অধ্যাপক ড. আহমেদ মাওলা।।
পরিবর্তনশীল সমাজ ও প্রবহমান সময়–স্রোতের প্রেক্ষাপটে সৃষ্টিশীল ব্যক্তিচৈতন্যের রূপান্তরও অনিবার্য। যেহেতু বহমান বহির্বস্তুজগত এবং স্রষ্টার অনুভব সংবেদন মন–এ দুয়ের জটিল বাস্তবতা একাত্ত হয়ে প্রকাশ ঘটায় রূপের; সে কারণে উপন্যাসের ফর্ম নির্মাণের ক্ষেত্রে সাধিত হল জটিলতর রূপান্তর।(১) উপন্যাসের প্রথাগত ধারণা–প্লট, চরিত্র, সময়, বিষয়, ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সাধিত হয় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। নিরীক্ষাপ্রবণ ঔপন্যাসিকগণ রচনা করলেন anti plot, anti hero, anti-time উপন্যাস। কারণ সমাজ কাঠামের পরিবর্তনের সঙ্গে স্রষ্টার
মনোজাগতির ইতিহাসও জড়িত। সমাজের দ্ব›দ্ব জটিল পরিস্থিতি স্রষ্টার মনোলোকে যে প্রতিবিম্বন তৈরি করে, সেই বাস্তবভাবসত্য প্রকাশের অন্তর্জগতকে আবিষ্কার করতে নিয়ে হয় প্রয়োগনানুগ শিল্পশৈলী। বিশশতকের প্রথমার্ধ সংগঠিত দুই বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, ফ্রয়েডের The interpretiatio of Dreams (1913), The Psychology of Everyday life (1914), Ges On Dream (1941) n¨vfjK Gwjm-Gi Studies in the psychology of sex (1897-1928) ইত্যাদি মনোঃসমীক্ষণতত্ত্ব বিশ্বব্যাপী মানব মনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ফ্রয়েড প্রথম সন্ধান দিলেন যে, চেতন এবং অচেতনের মাঝখানে মস্তিস্ক অবচেতন মনেরও একটি ব্যাপার আছে। অবচেতন মনের এই স্তরটি চরম বিশৃঙ্খল ও অরাজগতার লীলাভূমি। শুধু তাই নয়, অবচেতনের এই স্তরটির মূল উৎস হচ্ছে যৌনানুভূতি। Sex is the main spring of our unconscious life ফ্রয়েডের এই আবিষ্কারের ফলে মানুষের ব্যক্তিত্বের রূপটি পাল্টে যায়।
মানুষের বহিরঙ্গের অনুপুঙ্খ বিবরণধর্মী বাস্তবতার পরিবর্তে অন্তর্জীবনের গভীরতর বাস্তবতার (inner reality) সন্ধান, অবচেতন আকাঙ্খার রূপায়ণ, চরিত্র অঙ্কনের পরিবর্তে আত্মন্বেষণ (Searcho of indentity) চেতনাপ্রবাহ (stream of consciousneses) কিংবা অন্তঃসংলাপ (interior monologue) রীতির ব্যবহার প্রচলিত সময় ধারণার পরিবর্তে সময়ের ভগ্ন-ক্রম বিন্যাস, সূক্ষ্ম সংকেত প্রতীক ও নিগূঢ় চিত্রকল্পের ব্যবহার এই সব কুল লক্ষণের যুদ্ধপরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্যে সুচিহ্নিত।(২)
জাঁ পল সার্ত্রের (১৯০৫–১৯৮০) অস্তিত্ববাদী দর্শন নতুন শিল্পসূত্রের জন্ম দেয়। লেখা হয় চেতনাপ্রবাহশৈলীর উপন্যাস। জেমস্ জয়েস (১৮৮২–১৯৪১) ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৮২–১৯৪১) এবং ডরোথি রিচার্ডসন বিশশতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে চেতনাপ্রবাহ ধারার প্রথম সফল প্রয়োগ করেন। চেতনাপ্রবাহ পদ্ধতিটি একটি বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের পরিচায়ক। পূর্ববর্তী উপন্যাসের সরলরৈখিক প্লট ও আনুপূর্বিক সময় ব্যবহারের বিরুদ্ধে গিয়ে চরিত্রকে প্লটের নিয়ন্ত্রক করে তার মনের ভুবনকে উন্মোচিত বা ব্যাখ্যা করার পদ্ধতিকেই চেতনাপ্রবাহশৈলী বলা হয়। এই পদ্ধতিতে চরিত্রের সময় হযে দাঁড়াল ঘটমান ও চলমান। বাইরের বস্তু জগতে চলমান ঘটনা মানুষের সতত সঞ্চরণশীল মননক্রিয়ার উপর প্রভূত প্রভাব ফেলে। কারণ মানুষের মন কোনো স্থির নির্দিষ্ট বস্তু নয়, তা নিয়ত পরিবর্তনশীল। প্রতিটি মুহূর্ত মানুষের চেতনাকে একটি নতুন নিবন্যাসে স্থাপন করে, এই মুহুর্মুহু ভেঙে পড়া চেতনাস্রোতকে বাইরের বস্তু জগতের চলমান ঘটনার সঙ্গে সমান্তরাল করে একই সূত্রে গ্রথিত করার বিশেষ শৈলীকেই চেতনাপ্রবাহশৈলী বলা হয়। ডরোথি রিচার্ডসনের একটি উপন্যাসের আলোকে প্রসঙ্গে মে সিনক্লেয়ার ১৯১৮ সালে প্রথম Stream of consciosness বা চেতনা প্রবাহ কথাটি ব্যবহার করেন। রিচার্ডসন যে উপায়ে মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে চরিত্রের চেতনাবোধ উপলব্ধি–অভিজ্ঞতা–অনুধাবনকে গড়িয়ে যেত দেন, তা বর্ণনা করতে গিয়ে সিনক্লেয়ার Stream of consciosness এর সংজ্ঞাটি দেন। এই শৈলীতে লেখা উপন্যাস প্রথমে ভেঙ্গে দেয় প্লট ধারণা এবং চরিত্রের একরৈখিক বিন্যাস।
জেমস্ জয়েসের ‘ইউলিসিস’ মাত্র চব্বিশ ঘন্টার কাহিনি। তাতে চরিত্র বিভিন্নভাবে পরস্পরের কাছে আসে, দূরে যায়, আবার কাছে আসে। প্লট বলতে ঐ তিন চরিত্রের, প্রধান দুজনের মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে গড়িয়ে যাবার বিবরণ। ভার্জিনিয়া উলফ-এর টু দি লাইট হাউস এ প্রথাগত প্লট বলতে কিছু নেই। একটি পরিবার ছুটি কাটাতে এসে এক স্থান থেকে নৌকা করে আরেক স্থানে যাবে কি যাবে না এভাবনা হচ্ছে গল্প। এর মধ্যে মিসেস র্যামজে ও তার স্বামী ও পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা এবং খুঁটিনাটি যে চিত্র তেরি করে , তাতে ঐ গল্পহীন গল্পের মানুষগুলো বেড়ে ওঠে। আমরা একটি প্রধান চরিত্রের চেতনাধারার বিকাশকে দেখি, তার অনুভূতির আলোকে বিশ্বকে প্রত্যক্ষ করি। অর্থাৎ চেতনাপ্রবাহশৈলীর উপন্যাসে প্লটকাঠামো ভেঙ্গে যায় এবং এ শৈলীর উপন্যাসে সময় একবারে খণ্ডিত, আনুপূর্বিক বলতে কিছু নেই, কারণ সময়ের পরম্পরা নির্ধারিত হয় চরিত্রের চেতনাপোলব্ধি থেকে। এজন্য সময় অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের সীমারেখায় বিন্দু না থেকে সময়, চরিত্রের চেতনায় একাকাকার হয়ে যায়, সময় বিন্যাস হয় ভগ্নক্রম শৈলীতে।
