চন্দন আনোয়ার।।
গুলি খেয়ে কাঁটাতারে ছয় ঘণ্টা ঝুলে ছিল তরুণী ফেলানির লাশ! তাঁর শরীরের একাংশ ছিল ভারতে, আরেক অংশ ছিল বাংলাদেশে, আধ-ঘণ্টা জীবিত থেকে চিৎকার করেছিল পানি পানি করে! সেদিন বিকেলে ছিল তার বিয়ে। দিনটি ছিল ৮ জানুয়ারি ২০১১। শুক্রবারের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর। ফেলানির জীবনে আর ভোরের প্রহর কাটবে না, এবং কোনোদিনই আর আসবে না ঝলমলে সূর্যোদয়ের নতুন এমন একটি দিন, যেদিন তার বিয়ে হবে, মিলন বাসর হবে, সুখ হবে। কাঁটাতারেই ঝুলে থাকবে তার শরীরের মতো তার স্বপ্নগুলো। গত ছয় দশক ধরে ভোরের কুয়াশা কাটেনি বাঙালির জাতীয় জীবনে। ফেলানির মতোই কাঁটাতারে ঝুলে আছে এপার ওপার দুইপারের তিরিশ কোটির উর্ধ্বে বাঙালির স্বপ্ন ও স্বাধীনতা, বাঙালির আত্মপরিচয় ও জাতীয়তা। একটি অলিখিত মানচিত্রের জন্য এরিমধ্যে ভাষাযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন যুদ্ধে বাঙালি প্রায় ৫০ লক্ষের মতো প্রাণ খরচ করেছে। নিজভূমেই সে সবচেয়ে অনিরাপদ থেকেছে। যেখানেই আশ্রয় চেয়েছে সেখানেই চলেছে গুলির পর গুলি। ভয়ানক এক আত্মঘাতী বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় প্রহরে প্রহরে আঘাতে-পক্ষাঘাতে এখন বাঙালি আরো বিকলাঙ্গ, পঙ্গু, বাকসর্বস্ব প্রাণিবিশেষ। ধর্মহীন দ্বি-জাতিতত্ত্বের নির্মম বলির শিকার বাঙালির দেশ দ্বি-খণ্ডিত, তার আত্মপরিচয়ও দ্বি-খণ্ডিত। একটি সবল আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধারের জন্য বাঙালির একাংশ শেষপর্যন্ত সশস্ত্র যুদ্ধে নামল বটে; কিন্তু তার ফল নিদারুণ প্রহসনে ঠাসা। আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতা দখলের কুৎসিত লড়াইয়ে একদল হারে তো আর একদল জিতে, ব্যারাক থেকে ট্যাংক বেরিয়ে আসে গণতন্ত্রের শুদ্ধি অভিযানে।
মানুষ যদি আর মানুষই না থাকে, তবে রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এসব কার জন্য? দেশভাগের ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে স্বাধীনতার স্বাদ এতই বিষাক্ত হয়ে উঠল যে, অন্ধকার মৃত্যুপুরীতে পরিণত হল পাঞ্জাবসহ সারা ভারতবর্ষ! ১৪ই আগস্ট লাহোর স্টেশনে শিখদের উপর আক্রমণ, ১৫ই আগস্ট অমৃতসরের বাজারে গণহত্যা ও মুসলিম নারীদের গণধর্ষণ, পাঞ্জাবের গণহত্যা, দিল্লির মুসলমানদের কচুকাটাসহ সর্বস্বান্ত ও সর্বহারার মিছিল দিয়ে পালিত হল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার উৎসব, আর উৎসবের খরচা হল ৬ লক্ষ ভারতীয়ের প্রাণ, ১ লক্ষ নারীর সম্ভ্রম ও ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের বাস্তুচ্যুতি ও অগণিত মন্দির-মসজিদ-মাজারে ধ্বংসতাণ্ডব। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ তথা স্বাধীনতাই হয়ে গেল বাঙালির জীবনের চিরস্থায়ী অভিশাপের ট্রাজেডি। জিন্নাহ-নেহেরু-প্যাটেলরা সেদিন মধ্যরাতে কৃষ্ণের রাধা দখলের মতো যখন ক্ষমতা দখলের আদিম উল্লাসে মেতে উঠেছিল, ঠিক তখনি কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানির মতোই (যার শরীরের একাংশ ভারতে, একাংশ বাংলাদেশে) বাঁচার আর্তি জানিয়েছিল নৃশংস আত্মবিচ্ছেদের ট্রাজেডির শিকার বাঙালি। রবীন্দ্রনাথের কথিত ‘অতিনৃশংস আত্মবিচ্ছেদে’র যন্ত্রণায় পাণ্ডুর হয়ে কাতরিয়েছে দুই ভূখণ্ডের বাঙালি; নিজের আবাসভূমি ছেড়ে যারা পালাতে পারল কিংবা মাটি কামড়ে থেকে গেল যারা, সকলেই নিজ দেশে উদ্বাস্তুর মর্যাদা পেল। সর্বগ্রাসী ভাঙনের শিকার হল বাঙালি, ‘তার পরিবার ভেঙেছে। দেশ ভেঙেছে। হৃদয় ভেঙেছে।’