২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার, দুপুর ১২:২৬
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছড়া সাহিত্যের বিষয়
মঙ্গলবার, ১১ আগস্ট, ২০২০

নাজিয়া ফেরদৌস।।

বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধ পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি অতুলনীয় নাম। কেবল নাটক, উপন্যাস, কবিতা, ছোটগল্প দিয়েই তিনি নিজের সাহিত্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন নি, তার সাথে যুক্ত ছিল অনবদ্য ছড়া সাহিত্যও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম লিখিতভাবে ছড়া সংগ্রহ করে প্রচারের প্রয়াস করেন। ছড়ার মাহত্ম্যকে তিনি মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই নিজেও ছড়া রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। জীবনের শেষ সময়গুলোতে ছড়া রচনার মাধ্যমে তিনি নিজের মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন। শিশুর মত সরলতায় ফিরে গিয়ে তিনি বার্ধ্যক্যেও লাঘব করতে চেয়েছিলেন অভিজ্ঞতা আর গ্লানির ভারকে । অসাধারণ শিশুমনস্কতা ও বিভিন্ন বিষয় আশ্রিত তাঁর ছড়াগুলো ‘ছড়াসাহিত্য’ হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের ছড়াসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাঁর পাঁচটি গ্রন্থকে। যথা : ‘শিশু’, ‘শিশু ভোলানাথ’, ‘খাপছাড়া’, ‘ছড়ার ছবি’, ‘ছড়া’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছড়া সাহিত্য’এ রয়েছে বিচিত্র বিষয়ের সমাহার। লোকছড়ায় যেমন বিচিত্র বিষয় স্থান লাভ করেছে তেমনি রবীন্দ্রনাথের ছড়াতেও সন্নিবেশিত হয়েছে হাজারো বিষয়। বিষয় ভিত্তিক বিভাজনের ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে তাঁর ছড়ার মূল বিষয়গুলোকে ৩ ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা-

১) শিশুর উপযোগী ছড়া

২) বড়দের উপযোগী ছড়া ও

৩) সকল বয়সের উপযোগী ছড়া ।

শিশুর উপযোগী ছড়া :

শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য রবীন্দ্রনাথ বেশিরভাগ ছড়া রচনা করেছেন। তাঁর প্রায় সকল ছড়া গ্রন্থেই শিশুদের উপযোগী ছড়া রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ শিশুদের ভালোবাসতেন। বাংলার লোকছড়ায় শিশুদের জন্য যে সমৃদ্ধ ছড়াগুলো রয়েছে সেগুলো দ্বারা তিনি খুবই প্রভাবিত হয়েছিলেন। ছোটবেলার লোকছড়াকে তিনি সারাজীবন অন্তরে লালন করেছিলেন। ‘ছেলে ভুলানো ছড়ার মধ্যে আমি যে রসাস্বাদ করি, ছেলেবেলার স্মৃতি হইতে তাহাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব।’(১) তাই সেই ছেলে-ভুলানো ছড়াকেই তিনি শেষ বয়সে এসে মৌলিক ছড়ায় রূপায়িত করলেন। প্রথমে নিজের মাতৃহারা সন্তানদের জন্য, পরে সকল শিশুদের উপযোগী ছড়া রচনার মাধ্যমে নিজের বাল্যকালকে ফিরে পেতে চাইলেন। ছড়ার মাধ্যমে তিনি শিশুর সরল কল্পনার জগতে অবগাহন করে অনাবিল আনন্দ লাভ করতে পেরেছিলেন। তাঁর শিশু উপযোগী ছড়াগুলোকে দুইভাগে ভাগ করা যায়-

১) শিশুদের উদ্দেশ্যে রচিত ছড়া ও

২) শিশুর বয়ানে রচিত ছড়া

শিশুদের উদ্দেশ্যে রচিত ছড়াগুলোর বৈশিষ্ট্য হল এগুলো শিশুদেরকে উদ্দেশ্য করে রচিত হয়েছে। কখনো রবীন্দ্রনাথ শিশুকে অমূল্য সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কখনও বা তাকে বসিয়েছেন জগতের সবচেয়ে সরলতার মূর্তির আসনে। লোকছড়ায় শিশুকে যেভাবে দেখা হয়েছে তাকে রবীন্দ্রনাথও উপলব্ধি করেছিলেন। ‘আমাদের ছেলেভুলানো ছড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য সম্ভবত : শিশুকে এক মহামূল্যবান সম্পদরূপে কল্পনা করা।’(২)  ফলে শিশুকে ভুলিয়ে রাখতে তারা ছড়ার আশ্রয় নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথও শিশুকে ভোলানোর জন্য, তার মনকে আনন্দ দানের জন্য যেমন ছড়া রচনা করেছেন তেমনি শিশুকে মহামূল্যবান করে তোলাও তাঁর ছড়ার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।

‘শিশু’ গ্রন্থের ‘খেলা’, ‘খোকা’, ‘ঘুমচোরা’, ‘অপযশ’, ‘বিচার’, ‘চাতুরী’, ‘ভিতরে ও বাহিরে’, ‘অস্তসখী’, ‘হাসিরাশি’, ‘পরিচয়’, ‘বিচ্ছেদ’, ‘উপহার’, ‘পাখির পালক’ ইত্যাদি; ‘শিশু ভোলানাথ’ গ্রন্থের ‘রবিবার’, ‘পুতুল ভাঙা’, ‘মুর্খু’, ‘খেলা ভোলা’, ‘সংশয়ী’, ‘দুষ্টু’, ‘অন্য মা’, ‘দুয়োরাণী’, ‘বাণী-বিনিময়’ ইত্যাদি ছড়া শিশুর উদ্দেশ্যে লেখা। যেমন : ‘খেলা’ ছড়াটিতে তিনি শিশুর সরল চরিত্র তুলে ধরেছেন। মমতা ভরে তিনি বলছেন-

‘তোমার কটি তটের ধটি

 কে দিল রাঙিয়া।

 কোমল গায়ে দিল পরায়ে

 রঙিন আঙিয়া।’(৩)

সব শিশুই বাবা মায়ের কোল জুড়ে এক শুভক্ষণে আসে। হাসি-খুশি মুখ আর চঞ্চল এলোমেলো নাচে জননীর মুখে হাসি ফোটায়। ভিখারীর মত মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল নয়নে যেন কি সে চায়। তার সারাদিনের চঞ্চল এলোমেলো কার্যক্রমে সূর্য ও চাঁদও যেন হেসে ওঠে। অবশেষে ঘুমের বুড়ি এসে চোখ ঢুলিয়ে তার পরশ বুলিয়ে যায়। শিশুর এমন কার্যক্রমের প্রতিই দৃষ্টি দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

‘খোকা’ ছড়াটিতে খোকার ঘুম নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে রূপকথার দেশ থেকে যেখানে দুটি পারুল কুঁড়ি দোল খাচ্ছে সেখান থেকেই ঘুম খোকার চোখে যাওয়া আসা করে। কিন্তু ঘুমের ঘোরে চমকে উঠে খোকার যে হাসি ছড়িয়ে যায় ঠোঁটে তা কোন দেশ থেকে এসেছে সে কথা ছড়াকারের অজানা। ফাল্গুনে, আষাঢ়ে, আশীর্বাদ এসে খোকার কচি কোমল গায়ে পরশ বুলিয়ে যায়। এই ‘তরুণতনু’ খোকার ভার তিনি অর্পণ করেছেন প্রকৃতির কাছে। আবার ‘ঘুমচোরা’ ছড়াটিতে খোকার ঘুম কে নিয়ে গেল তাই নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন হয়েছেন। ঘুমচোরাকে ধরতে পারলে তার শাস্তি দানেও তিনি বদ্ধপরিকর-

      ‘কে নিল খোকার ঘুম চুরায়ে।

কোনমতে দেখা তার   পাই যদি একবার

       লই তবে সাধ মোর পুরায়ে।’(৪)

‘অপযশ’ ছড়াটিতে মায়ের মনে খোকার জন্য যে স্নেহ তাই প্রকাশ পেয়েছে। দুষ্টু খোকা যত দোষই করুক না কেন মায়ের কাছে সে কোনোভাবেই দোষী নয়। বরং যারা খোকাকে গালমন্দ কওে মা তাদেও ভৎর্সনা করেন। মায়ের কাছে শিশু সন্তানের চিরন্তন স্নেহের প্রতিচ্ছবি এই ছড়াটি যার আর একটি নজির রয়েছে ‘বিচার’ ছড়ায়। এখানে মা বলেছেন-

‘যত তোমার খুশি,

 সে বিচারে আমার কী বা হয়।

 খোকা বলেই ভালোবাসি,

 ভালো ব‘লেই নয়।’(৫)

