২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, রাত ১১:৪৬
বিসর্জন : দেবতার নামে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ
শনিবার, ১ আগস্ট, ২০২০

গওহর গালিব।।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে আদিগন্ত ব্যাপ্ত হয়ে আছেন তিনি,… রবীন্দ্রনাথের উপযোগিতা, ব্যবহার্যতা ক্রমশই বিস্তৃত হয়ে, বিচিত্র হয়ে প্রকাশ পাবে বাংলা সাহিত্যে।’ তাই তো আজ বড় দুঃসময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গভীরভাবে মনে পড়ছে। আমরা আজ যে সঙ্কট ও সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি সেখানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অস্তিত্ব ও প্রজ্ঞা সমেত ধ্রুব সত্য হয়ে ধরা দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় শতবর্ষ পূর্বে ধর্মের নামে এক সর্বগ্রাসী আগ্রাসনকে চিহ্নিত করে তাঁর ‘‘বিসর্জন’’ নাটকে বলেছিলেন, ‘দেবতার নামে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ।’

 এখানে দেবত্ব বলতে তিনি ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস ও ধর্মীয় গোড়ামিকে বুঝিয়েছিলেন। ধর্মকে বুঝে না বুঝে মানুষ যে ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে সীমাহীন দুর্যোগ ও দুর্ভোগের স্বীকার হয়, তার রক্তক্ষরণ রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন শত বছর পূর্বে। তাই ধর্মের নামে সৃষ্ট দাহ ও যন্ত্রণার আয়ুধও তিনি দিয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞায়। তাঁর এই চেতনারই এক কালজয়ী সৃষ্টি ‘‘বিসর্জন’’ নাটক। ধর্ম যে নিছক এক আনুষ্ঠানিকতা নয়, নয় শুধু লোকাচারের অনুশাসন, বরং সত্যিকার ধর্ম হলো মানব কল্যাণের- তাঁর এ ভাবনার শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ ‘‘বিসর্জন’’ নাটক।

জীবপ্রেম ও মানববাদের শ্রেষ্ঠতম কীর্তি ‘‘বিসর্জন’’ নাটকটি। রাজর্ষি উপন্যাসের ঘটনাংশ নিয়ে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে রচিত বিসর্জন নাটকটি রবীন্দ্রদর্শনের শ্রেষ্ঠতম স্বাক্ষর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বিসর্জন নাটকটি এর কালোত্তীর্ণ প্রাসঙ্গিকতায় আজও প্রাসঙ্গিক। অর্থাৎ ধর্মীয় কুসংস্কার ও গোড়ামির বিপরীতে প্রেমই হলো মানবকুলের শ্রেষ্ঠতম শান্তির নিয়ামক। রবীন্দ্রনাথের মতে এই বিষয়টিই আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সঙ্কট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। সমগ্র জীবনব্যাপী রবীন্দ্রনাথ যা ভেবেছেন, যা লিখেছেন তার মূলে ছিল মানববাদ। আর এই মানববাদ তথা জীবপ্রেমকেই রবীন্দ্রনাথ প্রতিপাদ্য করেছেন তাঁর এ নাটকে।

এ নাটকে তিনি যে দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে ছিলেন বদ্ধপরিকর তা হলো- ‘ধর্ম যখন তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও স্বরূপ হারিয়ে নিমজ্জিত হয় গোড়ামি ও আচার সর্বস্বতায়, তখন তা হয়ে ওঠে মানবতাবিরোধী।’ রবীন্দ্রনাথ জানতেন আচার সর্বস্ব ও ধর্মের অন্ধ অনুসারিরা ধর্মের বাহ্য রূপকে টিকিয়ে রাখার জন্য হয়ে ওঠে একরোখা ও প্রাণহন্তারক। মানুষ ধর্মকে উপলক্ষ করে কতটা নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে পারে, তার প্রমাণ এদেশে পূর্বেও ছিল, এখনও আছে। যুগে যুগে কালে কালে এ ভূভাগে একদল মানুষ ধর্মের নামে উন্মাদনা চালিয়েছে কারণে অকারণে। আর ধর্মের নামে এই বীভৎসতার প্রতিবাদ রবীন্দ্রনাথ বিসর্জন নাটকে জানিয়েছেন এক দার্শনিক প্রজ্ঞায়।