উইলিয়াম জেমস্ (১৮৮২-১৯১০) তার প্রিন্সিপলস অফ সাইকোলজি (১৯৮০) গ্রন্থে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তির ক্রমপরিবর্তনশীল মনের অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে Stream of consciousness শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছ ফ্রয়েডীয় মনস্তত্তে¡র চেতন অবচেতন মনের সূত্র। ফরাসী দার্শনিক বের্গসঁ এর বিখ্যাত তত্ত¡ duration বা স্থিতিকাল এবং চেতন হচ্ছে মানুষের মনোজাগতির চলিষ্ণুতা। চেতনাপ্রবাহশৈলীর উপন্যাসে ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণই প্রধান, ব্যক্তির চেতনা অবচেতন মনের ধূসর অঞ্চলের জটিল গ্রস্থি আবিষ্কারই এ শিল্পশৈলীর উপন্যাসের লক্ষ। তাই এর ভাষা হয় আত্মকথন মূলক Interior monologue। ব্যক্তি মনোজগতের দ্রুত-বিলিয়মান দিগন্ত রেখা আবিস্কার যেহেতু চেতনাপ্রবাহশৈলীর উপন্যাসের অন্যতম লক্ষ্য তাই চরিত্রের আত্মকথনে অনেক সময় বহির্বাস্তবের কার্যকারণসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
চাঁদের অমাবস্যা :
বাংলাদেশের উপন্যাসে সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১) প্রথম পাশ্চাত্য জীবনদৃষ্টি ও শিল্পবোধকে আত্মস্থ করে চেতনা প্রবাহ শৈলীর শিল্পসফল উপন্যাস রচনা করেছেন। চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪) এবং কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮) উপন্যাসে তিনি প্রয়োগ করছেন অস্তিত্ববাদী জীবন দর্শন কিন্তু ব্যবহার করেছেন চেতনাপ্রবাহ শিল্পশৈলী। আঙ্গিক চেতনায় এই নতুনত্ব এবং জীবনদর্শনে আন্তর্জাতিকতা তাঁকে সমকালীন অন্য লেখকদের থেকে আলাদা করেছে। বিরুদ্ধ সমাজ সময়ে পীড়িত, আত্মবন্দি ব্যক্তিমানসের যন্ত্রণা, উৎকণ্ঠা, শঙ্কা, মনস্তাপের আত্মবিবরে নিমজ্জিত ব্যক্তি মনের গহন গোপন প্রতিক্রিয়া আবিষ্কারের ঐকান্তিকতায় এই আঙ্গিক, বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসে আমাদের নিয়ে যায় অস্তিত্বের প্রগাঢ় অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, বিমিশ্র সত্তা থেকে শুধু সত্তার অভিমুখে।(৩) তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসই একজন প্রতিভাবান শিল্পীর প্রযত্ন প্রয়াস সহজে চোখে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর ইউরোপীয় উপন্যাসের শিল্পশৈলীর দৃষ্টিকোণ থেকে চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসের আঙ্গিক বিবেচনা করা যায়। দৃষ্টিকোণ, পরিচর্যা, চরিত্রায়ণ, সময়ের বিন্যাস ভাষাশৈলী প্রতিটি ক্ষেত্রেই চাঁদের অমাবস্যা প্রথাগত উপন্যাস থেকে আলাদা।(৪) উপন্যাসের ঘটনাস্রোত সর্বত্রই উর্দ্ধমুখী, বর্ণাঢ্য, উচ্চগ্রামে বাঁধা, চরিত্রের আত্মজিজ্ঞাসা-প্রশ্ন-প্রতিউত্তর, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও বিবরণের মধ্য দিয়ে কাহিনি পরিণামমুখী হয়েছে। ঔপন্যাসিকের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা পরিমণ্ডলের ঐশ্বর্য, উদ্ভাবনী-স্বাচ্ছন্দ্য, মানসিক সতর্কতা ও একাগ্র নিষ্ঠা সুস্পষ্ট। যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর আত্মখননময়, উদ্বেগাকুল পরিস্থিতির সঙ্গে যে কোন পাঠক সহমর্মী ও সহযাত্রী হয়ে ওঠে। আপাতভাবে লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ ব্যবহৃত হলেও এ উপন্যাসে, মূলত শিল্প প্রক্রিয়ায় কার্যকর থেকেছে ভীতসন্ত্রস্ত, আতঙ্ক শিহরিত আরেফ আলীর আত্মসংবেদনশীল প্রেক্ষণবিন্দু। অস্তিত্বগত প্রান্তি পরিস্থিতির তীক্ষ্মমুখী আঘাতে আরেফ আলী আত্ম-যন্ত্রণাকাতর, চেতন-অবচেতনায় রক্তাক্ত, সত্যানুসন্ধানে আত্মখননকারী, জটিল ও স্তরবহুল অভিজ্ঞতায় ক্রমসংকুচিত। তার অস্তিত্ব সংকটের এই অন্তর্ময় তীব্র তীক্ষ্ম, প্রগাঢ় সংরাগ ও সংক্ষোভময় দৃষ্টিকোণের জন্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চাঁদের অমাবস্যায় অনেকাংশে এক্সপ্রেশনিস্ট।(৫) কেন্দ্রীয় চরিত্রের প্রেক্ষণবিন্দু দ্বারাই উপন্যাসের ফর্ম নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। উচ্চারিত, অনুচ্চারিত প্রশ্নমালায় আরেফ আলীর আত্মসমগ্র উদ্ভাসিত।
বড় বাড়িতে আশ্রিত যুবক-শিক্ষক আরেফ আলী এক জ্যোস্নাপ্লাবিত রাতে বাঁশ ঝাড়ে এক যুবতী নারীর অর্ধ উলঙ্গ মৃতদেহ প্রত্যক্ষ করে। সে যে বাড়ির আশ্রিত, সে বাড়ির দরবেশ নামে খ্যাত কাদের ঐ যুবতী নারীর ধর্ষণকারী এবং হন্তারক। হত্যাকারীকে শনাক্ত করার পর সত্য প্রকাশের প্রশ্নে যে দ্বিমুখী সংকটের সম্মুখীন হয়- যদি সে বিবেকের তাড়নায় সত্য প্রকাশ করে, তবে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হবার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে সে যদি এ হত্যাকাণ্ডের কথা গোপন রাখে তবে তার মানবিক চেতনা, দায়িত্ববোধ অবহেলিত হয় এবং বিবেকের আত্মযন্ত্রণা থেকেও সে মুক্তি পাচ্ছে না। এই অস্তিত্ব সংকট ও বিবেকী দংশনের দ্বিবিধ দ্বন্দ্বজটিল পরিস্থিতির পরিণামে তার সত্য প্রকাশের দায়ই জয়ী হয়। চাঁদের অমাবস্যা’র যুবক-শিক্ষক আরেফ আলীর এই প্রান্তিক পরিস্থিতিকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ চেতনা প্রবাহের পথে ব্যক্তিমনের জটিল অন্ধিসন্ধির কুশলী উদঘাটন প্রশ্ন ও যুক্তির অসাধারণ বিন্যাস লক্ষ করা যায়- অকস্মাৎ তার মনে নানা প্রকার প্রশ্ন জাগতে শুরু করে। খই ফোটার মত, একটির পর একটি।… প্রথম রাতে কাদের কেন মাঠে ঘাটে একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সে কথাই তাকে প্রথম জিজ্ঞাসা করতে হবে। প্রত্যত্তুরে কাদেরও তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারে, সে-ই বা কেন শীতের গভীর রাতে বাইরে ঘোরাঘুরি করছিলো। কিন্তু প্রশ্নটির উত্তর দিতে সে প্রস্তুত। সে দ্বিধা না করে স্বীকার করবে। কাদেরকে সে অনুসরণ করছিলো। … একটা কথায় যুবক শিক্ষকের মনে শীঘ্র খটকা লাগে। কেন সে কাদেরকে তার ভ্রমণের কথাটি জিজ্ঞাসা করতে চায়? একটি বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ; যুবতী নারীর মৃত্যুর সঙ্গে কাদেরের কোন সম্বন্ধ নাই। সে-বিষয়ে নিঃসন্দেহ না হলে তার সঙ্গে সাক্ষাতের কোন প্রয়োজনীয়তা সে বোধ করতো না, তার মনে হঠাৎ মেঘ কেটে আলোও প্রকাশ পেত না। বস্তুত, তাকে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজনও দেখতো না। তবে কেন সে প্রশ্নটি তার প্রশ্নতালিকার শীর্ষে বসিয়েছে? অবিশ্বাস সত্তে¡ও সে কী বিশ্বাস করে কাদের দরবেশ? সে কথাই সে প্রথম যাচাই করে নিতে চায়?(৬)