আবার, খোকাও যে মাকে অনেক বেশি ভালোবাসে তার নিদর্শন মেলে ‘চাতুরী’ ছড়ায়। এখানে ছড়াকার দেখান খোকা মায়ের বুক ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না যতই তার পারিজাতের বনে উড়ে যাওয়ার সাধ থাক। মায়ের মুখের কথা শিখবে বলেই সে বোবার মত মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। ছড়াকারের মতে খোকা আগে খুব ধনি ছিল কিন্তু মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্যই সে সন্ন্যাসী ভিখারী বেশে মায়ের কোলে এসে জায়গা নিয়েছে। ‘ভিতরে ও বাহিরে’ ছড়াটিতে খোকার অবস্থান জগত ‘মায়ের অন্তঃপুরে’ বলে ছড়াকার তুলে ধরেছেন, যেখানে খোকার জন্য প্রকৃতিরাজ্য নিবেদিত। অপরদিকে তিনি মানুষের পৃথিবীকে বলেছেন ‘জগৎ পিতার বিদ্যালয়’ যেখানে সুখ-দুঃখের মিলিত সংগ্রামে টিকে থাকতে হয়। খোকার পৃথিবী থেকে তা আলাদা। ‘অস্তসখী’ ছড়ায় তিনি এমন একটি ছোট মেয়ের কথা বলেছেন যেন সে শুকতারা, যেন নতুন হয়ে সে পুরোনোর স্থান নিতে এসেছে। নবীন-প্রবীণের মধ্যে এসে রচনা করেছে বন্ধন। আবার ‘হাসিরাশি’ ছড়াটিতে তিনি বর্ণনা করেছেন একটি ছোট মেয়ের যার নাম বাবলারাণী। ফুটফুটে তার দাঁত, মুখে চাঁদের হাসি, কচি কচি হাত আর পুটপুটে ঠোঁট। আকাশের চাঁদকে সে আয় আয় বলে ডাকে। সেই ডাকে চাঁদও যেন তারাদের ফেলে তার কাছে ছুটে আসতে চায়। ছড়াকার চান তার হাসিরাশি, যেন তার হাসিতেই বাঁধা থাকে।

একটু ভিন্নভাবে শিশুর উদ্দেশ্যে রচিত ছড়া হল ‘পরিচয়’। এখানে ছোট্ট মেয়েটিকে পাড়ার সবাই লক্ষ্মী বললেও তার বাবা তা মানেন না। কারণ সে ভোর না হতেই খিলখিল হাসিতে সাড়া পাড়া জাগিয়ে তোলে, বাবার কাঁধকে বাহন বানিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে, কোলে চড়ে নরম নরম ঘুষিতে বাবাকে ব্যস্ত করে তোলে-

‘আমি ব্যস্ত হয়ে বলি-

একটু রসো রসো মা।’(৬)

আবার এসব থেকে একটু অন্য রকমভাবে রচিত হয়েছে ‘বিচ্ছেদ’ ছড়াটি। এখানে ছোট্ট মেয়েটির বিয়োগে বেদনাহত হয়েছেন ছড়াকার। তাঁর অনুপস্থিতিতে সকল কিছুতেই যেন শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। টাপুর টাপুর বৃষ্টি পড়ছে, আকাশে মেঘ করেছে, সকালের সূর্যের মুখও ফ্যাকাশে মনে হচ্ছে। তার বিরহে খাঁচার ময়নাটিও ঝিমোচ্ছে। সে ভুলে গেছে লেজ নাচাতে। সেই মেয়েটির রেখে যাওয়া বইগুলোও কেউ আর খুলছে না। কোন কিছুর অভাব না থাকলেও বারে বারে বাড়ির সব কিছুই তার কথা মনে করিয়ে দেয়। আগাগোরা কষ্ট দিয়ে ছড়াটি তৈরি। ‘উপহার’ ছড়াটিতে শিশুকে স্নেহ উপহার দিতে চান তিনি কিন্তু স্নেহের চেয়ে মূল্যবান কোন কিছুই তিনি পান না। টাকা-কড়ি, ধন-সম্পদ, সব ফুরিয়ে যায় কিন্তু স্নেহ ফুরায় না। তিনি তাই মূল্যবান বস্তুর চেয়ে স্নেহকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। পাহাড়ের চূড়া যেমন তার স্নেহের নদীটি যতদূর বয়ে যাক তাকে ভুলতে পারে না তেমনি মানুষের মনেও স্নেহই সব সময় অমর হয়ে থাকে। ছড়াকার তাই তাঁর ভবিষ্যৎকে আর্শিবাদের উপহার প্রদান করতে চেয়েছেন। ‘পাখির পালক’ ছড়াটিতে একটি শিশুর মনক্ষুণ্ন হওয়ার ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। খুব উৎসাহে শিশুটি তার মায়ের কাছে  একটি সোনালি পালক এনে-

          ‘বলে তাড়াতাড়ি- ‘ওমা দেখ্ দেখ্,

          কী এনেছি দেখ্ চেয়ে।’(৭)

কিন্তু তুচ্ছ বস্তুটি দেখার পর মা খুবই হতাশ হয়ে পালকটি মাটিতে ফেলে দিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চলে যায়। এতে শিশুটির মন ভেঙে যায়। সে আর কখনই তার সে পালক কাউকে দেখায় না। ‘আশীর্বাদ’ ছড়াটির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর সকল শিশুকে আশীর্বাদ করার জন্য সকলের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন-

      ‘ইহাদের কাছে ডেকে   বুকে রেখে কোলে রেখে

                তোমরা করো গো আর্শীবাদ।’(৮)

শিশুদের উপযোগী ছড়া শিশুকে কেন্দ্র করেই তিনি রচনা করেছেন। শিশুর স্বভাব, চাঞ্চল্য, তাকে ঘিরে সবার মনোভাব, তার কার্যক্রম এসব বিষয়কে কেন্দ্র করেই শিশুদের উদ্দেশ্যে রচিত ছড়াগুলো উঠে এসেছে। শুধু বাস্তব জীবনে শিশুর কার্যক্রমকে উদ্দেশ্য করেই ছড়াগুলো রচিত হয় নি। শিশুর মনের কল্পনার জগতকে উন্মুক্ত করতে তিনি রচনা করেছেন ‘শিশু ভোলানাথ’ গ্রন্থের ‘তালগাছ’ ও ‘বুড়ি’ কবিতাটি।

বাল্যকালে পাঠ্যবইয়ে ‘তালগাছ’ ছড়াটি পড়েনি এমন মানুষ খুব কমই আছে। ছড়াটি একদিকে যেমন তুচ্ছ তালগাছকে অপূর্ব সৌন্দর্যে ফুটিয়ে তোলে তেমনি জাগিয়ে তোলে শিশুর কল্পনাপ্রবণ মনকেও। তালগাছ হয়ে ওঠে একটি চরিত্র যে মানুষের মত একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মনে তার স্বপ্ন কালেঅ মেঘ ফুঁড়ে সে একেবারে উড়ে যাবে। কিন্তু তার পাখা নেই বলে সে তার ইচ্ছাকে মেলে ধরে গোল গোল তালপাতায়। যখন বাতাস আসে বাসা ফেলে, আকাশে তারাদের ছাড়িয়ে সে চলে যেতে চায় দূরে। কিন্তু বাতাস থেমে গেলেই যখন পাতা কাঁপা থেমে যায় সে যেন কল্পনা থেকে বাস্তবে অবতরণ করে। তার মনে হয় মায়ের স্নেহমাখা মাটিই তার মা। তাই আরেকবার মায়ের স্নেহমাখা পৃথিবীর কোণটি তার ভালো লাগে-

‘যেই ভাবে,   মা যে হয় মাটি তার

               ভালো লাগে আর বার

               পৃথিবীর কোনটি।’(৯)

এভাবে শিশুর কল্পনার জগতটিকে বিস্তৃত করে তিনি আবার তাকে মাতৃভূমিতে মায়ের আঁচলে ফিরিয়ে আনেন।

ঠিক এই রকম আরেকটি ছড়া ‘বুড়ি’। চির পরিচিত এই ছড়াটি সকলের কাছেই সমান জনপ্রিয়। যখন পড়ি-

‘এক যে ছিল চাঁদের কোণায়

চরকা কাটা বুড়ি

পুরাণে তার বয়স লেখে

সাতশো হাজার কুড়ি।’(১০)

তখন শিশুর কল্পনার জগত পৃথিবী ছাড়িয়ে ছড়িয়ে যায় সুদূর চাঁদের দেশে। যেখানে প্রাচীন এক বুড়ি লক্ষ কোটি তারা ধরার পণ করে সাদা সুতার জাল বুনে চলেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। বুড়ির ঘুম পেল, স্বপ্নে তার বয়স সে গেল ভুলে, পথভুলে সে এসে পড়লো মায়ের কোলে। ছোট্ট শিশু হয়ে সে বারবার চাঁদের দিকে হাত নেড়ে ফিরে যেতে চায় কিন্তু মাকে দেখার সাথে সাথেই চাঁদের কথাই সে ভুলে যায়। কেউ বুঝতে পারে না যে সে খুকু নয় ‘আদ্যিকালের মেয়ে’। তারপরেও সবাই তাকে ‘বুড়ি বুড়ি’ করে ডাকে। মানব সমাজে মানুষের তিরোধান ও পুনরায় শিশু হয়ে জন্মানোর চক্রকেই তিনি ইঙ্গিত করেছেন এই ছড়ায়-