আর এই ভাঙনের খেলায় পড়ে কী ভয়ানক রক্তক্ষরণ ঘটেছে তারই একটি দৃষ্টান্ত হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের প্রবীণ ও তার আত্মজার নির্মম বাস্তবতা, যে বাস্তবতা দেখে চোখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। জানা গেছে, পাঁচ দশকের দুই বাংলার দশ শ্রেষ্ঠগল্পের একটি এই গল্পটি। কিন্তু যদি পাঁচ দশকের একটি গল্প নির্বাচনের প্রশ্ন ওঠে, তখনও সম্ভবত, এই গল্পটিই স্বমহিমায় সামনে দাঁড়াবে।নামগল্পটি ছাড়াও ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ (১৯৬৭) গল্পগ্রন্থের বাকি সাতটি গল্পের (পরবাসী, সারাদুপুর, অন্তর্গত নিষাদ, মারি, উটপাখি, সুখের সন্ধানে, আমৃত্যু আজীবন) প্রত্যেকটিই বাংলা ছোটগল্পের ভাণ্ডারে হীরকজ্যোতি নিয়ে জাজ্বল্যমান।
দেশভাগজনিত নৃশংস আত্মবিচ্ছেদের ভয়াবহ মানবিক যাতনার প্রত্যক্ষ শিকার আমাদের ছোটগল্পের এই বরপুত্র। তাই তাঁর সৃষ্টির জমিনের একটি বিস্তৃত জায়গা জুড়ে আছে দেশভাগ ও তার ফলে সৃষ্ট মানবিক সংকট। রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা, কিছু স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থচিন্তার নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে তৃণমূল মানুষ যেভাবে মিছিল করে তার পিতৃপুরুষের বাস্তুভিটা ত্যাগ করেছিল এবং পরিণতিতে যে ভয়ানক মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল, এবং তার স্বাক্ষী হিসেবে ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছে’র আত্মধিকৃত প্রবীণকে যেভাবে হাসান ভাবিকালের সামনে এনেছেন, তাতে পাওয়া যায় মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত বিরাট উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর শেকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণার পুঞ্জিকৃত ইতিহাস। মিথ্যা আশ্বাস, ভণ্ডামি আর গোঁজামিলের স্বাধীনতা এলো।ধর্মের ভিত্তিতে একটি সুগঠিত জাতিসত্তাকে গরুকাটার মতো কেটে দুই ভাগ করে যার যার সুবিধামত ভাগবাটোয়ারার যে নাটক রচিত হল তার পরিণতি এতটা আত্মঘাতি হবে, নিজের আত্মজাকে উদ্বাস্তু জীবনের জীবিকার প্রধান অবলম্বন করা হবে, দেশভাগের হোতারা সেদিন কি তা ভেবেছিল? হাঁপানী আক্রান্ত এই উদ্বাস্তু প্রবীণের জীবনধর্মের এই নিষ্ঠুর ট্রাজেডি ও নির্মম আত্মযন্ত্রণার বিষবাতাস কি স্বাধীনতার সুখকে ছুঁয়ে যায়নি? নিজের নিরাপদ ও সুখের আশ্রয় ফেলে এসে গ্রামের নোংরা পরিবেশ ও চরম নৈরাজ্যের মধ্যে জীবনযাপনের গ্লানির সাথে যোগ হওয়া নিদারুণ অর্থসংকটে পতিত প্রবীণের বেঁচে থাকার জন্য এই একটি পথ করে দিয়েছে স্বাধীনতা, তা হল নিজের আত্মজাকে দুই টাকায় প্রতি রাতে বিক্রির সুলভ সুযোগ। ‘শ্লেষের দলা শ্বাস নালীটাকে একেবারে স্তব্ধ’করে দিলেও এবং ‘চোখ কপালে তুলে’কাশলেও প্রবীণকে ঠিকই ভদ্রতার নাটক করতে হয়েছে। অন্যথা, নিজের আত্মজাকে দুই টাকায় বিক্রি করার মতো জঘন্য অপরাধের অপরাধী পিতার এই নির্লজ্জপনা স্বাধীন দেশে চলবে কেন? স্বাধীনতার অপমান মানবে কেন? তাই কুৎসিত বাস্তবতায় পতিত এই পিতাকে একেবারেই বিবেকবর্জিত নিজের আত্মজাকে দুই টাকার বিনিময়ে বখাটের হাতে তুলে দিতে হয়নি। তার ভেতরে বিবেক সক্রিয়। তাই, সুহাস ও ফেকুর দুই দুই করে চার টাকা প্রবীণের হাতে দিয়ে ফেকু যখন বলল, ‘সুহাস আর আমি দিচ্ছি।’তখন প্রবীণ ভীষণ ভীতু-সন্ত্রস্ত, চেয়ার থেকে হেলে পড়ে শরীর। জীবন তাকে দক্ষ অভিনেতা বানিয়েছে! মিথ্যা অভিনয়ের এই ছলটুকু করতে পারল নিখুঁতভাবেই, ‘দাও। আর কত যে ধার নিতে হবে তোমাদের কাছে! কবেই-বা শুধতে পারব এই সব টাকা। সুহাস উঠে দাঁড়ায়। চলে যাবে এখন? এত তাড়াতাড়ি? রুকু রাগ করবে- চা করতে দিলে না ওকে। ওর সঙ্গে দেখা না করে গেলে আর কোনদিন কথা বলবে না।’ এদিকে প্রবীণের শয্যাগত স্ত্রী এই প্রসঙ্গে কথা বললে বৃদ্ধ হিংস্র ব্যবহার করে, ‘চুপ, চুপ, মাগী চুপ কর, কুত্তী-’