উপন্যাসের ‘‘পাঁচ’’ অংশে এভাবে আরেফ আলীর ভয়–বিহŸল চিত্তে পাঁচটি প্রশ্ন জাগে এবং তার এই আত্মজিজ্ঞাসার মধ্যে ব্যক্তিমনের নানা দ্ব›দ্ব, শঙ্কা, একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, অনিশ্চয়তা, অপরাধবোধ ও সত্য নিষ্ঠা লক্ষ করা যায়।
চন্দ্রালোকিত রাতে বাঁশঝাড়ে যুবতী নারীর মৃতদেহ প্রত্যক্ষ করেছে আরেফ আলী, সে অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িতবোধ করলেও সে আসলে জড়িত নয়। তবু সে নিজের অভিজ্ঞতার অর্থ বোঝার চেয়ে কাদেরের সঙ্গে একটা সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অনেক ভেবেও তার মনের খটকা যায় না। তার কাছে এই প্রথম প্রশ্নটি বিশেষ প্রয়োজনীয় মনে হয়, কারণ প্রশ্নের উত্তর তার মনের অশান্তি, বিশৃঙ্খলতা এবং মনের অন্ধকার দূর করতে পারে। শুধু এ প্রশ্ন নয়, অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর কাদেরের মনে পরিচয়ও দেবে। কাদেরকে বুঝতে না পারার কারণে বিচিত্র অভিজ্ঞতাটির রহস্য উন্মোচিত হবে না। তাই অন্যান্য প্রশ্নও তার মনে জেগে ওঠে এবং তাকে অস্থির করে তোলে– দ্বিতীয় প্রশ্নঃ কাদের কী যুবক শিক্ষককে হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেছিলো? ঘটনাটি সে কাদেরের দৃষ্টিতে ভেবে দেখে। প্রথম রাতে কাদের তাকে বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে। দুজনে মুখোমুখি হলে যুবক শিক্ষক হঠাৎ উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে পালিয়ে যায়। তখন কৌতুহলী হয়ে কাদের বাঁশঝাড়ে প্রবেশ করলে মৃতদেহটি দেখতে পায়। তারপর যুবক শিক্ষককে হত্যাকারী সন্দেহ করায় তার জন্য স্বাভাবিক নয় কী?
এখানে যুবক শিক্ষক একটু ইতস্তত করে। সে বুঝতে পারে না, ভূমিকা না দিয়ে প্রশ্নটি করা সমীচীন হবে কিনা?(৭)
আরেফ আলী নিজেই মনে মনে উত্তর তৈরি করে–কাদের যদি তাকেই হত্যাকারী সন্দেহ করে, তবে সে পুলিশকে খবর দেয়নি কেন বা অন্য কারো কাছে হত্যার কথা প্রকাশ করেনি কেন? এভাবে যুক্তির শৃঙ্খল–বিশৃঙ্খলতা আরেফ আলীকে বিবরবাসী, আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। কাদের যে হত্যাকারী এ কথাটা সে পুলিশের কাছে কীভাবে প্রকাশ করবে? সে যে বাড়ির আশ্রিত, কাদের সে বাড়িরই লোক। কথাটা তার পক্ষে প্রকাশ করাটা সহজ হবে না। পশ্চাতে আশ্রয়হীন অস্তিত্ব বিপন্নের আশঙ্কা তাকে বিহŸল করে তোলে। আত্মবিবরে ডুব দিয়ে যুবক শিক্ষক ভাবে, বাঁশঝাড়ের কথাটি কারো কাছে প্রকাশ করা যায় না।সে–কি কাদের আর তার মনের গোপন কথা। শরীরের গোপন স্থানে গুপ্তক্ষতের মত। এমন কথা কাউকে বলা যায় না। মনের গহিন গুহা থেকে আবার ভেসে ওঠে প্রশ্নঃ
কাদের যে হত্যাকারী সে ধারণা কী করে যায়? যে ধারণা পরদিন দুপুর বেলা পর্যন্ত তাকে ভীত–নিপীড়িত করেছে, সে ধারণা থেকে কোন যুক্তি–সাক্ষ্য প্রমাণের সাহায্যে সে মুক্তিলাভ করে? এ প্রশ্নও যুবক শিক্ষক ঠক্কর খায়। কি এ প্রশ্নে কী কোন বোধগম্য উত্তর আছে? সবই বিশ্বাস। দোষী, সেটাও বিশ্বাস, নির্দোষ, সেটাও বিশ্বাস। বিশ্বাসের উপরই কী সমগ্র মানবজীবন নির্ভর করে নাই?… এ উত্তরই কী যথেষ্ট? সব বিশ্বাসেরই কোন না কোন হেতু থাকে। জীবনের একমাত্র অবলম্বন হোক, তবু তার মধ্যে একটি যুক্তির কাঠামো থাকে। না, তার এ বিশ্বাসের কোনই যুক্তি নাই।(৮)
তৃতীয় প্রশ্নঃ সে রাতে কাদের তার ঘরে কেন এসেছিলো? যুবক শিক্ষকই হত্যাকারী কিনা সে নিশ্চিত করে দেখার উদ্দেশ্যে কী? বা গভীর রাতে একটা অসহায় মৃতদেহ দেখে মনে পরম নিঃসঙ্গতা বোধ করলে সঙ্গলিপ্সা আশ্বাসেরজন্যে?(৯) কাদের সাব্যস্ত করে, যুবতী নারীর মৃতদেহটি গুম করে দেবে। কেন?…. যুবতী নারীর যে প্রাণ নিয়েছে তার শাস্তির কথা কি কাদের ভাবে নাই? দেহ গুম করে দিয়ে সে খুনীর অপরাধও নিশ্চিত করে দিয়েছে। তার শাস্তির চেয়ে যুবতী নারীর মান-মর্যাদই কি তার কাছে বড় ঠেকেছে?… যুবক শিক্ষক ঠিক করে, এ-বিষয়ে কাদেরকে প্রশ্ন করতে হবে।(১০)
অতএব পঞ্চম প্রশ্নঃ সাহায্যের জন্যে কাদের তারই কাছে কেন আসে?… শ্রান্তভাবে যুবক শিক্ষক আপন মনে স্বীকার করে, তার চারধারে ঘোর অন্ধকার, সে অন্ধকারের মধ্যেই অন্ধের মতই সে প্রশ্নগুলি তৈরি করেছে।(১১)
আরেফ আলীর অর্ন্তমুখী চেতনাস্রোত, সত্তা-আতঙ্কিত জিজ্ঞাসা তার অস্তিত্বমূলক প্রবলভাবে প্রকম্পিত করে। তার অন্তর্দ্বন্দ্বময়, রক্তাক্ত ঔপন্যাসিক এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রশিল্পীর মত মেধাবী চিত্রকল্পে বিন্যান্ত করেছেন।(১২) চরিত্রের আত্মকথনে ভাষা হয়ে উঠেছে চিত্রকল্পময়-
(ক) ওপরে ঝলমলে জ্যোৎস্না, কিন্তু সামনে নদী থেকে কুয়াশা উঠে আসছে। কুয়াশা না আর কিছু, হয়তো সে ঠিক বোঝে না। হয়তো একদল সাদা বকরী দেখে, শিং–দাত–চোখ কিছুই না। হয়তো মনে হয় রাত্রি গা–মোড়ামুড়ি দিয়ে উঠে বসেছে, চোখ ধাঁধানো অন্তহীন জ্যোৎস্নালোকে আভাস দেখা দিয়েছে।(১৩)
(খ) যুবক শিক্ষক জ্যান্ত মুরগি মুখে হাল্কা তামাটে রঙের শেয়াল দেখেছে, বুনো বেড়ালের রক্তাক্ত মুখ দেখেছে, মানুষের দুঃখ–কষ্ট মহামারি–হাহাকার দেখেছে, কিন্তু কখনো বিজন রাতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখে নাই। হত্যাকারী দেখে নাই।(১৪)