‘সবচেয়ে যে পুরানো সে

 কোন মন্ত্রের বলে,

 সবচেয়ে আজ নতুন হয়ে

 নামল ধরাতলে।’(১১)

‘শিশুর জীবন’ কবিতায় বড়দের প্রতি কিছুটা কটাক্ষ চোখে পড়ে। প্রথমে তিনি বলতে চেয়েছেন বাল্যকালের সরলতায় নিজেকে সব সময় ধরে রাখা অনেক বেশি অসাধ্য বলেই আমরা প্রতিমুহূর্তে আমাদের মনের ভাণ্ডারে হাজার হাজার বিষয় সঞ্চয় করি। ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ হলেও আমাদের আশ মেটে না। তাই ‘খোঁজার পরে আবার চলে খোঁজা’। ভবিষ্যতের ভালোর কথা চিন্তা করে  দিন রাত খেটে চলি তাই বাল্যের মত ছুটিও আমাদের কপালে জোটে না। সূক্ষ্ণ বিচার বিবেচনা আর জটিল জীবনের মন্ত্রনায় জীবনে কেউ আর নির্ভার হতে পারে না। যে অকৃত্রিম সরলতায়, নির্ভাবনায় শিশু দিন কাটায় কর্মক্লান্ত ছড়াকার সেই জীবনে ফিরে যেতে চেয়েছেন বারং বার, যেই জীবনে ‘সুখ রবে মোর বিনা মূল্যেই কেনা।’ তিনি উপলব্ধি করেছেন বড়দের জগতে শুধু প্রতিযোগিতার ঠেলাঠেলি। এখানে, সস্তা ও দামির বিবেচনায় শুধু সময় বইয়ে দেওয়া, কিন্তু কোন কিছুতেই সন্তুষ্ট হয়না মন। তাই তিনি যে জীবনের শুরু বাল্যকাল দিয়ে হয়েছে সেই বাল্যে গিয়েই শেষ করতে চান। তিনি শিশুর স্বভাব দেখতে পান সমগ্র পৃথিবীতে, সকালের আলো, শিশির, গাছ, ফুল, পাখি, জল, স্থল, হাওয়া সব কিছুতেই শিশুর সারল্য বিদ্যমান। প্রকৃতির ঋতু বদলায়, ফুলেরাও নতুন হয়ে ফোটে, ধরে রাখে শিশুর মত উজ্জ্বলতা। এক অজানা শিশুসাথীর কাছে তিনি আবার শিশুকাল প্রার্থনা করেছেন। জটিল জীবন থেকে মুক্তি লাভ করে চেয়েছেন ‘সহজ চোখে দেখব সহজ দেখা।’ এ যেন শিশুর জীবনকে পাওয়ার ব্যাকুল বাসনা। রবীন্দ্রনাথের ছড়ার এটি একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যও বটে।

রবীন্দ্রনাথ কেবল যে শিশুকে উদ্দেশ্য করেই ছড়া রচনা করেছেন তা নয়। তিনি ছড়া লিখেছেন শিশুর মত হয়ে, শিশুর মানসিকতায়, শিশুর জবানিতে। একটি শিশু কী ভাবে, কিভাবে চলতে চায়, কী তার মনের জিজ্ঞাসা, কিভাবে সে নিজেকে বড় করে তুলতে চায়, তার কল্পনায় সে কী আঁকে, পৃথিবীকে সে কী নজরে দেখে ইত্যাদি বহু বিষয়কে শিশুর ভাষায় তার কথায় অসাধারণ নৈপুণ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। কখনো শিশু মায়ের কাছে তার মনোভাব পোষণ করেছে আবার কখনো নিজের মনেই তার অপূর্ণ সাধের কথা ব্যক্ত করে গেছে। প্রকৃত বিষয় হল-

‘সত্যিকার শিশুসাহিত্য নিছকই শিশুতোষ ঝুমঝুমি নয় যথার্থ সাহিত্যবোধের সঙ্গে তার কোন প্রকৃতিগত পার্থক্য নেই, তাকে মোটেই কোন খণ্ডিত, কি অপূর্ণ কি অলিক প্রবেশ বলে গণ্য করার কারণ নেই। তাতে থাকতে পারে পূর্ণ ও পরিণত জীবনের নানা স্পন্দন, বিশ্বসংসারের যাবতীয় বস্তু ও রহস্য মানবসত্তারই বিস্ময়কর উন্মীলন।’(১২)

‘শিশু’ গ্রন্থের ‘জন্মকথা’, ‘প্রশ্ন’, ‘সমব্যাথী’, ‘বিজ্ঞ’, ‘ব্যাকুল’, ‘সমালোচক’, ‘বীরপুরুষ’, ‘নৌকাযাত্রা’, ‘ছুটির দিনে’, ‘বনবাস’, ‘বৈজ্ঞানিক’, ‘মাতৃবৎসল’, ‘লুকোচুরি’, ‘দুখঃহারী’, ‘বিদায়’, ‘আকুল আহ্বান’ ইত্যাদি; ‘শিশু ভোলানাথ’ গ্রন্থেও ‘রবিবার’, ‘পুতুল ভাঙা’, ‘মুর্খু’, ‘সাত সমুদ্র পাড়ে’, ‘খেলা ভোলা’, ‘সংশয়ী’, ‘দুষ্টু’, ‘অন্য মা’, ‘দুয়োরাণী’, ‘মর্তবাসী’, ‘বাণী-বিনিময়’ ইত্যাদি ছড়ায় তার প্রকাশ পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে কিছু ছড়ায় মায়ের কাছে কাল্পনিক ও বাস্তবতা মিলিয়ে হাজারো প্রশ্ন রেখেছে ছোট্ট শিশুটি। তার সে প্রশ্নের উত্তর দিতে বয়স্করাও চিন্তায় পড়ে যায়। কখনো কেউ তার উত্তর দিতে চেষ্টা করে আবার কখনো সে কোনো উত্তরই পায় না। নিজের মতই তখন সে তার উত্তর সাজিয়ে নেয়। যেমন : ‘জন্মকথা’ ছড়াটিতে খোকা মাকে ডেকে বলে সে কোথা থেকে এলো। মাও হেসে কেঁদে বলে যে সে তার বুকের মাঝেই লুকিয়ে ছিল। ছিল মায়ের পুতুল খেলায়, ঠাকুর পূজার সিংহাসনে, চিরকালের ভালোবাসায়, যৌবনের সৌরভে, মায়ের কান্না হাসিতে, সবকিছুতে। মা ভেবে পান না, যে সবার ছিল সে কি করে মায়ের আপনার হয়ে গেল। ছেলের প্রশ্নে মা তাকে হারানোর ভয়ে ক্ষীণ বাহুর আড়ালে লুকিয়ে রাখেন।

‘প্রশ্ন’ ছড়াটিতে ছোট শিশুটি মাকে বলে পড়ায় ছুটি দিতে কারণ সে মায়ের ঘরে বসে পড়া পড়া খেলবে। দুপুর বেলাকেই সে বিকেল মনে করতে চায়। সবাই কাজ শেষ করে দুপুরে ঘরে ফিরে আসে, সে এটাকেই সন্ধ্যা বলে মনে করতে চায়। আশ্চর্য তার আবদার-

‘মনে করনা উঠল সাঁঝের তারা,

মনে করনা সন্ধ্যে হল যেন।

রাতের বেলা দুপুর যদি হয়

দুপুর বেলা রাত হবে না কেন।’(১৩)

এরকমই বিচিত্র প্রশ্নবাণে মাকে জর্জরিত হতে দেখা যায় ‘সমব্যাথী’ ছড়াটিতে। এখানে একটি কুকুর ছানার প্রতি সমব্যাথী খোকা তার মাযের কাছে বলছে- সে যদি কুকুর ছানা হত তবে কি তার মা তাকে পাতের ভাতে মুখ দিতে মানা করত? দুর দুর করে তাড়িয়ে দিত? যদি তাই হয় তবে খোকা আর মায়ের কোলে থাকবে না। অভিমানে সে বনেই চলে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। পশুর প্রতি এমন সরল ভালোবাসা ও মায়ের প্রতি অভিমান শিশুদের দ্বারাই সম্ভব যার সার্থক রূপদান করেছেন রবীন্দ্রনাথ।