দেশভাগের ট্রাজেডির শিকার বাস্তুভিটাহারা প্রবীণ ভেতরে-বাইরে আত্মদ্বন্দ্বে পরাভূত এক মহান ট্রাজিক নায়ক। তার ভাষায়, ‘দেশ ছেড়েছে যে তার ভেতর বাইরে নেই। সব এক হয়ে গেছে।’ কৃত্রিম ভদ্রতার আড়ালে নিজের আত্মজাকে বখাটেদের হাতে তুলে দেবার যাতনা অসহ্য হয়ে উঠলেও সামনে শুধুই অন্ধকার। তার ভেতরে হাহাকার তার প্রাঙ্গণে লাগানো করবী গাছের সাথেই তুলনীয়।করবী ফুলের বিচি থেকে বিষ পাওয়ার আশায় লাগিয়েছিলেন করবী গাছ। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, সেই বিষ এখন তাকেই গলাধঃকরণ করে নীল হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে হচ্ছে। নিজে তার পরিবারকে বাঁচাতে পারছেন না, পালাতেও পারছেন না। একদিকে পাশের ঘরে নিজের আত্মজাকে খাবলে খাচ্ছে দুই বখাটে। মেয়ের চুড়ির শব্দ, কান্নার শব্দ, গোঙানির শব্দ, বখাটের অট্টহাসি পিতার কানে আসছে, অন্যদিকে অসহায় পিতা করবী গাছের গল্প বলছে ইনামের কাছে, যে দুই টাকার জোগাড় করতে পারেনি। গল্প বলতে গিয়ে বারবার শ্লেষ্মা এসে কণ্ঠরোধ করে দিচ্ছে। কোন বাক্যই সে সমাপ্ত করতে পারে না। মেয়ের চুড়ির শব্দ তার কণ্ঠরোধ করে দিচ্ছে।
বুড়ো গল্প করছে, ভীষণ শীত করছে ওর, চাদরটা আগাগোড়া জড়িয়েও লাভ নেই। শীত তবু মানে, শ্লেষ্মা কিছুতেই কথা বলতে দেবে না তাকে। আমি যখন এখানে এলাম, আমি যখন এখানে এলাম, হাঁপাতে হাঁপাতে কাঁপতে কাঁপতে সে বলছে, বুঝলে যখন এখানে এলাম…তার এখানে আসার কথা আর ফুরোচ্ছে না- সারারাত ধরে সে বলছে, এখানে যখন এলাম- আমি প্রথমে একটা করবী গাছ লাগাই…তখন হু হু করে কে কেঁদে উঠল, চুড়ির শব্দ এলো, এলোমেলো শাড়ির শব্দ আর ইনামের অনুভবে ফুটে উঠল নিটোল সোনারঙের দেহ-সুহাস হাসছে হি হি হিÑআমি একটা করবী গাছ লাগাই বুঝলে? বলে থামল বুড়ো, কান্না শুনল, হাসি শুনল, ফুলের জন্য নয়, বুড়ো বলল, বিচির জন্যে, বুঝেছ, করবী ফুলের বিচির জন্যে। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে। আবার হু হু করে ফোঁপানি এলো আর এই কথা বলে গল্প শেষ না করতেই পানিতে ডুবে যেতে, ভেসে যেতে থাকল বুড়োর মুখ-প্রথমে একটা করবী গাছ লাগাই বুঝেছ আর ইনাম তেতো তেতো-এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন কাঁদতিছ তুমি? (আত্মজা ও একটি করবী গাছ)
‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’গল্পের সমাজবাস্তবতাও বিশেষ সাংকেতিকতায় পূর্ণ। সে অর্থে গল্পের বড় পরিসরে সমাজচিত্র না পেলেও তিন বখাটে এবং তাদের সংক্ষিপ্ত সংলাপের মধ্য দিয়ে অধঃপতিত গ্রামবাংলার একটি জনপদের ছবি দেখতে পাই। অসুস্থ, শিক্ষাবঞ্চিত, নানা অবিচারে পূর্ণ এলাকাটি। তিন বখাটে ফেকু, সুহাস, ইনামের মতো স্কুলত্যাগী, বিড়িখোর, নারীভোগী ছেলেদের আলাপচারিতায় কিছু কদর্য সমাজসত্য উঠে আসে। আপাতবিচারে, ওদের কথাবার্তাকে খাপছাড়া ও অগোছালো মনে হলেও প্রত্যেকটি বাক্য লেখকের সুচিন্তিত লেখা, সমসাময়িক সমাজঅন্বিষ্ঠ। প্রত্যেকটি বাক্যই একটি বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত। সুহাসের ছোটমামার বিয়ের বিরক্তিকর কাহিনি শুনে অধৈর্য হয়ে ফেকু বলেছে, ‘তোর ছোটমামা বিয়ে করতি গিলো ক্যানে ক তো?’ পরিহাসের ছলে বললেও সমাজের আন্তঃক্ষতের দিকেই ইঙ্গিত যায়। যে সমাজে দুই টাকা দিয়ে রুকুর মতো এক তরুণী ভোগ করার অবারিত সুযোগ আছে, সে সমাজে প্রচলিত বিয়ে এক অর্থে অর্থহীনই বটে। তাই সম্ভবত, মামার সুন্দরী শ্যালিকাদের বিনা পয়সায় পাচ্ছে সুহাস এমন কুশ্রী কথার বলতে এবং সুযোগ পেলে নিজেও সুযোগ নেবার কথা বলতে ফেকুর রুচিতে বাঁধে না।
…মামীর বোনেরা যা সুন্দর সে আর কলাম না। তোর মামার বাড়িটা কোয়ানে, মামার শালীরা বেড়াতে আসলি কস আমাকে-ফেকু কথা না বললেই নয়, তাই বলে। সেটি হচ্ছে না, বুজিচো-চোখ বন্ধ করে মনের আরামে বলল সুহাস। ও, তাই তুমি মাসে পাঁচবার করে ছোটমামার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতি যাচ্ছো? বুজিচি, ওখেনে তো পয়সাকড়ি লাগে না; আরামেই আছো দেহা যায়-ফেকু চোখ মটকে বলে। (আত্মজা ও একটি করবী গাছ)