বহির্বাস্তবতা রূপায়ণে ঔপন্যাসিকের এই চিত্রকল্পময় পরিচর্যা চরিত্রের মনোবিশ্লেষণের সঙ্গে সমীকৃত। জীবনে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আরেফ আলী হয়নি-বিজন রাতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখে নাই। হত্যাকারী দেখে নাই। অপ্রত্যাশিতভাবে সেই দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে আরেফ আলীর মহাভয় হতে থাকে। ভয় ক্রমাগত ভিন্ন চেহারায় রূপ নেয়Ñসাদা বকরী- যার শিং-দাঁত-চোখ কিছুই নেই। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসত্রয়ের বাক্যপ্রবাহে ভয় এবং ভীতি অনুষঙ্গ স্পর্শী শব্দপুঞ্জের ব্যবহার যেমন মননে আবেগে জাগ্রত ও সুচিন্তিত, তেমনি নির্মিত ও নির্মীয়মান মানবসত্তা উন্মোচনে সচকিত ও আগ্রহী। ভয় এবং ভীতিঅনুষঙ্গবাহী শব্দ লালসালুতে ব্যবহৃত হয়েছে ৭০ বার; চাঁদের অমাবস্যায় ১৫০ বার এবং কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসে ১৭৫ বার। তুলনাসূত্র ও আভ্যন্তর উপাদান সাক্ষ্য অনুসারে এ তথ্য স্পষ্ট যে, লালসালুর ভয় ও ভীতি শিহরণ অস্থির অন্তর্জালাময় ও অস্তিত্ব জিজ্ঞাসা চাঁদের অমাবস্যায় ঘণিভূত, বলয়িত ও তত্ত¡লগ্ন।(১৫) ভীতি বিহবল, শঙ্কাগ্রস্ত আরেফ আলীর অস্তিত্বের স্বরূপ নির্ণয়ে পতঙ্গের উদাহরণ ব্যবহার করেছেন। দ্বিতীয় রাতে যুবতী নারীর মৃতদেহ সরানোর কাজে সে কাদেরকে প্রশ্নহীনভাবে সাহায্য করার পর আরেফ আলী যখন আপন অস্তিত্বের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে এভাবে-
ক. কাদেরের পায়ের তলে সে যেন ঘৃণ্য বস্তু, শিড়দাঁড়হীন নপুংসক কীটপতঙ্গ কিছু।
খ. যুবক শিক্ষক যেন তুচ্ছ কীটপতঙ্গ।
আতঙ্ক শিহরণ ব্যক্তি-অস্তিত্বের এস্বরূপ উন্মোচনের অন্তর্যাত্রা আবিষ্কারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অসাধারণ শিল্প নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। বহির্বস্তবতা ও অস্তিত্ব কাঠামোর আনুভূমিক বৈশিষ্ট্য রূপায়ণে তিনি ব্যবহার করেছেন অভিব্যক্তিবাদী পরিচর্যা কৌশল। ব্যক্তির একক অস্তিত্ব তখনই প্রতীয়মান হয়, যখন তা অপর সত্তায় প্রতিবিম্বিত হয়। আরেফ আলীর আতঙ্কগ্রস্ত অস্তিত্ব আলোকিত হয়েছে কাদেরের ব্যক্তিসত্তার প্রতিস্মরণে। সত্তা ও অপরাগতার এই বাঙ্ময় সমীকরণে উন্মোচিত হয়েছে আরেফ আলীর অস্তিত্ব। মোট ষোল অংশে বিন্যস্ত আরেফ আলীর আত্ম-অনুসন্ধান ও সংকটদীর্ণ অস্তিত্বের মননক্রিয়া প্রতিফলিত কাদেরের সঙ্গে উচ্চারিত অনুচ্চারিত সংলাপে। মূল ঘটনাস্থল হয়ে ওঠে আরেফ আলীর চেতনালোক, তাই বহির্বাস্তবের আপাত পারম্পর্যহীন শৃঙ্খলা তার মস্তিষ্কের বিভ্রম-বাস্তবতার চেতনাপ্রবাহ বিন্যস্ত হয়। ঘটনার এই অন্তঃপ্রবাহসূত্র চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসকে প্রথাগত প্লটবিন্যাসরীতি থেকে স্বতন্ত্র করেছে। ঔপন্যাসিক হিসেবে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্ তত্ত¡ আশ্রয়ী নন ফর্ম-আশ্রয়ী। তত্ত¡ বা দর্শনশাসিত মনের কাছে চরিত্রচেতনা কিংবা পূর্ব নির্ধারিত চিন্তাই মুখ্য মূল্য পায়। কিন্তু উপন্যাসের শিল্পগত সাফল্যের মূলে রয়েছে চেতনা ও কর্মের অন্তর্বয়ন।(১৬) অবশেষে যুবক শিক্ষক অস্তিত্বের মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে আত্মমীমাংসায় উপনীত হয়। কাদের যে হত্যাকারী কথাটা প্রকাশ না করে তার নিস্তার থাকে না।
কথাটা প্রকাশ না করে তার উপায় নেই। উপায় থাকলে সে বলতো না। বাঁশঝাড়ে একটি নারী অর্থহীনভাবে জীবন দিয়েছে। তার বিশ্বাস, মানুষের জীবন এত মূল্যহীন নয়। (১৭)
সার্বজনীন মানবিক বোধ থেকেই আরেফ আলী হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কাহিনী প্রথমে দাদাসাহেবের কাছে ও পরে পুলিশের কাছে প্রকাশ করে। হত্যাকাণ্ডের কথা প্রকাশের মধ্য দিয়ে আরেফ আলীর আত্মজিজ্ঞাসা ও ক্রমমুক্তির তপস্যা পরিণামুখী হযেছে। মনে মনে যে সব সম্ভাবনা সে দেখেছিলো, তা সত্যে পরিণত হয়ে তার সিদ্ধান্তকে অর্থপূর্ণ করেছে। …সে সংগ্রাম পরের বিরুদ্ধে মনে হলেও আসলে নিজেরই বিরুদ্ধে ছিলো, সে সংগ্রামে সে জয়লাভ করেছে।এভাবেই চাঁদের অমাবস্যা হয়ে উঠেছে অস্তিত্ববাদী উপন্যাস। অস্তিত্ববাদের মূল কথা হচ্ছে, ব্যক্তি চেতন্যে যা সত্য বলে উপলব্ধি করবে, তার দায় তাকে অবশ্যই বহন করতে হবে। আরেফ আলী নিজের নিরাপদ আশ্রয়, চাকরি, বিপন্ন অস্তিত্বের কথা পরিত্যাগ করে সত্য প্রকাশের দায়ে দাদা সাহেব ও পুলিশের শরনাপন্ন হয়েছে।
সে হয়ত ভেবেছিল, তার কথা কেউ বিশ্বাসই করবে না কিংবা বিশ্বাস করলেও গ্রহণ করবে না অথবা সে চক্রান্তের শিকার হতে পারে, এমন কি বিচারে তার ফাঁসি পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। সত্য প্রকাশের পর আরেফ আলীর পরিণতি আমাদের সমাজের গূঢ় সত্য উন্মোচনে আরো ইঙ্গিতবাহী–পুলিশ–কর্মচারীর চোখ একবার ক্রোধে সঙ্কুচিত হয়ে ওঠে। …সোজা হয়ে বসে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে যুবক শিক্ষককে প্রশ্ন করে আপনার আর কিছু বলার নাই? যুবক শিক্ষক উত্তর দেয় না। শুনছেন? সাব ইন্সপেক্টর বলে। কনস্টেবলের বুটের আওয়াজ হয়।(১৮)
পুলিশের ক্রোধ সঙ্কুচিত চোখ এবং বুটের আওয়াজ থেকেই আরেফ আলীর পরিণতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হত্যাকারী কাদেরেরর পেছনে রয়েছে দরবেশ অভিধা এবং অভিজাত পরিবারিক পটভূমি। তাছাড়া দাদাসাহেব ধর্মপ্রাণ মানুষ। চাকুরী জীবনে বিধর্মী মনিবের প্রতি বিতৃষ্ণার রেশ ধরে গ্রামের বাড়িতে অবসর জীবনযাপন করতে এসে তিনি কঠোর হাতে তাঁর পরিবারের ধর্মীয় বিধিনিষেধ আরোপ করেন এবং গড়ে তোলেন একটি ধর্মীয় পরিমণ্ডল। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষাদানে তিনি সদা-সতর্ক। কাদেরের মধ্যে একটা দরবেশি ভাব আছে সে কথা তিনিই প্রচার করেন। কাদেরের পরিবারের এই সামাজিক ও ধর্মীয় মর্যাদার কাছে দরিদ্র স্কুল শিক্ষক আরেফ আলীর কথা যে মিথ্যা প্রমাণিত হবে এতো স্বাভাবিক।
২.
চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসটি যে শিল্পশৈলীর জন্য বিশিষ্ট, তা হচ্ছে চেতনাপ্রবাহশৈলী। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ জীবনদর্শন ও শিল্পাভিপ্রায়ে সন্দেহাতীতভাবে ছিলেন পাশ্চাত্য অনুসারি। ঔপন্যসিকের বক্তব্য থেকে জানা যায়Ñউপন্যাসটির বেশির ভাগ ফ্রান্সের আলপস্ পর্বত অঞ্চলে পাইন ফার–এলম গাছ পরিবেষ্টিত ইউরিয়াজ নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে বসে লেখা। একজন নিরাসক্ত সত্য দ্রষ্টা শিল্পীর দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের সমাজ সত্যের অন্তর্মূলে প্রবেশ করতে গিয়ে তিনি এই শিল্পশৈলীর আশ্রয় গ্রহণ করা খুব স্বাভাবিক। যুদ্ধোত্তর পাশ্চাত্য ঔপন্যাসিক–ফ্রানৎস কাফ্কা (১৮৮৩–১৯২৪), আলবেয়ার ক্যামু (১৯১৩–৬০), ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৮২০১৯৮১), উইলিয়াম ফকনার (১৮৯৭–১৯৬২), জেমস্ জয়েস (১৮৮২–১৯৪১) প্রমুখ চেতনাপ্রবাহ ধারায় উপন্যাস রচনা করেন। পাশ্চাত্য শিল্পাদর্শস্নাত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বাংলা উপন্যাসে এই শৈলী প্রয়োগ করতে গিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন আমেজ সৃষ্টি করেছেন।
জয়েসের Ulyssess (1922) এর Stephen, To the Lightouse-Gi Mrs. Ramsay –এর Ulysess–এর মনন বিন্যাসের সঙ্গে আরেফ আলীর মানস ক্রিয়ার কোনো মিল নেই। জয়েসের Ulyssess –এর মত চাঁদের অমাবস্যাতেও কোনো নাটকীয়তা নেই। হত্যা এবং হত্যাকারীকে আমরা প্রথম অধ্যায়ে জেনে ফেলি, তারপর কাহিনির যে অগ্রগতি তা হত্যাকারী নয় হত্যার দৃশ্য অবলোকনকারী বা একমাত্র সাক্ষী আরেফ আলীর মনন ক্রিয়াতেই বিন্যা¯Í। সাক্ষী হিসেবে তার দায়ই বেশি, কারণ হত্যার দৃশ্যটি তার সমস্ত জীবনের নির্মল অভিজ্ঞতাকে আঘাত করেছে এবং তার স্বাভাবিক জীবনের সমস্ত শান্তি নষ্ট করে দিয়েছে।
প্রথা মাফিক প্রাত্যাহিক কাজগুলো করতে গিয়ে হঠাৎ তার বিচ্যুতি ঘটে। শ্রেণি কক্ষে ভূগোল পড়াতে গিয়ে সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে–
ক. আরেফ আলী অনেকক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। একসময়ে হঠাৎ সচেতন হয়ে সে লক্ষ্য করে, ছাত্রদের কোলাহল ঝড়ের বেগ ধারণ করেছে।… অন্যদিন তীক্ষ্ম গলায় তবু হৃদ্যতার সঙ্গে শিক্ষক আরেফ আলী আঙ্গুল নেড়ে শাসন করতো। আজ কেমন শ্রান্ত গলায় বলে, না, না, গোলমাল করো না।(১৯)
তার নিস্তার নাই, তার মনে প্রাণে ও দেহের রন্দ্রে রন্দ্রে বিভীষিকাময় ছায়া।(২০)
গ. হঠাৎ সচেতন হয়ে যুবক শিক্ষক লক্ষ্য করে, ক্লাসঘরে অখÐ নীরবতা।…এধার ওধার তাকিয়ে অবশেষে আমজাদকে জিজ্ঞাসা করে, কী? বলেছ উপদ্বীপের নাম? আমজাদ প্রতিবাদ করার আগেই সজোরে মাথা নেড়ে বলে, কী বলছি! উপদ্বীপ নয়, নদীর নাম। আমজাদ নিরুত্তর হয়ে থাকলে পেন্সিল দিয়ে টেবিলে আওয়াজ করে কৃত্রিম বিস্ময়ের সঙ্গের আরেফ আলী বলে কী? ভুলে গেছ সব? কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর আমজাদ শিক্ষকের দিকে সোজা তাকিয়ে গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করে, স্যার, আপনার আজ শরীর ভালো নয়?(২১)
বহির্বাস্ততার সঙ্গে এভাবে আরেফ আলী অসংলগ্ন হয়ে ওঠে। ক্রমশ সে পরিপার্শ্ব বিচ্যুত হয়ে মনন অভিযাত্রায় অগ্রসর হয়। আরেফ আলীর এই চেতন–অবচেতন–সচেতন মনের দ্ব›দ্ব জটিল পরিস্থিতিতে ঔপন্যাসিক চেতনাপ্রবাহ শৈলীতে বিন্যাস্ত করেছেন। চেতনাপ্রবাহ শৈলীর উপন্যাসের দুই শিল্পকৌশল–অন্তর্বিশ্লেষণ এবং অনুচ্চারিত মনোকথন উপন্যাসে এই উভয় শৈলীর ব্যবহৃত হয়েছে। এই দুই শৈলীর পরিচর্যার আরেফ আলীর সংকটদীর্ণ, ভীত–বিহŸল মনের আত্ম–অন্বেষণ, ক্রমমুক্তির তপস্যা ও জাগ্রত বিবেকের রক্তাক্ত চেতনা বিম্বিত।