কখনো আবার মায়ের কাছে নালিশ জানায় ছোট্ট শিশুটি। ছোট বোনের কার্যক্রম, বাবা আর ভাইয়ের কার্যক্রম কার কাছে ঠিক বলে মনে না হলে সে মায়ের কাছে গিয়ে তাদের নামে নালিশ জানায়। ‘বিজ্ঞ’ ছড়াটিতে খোকা নালিশ করে তার ছোট্ট বোনটির কা- দেখে। কারণ তার বোন কিছুই বোঝে না। পড়তে দিলে বই ছিঁড়ে ফেলে, খেলতে দিলে নুড়ি খেয়ে ফেলে, খোকা দুষ্টুমি করে মুখ ঢেকে এলে ভয়ে কেঁদে ওঠে, এমন আরো অনেক বোকামি সে করে। তাই খোকা নালিশ জানায় মায়ের কাছে। আবার বাবার বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে দেখি ‘সমালোচক’ ছড়াটিতে। এখানে শিশুটি বাবার একজন কঠোর সমালোচোকের ভূমিকা পালন করেছে। বাবার লেখা মা বোঝে না বলে তার ধারণা, সে চায় বাবা মায়ের রূপকথার গল্পের মত লেখুক। স্নান সেরে মা বাবাকে খেতে বললে বাবা অনেক সময় তা শোনেন না, তার মনে হয় বাবা ইচ্ছে করেই সারাক্ষণ ‘লেখা লেখা’ খেলা করেন কিন্তু সে খেলতে গেলেই তাকে ‘দুষ্টু ছেলে’ বলা হয় যার কারণ সে খুঁজে পায় না। বাবা বড় বড় রুলটানা কাগজ কালো কালিতে লিখে নষ্ট করে অথচ সে নৌকা বানাতে গেলে বলে ‘নষ্ট করতে নাই।’ তাই শিশুটি অভিমানে মায়ের কাছে নানা প্রশ্ন করে উত্তর জানতে চায়।

অনেক ছড়াতেই সাহসী শিশুর বীরত্বকে তুলে এনেছেন রবীন্দ্রনাথ। বড়দের মতো সাহস দেখিয়ে বড়, কঠিন কাজ করতে পারার কল্পনা শিশুমনে সহজাত। তিনি মনে করতেন-‘বীরত্ব জিনিসটা কোথাও বা অসুবিধার হইতেও পারে, কিন্তু ওটার প্রতি মানুষের একটা গভীর শ্রদ্ধা আছে। সেই শ্রদ্ধাকে জাগাইয়া রাখিবার জন্য সকল দেশের সাহিত্যেই প্রচুর আয়োজন দেখিতে পাই।’(১৪)

এই আয়োজনে তিনিও পিছিয়ে থাকেন নি। তাঁর ‘বনবাস’, ‘বীরপুরুষ’, ‘দুঃখহারী’, ছড়ায় শিশুর কাল্পনিক বীরত্বের কথা প্রকাশিত। ‘বীরপুরুষ’ ছড়াটিতে চিত্রিত হয়েছে একটি সাহসী শিশুর ছবি। সে মনে করছে যে ঘোড়ায় চেপে পাল্কিতে মাকে নিয়ে সে বিদেশ ঘুরে বহুদূর দেশে যাচ্ছে। নিজের বীরত্বের পরিচয় দিতে সে রোমহর্ষক প্রকৃতির বর্ণনা দিচ্ছে। এমন সময় ডাকাতের আক্রমনে যখন পাল্কি ছেড়ে বেহারাগুলো পাশের কাঁটাবনে পালাল তখন বীরপুরুষের মত একাই খোকা লড়াই করতে ছুটল। বলল-

‘ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে

ঢাল তলোয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে,

কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে

শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।’(১৫)

প্রচণ্ড যুদ্ধ শেষে বীর বেশে খোকা ফিরে এলো। মা তার বীর পুত্রকে চুমো খেয়ে কোলে তুলে নিয়ে বীরত্বের প্রশংসা করলেন। অসাধারণ কল্পনার বিচরণ থেকে রবীন্দ্রনাথ এই ছড়াটি রচনা করেছেন। এরকমই বীরত্বের পরিচয় পাওয়া যায় ‘বনবাস’ ও ‘দুঃখহারী’ ছড়ায়। এখানেও ছোট শিশুটি নিজের বীরত্বের পরিচয় দিতে প্রস্তুত।

আরেক ধরনের বিষয় প্রধান্য পেয়েছে শিশু উপযোগী ছড়াগুলোতে। শিশুর মনের গোপন চিন্তা, বাসনাকে রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করতে চেয়েছেন বিভিন্ন ছড়ায়। শিশুর মনের বিচিত্র সাধ, তার ইচ্ছা, তার স্বপ্নকে তিনি ছড়ার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ‘শিশু’ গ্রন্তের ‘বিচিত্র সাধ’, ‘মাস্টর বাবু’, ‘ছোটবড়’, ‘রাজার বাড়ি’, ‘মাঝি’, ‘জ্যোতিষি’, ‘শাস্ত্র’, ‘কাগজের নৌকা’; ‘শিশু ভোলানাথ’ গ্রন্থেও ‘সময় হারা’, ‘সাত সমুদ্র পারে’, ‘পথহারা’, ‘রাজা ও রাণী’, ‘দূর’, ‘বাউল’, ‘ঘুমের তত্ত্ব’, ‘মর্তবাসী’, ‘চিত্রবিচিত্র’ গ্রন্থের ‘সাধ’, ‘স্বপ্ন’ ইত্যাদি ছড়াতে শিশুর মনের গোপন ইচ্ছা ও তার বহুমুখি সম্ভব অসম্ভব সাধের কথা প্রকাশ করেছেন ছড়াকার।

‘বিচিত্র সাধ’ ছড়াটিতে শিশুটি চেয়েছে ফেরিওলা হতে। সেলেট ফেলে দিয়ে চুড়ি, পুতুল ফেরি করার মাঝেই সে আনন্দের খনি দেখতে পায়। ফুল বাগানের মালিকে দেখে তার মনে হয় মালী খুব স্বাধীন। তাকে যেমন কেউ ‘সাফ জামা’ পরায় না তেমনি কোদাল নিয়ে ধুলৈামাখা হলেও কেউ তাকে কিছু বলে না। তাই সে মালী হতে চায়। পাহারাদার হতেও তার খুব ইচ্ছা। আবার ‘মাঝি’ ছড়াটিতে তার ইচ্ছো করে খেয়া ঘাটের মাঝি হতে। মাঝি হলেও সে মাকে ছেড়ে বাবার মতো বিদেশে যাবে না তাই সে মায়ের কাছে অনুমতি চায়-

‘মা যদি হও রাজি,

বড় হলে আমি হব

খেয়া ঘাটের মাঝি।’(১৬)

‘কাগজের নৌকা’য় শিশুটির মনের ব্যতিক্রমী আশার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তার ইচ্ছে করে কাগজের নৌকা বানিয়ে সে তাতে নিজের নাম ঠিকানা বড় বড় করে লিখে দেবে, নৌকা ভাসিয়ে সে সারারাত ভাবে তার সাধের নৌকাটা কার ঘাটে ভিড়ছে, কোন দেশে দেশে ঘুড়ছে। রাত বাড়তে যখন তার চোখে ঘুম আসে তখন সে ভাবে তার তার নৌকার মধ্যেও নিশ্চই ঘুমপাড়ানিয়া মাসি তার ঘুম নিয়ে চড়ে বসেছে।

শিশুরা বড়দের দেখেই সব কিছু শেখে। তাই শিশুর মনে বড় হয়ে বড়দের মতো আচরণ করার ইচ্ছা স্বাভাবিক ভাবেই গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথও এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন। শিশু মনের অসম্ভব সব ইচ্ছাকে তিনি চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘মাস্টারবাবু’ ছড়ায় শিশুটি কানাই মাস্টার হিসেবে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। তার মনের অপূর্ণ মাস্টারির সাধ সে পূরণ করছে তার সাধের বিড়াল ছানাটিকে পড়তে বসিয়ে। পড়ায় ফাঁকি দিলে মাস্টারমশাই যেমন করে তাকে বকাঝকা করে তেমনি ভাবে সে তার অবাধ্য বিড়াল ছানাটিকে শাসন করছে, তাকে চুরি করে মাছ খেতে নিষেধ করছে, গোপালেন মতো ভালো হওয়ার উপদেশ দিচ্ছে। বলছে পড়ার সময় পড় আর ছুটি হয়ে গেলে খেলার সময় খেল। তার কথায় অবোধ বিড়াল এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে যেন সব বুঝেছে কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তার আর দেখা মেলে না। এমনই আর একটি ছড়া ‘ছোটবড়’। এখানে শিশুটি চেয়েছে তার বাবার মতো বড় হতে। তার ইচ্ছে যখন সে বড় হয়ে যাবে তখন বড় ভাইয়ের মতো খাঁচায় সে পাখি পুষবে। দেরি হয়ে গেলেও সে স্নানের জন্য তাড়া করবে না বরং ছাতা হাতে পাড়া বেড়িয়ে আসবে। যখন তাকে পড়াতে গুরুমশাই আসবে সে বলবে-

‘আমি বলব, ‘খোকা তো আর নেই’

হয়েছি যে বাবার মতো বড়।’