শিক্ষাবিমুখ এইসব বখাটে চরম হতাশায় আক্রান্ত। পকেটমার থেকে শুরু করে এহেন কাজ নেই তারা করে না।সিগারেট থেকে নারীভোগ সব প্রেকটিসই চলে। পুরো সমাজ কাঠামোর প্রতিই ওদের তীব্র ঘৃণা। মানবিক কোন শিক্ষাই তারা পায়নি, ফলে মানুষ হবে কী করে? পঙ্গু স্বাধীনতা বিকলাঙ্গ প্রজন্মের জন্ম দিয়ে অসুস্থ ও অসম ব্যবস্থার তৈরি করে দিয়েছে, যেখানে তরুণী মেয়ের শরীর বিক্রি করে পিতাকে বেঁচে থাকতে হয়। তরুণী রুকু অখণ্ড বাংলার প্রতীক হয়ে উঠেছে। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, বাবার ব্যর্থতা ও স্বার্থের কারণে নিঃশব্দে মেনে নিতে হচ্ছে এই রমণনিপীড়ন। যেভাবে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাঙালিকেও মেনে নিতে হয়েছিল দেশভাগের নাটক, নৃশংস আত্মবিচ্ছেদের ট্রাজেডি।
বৃদ্ধার করবী গাছের বিষ কী ভয়ানক পরিমাণে ছড়িয়েছে তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ‘পরবাসী’গল্পের বশির। একটি চমৎকার বর্ণনা দিয়ে গল্পটির সূচনা, ‘কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করে। কিছু একটা শব্দ। কিন্তু কিছুই শোনা গেল না।’বশিরের এই কিছু শোনার ব্যাকুল তিয়াশাই গল্পের প্রাণপ্রবাহ। দেশত্যাগি মানুষগুলো এভাবেই তার জন্মভিটার শব্দ কান পেতে শুনতে মরিয়া। নিরক্ষর, নিতান্তই গোবেচারা টাইপের এক অতিসাধারণ বশিরের খোঁজ নেবার প্রয়োজন ছিল না যে, দেশভাগ হতে চলেছে।খুব স্বাভাবিকভাবেই সে তার নিয়মিত অভ্যস্ত কাজে নিয়োজিত। সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিষ তার রক্তে তখনও বাসা বাঁধেনি। দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে বিভেদের সংঘাত চলছিল তা খুব দ্রুতই পৌঁছে গেল গ্রামের প্রত্যন্ত জনপদে। বশির কী করে রক্ষা পাবে? ‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় রক্ষা পায়?’ আকস্মিক সুনামির মতোই ধেয়ে আসা প্রতিপক্ষরা বীভৎস উল্লাস করে বশিরকে চিরকালের জন্য নিঃস্ব করে গেল। তার ছাব্বিশ বছরের বউ, সাতবছরে ছেলের প্রাণপাখি বাতাসে উড়িয়ে জনমের মতো একা করে গেল।
বাড়িটা ততক্ষণে পুড়ে শেষ। ওরা চলে গেল। বল্লম দিয়ে মাটির সঙ্গে গাঁথা বশিরের সাত বছরের ছেলেটা। ছাব্বিশ বছরের একটি নারীদেহ কালো একখ- পোড়া কাঠের মত পড়ে আছে ভাঙা দগ্ধ ঘরে। কাঁচা মাংস-পোড়ার উৎকট গন্ধে বাতাস ভারি।
আল্লা তু যি থাকিস মানুষের দ্যাহোটার মধ্যি-বুকফাটা চিৎকার করে উঠল বশির, কোতা, কোতা থাকিস তু, কুনখানে থাকিস বল।(আত্মজা ও একটি করবী গাছ)
বুকভাঙা আর্তনাদ নিয়ে নিঃস্ব বশিরকে নিজ দেশ থেকে পালিয়ে পাকিস্তানের পথে পা বাড়াতে হয়। তীব্র শীতের রাতে মজা-ডোবা, বন্ধুর অচেনা পথ ধরে বশির এগুতে এগুতে সীমান্তবর্তী এলাকার খালের পাড়ে হঠাৎ আবিষ্কার করে ধুতিপরিহিত একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, যে কিনা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে রাতের অন্ধকারে ভারতে ঢুকতে যাচ্ছে। প্রাগৈতিহাসিক জিঘাংসা বুকে চাড়া দিয়ে উঠলে বশির সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষটাকে খুন করে নিজের স্ত্রী-সন্তান হত্যার বদলা নিল। মূলত, গল্পটিতে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে, অর্থহীন স্বাধীনতা তৃণমূল মানুষের ভেতরে কিভাবে আদিম বর্বরতাকে সাম্প্রদায়িকতার প্রলেপে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দুর্বিপাকে পড়ে বশিরের মতো সম্পূর্ণ নিরপরাধ সাম্প্রদায়িক ভেদবোধহীন মাটির মানুষটিও বদলে হয়ে গেল কী ভয়ানক নিষ্ঠুর কাপালিক! বিনা কারণেই হিন্দু দাঙ্গাবাজদের বশিরের ঘর-বাড়ি, স্ত্রী-সন্তানকে পুড়িয়ে দেওয়া এবং সম্পূর্ণ অচেনা অসহায় একজন মানুষকে হত্যা করে বশিরের জিঘাংসা নিবৃত করার চেষ্টায় প্রমাণ হয়, সাতচল্লিশের দেশভাগ এবং তারই প্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কী পরিমাণ বিভেদ সৃষ্টি করেছিল মানুষে মানুষে।