ক. অন্তর্বিশ্লেষণঃ ঘটনাটি প্রকাশ না করার পক্ষে যে সব যুক্তি সে পরিষ্কারভাবে ভাবতে সাহস পায় নাই, এবার সে–সব যুক্তি বিশ্লেষণ করে দেখতে তার আর বাধে না। চারপাশে খোলা মাঠ, আর বাধা কোথায়? প্রথমত, সে নিজের কথা ভাবে। কে সে? একজন দরিদ্র শিক্ষকমাত্র।… কার জন্যই বা সে নিজের সর্বনাশ করবে? যুবতী নারী তার আত্মীয় নয়, তার মৃত্যুতে সে ব্যক্তিগতভাবে কোন প্রকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এই হতভাগা দেশে কত কত যুবতী নারীর জীবন অর্থহীনভাবে এবং অকারণে শেষ হয়। কে প্রতিবাদ করে, কে একবার ফিরে তাকায়? সেখানে জীবন মূল্যহীন সেখানে আরেকটি জীবন শেষ হয়েছে। কিভাবে হয়েছে, তাতে কোনো অন্যায় অবিচার হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে সে নিজের উপর বিপদ ডেকে আনবে কেন? তারপর কাদেরের কথা। হোক তার অপরাধ অতি গুরুতর বা যুবতী নারীর সঙ্গে তার সম্পর্কের কারণ পশুবৎ বাসনা, হোক সে নির্মম–নির্দয় মানুষ। তবু সে যুবক শিক্ষকের কোন ক্ষতি করে নাই। তাছাড়া, কাদের তার বন্ধু না হোক, সে তার শত্রæ নয়; তার প্রতি সে হিংসাদ্বেষ বা প্রতিহিংসার ভাব বোধ করে না। কাদেরের সঙ্গে লড়াই করে তার কি লাভ হবে, কারইবা সে মঙ্গল করবে?(২২)
আরেফ আলীর এই অন্তর্বিশ্লেষণ চেতনাপ্রবাহশৈলীর একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি। চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসে আরেফ আলীর আর্ত্মদ্ব›দ্ব এবং আতঙ্ক–শিহরিত মনের যুক্তিকে এই অন্তবিশ্লেষণের সাহায্যে উপস্থিত করেছেন লেখক। আরেফ আলী হত্যার ঘটনা প্রকাশের পক্ষে আত্মযুক্তির বাঁধাহীন পথের সন্ধান পায় আবার অকস্মাৎ তার মনে সামাজিক বাঁধার শঙ্কাময় যুক্তি সেপথকে রুদ্ধ করে ফেলে।
খ অনুচ্চারিত মনোকথন পদ্ধতিতে ঔপন্যাসিক আরেফ আলীর সংকটদীর্ণ মনের এই পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন- যুবক শিক্ষক একটি বিচিত্র কথা লক্ষ্য করে। … না বলার পক্ষে কারা অতি আগ্রহের সঙ্গে সে–সব যুক্তি যুগিয়েছে? জীবিত মানুষেরা। জীবিত মানুষরা তাদেরই কথা বলছে, মৃতমানুষের কথা বলছে না। তারপর আরেকটি কথা সে বুঝতে পারে জীবিত মানুষের পক্ষে জীবিত থাকার জন্যে আকুল আকাঙ্খা, বা জীবন থেকে যতটুকু পারা যায় লাভ– সুবিধা আদায় করার তীব্রবাসনা আপত্তিজন নয়, কিন্তু যারা যুক্তিগুলো পেশ করছে তারা যেন নামেই শুধু জীবিত। আসলে তারা মৃত, তাদের জীবনও ধার–করা জীবন। তা না হলে তারা মৃত নারীর প্রতি কোনো সমবেদনা বোধ করবে না কেন, যে মানুষ তার মৃত্যু ঘটিয়েছে তার প্রতি ঘৃণাবোধ করবে না? জীবনের ব্যাপারে তারা প্রতারক বলেই তাদের মনে এত ভীতি, সত্য ঘটনাটি লুকুবার জন্যে এত অধীরতা, এত শঠতা।(২৩)
এই অনুচ্চারিত মনোকথনের মধ্যে আরেফ আলীর আত্মদ্ব›দ্ব কাটিয়ে তার বিবেকী জাগরণ ও আত্মমুক্তির প্রত্যাশা যেমন লক্ষ করা যায়, তেমনি, সামাজিক বাঁধার দিকও প্রতিফলিত হয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অসাধারণ শিল্পকৌশলে তা বিন্যস্ত করেছেন। ইউরোপীয় দুই ঔপন্যাসিক, আলবেয়ার কাম্যুর দ্য আউট সাইডার এবং ফ্রানৎস কাফকার দ্য ট্রায়াল এর সঙ্গে কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
ক. কখন সে মৃতদেহ প্রথম দেখে? একঘন্টা, দুঘণ্টা আগে? হয়তো ইতিমধ্যে এক প্রহর কেটে গেছে, কিন্তু যুবক শিক্ষকসেকথা বলতে পারবে না।(২৪)
খ. সেখানে আলো–অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ–উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়। অবশ্য কথাটা বুঝতে তার একটু দেরি লেগেছে, কারণ তা ঝট করে বোঝা সহজ নয়।… তারপর বাঁশির আওয়াজ সুতীব্র হয়ে ওঠে। অবশ্য বাঁশির আওয়াজ সে শোনে নাই।(২৫)
আলবেয়ার ক্যামুর দ্য আউট সাইডার–এর চরিত্রের কাছেও এই বিভ্রম চেতনার বিন্যাস লক্ষ করা যায়– আমার মা মারা গিয়েছেন। আজ না বিগতকাল, আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারব না।(২৬)
শিল্পশৈলীর প্রশ্নে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর এই অনুস্মরণ চাঁদের অমাবস্যার উপন্যাসের গঠন কাঠামো ও বক্তব্য প্রকাশে অধিক সাহায্য করেছে। সর্বোপরি যুক্তির শৃঙ্খলা ও আরেফ আলীর দ্বিধাদীর্ণ মনোজাগতিক রহস্য উন্মোচনে এই শৈলীর প্রয়োগ ছিল অবিকল্প, অনিবার্য। ঘটনা কিংবা চরিত্র নয়, ঘটনা উত্তর প্রতিক্রিয়া আবিষ্কারে চেতনাপ্রবাহ শৈলীর তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আরেফ আলীর দ্বিধামুক্তি তথা হত্যার ঘটনা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার বিবেকী জকাগরণে একথা প্রমাণ হয়েছে যে, অমাবস্যার অন্ধকার ক্ষণস্থায়ী, আলোই একমাত্র সত্য, স্থায়ী এবং উপন্যাসের নামার্থ ব্যঞ্জিত হয়েছে এভাবে।
৩.
উপন্যাসের ভাষা, তার শিল্পকাঠামোরই একটি অংশ।চাঁদের অমাবস্যা চেতনাপ্রবাহ শিল্পশৈলীর উপন্যাস, এর ভাষা অনুসৃত শিল্পশৈলী অনুসারেই বিন্যাস। দুজন সমালোচক বলেছেন, উপন্যাসের যে ভাষার ব্যবহার লেখক করেছেন তাতে ফারসি আঙ্গিকে বাংলায় তার একটি নিজস্ব লেখভঙ্গি তৈরি হয়েছে।(২৭) চেতনাপ্রবাহ শৈলী ব্যবহারের ফলে এ উপন্যাসের ভাষা পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হারিয়ে ফেলেছে।(২৮) দুটি অভিমতের কোনটিই গ্রহণযোগ্য নয়। বস্তুত বিষয় ও শিল্পশৈলীর অনিবার্য প্রয়োজনে ঔপন্যাসিক বিশেষ ভাষাশৈলী গ্রহণ করেছেন। এ সম্পর্কে সৈযদ ওয়ালীউল্লাহ্ বলেছেন, এই বইয়ের ভাষা আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই ফলটারিং দ্বিধাগ্রস্ত যুবক শিক্ষকের বিলম্বিত চৈতন্যকে ফুটিয়ে তোলার জন্য কিছুটা হোচট খাওয়ার ভঙ্গি তৈরি করতে হয়েছে। আমি অবশ্য আরো জটিল করতে পারতাম ফকনারের দি সাউন্ড অব ফিউরীর মত। কিন্তু ইংরেজি ভাষা, বিশেষ করে গদ্য ভাষা যে সমস্ত শিল্পগত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, বাংলা তো তা নয়; বাংলা লিখিত গদ্যের চলাচলও দীর্ঘ নয়। তাই একটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে আমাকে কাজ করতে হয়েছে। একবার ভেবেছিলাম, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গদ্যভঙ্গির সঙ্গে আধুনিক গদ্যভঙ্গির মিশ্রণ ঘটিয়ে চরিত্রের দ্বিধা-দ্ব›দ্বকে স্পষ্ট করব, কিন্তু গল্পের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবার ভয়ে সেদিকে অগ্রসর হইনি।(২৯) ঔপন্যাসিকের এই স্বীকারোক্তি থেকে বোঝা যায়, উপন্যাসের শিল্পশৈলীর উপযোগী একটি ভাষার কথা সচেতনভাবে চিন্তা করেছেন। বলেছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে ফলটারিং। অর্থাৎ ভয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভগ্নস্বরে বলা ভাষাভঙ্গিকে তিনি চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন।
উপন্যাসের কাহিনিকেন্দ্রে চরিত্রের সংখ্যা মাত্র তিন–যুবক শিক্ষক আরেফ আলী, কাদের এবং দাদাসাহেব। তিনটি চরিত্রের মধ্যে দাদাসাহেবের চরিত্রটির তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেই–পারিবারিক আভিজাত্য ও ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক আবহ সৃষ্টির নেপথ্যে ছায়া হিসেবে তাকে কাহিনীর পটভূমিতে স্থাপন করা হয়েছে। কাদেরকে দরবেশ বলে প্রচার করা এবং তার দরবেশি লাভের বৃত্তান্ত সবই দাদাসাহেব কথিত। কাদেরের বিকৃত স্বভাব ও অসামাজিক আচরণকে দাদাসাহেব এমন এক ধর্মীয় মাহাত্ম্য আরোপ করেছেন যে, তার প্রতি কোন মন্দ ধারণা পোষণ করা যায় না। ঔপন্যাসিক, দাদাসাহেব প্রতিষ্ঠিত ধর্ম মূল্যাশ্রয়ী সামাজিক ধারণার কেন্দ্রমূলে আঘাত করেছেন, কারণ সে ধারণা মিথ্যা, আরোপিত। দাদাসাহেব প্রসঙ্গে বর্ণিত ঔপন্যাসিকের ভাষা যথার্থই তার চিন্তা ও চরিত্রের অনুগামী। তৎকালীন বাঙালি মুসলমান সমাজের উদ্ভট ঐতিহ্যবোধ ও অলিক জাত্যাভিমানী মনোভাবের প্রতিনিধি– আজ সে ধন–সম্পদ বা মানইজ্জত নাই, কিন্তু এককালে চারধানে তাঁদের বড় নাম–ডাক ছিলো। তখন তারা বিশাল জমিদার মালিক ছিলেন। তাদের ঘোড়াশালে তখন ঘোড়া ছিল, হাতিশালে হাতি। খিল্লাত পরিধান করে রেশমের খরিতায় পত্রাদি বাঁধতেন; খাশমহল, আতর–বাইদমস্কের সুগন্ধিতে ভরপুর করতো এবং বিশেষ উৎসবের দিনে বাদশাহী কায়দায় পথে–ঘাটে মোহর ছড়াতেন। তখন আবাদার–চোবদার রাখতেন গণ্ডায় গণ্ডায় সবের–সেবন্দিও পুষতেন। আজ সেদিন আর নাই।(৩০)
আরবি–ফারসি শব্দের বহুল ব্যবহার–মানইজ্জত (সম্মান, সম্ভ্রম, আবরু) মালিক (অধিকারী, প্রভু), খিল্লাত (রাজদত্ত সম্মানসূচক পোষাক), খরিতায় (রেশম কাপড়ের তৈরি থলি বিশেষ), বাদশাহি কায়দায় (রাজকীয় নিয়মে), মোহর (স্বর্ণের তৈরি মুদ্রা বিশেষ), আবাদার (বায়না), চোবদার (ভারি অস্ত্রের বাহক), সবের–সেবন্দি (শুশ্রƒষাকারী, পরিচারক, ভূত্য, ভক্ত ইত্যাদি) উদ্ধৃতির মোট তেষট্টিটি শব্দের ছয়টি বাক্যের মধ্যে তেরটি শব্দ ফারসি এবং দুইটি শব্দ (জমিদার, মালিক) আরবি। শব্দ ব্যবহারের এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চরিত্রের আবহ অনুযায়ী ভাষা তৈরিতে কতটা সতর্ক ছিলেন।
ঔপনাসিকের বর্ণনায় কাদের সম্পূর্ণভাবে নিষ্কর্মা। অত্যন্ত স্বল্পভাষী এবং অসামাজিক বলে তার মনের পরিচয় পাওয়া দুষ্কর, কিন্তু তার বাইরের চেহারা নিদ্রালস। নিদ্রালস ভাব কাটলে চরম উদাসীনতা নামে তার মুখে। কাদেরের এই পরিচয় থেকে তার চরিত্রের স্বরূপ বোঝা যায়। উপন্যাসে তার সংলাপও স্বল্প, দূরাগত, কখনো প্রসঙ্গহীন, রহস্যময় এবং খনখনে গলার– কী বললেন? কাদের দৃষ্টি পূর্ববৎ লন্ঠনের ওপর নিবন্ধ। একটু চুপ থেকে সে কেমন খনখনে গলায় বলে, তোসতারী কিংখাবের কথা বলছিলাম। আরেকটি বিসদৃশ জিনিসঃ খনখনে গলা। মুখের সঙ্গে মানায় না তোসতারী কিংখাব? শোনেন নাই গলা আরো নম্র করে যুবক শিক্ষক উত্তর দেয় না। পুরানো আমলের জিনিস। সিন্ধুকে তালা বন্ধ থাকে। যুবক শিক্ষক বোঝে, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কোন মূল্যবান বস্তুর কথা কাদের বলছে, কিন্তু সে–কথার আকস্মিক উত্থাপনের অর্থ সে বোঝে না।(৩১)
তোসতারী কিংখাব আসলে সামন্ত মূল্যবোধ ও নানা বিধি-নিষেধের ক্ষয়িষ্ণু প্রতীক। বড় বাড়ি দরবেশ নামে পরিচিত স্বল্পভাষী, অমিশুক কাদের জ্যোৎস্নারাতে বাঁশ ঝাড়ে একটি হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর দ্বিতীয় রাতে আরেফ আলীর কাছে আসে এবং প্রায় প্রসঙ্গহীন তোসতারী কিংখাবÑএর কথা বলে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কাদের তার পরিবারের সম্ভ্রান্ত ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যুবক শিক্ষককে। পুরো উপন্যাসে তার ভাষা প্রায় প্রসঙ্গহীন, ছেঁড়া, ইঙ্গিতময়। আরেফ আলীর আত্মদ্বন্দ্বময় আতঙ্ক শিহরিত মনন অভিযাত্রার বিপরীতে কাদেরের ছেঁড়া ছেঁড়া, ইঙ্গিতময় সংলাপের বিন্যাস উপন্যাসের শিল্পশৈলীকে ব্যক্সময় করে তুলেছে: মেয়েলোকটাকে চিনতেন?