‘‘বিসর্জন’’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ মূলত মনুষ্যত্ব ও পশুত্বের দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে মানবপ্রেমের জয়গানকে প্রধান করে তুলেছেন। ধর্মের নামে পশুহত্যা বা পশুবলী রবীন্দ্রনাথ কখনই মেনে নিতে পারেননি। তাই এ নাটকে আমরা দেখি ধর্মকে রবীন্দ্রনাথ অহেতুক রক্তপাত থেকে মুক্ত করে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছেন প্রেমের ওপর। নাট্যকার মূলত প্রেমের মন্ত্রকেই প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছেন বিসর্জন নাটকে। রক্তপাত ও হিংসা কখনই মানবকল্যাণের পথ হতে পারে না, তাই শান্তি ও মঙ্গল কামনায় বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিসর্জন নাটকে প্রতিপাদ্য করলেন ‘মানবপ্রেমই শ্রেষ্ঠ ধর্ম ’।

নাটকের প্রারম্ভে আমরা দেখি রাজমহীষী গুণবতী সন্তান কামনায় ধর্মগুরু রঘুপতির কাছে পশুবলী দেয়ার বাসনা ব্যক্ত করছে। কিন্তু রাজা গোবিন্দমাণিক্য সর্বজনীন প্রেমধর্মের স্বার্থে পশুবলী দেয়ার প্রথাকে তাঁর রাজ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু রাজপুরুহিত রাণীর বাসনাকে পুঁজি করে আপন পৌরহিত্যের প্রভাব ও দম্ভকে টিকিয়ে রাখার জন্য পশুবলী দেয়ার পক্ষে ছিলেন বদ্ধপরিকর।

সমগ্র জীবনভর রবীন্দ্রনাথের ধর্মাদর্শের মূলে ছিল মানবপ্রেম। সুতরাং আমরা দেখি রবীন্দ্রহৃদয়ের প্রতিনিধি হয়েই ‘‘বিসর্জন’’ নাটকে গোবিন্দমাণিক্যের আবির্ভাব। তিনি রাজা, তাই প্রেমের স্বপক্ষে অকারণে পশুবলী নিষেধাজ্ঞায় রাজক্ষমতা ব্যবহার করেন। অপরপক্ষে, রাজপুরোহিত রঘুপতি তাঁর ব্রাহ্মণ্যের অহম ও হাজার বছরের পালিত শাস্ত্রাচারের দম্ভে রাজাকে শুনিয়ে দেন, ‘শাস্ত্রবিধি তোমার অধীন নহে।’

রঘুপতির এ তর্জন মূলত হাজার বছরের ধর্মীও গুরুদের ধর্মের নামে ক্ষমতা ভোগের আস্ফালনেরই প্রতিধ্বনি মাত্র, যা আমাদের বর্তমান সমাজেও সবিশেষ দৃশ্যমান। কিন্তু রাজার ‘আজি হতে পশুবলী হইল নিষেধ’- এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় রাজশক্তি ও ব্রাহ্মণ্যশক্তি তথা ধর্মশক্তির লড়াই। সে লড়াইয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে রাজ্যের সকল মানুষ। রাজমাতা থেকে শুরু করে রাজ্যের প্রায় সকলেই এক অমল বিশ্বাস নিয়ে পক্ষ নেয় রঘুপতির তথা হাজার বছরের পালিত ধর্মের। ধর্মের প্রতি অন্ধ ও অনুরক্ত এ মানুষগুলোকে ধর্মগুরু দ্বিধাহীনচিত্তে কাজে লাগায় তাঁর আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে। অন্যদিকে নিঃসঙ্গ রাজার পাশে সেই অর্থে কেউ দাঁড়ায় না। শুধু দুঃখী বালিকা অর্পণা ও রঘুপতির পালিত পুত্র জয়সিংহই রাজার আদর্শ বুঝতে পারে।

আধিপত্যের মোহে অন্ধ রঘুপতি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত হতে পিছপা হন না। তিনি সেনাপতি নয়নরায়কে ধর্মের নামে উত্তেজিত করেন রাজার বিরুদ্ধে, দেবীর স্বপ্নাজ্ঞার কথা বলে রাজা হওয়ার লোভ দেখান রাজভ্রাতা নক্ষত্ররায়কে। তবে তার জন্য শর্ত জুড়ে দেন দেবীর চরণে দিতে হবে রাজরক্ত। ভাইকে দিয়ে ভ্রাতৃহত্যার এ হীন ষড়যন্ত্র দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে শুদ্ধচিন্তক জয়সিংহ। সত্য-অসত্য ন্যায়-অন্যায়ের দোলায় দোদুল্যমান জয়সিংহ তাই এক নিদারুণ বিস্ময় নিয়ে বলে ওঠে-

‘একী শুনিলাম ! দয়াময়ী মাতঃ;/…ভাই দিয়ে ভ্রাতৃহত্যা?/…হেন আজ্ঞা/মাতৃআজ্ঞা বলে করিলে প্রচার।’