গুরুমশাই শুনে তখন কবে,

‘বাবুমশায়, আসি এখন তবে।’(১৭) 

এামার কোলে সে চড়বে না, ঝিকে চাবি খুলে টাকা দেবে, বাবা বাণিজ্য থেকে যখন ছোট জামা নিয়ে আসবে তখন সে বলবে ‘দাদা পরুক এসে’ কারণ এ জামা তার হবে না সে বাবার মতো বড় হয়েছে। এমনি কত স্বপ্ন আর বিচিত্র সাধ নিয়ে শিশুটি কল্পনা করতে থাকে।

এর থেকে একটু ব্যাতিক্রম ইচ্ছার কথা পাওয়া যায় ‘সময়হারা’ ছড়াটিতে। এখানে শিশুটি নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করতে চায় তাই সে ভাবে মসময় যদি বন্ধ হয়ে যেত তবে ভালো হত। স্কুলে যেতে সে না চাইলে যদি কেউ মন্দ বলে তবে সে বলবে ‘দশটা বাজাই বন্ধ’। সময় বন্ধ হলে আর রাত হবে না, খেলার সময় শেষ হবে না, শেষ হবে না ‘গল্প বলার বেলা’। তখন সে মনের আনন্দে তাধিন তাধিন নেচে বেড়াবে।

‘সাত সমুদ্র পাড়ে’ ছড়াটিতে শিশুটি মেঘলা দিনে বৃষ্টি নামলে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতে চায়, আবার ‘জ্যোতিষী’ ছড়ায় শিশুটি মনে কওে তার ডানা না থাকায় সে যেমন উড়তে পারে না, আকাশের তারারা পা নেই বলে নিচে আসতে পারে না, তারা সারারাত ঘাটের পানিতে ছায়া দেখে কাটায়। তারাগুলো ভাবে যদি মায়ের ছেলে হয়ে এই ছাদে আসতে পারতো তাহলে তার মায়ের সাথে রাতে ঘুমাতে পারতো, সারা বেলা খেলতে পারতো। কিন্তু আবার তার মনে হয় তারারা দিনের বেলায় দেখতে পায়না বলেই হয়তো তারা আসে না বরং আকাশে মাদুর পেতেই ‘দেখা দেখা’ খেলে।

শিশু মনের ইচ্ছার অসাধারণ প্রকাশ দেখা যায় ‘ইচ্ছামতী’ ছড়ায়। শিশুটি এখানে নদী হতে চায়। তার মনে হয়-

‘যখন যেমন মনে করি

তাই হতে পাই যদি,

আমি তবে এক্খনি হই

ইচ্ছামতী নদী।’(১৮)

আবার, রাজমিস্ত্রী হওয়ার ইচ্ছার কথা সে প্রকাশ করে ‘রাজমিস্ত্রী’ ছড়ায়। তমিজ মিয়ার গরুর গাড়ি চড়ে সে শহরে গিয়ে দালান বানাবে। কিন্তু যখন সবাই বলবে এত বড় দালান বানাতে পেরেও সে কেন কোঠা ঘরে থাকে তখন সে দেবার মতো কোন উত্তর খুঁজে পায় না।

‘দুই আমি’ ছড়াটিতে অবাস্তব একটি কল্পনার জগতে শিশুটি বিচরণ করে। তার মনে হয় যদি সে আর একজনও হত তবে কেমন হতো, কেমন হতো সেই আরেক জনের ভাব সাব। কিন্তু সেই আরেকজনকে সে মানুষ রূপে নয় প্রকৃতি হিসেবে ভেবে নেয় যে তার ইচ্ছার মতই পলে পলে বদলায়, কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টির রূপ ধরে। কখনও বা চাঁদকে ধরার ফাঁদ ফাঁদে। কিন্তু যখন মায়ের কথা মনে হয় তখন তার মতই সেই অন্যজন মায়ের কোলে ফিরে আসে।

আবার ‘চিত্রবিচিত্র’ গ্রন্থের ‘সাধ’ ছড়াটিতে শিশুটি মনে করে যে- ফুলের সাধ হয় প্রজাপ্রতি হতে, প্রদীপ চায় জোনাকি হয়ে উড়ে বেড়াতে, পুকুরের জলের পাখি হতে মন চায় আর খোকা ভাবে-

        ‘আমি ভাবি ঘোড়া হয়ে

মাঠ হব পার

কভু ভাবি মাছ হয়ে

কাটিব সাঁতার।’(১৯)

রবীন্দ্রনাথ শিশুর মনোবাসনা বিষয়ক ছড়াগুলোতে তাঁর চিন্তাকে বিস্তৃত হতে দিয়েছেন। সুতো ছেড়ে উড়তে দিয়েছেন মনের মত। লাগাম ছাড়া শিশুর চিন্তাকে তিনি প্রশ্রয় দিয়েছেন। তিনি শিশুর মত করে ভাবতেন বলেই এমন অসাধারণ মনের ইচ্ছাতে তিনি নিজের শিশু মনকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শিশুতোষ ছড়ার বিষয় প্রকৃতপক্ষে এমনই হওয়া উচিত। যা হবে শিশুর জন্য, শিশুর মনের মতো। কারণ- ‘ছড়ার রাজ্যে বুদ্ধি ও বিচারের অধিকার নেই। শিশুদের কাছে বুদ্ধি ও বিচার অপেক্ষা রসের মূল্য বেশি। মস্তিষ্ক অপেক্ষা হৃদয় বড়।’(২০)

শিশুর কল্পনাকে অনেকখানি প্রশস্ত করে রূপকথা। আমাদের দেশে প্রচলিত রূপকথাগুলো শিশুমনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। তারা কল্পনায় রূপকথার রাজ্যে বিচরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাস্তব এবং কল্পনার মিলিত চিন্তা তাদের চিন্তা শক্তিকে বাড়িয়ে তোলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছড়াসাহিত্যেও এই বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ-

‘বাস্তব এবং কল্পনায় মিলিয়াই ছড়ার জগত গড়িয়া উঠে, কেবলমাত্র অবিমিশ্র বাস্তব ও যেমন ইহাতে থাকে না, তেমনিই অবিমিশ্র কল্পনার উপাদানেও ইহা সৃষ্টি হয় না। সাহিত্য মাত্রেরই ইহা সাধারণ ধর্ম।’(২১)

‘শিশু’ গ্রন্থের ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘রাজার বাড়ি’, ‘ছুটির দিনে’; ‘শিশু ভোলানাথ’ এর ‘পথহারা’ ও ‘সোনারতরী’ গ্রন্থের ‘নিদ্রিতা’, ‘সুপ্তোত্থিতা’, ‘বিম্ববতী’, ‘রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে’ ইত্যাদি ছড়া রূপকথাকে আশ্রয় করে রচিত। এসব ছড়ায় রূপকথার মাধ্যমে কখনো শিশুকে কাল্পনিক জগতে তিনি নিয়ে গেছেন কখনো আবার, শিশু নিজেই রূপকথার জগতে বিচরণ করেছে। যেমন: ‘সাত ভাই চম্পা’ ছড়ায় রূপকথার সাতটি চাঁপা ফুলের মধ্যে বন্দি সাতটি ভাই ও তাদের একটি পারুল বোনের কথা বলা হয়েছে। যেখানে-

‘ফুলের খেকে মুখ বাড়িগয়ে

দেখতেছে ভাই বোন-

দুখিনী এক মায়ের তরে

আকুল হল মন।’(২২)

‘রাজার বাড়ি’ ছড়াটিতে আছে ঘুমন্ত রাজকন্যা, সোনার কাঠি, রূপার কাঠি, সুয়োরাণী, দুয়োরাণীর কথা, যেই রাজকন্যার দুহাতে কাঁকন, কানে দুল, বিস্তৃত দীর্ঘ চুল মাটিতে লুটিয়ে পরে। আবার ‘পথহারা’ ছড়ায় এক অন্যরকম রাজ্যে শিমুটি প্রবেশ করে। সে পথ হারিয়ে চলে যায় গা ছম ছম করা ভয়ংকর জুজুদের গহীন বনে। সেখানে সে দেখে খেজুর গাছের মাথায় বসে বেঁটে বেঁটে মানুষ তাকে দেখছে, গাছ থেকে লম্বা লম্বা পা ঝুলছে। পথ খুঁজতে সে সাহায্য চায় শেয়ালের কাছে-

‘ডেকে বলি- ‘শেয়াল ভায়া,

মায়ের গাঁয়ের পথ তোরা কেউ

দেখিয়ে দে না মোরে।’(২৩)

এভাবে শিশু মনের বিচিত্র কল্পনাকে ছড়ায় তুলে ধরতে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

বড়দের উপযোগী ছড়া :