গ্রামের সরল বিশ্বাসী ওয়াজুদ্দির দেশপ্রেমের অকৃত্রিম বক্তব্য, ‘তোর বাপ কটো? এ্যাঁ-কটো বাপ? একটো তো? দ্যাশও তেমনি একটো’ভেদবিভেদের নষ্ট রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি জোরালো প্রতিবাদ। দেশের সাধারণ মানুষের হাজার বছরের বন্ধন ও বিশ্বাসে একটি বিভেদের দেয়াল তৈরি করে দিল নেতারা। তারই পরিণতিতে এ কী নির্মম পরিহাস! ওয়াজুদ্দির মতো খাঁটি মাটিপ্রেমিক মানুষকে ‘কপালে চওড়া করে সিঁদুর লেপে’আসা অপরিচিত মানুষেরা খুন করল নৃশংসভাবে। জননীর মতোই পবিত্র সম্পর্কের জন্মভূমিকে ছাড়তে গিয়ে নাড়ির টানে অস্থির হয়ে বশির খেপার মতোই ছুটে ফিরেছে। কিন্তু যখনই চোখে ছবির মতো ভেসে উঠেছে তার যুবতী স্ত্রীর পোড়া লাশ এবং বল্লম দিয়ে মাটির সাথে গাঁথা তার সাত বছরের ছেলের ছবি, তখনই বশির আর মানবিক মানুষ থাকে না। ফিকে হয়ে আসে দেশপ্রেমও। “মনে মনে সে বলছে, ‘আমি আর বচির নাই-বচির শ্যাষ. বচিরের হয়ে গেলচে-দ্যাশ ফ্যাশ নাই-আমি এ্যাকোন আর এক দ্যাশে জন্ম লোব।”প্রতিশোধ স্পৃহায় বশির অন্ধ বিবেকহীনের মতোই খালের পাড়ের সাদা ধুতি পরিহিত অপরিচিত মানুষের মুখোমুখি দাঁড়াতে এবং নিষ্ঠুরভাবে খুন করতে তার হাত-বিবেক কাঁপেনি।
হাসানের এই গল্পটিতে একটি ভিন্নমাত্রার আবেদন আছে। স্বাধীনতার নেতৃবৃন্দ ক্ষমতার অন্ধ মোহে বিবেক বিসর্জিত অন্ধ অজগরের মতোই সব কিছু গ্রাস করে নিতে, নিজেদের আধিপত্য ও অহমিকাকে জিইয়ে রাখতে ঘৃণ্য তৎপরতা চালিয়েছে। পরিণতিতে এক দেশকে দুই দেশ করে এবং একজাতিকে দুইভাগ করে। একটি অখ- বিশ্বাসকে আন্তঃবিভেদের বীভৎস খেলায় নামিয়ে দিয়ে দেবতার মতো ঊর্ধ্বে বসে হেসেছে। দুই সম্প্রদায়ের বন্ধন বিশ্বাসে একই সঙ্গে দুটি টর্চ ফেলে দেখেছেন হাসান।
একসঙ্গে দুটি টর্চের আলো পড়ে, বশিরের মুখে একটি আর একটি মৃত্যুযন্ত্রণাখিন্ন হতবাক সেই মুখের ওপর। আলো সরে গেলে বশির দেখল সেই মুখ ঠিক যেন ওয়াজুদ্দির মুখ-রক্তাক্ত, বীভৎস, তেমনিই অবাক। চোখের ওপর থেকে ধোঁয়াটে পরদা যেন সরে গেল, আর তার চোখের পানিতে ধূসর হয়ে এলো দুটি পৃথিবী-যাকে সে ছেড়ে এলো এবং যেখানে সে যাচ্ছে।(পরবাসী)
সাতচল্লিশের দেশভাগ, এরই প্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও দেশত্যাগ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে একটি বিরল সৃষ্টি হাসানের ‘পরবাসী’ গল্পটি। গ্রামের সহজ সরল মানুষদের হাজার বছরের সৌহার্দ্যরে বন্ধনকে বিষাক্ত করে ফায়দা লুটেছে ক্ষমতালোভীরা। তার পরিণামের শিকার বশিরের মতো শান্তপ্রিয় নিরীহ মানুষ।
[২]
হাসান আজিজুল হকের ‘উটপাখি’গল্পটি তাঁর সমগ্র গল্পের প্রেক্ষিতে একটি স্বতন্ত্র মেজাজ ও মাত্রা বহন করে। বিশেষত, জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে দার্শনিক বিচার বিশ্লেষণ গল্পকার হিসেবে তাঁর ধাঁচে যায় না। কোন প্রকার ইজমে বিশ্বাস নেই তাঁর। প্রায় আজীবন দর্শনশাস্ত্রে অধ্যাপনা করেও আশ্চর্য রকমভাবে নিরাপদ থেকেছেন পাঠকদের দর্শন শেখানোর অপকৌশল থেকে। গল্পের নায়ক একজন ডাকসাইডের জনপ্রিয় লেখক। তরুণ সমাজের উপর প্রবল আধিপত্য তার। সৃষ্টিশীলরা সমাজের অগ্রসরমান চিন্তাশীল দেবতাতুল্য মানুষ, যার চিন্তা মানুষকে সুস্থ-সুন্দরের পথ দেখাবে। কিন্তু তার লেখা পড়ে তরুণ সমাজ হতাশা আক্রান্ত হয়, ‘পাগলের মত হতাশা মাখে, পান করে।’