জয়সিংহের এ বিস্ময় মূলত আবহমান কালের প্রতিটি শুদ্ধাচারী মানুষের হাহাকার। কারণ ধর্মের নামে যুগে যুগে যে অনাচার হয়েছে, তা সত্যিকার ধার্মিক মাত্রই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। তাই তো রাজা যখন এ হীন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জ্ঞাত হন, তখন তিনি বেশ বুঝতে পারেন দেবতার দোহাই দিয়ে রঘুপতি সকল অন্ধবিশ্বাসীকেই এ কাজে ব্রতী করেছেন। তাই তাঁর বেদনার্ত উচ্চারণ-‘…জানিয়াছি, দেবতার নামে/মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ।’

গোবিন্দমাণিক্যের এ উক্তি আজ চিরন্তন এক বাণীরূপ লাভ করেছে। গোবিন্দমাণিক্যের ঘটনা দৃষ্টে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয় যে- হিংসা-ধর্ম ও ধর্মের অন্ধত্ব শুধু মানুষের মনুষ্যত্বই কেড়ে নেয় না; বরং প্রিয়জন থেকেও তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ধর্মান্ধত্বতার কারণে রাণী গুণবতী কর্তৃক রাজা গোবিন্দমাণিক্যকে অসহায় ও একলা করে যাওয়ার ঘটনাটি এ বিষয়কেই ইঙ্গিত করে। রবীন্দ্রনাথের কোন সৃষ্টিই কোন নির্দিষ্টকালের সীমায় আবদ্ধ থাকেনি। তেমনি ‘‘বিসর্জন’’ নাটকের উপযোগিতাও আজ কাল থেকে কালান্তরে পরিদৃশ্যমান। আজ আমরা যে অবস্থার ভেতর দিয়ে চলছি, তা মনে হয় আর কখনই এ ভূখণ্ডে ঘটেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মের নামে যে তাণ্ডব, মানবতা ও মনুষ্যত্বের যে অবনমন তা বোধ হয় পূর্বে আর কখনই ঘটেনি। ধর্মের অন্ধ বিশ্বাস আর আধিপত্য বিস্তারের তাণ্ডব লীলায় আজ পশুর মতো বলী হচ্ছে আমাদের ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরা।

অবশেষে বিসর্জন নাটকের অন্তিমে আমরা জয়সিংহের আত্ম-উৎসর্গের মধ্যদিয়ে রঘুপতির মনভাবনার পরিবর্তন ঘটতে দেখি। রঘুপতি পুত্রতুল্য জয়সিংহকে হারিয়ে হাজার বছরের অন্ধ বিশ্বাস থেকে বের হয়ে মানবধর্মে দীক্ষিত হতে সমর্থ হন। জয়সিংহকে হারানোর পর ভিখারিণী অর্পণাকে কাছে পেয়ে রঘুপতি বলে ওঠেন-‘পাষাণ ভাঙ্গিয়া গেল-জননী আমার/এবার দিয়েছ দেখা প্রত্যক্ষ প্রতিমা/জননী অমৃতময়ী।’

রঘুপতির এই আত্মবোধনের মধ্য দিয়ে মূলত রবীন্দ্রদর্শনই উচ্চকিত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ প্রেম ও প্রতাপের দ্বন্দ্বে প্রেমই জয়লাভ করে।

‘‘বিসর্জন’’ নাটকে রঘুপতির পরিবর্তন ঘটলেও আমাদের চার পাশে বর্তমানের রঘুপতিগণ আরও বেশি আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এ নাটকে যে মানববাদকে দার্শনিক রূপ দিয়েছেন, আজ সময় হয়েছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই সে আদর্শকে মননে ও চর্চায় আঁকড়ে ধরার। তা না হলে রঘুপতির মতো ধর্মের ধ্বজাধারীরা নিজেদের স্বার্থে সাধারণ মানুষের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে সৃষ্টি করবে আর এক অন্ধরাজ্যের। ধর্মই হলো মানুষের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসের জায়গা। মানুষের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কালে কালে রঘুপতিরা নিজেদের স্বার্থে সময়, সমাজ ও ক্ষেত্র বিশেষে রাষ্ট্রকেও শাসন করছে। আজ আমাদের সমাজে যে ধর্মীয় উগ্রবাদিতার প্রসার এবং যে ঘূর্ণাবর্তের ভেতর দিয়ে আমরা চলছি তাতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘‘বিসর্জন’’ নাটকের কালজয়ী প্রাসঙ্গিকতা ধ্রুব সত্য হয়ে ধরা দেয়।

( লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং কথাসাহিত্যিক)

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *