে তাঁকে নিয়ে রচিত কবিদের কবিতাও উদ্ধৃত করেছি। অন্যদিকে তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বনানী কবরস্থানে নেওয়া হলে সেখানে চৌকিদার ছাড়া আর কারো উপস্থিতি ঘটাইনি। এই চৌকিদার হলো সেই বুড়ির ছেলে যে একদিন যুবক শেখ মুজিবকে স্নেহ করে অনেক কথা বলেছিলেন। যার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে জানতে পেরেছি। শেষে লাশ দাফনের ঘটনা সংযুক্ত করেছি। যেখানে রবীন্দ্রনাথকে হাজির করেছি। বঙ্গবন্ধুর মুখে বসিয়েছি রবীন্দ্রনাথের সেই চিরন্তন বাক্য মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।
মিল্টন বিশ্বাস : ২০১১ ও ২০১২ সালে প্রকাশিত দুটি উপন্যাস যথাক্রমে ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’ ও ‘গাছটির ছায়া নেই’ সম্পর্কে কিছু বলুন।
সেলিনা হোসেন : দুটি উপন্যাসেই বিষয়ের বৈচিত্র্য আছে। ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’ উপমহাদেশের বিখ্যাত কবি মির্জা গালিবকে নিয়ে লেখা। ইতিহাসের অনেক কিছু এখানে অবলম্বিত হয়েছে। অনেকেই বলে থাকেন এটি আমার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
কিন্তু আমি ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ দিয়েই পরিচিত হতে পছন্দ করি। ‘গাছটির ছায়া নেই’ উপন্যাসটি এইচআইভি বা এইডস নামক অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ তথা এশিয়া ও আফ্রিকার পটভূমিতে অর্থাৎ দুই মহাদেশের কতিপয় মানুষের গল্প নিয়ে এর কাহিনী বিস্তার লাভ করেছে। এই যে দক্ষিণ এশিয়া বা আফ্রিকার পটভূমি ব্যবহার এটিও আমার উপন্যাসের নিরীক্ষার দৃষ্টান্ত।
মিল্টন বিশ্বাস : কথাসাহিত্যের এই নিরীক্ষা বা কনটেন্ট ও ফর্ম নিয়ে আপনার ভাবনা কীভাবে এগিয়েছে?
সেলিনা হোসেন : আমি যে বিষয়টাকে ধরতে চাই গল্প-উপন্যাসে, সেই বিষয় অনুযায়ী ভাষা এবং আঙ্গিকের চিন্তা করি। যেমন আমার ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসে আমি কাহিনি হিসেবে তুলে এনেছি অষ্টম শতাব্দীর বাংলাদেশ। যে সময়ে বেশ কয়েকজন কবি বাংলা ভাষার চর্চা করছেন। যে ভাষাটি আজকের প্রমিত বাংলায় রূপান্তর হয়েছে। এই উপন্যাসে আমি সে সময়টাকে ধরে আঙ্গিকে মডার্ন প্যারালাল ব্যবহার করেছি। বিষয়ের কারণে ভাষা ও আঙ্গিক উপন্যাসে স্বতন্ত্র হয়েছে। বিষয়টি প্রথমত মুখ্য ছিল। দ্বিতীয়ত এর নির্মাণ। ভাবতে হয়েছে দুটোকে সমন্বয় করেই। ‘চাঁদবেনে’ উপন্যাস মিথ এবং বর্তমানের সমন্বয়। আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কের রাজনীতিতে চাঁদ সওদাগর থেকে নিরন্ন কৃষক চাঁদের রূপান্তর আমার মূল অন্বিষ্ট ছিল।
মিল্টন বিশ্বাস : সাম্প্রতিককালের কথাসাহিত্যের মধ্যে সম্ভাবনা ও প্রতিশ্রুতি কেমন দেখছেন?
সেলিনা হোসেন : আমি মনে করি এই সময়ে যারা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশকের সাহিত্যিক হিসেবে উঠে এসেছেন- তারা অনেকেই নিজ নিজ শক্তির জায়গা থেকে এই বলয়টাকে নির্মাণ করে চলেছেন। আমাদের আশাহত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এই সময়টাকে তারা তাদের মতো করে ধরছেন। তাদের লেখায় নানাপ্রসঙ্গ আসছে- যে প্রসঙ্গগুলো আমাদের পূর্ববর্তী সাহিত্যিকদের রচনায় আসেনি। এই সময়ের লেখকদের বিষয়কে নতুন করে দেখার এবং আঙ্গিক নতুন করে ব্যবহার করার প্রবণতায় আমাদের সাহিত্যচর্চার ধারাবাহিকতাকে-নতুন সময়ের লেখকরা নতুনভাবে সৃষ্টি করে চলেছেন।
মিল্টন বিশ্বাস : আপনাকে ধন্যবাদ
সেলিনা হোসেন : ধন্যবাদ।