বাস্তবে লেখক নিজে প্রচণ্ড রকমের জীবনবাদী। তিনি যাপন করেন অফুরান আনন্দময় সুস্থ সামাজিক একটি জীবন। লেখক আর লেখার এই বৈপরীত্যই প্রমাণ করে লেখক সৎ নন। সব কিছুই তার ভান বা মেকি। লেখক নিজেই স্বীকার করেন, মৃত্যু সম্পর্কে কোনোদিনই সতর্ক ও সচেতন ছিলেন না। কিন্তু আকস্মিক মৃত্যুচিন্তা অনুপ্রবেশ করে তার ভেতরে। যে মৃত্যু হরহামেশাই তার লেখায় থাকে সেই চিন্তায় নিজে আক্রান্ত হয়ে আত্মোপলব্ধি ঘটেছে, তার সব লেখাই বাস্তবতাবর্জিত। লেখকের চিন্তার নবজাগরণ ঘটে। এখন জীবন তার কাছে চাতুরীর নামান্তর। তার ভাষায়, ‘জীবন ক্রমাগত ছল করে-আগাগোড়া ছেনালি করে যায় জীবন। কিন্তু সৎ মৃত্যু ছলনা করে না, চাতুরি করে না, প্রিয়জনের ভান করে না।’লেখকের বন্ধু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে খাপছাড়া রকমের ব্যবহার করে। তার ভাষায়, ‘ডাক্তার আমার কিছু করতে পারবে না।তুমি, তোমার ঐ ডাক্তার, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ, সবকিছু আমার কাছে এখন মৃত্যুচিহ্নিত। আমি চোখে চশমা পড়ে আছি।’আমাদের অভ্যস্ত যাপিত জীবনের মাদকতার আড়ালে থাকে বিশাল অন্তঃসারশূন্যতা ও অর্থহীনতা। লেখকের চোখের সামনে থেকে সেই আড়ালের পর্দা সরে গিয়েছে। তাই জীবন তার কাছে নিতান্তই অর্থহীন ও শূন্যগর্ভা। তুলনায়, মৃত্যু আস্থাশীল ও নির্ভার। ফলে লেখকের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে মৃত্যুচিন্তা ঢুকে জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’কবিতার মানুষটির মতো স্বেচ্ছায় জীবনের সাথে সমস্ত সম্পর্ক চুকে ফেলার জন্য মরিয়া লেখক।
সেইখানে বসে তিনি তাঁর পূর্ব জীবনের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক অস্বীকার এবং ছিন্ন করলেন। সমস্ত আনন্দ হাসি হুল্লোড় চিৎকার ও সামাজিকতা তাঁর কাছে স্বপ্নের ও তামাশার মত মনে হল। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার মত তিনি তাঁর আগের জীবনটিকে দেখতে থাকেন। দিনের পর দিন ক্ষয় পেতে পেতে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ মুছে গেল সেই জীবন এবং তার চোখে এক বিরাট বিস্তৃত বর্ণহীন ধূসরতা স্পষ্ট হয়ে উঠল। তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসন নিলেন। পুরনো জীবন থেকে নয় শুধু, পুরনো পৃথিবী থেকেও। সমাজ, সঙ্গ, বন্ধু, নিজের পূর্ব ব্যক্তিত্ব সব কিছু থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে ইজি চেয়ারে বসে তিনি তাঁর অসুস্থতার সম্মুখীন হলেন। (উটপাখি)
জীবন সম্পর্কে লেখকের বিশ্বাস পুরোপুরি পাল্টে গেছে। জীবন থেকে পালাতে চাইলেও এত সহজেই যে তাকে পালাতে দেবে না সে বিষয়েও লেখক সজাগ। প্রকৃতপক্ষে, মানুষ নিজের অজান্তেই রোপণ করে নিজের পতনের বীজ। উটপাখি যতই মরুবালুতে মুখগুঁজে আত্মগোপনের প্রচেষ্টা করুক না কেন সে জানে না যে, বালুর উপরে ফেলে আসা তারই পদচিহ্ন ধরে শিকারি আসবে।
জীবন আসলে এক রকম নেশার পিপাসা, পিপাসা ক্রমাগত বাড়তে থাকে; কখন আরো নারী, আরো খাদ্য, আরো সম্মান, অর্থ, স্বাস্থ্য চাইতে হয় জীবনের কাছে। কিন্তু আরো নারী, আরো খাদ্য, আরো সম্মান, স্বাস্থ্য শুধুই আরো অতৃপ্তি দেয়Ñআরো জঘন্যতাবোধ, আরো মরিয়া হতাশা, চেতনা যত তীব্র হয়, হতাশা, অর্থহীনতা, হয়ে দাঁড়ায় আমাদের বিধিলিপি। তখন সবকিছূকেই ফাটিয়ে দিয়ে, জীবনকে খোলা আকাশের নিচে চিৎ ফেলে বুকের উপর পা দিয়ে মৃত্যু স্থির চোখে তার দিকে চেয়ে থাকে। (উটপাখি)