রবীন্দ্রনাথ ছড়ার ছন্দ আর বৈশিষ্ট্যকে কেবল শিশুদের উপযোগী ছড়া রচনায় ব্যবহার করেন নি। তিনি বড়দের জন্যও রচনা করেছেন অজস্র ছড়া। সমাজের অসঙ্গতি, সামাজিক অপরাধ, দুর্নীতি, লোক ঠকানো, মানুষের বিচিত্র কর্ম এমনকি স্বভাব-চরিত্র নিয়েও তিনি ছড়া রচনা করেছেন। বড়দের জন্য রচিত ছড়ায় তিনি সমাজকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। আবার কখনো নিছক রঙ্গরসে মনোরঞ্জনের চেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছেন। সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের মতে ‘আমাদের বিবেচনায় ছড়া শিশুর জন্য যেমন হতে পারে, পরিণত মানুষের জন্যও হতে পারে।’(২৪)  রবীন্দ্রনাথ এই কথাটি ভেবেছিলেন বলেই তিনি বড়দের জন্যও ছড়া করতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর বড়দেও জন্য রচিত ছড়াগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন :

১) সামাজিক অসঙ্গতি বিষয়ক

২) চরিত্র বিষয়ক

৩) নারী বিষয়ক

৪) শিক্ষা বিষয়ক

৫) সামাজিক অনাচার বিষয়ক

৬) কাহিনি বিষয়ক

৭) চিকিৎসা বিষয়ক

৮) ব্যঙ্গাত্মক ইত্যাদি।

সামাজিক অসঙ্গতি বিষয়ক ছড়াগুলোর মধ্যে ফুটে উঠেছে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন নিয়মের অনিয়ম। ‘উজ্জ্বল ছবি ও ছবিখণ্ড হিসেবে ছড়াগুলি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। আপাত মনে হয় বুঝি ছোটদের জন্য লেখা। কিন্তু এগুলির রস ছোটদের অপেক্ষা বড়োদের বেশি উপভোগ্য।’(২৫) তিনি তুলে ধরেছেন সমাজ বাস্তবতার নেতিবাচক কিছু দিক। কখনো হাস্যরসে, কখনো ব্যঙ্গ করে তিনি সমাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। ‘খাপছাড়া’ গ্রন্থের প্রায় ২৮টি ছড়াই সামাজিক অবস্থা নিয়ে রচিত। ৮, ১১, ৫৪ সংখ্যক ছড়ায় সমাজের অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ডের প্রকাশ দেখা যায়। ৮নং ছড়ায় এক ঠক পাখিওয়ালা কাককে কালো রং চন্দনা বলে পানুলাল হালদারের কাছে বিক্রি করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু চতুর পানুলাল তা বুঝতে পারলে ঠক বিক্রেতা তাকে বোঝাতে চায় যে ‘বাবা’ নাম বলতে শেখেনি তাই তার পাখি ‘কাকা’ নামেই বন্দনা করে। এরকমই আরেকজন ঠকের দেখা মেলে ৫৪ নং ছড়ায়। এখানে অপব্যায়ী দানুবাবু শ্রীবিষ্ণুর নাম নিয়ে চাঁদার টাকা তুলে মানুষকে ঠকিয়ে বেড়ায়। চুরির নজির মেলে ১১ নং ছড়ায়। এখানে মেছুয়াবাজারের চারজন পালোয়ান গায়ের জোরে চুরি করতে এসে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। শাস্তি থেকে বাঁচতে তারা বলে-

‘ভেবেছিনু হেথা হয়

 নৈশবিদ্যালয়-

নির্খচা জীবিকার

বিদ্যা-উপার্জন।’(২৬)

আবার ‘খাপছাড়া’র ১০, ৩৬, ৪১, ৭০, ৭১,৭৭, ৭৯, ৮৮ নং ছড়ায় ও ‘চিত্রবিচিত্র’ এর ‘বিষম বিপত্তি’ ছড়ায় পাওয়া যায় সমাজে চাকরির অপ্রতুলতা, চাকরিচ্যুতি, বেকারত্ব, দারিদ্র ইত্যাদির কারণে সৃষ্ট অভাবের বাস্তব চিত্র। ১০ নং ছড়ায় নওগাঁর তিনকড়ি ঘরে ঘরে ঋণ করে সময় কাটায়। খাবারের অভাবে সে শুকিয়ে গেলেও বলে যে তার ঘরে কিঙ্কর কিঙ্করী ঠাসা তাই সে কম খেয়ে শরীরটাকে ক্ষীণ রাখছে।

৩৬ নং ছড়ায় ভিক্ষুক তিন কড়ি সারা পাড়া খুঁজে যে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ফেরে তাও তার কাছ থেকে কেড়ে নেয় সিধু। নিজে অনাচার করলেও সে তিনকড়িকে ধিক্কার দিয়ে বলে-

‘ভিখ্ মেগে ফের, মনে

ঘয় না কি ধিক্কার?’

ঝুলি নিজে কেড়ে বলে

‘মাহিনা এ শিক্ষার।’(২৭)

৪১ নং ছড়ায় নিতান্ত অভাবের স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেন ছড়াকার। ইটের গাদার নিচে ভাঙা দেয়ালের গায়ে হেলে পড়া একটি বাড়ির চিত্র তিনি দেখান এই ছড়ায়। এ বাড়ির পাঁচিল নেই শুধু ইট সুরকি বাকি আছে। এবাড়ির মানুষ দই সন্দেশ খায় না, খায় খই আর মুড়কি। অভাবে তাদের সব কেড়ে নিয়েছে এখন শুধু –

‘গলায় দেবার মতো

বাকি আছে দড়িটা।’(২৮)

চাকরিচ্যুত হয়ে অভাবের ঘনঘটা দেখা যায় ৭০ নং ছড়ায়। যে মাসে অফিস থেকে লোকটার নাম কাটা যায় সেদিন থেকেই সে বউয়ের শাড়ি খুলে নিজে পরে আর বউ পরে তার গামছা। অভাবের তাড়নায় তাকে ঘরের যত জিনিস ছিল সব বিক্রি করতে হয়। বিক্রি করতে করতে শেষে টিনের চামচ পর্যন্ত সে বেচে দিতে চায় কিন্তু দাম অনেক কমালেও কেউ তা আর কেনে না। অপরদিকে হাস্যরসাত্মকভাবে  ভীষণ করুণ চিত্র এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ ৭১ নং ছড়ায়। সুদের হার বেড়ে যখন নবুর সতেরো টাকা জমল তখন সে তা শোধ দিতে একসাথে পাঁচ মেয়ে বিয়ে করল। কিন্তু তার জীবনের অবস্থা হয়ে উঠল শোচনীয়। কারণ-

‘কাজ দিল কন্যারা

 ঠেলাগাড়ি ঠেলাবার,

 রোদ্দুরে ভার্যার

 ভিজে চুল এলাবার।’(২৯)

এভাবে একদিকে যেমন তিনি মানুষের অভাবের কারণে সৃষ্ট করুণ অবস্থার চিত্র এঁকেছেন তেমনি অপরদিকে এঁকেছেন বিভিন্ন সামাজিক অনাচারের ছবি। ২৫, ৪৮, ৪৯ নং ছড়ায় এই চিত্র ধরা পরে। ২৫ নং ছড়ায় অন্যদের জন্য মামলায় জড়িয়ে লোকটি সব শেষ করে ফেলে। গিনি, টাকা, সিকি,সব তার শেষ হয় উকিল ও আমলাকে দিতে গিয়ে। শেষে তার গরুহীন গোয়ালের তলাহীন গামলায় শুধু তুষ আর খুদকুঁড়োই অবশিষ্ট থাকে। আইনি ব্যবস্থার করুণ পরিণতির প্রতি এখানে ছড়াকার ইঙ্গিত করেছেন।

ছড়ায় রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন বাংলার ঘরে ঘরে প্রচলিত নিঃস্ব করে দেওয়া পণ প্রথার চিত্র। ৪৮ নং ছড়ায় বিয়েতে কনের পণের আশা করে হিরু চাকরি ছেড়ে দেয়। কিন্তু ভাগ্য দোষে বিয়ের আগেই শ্বশুর মারা গেলে কন্যাও বিয়ে করতে রাজি হয় না। এই শোকে সে বর বেশ ছেড়ে দরবেশের সাজ ধরে। অপরদিকে ৪৯ নং ছড়ায় বিয়ের কথা পাকা করতে বরের বাপের বাড়ি চলেছে বৈবাহিক। সাথে তার দই বাহিকও রয়েছে। আরো রয়েছে পণের টাকার হিসাব পাকাপাকি করতে সই-বাহিক। বিষয়টি বিস্ময়কর ও দুঃখজনক হলেও ছন্দের মাধ্যমে ছড়াকার তা অসাধারণভাবে তা তুলে ধরেছেন-

‘পণ দেবে কত টাকা

 লেখাপড়া হবে পাকা,

দলিলের খাতা নিয়ে

এসেছে সই-বাহিক।’(৩০)