…সে বলে, না সে বেঁচে না বা কীভাবে মরেছে, তাতে আপনার কি? …কাদের থেমে আবার বলে, কিন্তু দুর্ঘটনার কথা কাউকে বললে আমার কি হবে জানেন? ফাঁসী! থেমে আবার বলে, তাতে আপনার লাভ কি হবে? আরেফ আলী এবং কাদেরের এ সংলাপের ভাষা সাবলীল কিন্তু শানিত। চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসে আরেফ আলীর মনে চেতন-অবচেতনলোকের ভাবনাধারা প্রকাশ্যে যে ভাষাশৈলী ব্যবহার করেছেন, ঔপন্যাসিকের স্বীকারোক্তি মতে তা ফলটারিং অর্থাৎ দ্বিধা বা আতঙ্কগ্রস্ত মনের ভাষা- ক. তারপর বাঁশীর আওয়াজ সুতীব্র হয়ে ওঠে। অবশ্য বাঁশীর আওয়াজ সে শোনেনি। হয়তো ইতিমধ্যে একপ্রহর কেটে গেছে, কিন্তু যুবক শিক্ষক সে কথা বলতে পারবে না। আরেফ আলীর দ্ব›দ্বময় মনের পরিস্থিতি উদঘাটনে এই হ্যাঁ এবং না বোধক বাক্যবন্ধ যথার্থ। আত্মজিজ্ঞাসায় ক্রম-অগ্রসরমান যুবক শিক্ষকের মনোকথনের ভাষা- বাড়ি ফেরবার পথে যুবক শিক্ষকের তৃপ্ত-মনে হঠাৎ অপ্রীতিকর একটি সন্দেহের ছায়া উপস্থিত হয়। যুবতী নারীর হত্যাকারী কে, সে নিজেই নয়? সে যদি কাদেরকে অনুসরণ না করতো, অপ্রত্যাশিতভাবে এবং অকারণে বাঁশঝাড়ের সামনে উপস্থিত না হতো, তবে দুর্ঘটনাটি ঘটতো না। একটু ভেবে সে নিজেকে দোষমুক্ত করে। একথা-সত্য যে বাঁশঝাড়ে সে উপস্থিত না হলে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটতো না, কিন্তু অন্যদিন অন্যখানে অন্য কোন প্রকারে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হতো। আসল হত্যাকারী সে নয়, কাদেরের মনের গভীর ভীতি। সে ভীতির মূলে সিন্দুকে লুকানো তোসতারী কিংখাব হতে শুরু করে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা।(৩২)
সে নিজেই নয় না করতো না হতো-তবে দুর্ঘটনাটি ঘটতো না- এভাবে না অব্যয় ক্রিয়াপদের পূর্বে বসিয়ে যুবক শিক্ষক আত্মনিরীক্ষায় নিজেকেই দোষী সাব্যস্ত করা এবং মূহূর্তে আবার দোষমুক্ত ভাবার মধ্যে ভাষার তীর্যকতা প্রকাশ পেয়েছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গদ্যের বৈশিষ্ট্য হয়েছে বর্ণনা নয় বিশ্লেষণ। আরেফ আলীর ভাষা হয়ে উঠেছে বিশ্লেষণাত্মক, তাই বাক্যের গঠন কখনো দীর্ঘ কখনো ছোট, কখনো সাধুক্রিয়া (তখনো কুয়াশা নাবে নাই, সে শোনে নাই) কখনো আঞ্চলিক শব্দের পাশে চলতি শব্দের মিশ্র প্রয়োগ (সাধারণ জীবনের নকসার সঙ্গে তার জীবনের মিলজুক নাই, শিয়াল কিংবা মাঠালী ইঁদুর, মাটির দলায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে) লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসের ভাষাশৈলীর ক্ষেত্রেও চেতনাপ্রবাহ শিল্পশৈলী উপযোগী এ স্বতন্ত্র গদ্যভাষা উদ্ভাবন করেন।
প্রকৃতপক্ষে উপর্যুক্ত দৃষ্টিকোণ, প্রকরণপরিচর্যা, পরিমার্জিত জীবনবোধ ও হৃদয়ধর্মের বিচিত্র জাগরণশক্তি হিসেবে মানুষকে চিহ্নিত করেছেন সৈযদ ওয়ালীউল্লাহ্ চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসে। মানুষের হৃদয়ধর্মের অপার শক্তি অনুধাবনে সৈযদ ওয়ালীউল্লাহ্ পাশ্চাত্য শিল্পশৈলী ও অস্তিত্ববাদী, জীবনবোধাশ্রয়ী। এক্ষেত্রে তিনি সমকালীন অন্য ঔপন্যাসিকদের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পথচারী, বিবেককেন্দ্রিক আত্মজাগরণের পক্ষপাতী। তাঁর উপন্যাসের গঠনকাঠামো সুনিপুণ, ভাষা–শৈলী নির্মাণে প্রযত্ন প্রয়াসী, জীবনর্থ সন্ধানে ভাববেগমুক্ত, মনোবিশ্লেষণে প্রোজ্জল। চাঁদের অমাবস্যা একই সঙ্গে অস্তিত্বাশ্রয়ী, চেতনাপ্রবাহ শিল্পশৈলীর উজ্জ্বল শিল্পকর্ম।
তথ্যনির্দেশ ও টীকা
১. সৈয়দ আকরম হোসেন, প্রসঙ্গঃ বাংলা কথাসাহিত্য, ১৯৯৭, ঢাকা, মাওলা ব্রাদার্স, পৃ. ১১১
২. গোপিকানাথ রায় চৌধুরী, দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যকালীন বাংলা কথাসাহিত্য, ১৯৮৬, কলকাতা, দেজ পাবলিশিং, পৃ.২৭–২৮
৩. প্রসঙ্গঃ বাংলা কথাসাহিত্য, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৫
৪. রফিকউল্লাহ্ খান, বাংলাদেশের উপন্যাসঃ বিষয় ও শিল্পরূপ, ১৯৯৭, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, পৃ. ২১০
৫. প্রসঙ্গঃ বাংলা কথাসিহত্য, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৩–৯৪
৬. চাঁদের অমাবস্যা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচনাবলী, প্রথম খÐ, সৈয়দ আকরম হোসেন, সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ, ১৯৯৩, পৃ. ১২৬–১২৭
৭. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৮
৮. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ.১২৯
৯. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ.১৩০
১০. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩১
১১. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩১
১২. সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লালসালু‘তে ইমপ্রেশনিস্ট, গীতময়, চিত্রাত্মক ও চিত্রকল্পময়ঃ ভাবনানুষঙ্গের কখনো প্রতীকস্পর্শী; চাঁদের অমাবস্যায় এক্সপ্রেশনিস্ট, বিশ্লেষণাত্মক, প্রতীকস্পর্শী, মেধাবী–চিত্রকল্পময়; কাঁদো নদী কাঁদোতে নতুন এক শিল্পমাত্রায় পরাবাস্তববাদী। প্রসঙ্গঃ বাংলা কথাসাহিত্য, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৫
১৩. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৫
১৪. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ.১০২
১৫. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৮২
১৬. বাংলাদেশের উপন্যাসঃ বিষয় ও শিল্পরূপ, পূর্বোক্ত, পৃ. ২১২–২১৩
১৭. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৭৪
১৮. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯৬
১৯. চাঁদের অমাবসা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৩
২০. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৪
২১. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৬–১১৭
২২. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ.১৮৮
২৩. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ.৯৫
২৪. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৫
২৫. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ.৯৫
২৬. আহমদ মাযহার, চাঁদের অমাবস্যা, ব্যক্তি অন্তর্জগত লালসালু এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মমতাজ উদ্দিন আহমদ সম্পাদিত, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৯, পৃ. ১৩৮
২৭. সৈয়দ আবুল মকসুদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জীবন ও সাহিত্য, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৮৮, ঢাকা, পৃ. ১৫৮
২৮. আবু রুশদ, শওকত ওসমান ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস, ১৯৮৮, ঢাকা, সৃজনী প্রকাশনী, পৃ. ৫৮
২৯. সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, বই, ষোড়শ বর্ষ, ১২শসংখ্যা, মার্চ ১৯৮১, পৃ. ৩
৩০. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০৮
৩১. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৯
৩২. চাঁদের অমাবস্যা, পূর্বোক্ত, পৃ.১২৬–১২৭
(অধ্যাপক ড. আহমেদ মাওলা, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)