মানসিক বিকারগ্রস্ত লেখক মূলত নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন, তাই ঘুম-জাগরণ নেই, সর্বসময় মৃত্যুচিন্তা আলোড়িত হতে থাকে মস্তিষ্কে। শহরের প্রান্তসীমায় ‘বুনোলতা জঙ্গলে ঢাকা’একটি বাড়িতে একাকি বসবাস তার। এই অসীম নির্জনতা তাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে বাস্তব পৃথিবী থেকে। চূড়ান্ত বিচারে মানুষ মূলত একা-লেখক তাই অনুধাবন করেছেন। লেখক এই সত্যও উপলব্ধি করেন, দৈহিকভাবে বেঁচে থাকলেও আত্মিকভাকে তিনি মৃত। বিষয়টাকে তার কাছে ‘নোংরা’বলেই মনে হয়। মরে গিয়েও দৈহিকভাবে বেঁচে থাকা। কোন কিছুতেই আর বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পান না লেখক। কবিতা, ধর্ম, দর্শন কিছুতেই তার আস্থা নেই।বন্ধু, প্রিয়জন হতাশ করেছে। তাই উটপাখির মতো বালুতে মুখগুঁজে নিজেকে আত্মরক্ষার শেষ কৌশল হিসেবে শেষ চেষ্টা করতে গেলেন তার প্রেমিকার কাছে। প্রেমিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক জীবিত সুস্থ মানুষের মতো কথা বলতে না পেরে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে পড়েন। লেখকের অসামাজিক অসংলগ্ন এলোমেলো আচরণ ও কথাবার্তা এখন তার প্রেমিকা মেয়েটির কাছে অর্থহীন; কেননা লেখকের জায়গায় আর একজনের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। প্রেমিকার কাছে প্রত্যাখ্যাত লেখকের আর বন্ধন বলতে কিছুই রইল না।
তুমি আমাকে কিছু দিতে পারো না? তুমিও আমার মত দেউলে, তাই না? লেখক থেমে গেলেন। তাঁর এই অসামাজিক, অসংলগ্ন ভয়ঙ্কর কথার উত্তরে মেয়েটি যেন বোবা হয়ে গেল।
কথার জবাব দিচ্ছো না কেন? গর্জন করে উঠলেন লেখক। কাঁপতে কাঁপতে মেয়েটি বলে, আমি তোমার কথার কিছুই বুঝতে পারছি না। এসব কি বলছ তুমি? তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। আমি, আমরা কেউ চাই না তুমি এখানে আসবে। ও ঘরে সে বসে আছে। এখনি হয়তো আসবে এখানে। কি ভাববে তোমাকে দেখলে?
আচ্ছা- হো হো করে হেসে ওঠেন লেখক, হাসতে হাসতে বলেন, সংসার পাতছ, না?
মেয়েরা আর কি করতে পারে? অনেক দিন অপেক্ষা করা গেছে তোমার জন্যে। তুমি তৈরি হতে পারলে না-কে আর কি করবে তোমার?
ঠিক বলেছো-লেখক বললেন, হৃদয় সিংহাস কতদিন শূন্য রাখা যায়!
বলেই উঠলেন তিনি। রাস্তায় এলেন, দেখলেন মৃত্যুর ছায়ায় আবছা শহর কাঁপছে, দুলছে, ভেঙে পড়ছে তাসের ঘরের মত। (উটপাখি)
গল্পের কাহিনিতে অতিকৌশলে সচেতনভাবে একটি বিষয় আড়াল করে গেছেন হাসান, কেন এই মৃত্যুচিন্তা? কেনই বা প্রচণ্ড জীবনবাদী একজন লেখক জীবনের সাথেই বৈরিতায় জড়িয়ে পড়লেন? কেন তাঁর এই নির্মম আত্মবিচ্ছেদ? তাঁর হতাশার জায়গাটা কোথায়? গল্পের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, লেখকের মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পিত পলায়নপর বিকারগ্রস্ততার মূল বীজ নিহিত আছে অসুস্থ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। রুগ্ন সমাজ চিন্তাশীল সচেতন মানুষের বাস উপযোগী নয়। সংসারের দিকচক্রবাল ঘূর্ণন হতে মুক্তির একটাই পথ সামনে-মৃত্যু। উপরন্তু আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের সময়কালে সৃষ্ট অরাজকতার কারণে সুস্থ চিন্তাশীল মানুষের বেঁচে থাকার উপায় ছিল না বলেই লেখক স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চাইছেন।
প্রচণ্ড জীবনপিপাসু মানুষ যদি কোন কারণে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে তার পরিণতি হয় ভয়ানক।প্রতিষ্ঠিত সমাজকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে বসে তখন। নিজের প্রতি আস্থাহীন হয়ে শেষে বেঁচে থাকাটাই হয়ে যায় চরম অর্থহীন।