এছাড়াও এই গ্রন্থের ৪২, ৫১, ৫২, ৬০, ৬৪,৭২, ৭৮, ৮১, ৮২, ৯২, ৯৬ নং ছড়ায় নানা ধরনের মানুষের প্রকৃতি ও কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। ৪২ নং ছড়ায় বলা হয়েছে নিজের উপার্জনের ইতিবাচক দিকের কথা। কারণ অন্যের টাকায় খেলে ও চললে সেখানে নিজের জুতোর পাত্তা না থাকলেও পরের জুতার স্বাদ ঠিকই পাওয়া যায়। ৫১ নং ছড়ায় কর্তাব্যক্তিদের স্বেচ্ছাচারিতা প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে রাণীর হাসি থামাতে সব দাম্ভিক লোককে রাজা হত্যা করে কিন্তু পরে রাণী যখন বলে যে এখন সে হাসবে কি করে, তখন রাজা বলে-

‘হসনীয় আমি রব তবু।’ এভাবে সে নিজের ক্ষমতা বলে সবাইকে হত্যা করলেও দাম্ভিকতা তার নিজের মধ্যেই জিইয়ে রাখে। ৭৮ নং ছড়াটিতে একটি বাস্তব চিত্র ছড়াকার তুলে ধরেছেন। পীতু নামের দরিদ্র লোকাটি লটারিতে যখন পঁচাত্তর হাজার টাকা পেল তখন তার চারপাশে মানুষের ভিড় লেগে গেল। জীবনী লেখার জন্য কেউ এলো, কেউ এলো নতুন সম্পর্ক গড়তে, এমনকি এক পিলেওয়ালা ছাত্রের জন্য তার কন্যার প্রস্তাবও এলো। দিন বদলে গেলে যে সমাজের সবার আচরণও বদলে যায় এ তারই নজির।

৮২ নং ছড়ায় দেখা যায় আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাওয়া অপরাধি সাধু ছাড়া পেলে চরেরা কর্তাকে খবর দেয়। তখন কর্তাকে রক্ষা করতে জেলখানাতেই আশ্রয় নিতে হয়। ছড়াকার খুব সচেতন ভাবেই বলেছেন-

‘মহারাজা ভয়ে থাকে

পুলিশের থানাতে,

আইন বানায় যত

পারেনা তা মানাতে।’(৩১)

নারী বিষয়ক কিছু ছড়ায় রবীন্দ্রনাথ নারীর বিভিন্ন স্বভাব নিয়ে ছড়া লিখেছেন। ২৩, ৬১, ৬৬, ৭৪, সংজোযন অংশের ৬, ১২, ১৬ নং ছড়া নারীকে কেন্দ্র করে রচিত। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে ২৩ নং ছড়ায়। এখানে সন্তোষ নামের ব্যক্তিটির বউ ছিল ‘বেঁটে জগদম্বা’। ডাক্তার গ্রেগসন তাকে ইনজেকশন দিলে তার দেহ সাত ফুট লম্বা হয়ে যায় কিন্তু এও সন্তোষের চোখে বাড়াবাড়ি ঠেকে। বউ তার থেকে লম্বা হবে তা সে মানতে পারে না। স্ত্রীর চেয়ে কোন কিছুতে কম থাকতে চায় না বলে সে ডাক্তারকে বলে তার পা লম্বা করে দিতে। এই শুনে ডাক্তারই হতভম্ব হয়ে যায়। প্রায় একই রকম চিত্র দেখা যায় ৬৬ নং ছড়ায়। সেখানে লোকটি বলে-

‘বটে আমি উদ্ধত,

নই তবু ক্রুদ্ধ তো,

শুধু ঘরে মেয়েদের সাথে মোর যুদ্ধ তো।’(৩২)

সে নিজেকে সাত্বিক সাধক বলে কিন্তু নিজে অপকর্ম করে বেড়ায়। দারোগা এলে সে দরজা বন্ধ করে দেয়। আবার সংযোজন অংশের ৬, ১২, ১৬ নং ছড়ায় নারীর অন্য রূপ তিনি এঁকেছেন। এসব ছড়ায় নারীরা দাম্ভিক ও স্বামীর উপর অত্যাচার চালিয়ে নিজের অবস্থানকে দৃঢ় রেখেছে। যেমন : ১২ নং ছড়ায় ছড়াকার রায় ঠাকুরাণী অম্বিকার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন-

‘নারী সমাজের তিনি তোরণের স্তম্ভিকা।

গয় নাকো তার দ্বিতীয় কাহারো দম্ভিকা।’(৩৩)

মানুষের স্বভাব নিয়েও রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ সব ছড়া রচনা করেনছেন। বিচিত্র স্বভাবের মানুষের আশ্চর্য পরিচয় তিনি করিয়ে দেন ‘খাপছাড়া’ গ্রন্থেও বিভিন্ন ছড়ায়। এছাড়া ‘ছড়া’ গ্রন্থের মধ্যেও অনেক চরিত্রের দেখা মেলে। ‘খাপছাড়া’র ৪৬, ৮৯, ১০১ নং ছড়ায় দেখা যায় নিতান্ত অলস স্বভাবের কিছু মানুষের চিত্র। যারা অলসতার কারণে কাজকর্ম বাদ দিয়ে কেববল দিন রাত ঘুমিয়ে কাটায়। ৪৬ নং ছড়ায় ভুপু নামের লোকটি ‘সময় চলেই যায়’ বলে প্রতিদিন নালিশ করলেও বালিশ থেকে তার মাথা ওঠে না। ঘড়ি চলতে থাকে বলে সে ঘড়িটা বন্ধ করে দেয়, কুঁড়েমির কারণে ভোরে দুপুরে বা রাতেও সে বিছানা ছাড়ে না। এমনি আরেকজন অলসের খোঁজ মেলে ৮৯ নং ছড়ায়। সে এতই অলস যে ডাকাত এলেও যেন তাকে না ডাকা হয় তাই সে ছোট বউকে জেগে  থেকে ডাকাত তাড়াতে বলে। তবে সে এও বলে ঘুম যদি তার ভাঙতো তবে সেও কিল, চড়, লাথি লাগিয়ে দিত-

‘ভাঙতে চায়না ঘুম

তানা হলে দুমাদুম্

লাগাতেম কিল ঘুষি

চালাতেম লাথি আর।’(৩৪)

অলসের পাশাপাশি যেমন কৃপণ স্বভাবের লোকের পরিচয় মেলে ১০৩ নং ছড়ায় তেমনি ১০২ নং ছড়ায় দেখা যায় অতি বিনয়ী একজন মানুষকে। আবার ৪৭ নং ছড়ায় সাক্ষাৎ মেলে একজন অতি ভীতু স্বভাবের মানুষের যার ভয় ঝালেও যেমন মিষ্টিতেও তেমনি। সে ভয় পায় চতুর্দিককে, নিজের ইটের বাড়ি এমনকি অন্যকারো বাড়িতেও তার ভয়। ভূত, প্রেত থেকে শুরু করে দিনের আলো ও রাতের অন্ধকারও তার ভয়ের কারণ। এই স্বভাবের ব্যক্তিটি রবীন্দ্রনাথের একটি ব্যতিক্রমী সৃষ্টি।

সমাজে শিক্ষা ব্যবস্থার অবনতি, শিক্ষার বেহাল দশা ইত্যাদি নিয়েও রবীন্দ্রনাথের ছড়া পাওয়া যায়। ‘খাপছাড়া’ গ্রন্থের ৩, ৫৯, ৭৩, ৮৫, ৯৮ ইত্যাদি ছড়া শিক্ষার বিষয়কে কেন্দ্র করে রচিত। রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছোটবেলায় মাস্টার সেজে শিক্ষার ভয়াবহতা প্রকাশ করতেন তার নিথর ছাত্রদের উপর। ‘পালকির বাইওে একএকদিন ছিল আমার মাস্টারি, রেলিংগুলো অঅমার ছাত্র, ভয়ে থাকত চুপ।’ ( রবীন্দ্র ১৯৯০ : ৫৯৩) তাঁর ছড়ার মধ্যেও এই বিষয়টি উঠে এসেছে। এখানে ৩ ও ৭৩ নং ছড়ায় শিক্ষার ভয়ে ভীতু ও ফাঁকিবাজ ছাত্রের কথা ছড়াকার বলেছেন। ৩নং ছড়ায় মতিলাল নন্দী এই ফাঁকিকে কার্যকর করতে পড়া এগোয় না বলে গঙ্গার জলে বই ছিঁড়ে ভাসিয়ে দেয়। পড়া দ্রুত এগোবার এই অভিনব চাতুরী তার ফাঁকিবাজী মানসিকতার পরিচয় দেয়। আবার ৫৯ নং ছড়ায় এমন এক শিক্ষকের কথা ছড়াকার বলেন যে শুধু হাসি দমন করে। তার হাসিশ্বর নামে এক ছাত্রও জুটে যে শুধু হাসে। গুরু বশিশ্বর তার হাসি থামাতে চেষ্ট করেন। কিন্তু তাও তার হাসি থামে না। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষায় মারধর একেবারে পছন্দ করতেন না। কিন্তু তার বাল্যকালে তিনি ছাত্রদের প্রচণ্ড মার খেতে দেখেছেন বলে তিনি এর বিপক্ষে ছিলেন। তিনি ছড়ায় এ ধরনের মার দেওয়া পণ্ডিতদের চিত্র তুলে ধরেন। ৯৮ নং ছড়ায় আমরা একজন অত্যাচারী পণ্ডিতকে পাই যিনি সব কাজ ফেলে শুধু ছেলেদের শাস্তি দিতেন, নাকে খত দেওয়াতেন, কান টেনে টেনে ফাঁকা করে দিতেন। এমনকি তার তাণ্ডবে ক্লাসের আসবাবপত্রও ঠিক থাকতো না। কারণ-