কোন বিবেক প্রবল মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে কীটপতঙ্গের মতো কেবল বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকতে চায় না। আর যে কারণেই হয়ত জীবনের ছল আবিষ্কারের পরে লেখকের বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। ‘অন্তর্গত নিষাদ’ গল্পের কেরানি লোকটা অর্থহীন জীবনের বিরুদ্ধে নিদারুণ ফুঁসে ওঠে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পেছনে ক্রমাগত দিশেহারা হয়ে ছুটে শেষে তার উপলব্ধি ঘটে, এই জীবনে সুখ আর পাওয়া হবে না কিংবা পেতে দেবে না। একশ্রেণির মানুষের একচেটিয়া আধিপত্য এখানে। ক্ষুব্ধ কেরানি দরজার সিটকিনি খুলতে গিয়ে আঘাত পাওয়ার মতোই সুখ ধরতে গেলে আঘাত পেয়ে রক্তাক্ত হতে হয়। তার জীবনের সুখ-স্বপ্ন ভয়ানক পরিহাস হয়ে সামনে দাঁড়ায়, তার স্বপ্নের নিমফুল ফুটে আছে জজ সাহেবের বাড়ির উঠোনের সজনে গাছে। অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা, অবহেলা জীবনকে এমন করে বেঁধে ফেলেছে যে, এখান থেকে মুক্তির কোন পথই খুঁজে পায় না। নগর ছেড়ে অনেক দূরে খোলা মাঠে বুকভরে নিশ্বাস নিতে গিয়ে সেখানেও বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। প্রাতঃরাশে বের হওয়া সমাজের অভিজাতশ্রেণির প্রতিনিধি উকিল সাহেবকে দেখে বিব্রত ও লজ্জিত হয়। অনধিকার চর্চার অপরাধে পালাবার পথ খুঁজে। উকিল তীব্র কটাক্ষ করে বলেছে-‘প্রাতভ্রমণ হচ্ছে- বটে বটে-সূক্ষ্ম একটা হাসি এলো ভদ্রলোকের ঠোঁটে এবং ক্রুর দুটি চোখের ওপর কাঁচা-পাকা ভ্রূ ঝুলে রইল, সকালে না বেড়ালে আমার কুকুরটারও খিদে হয় নাÑসরল মনে এই কথা বলে কুকুরের টানে ভেসে গেলেন তিনি।’চরমতম এই অপমানে অস্তিত্বের সংকট তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু সে পরাজয় মেনে নিতে প্রস্তুত নয় কিংবা পরাজয় সে কিছুতেই মানবে না।ক্ষুব্ধ কেরানি অবহেলার তীব্র জবাব দেবার মনোরথ নিয়ে মাসিক মাইনের সব টাকা দিয়েই একদিনের বাদশাহ সাজার সেই রূপকথার নায়কের মতোই অভিজাত মানুষ হয়ে যায়। পছন্দের সিনেমার টিকেট কেটে সিনেমা হলে প্রবেশ করে, সিনেমা দেখে সিংহের মতো স্মৃতি নিয়ে এসে বেয়ারা-দারোয়ানের রক্তচক্ষুকে অবহেলা করে শহরের সবচেয়ে অভিজাত হোটেলে পেটভরে তোফা খেয়ে, নিজের স্ত্রী-সন্তানদের জামা-কাপড়, স্নো-পাউডার, মশার কয়েল, ডেটল, মলম, সখের কলমদানি কিনে, মুখে পান ঢুকিয়ে চিবোতে চিবোতে বাড়ি ফিরেছে। স্ত্রী-সন্তানকে নতুন কাপড় পরিয়ে, সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে গল্প-আড্ডায় মজে, এক যুগ পরে স্ত্রীর গলা সোহাগে জড়িয়ে বিছানায় গেল। অবশেষে সকাল হতেই ‘ভরা সুখের সংসারে লাথি মেরে’কড়িকাঠে ঝুলে আত্মহত্যা করে জীবনকে কলা দেখিয়ে গেল, আর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে গেল পুঁজিবাদী সমাজকে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে। জীবনের সব বন্ধন এতটা খেলু করে মানুষটির এই যে স্বেচ্ছায় প্রস্থান, এই যে নির্মম আত্মবিচ্ছেদ, এর বাইরে আর কী ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়? পুঁজিবাদের প্রবল প্রতাপে সুবিধাভোগী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জৌলুসে মামুলি একজন কেরানির জীবন কীট-পতঙ্গতুল্য বা উকিলের কুকুর চাইতেও ইতরতর, তার সুখ, তার চাওয়া-পাওয়ার প্রশ্ন এই বাজার মূল্যে নিতান্তই কৌতুকের; সুস্থ আলো-বাতাসে নিঃশ্বাস নেবার অধিকারও খর্বিত। জীবনের সাথে তার এই নির্মম সংঘাত, এবং আত্মবিচ্ছেদ, এবং শেষে আত্মহত্যা এসবই জীবনবাদী একজন মানুষের প্রবল প্রতিবাদ। এর চাইতে বড় প্রতিবাদের শক্তি-সামর্থ্য কোনটাই ছিল না মানুষটার।
হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’(১৯৬৭)। দাঁড়াবার জন্য একজন লেখকের পায়ের নিচে যে পরিমাণ মাটির প্রয়োজন, তা এনে দিয়েছিল তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’(১৯৬৪)। তিন বছরের কাল ব্যবধানে তাঁর আর দাঁড়ানোর প্রয়োজন ছিল না, নেপোলিয়নের মতো শানিত তরবারি উঁচিয়ে প্রসার ও শাসন করে গেছেন বাংলা ছোটগল্পের সুবিশাল সাম্রাজ্য। ষাটের দশকের এই ক্ষত্রিয় লড়াকু বাংলা ছোটগল্পের ধারণাকে যথেষ্ট পাল্টে দিয়েছেন।
(চন্দন আনোয়ার, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।)