‘ক্লাসে যত কান ছিল

 সব হল খণ্ডিত,

 বেঞ্চিটেঞ্চিগুলো

 লণ্ডিত ভণ্ডিত।’(৩৫)

এভাবে শিক্ষাব্যবস্থার অমানুষিকতার পরিচয় তিনি তুলে আনেন ছড়ায়।

সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চিকিৎসা শাস্ত্রেও অনেক উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু মুনাফা অর্জনের চিন্তায় এই চিকিৎসা ব্যবস্থাকেও মানুষ নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। ফলে কেউ ভালো চিকিৎসায় প্রচুর টাকা দাবি করে কেউবা ভুয়া ডাক্তার সেজে রোগীর জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। সামাজিক অবস্থার এই অবনতির চিত্র আমরা রবীন্দ্রনাথের কিছু ছড়ার মধ্যে পাই। ‘খাপছাড়া’ গ্রন্থের ৩৩, ৫০, ৭৬ নং ছড়া চিকিৎসা ব্যাবস্থাকে কেন্দ্র করে রচিত। ৭৬ নং ছড়ায় তিনি একজন নাড়ীটেপা ভণ্ড ডাক্তারের চিত্র তুলে ধরেছেন। এই ডাক্তারের অতি উঁচু নাক দেখলেই তাকে দূর থেকেই চেনা যায়। তিনি এমনই ওষুধের নাম দেন যা মানুষের নয় এদেশের পশুদের জন্য ব্যবহৃত হয়। তিনি যে বাড়িতেই যান জোর করে রোগীর নাড়ী দেখে টাকা আদায় করেন। এখানে তার কোন ফাঁকি নেই। তার অনবদ্য চিকিৎসায় ভক্তমহল মৃত্যুকে বরণ করে পাড়ি জমায় নির্বাকপুরে। এমনই আরেক ডাক্তারের দেখা মেলে ৩৩ নং ছড়ায়। তার নাম ডক্তার ময়জন। তিনি বাতাসে কড়া বিষ মিশিয়ে পরীক্ষা চালান। তাঁর সেই পরীক্ষায় সারা শহরের কেউই বেঁচে থাকে না, মাত্র নয় জন নাবালক ছাড়া। এই পরিস্থিতি দেখে তিনি তার  গবেষণার অগ্রগতি চিন্তা করে খুশি হন। ভাবেন-

‘খুশি হয়ে ভাবে, এই গবেষণা

না জানি সবার কবে হবে শোনা,

শুনিতে বা বাকি রবে কয়জন।’(৩৬)

বর্তমানে আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার যে অবস্থা তারই ইঙ্গিত এই ছড়ায় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ সমাজ সচেতন ছিলেন বলেই এসব বিষয়ও তাঁর নজর এড়ায়নি।

মানুষের জীবনের বিচিত্র ঘটনাকে ছড়ায় রূপান্তরিত করার অদ্ভুত সাহস দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বিভিন্ন চরিত্রকে তুলে ধরতে ঘটনার বর্ণনা দেন অসাধারণভাবে। তাঁর ‘ছড়ার ছবি’ গ্রন্থের ‘ভজহরি’, ‘যোগীনদা’, ‘বুধু’, ‘অচলা বুড়ি’, ‘সুধিয়া’, ‘মাধো’, ‘কাশী’, ‘প্রবাসে’, ‘বালক’, ‘দেশান্তরী’, ‘আতার বিচি’, ‘মাকাল’, ‘শনির দশা’, ‘বাসা বাড়ি’; ‘শিশু’ গ্রন্থের ‘পূজার সাজ’; ‘ছড়া’ গ্রন্থের ২, ৩, ৪, ৬, ৮, ৯, ১০নং ছড়া, ‘চিত্রবিচিত্র’ গ্রন্থের ‘আগমনী’, ‘এক ছিল বাঘ’ ইত্যাদি ছড়া বিভিন্ন ঘটনা ও কাহিনিকে ধারণ করছে।

‘ভজহরি’ ছড়াটিতে ভজহরি নামক এক লোকের পাখির প্রতি টানের কাহিনি বলা হয়েছে যিনি মেয়ের বিয়েতে শুধু নানা জাতের পাখিদেরই নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ‘যোগীনদা’ ছড়াটিতে বর্ণিত হয়েছে যোগীনদা নামের এক ব্যক্তির কাহিনি। ইনি নানা রকম খাবার আরি উপহারের লোভ দেখিয়ে শিশুদের পড়াতে আনতেন। বয়স অনেক হলেও তা বোঝা যেত না তার মুচকি হাসি ভরা মুখ দেখে। রাতে তিনি অনেক আজগুবি গল্প শোনাতেন। যেমন : একদিন তিনি ট্রেনে করে যাচ্ছিলেন হঠাৎ রাজা তার বহর নিয়ে এসে যোগীনদার মাথায় তাজ পরিয়ে দিয়ে তাকে প্রভু হিসেবে বরণ করল। কিন্তু প্রকৃত বিষয় ছিল- তেরো বছর আগে রাজপুত্র বিয়ে করে কনেসহ বনে হারিয়ে যায়। তখন থেকেই তার খোঁজে চর ঘুরছিল। তারা পিণ্ডিদাদনখাঁ, লালামুসা, লুধিয়ানা, পাঞ্জাব, গুলজারপুর, আলমগির, রাওলপিণ্ডি, হারৎ জংসন সব জায়গায় খোঁজ চালাল। অবশেষে যোগীনদাকে দেখে তারা রাজাসাহেব সম্বোধন করে তার বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে চালাকি করে আসল পরিচয় না দেওয়ায় চর ভাবলো এই রাজপুত্র হবে। তার গায়ে তারা রাজলক্ষণও দেখতে পেল-

‘রাজলক্ষণ এতগুলো একখানা এই গায়

ওরে বাস রে, দেখে নি যে আর কোনো জায়গায়।’(৩৭)

এর পাঁচমাস পরেই মহাসমারোহে তাকে সবাই জৌনপুরের স্টেশন থেকে রাজবাড়িতে নিয়ে চলল। সময তখন ঠিক দুপুর। এই পর্যন্ত বলেই তিনি গল্প বলা থামিয়ে দিলেন। ছেলেদের চাপাচাপিতে আবার গল্প শুরু হল। রজপুত্র হওয়ার পর তিনি গলদঘর্ম হলেন মোটা মোটা পরোটা আর ঘি খেয়ে, মুটের বোঝার মত পাগড়ি আর কষ্টকর নাগরা জুতায় জীবন অতিষ্ট হল। রামলীলার দিন ঢিলা পাহারা থাকায় তিনি পালিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। যঙখন গল্প শেষে ছেলেরা বলল ‘কেন তুমি ফিরে এলে?’ তখন তিনি শুধু হাসলেন। তার গল্প কথক শিশুটির মনে গেঁথে গেল।

‘বুধু’ ছড়াটিতে এমন একজন কৃপণের কাহিনি বলা হয়েছে যে তার একমাত্র নাতি মোগলুর জন্যই টাকা জমায়। নিজে না খেয়ে সব টাকা রেখে দেয়। নাতিকে সে নামও দেয় না কারণ নাম ভাঁড়িয়ে সে দেবতাকে ফাঁকি দিতে চায়। মূলত বৃদ্ধ বুধুর নাতির প্রতি অগাধ ভালোবাসাই এই ছড়ার প্রতিপাদ্য।

একটি মজার ঘটনার ছড়া হল ‘কাশী’। কথক তখন গল্প শুনতেন যোগীনদার কাছ থেকে। তার এক খুড়ি ছিল যে কাঁঠালের বিচির আচার আর মোরব্বা বানিয়ে অনেক টাকা জমিয়েছিলেন।একদিন এক চোর চুড়ি করতে এসে খুড়ির হাতে ধরা পড়ল। খুড়ি তার হাত ভেঙে দিচ্ছিল কিন্তু অনেক অনুনয় করে সে ছাড়া পেল। এরপর একদিন গু-ার হাতে ধরা পড়ল যোগীনদা। গুণ্ডারা তার খুড়ির টাকা হাতাবার জন্য তাকে ধরে রাখল তাকে মারতে উদ্যত হল কিন্তু সে মুহুর্তে গুণ্ডার ভাগ্নি এসে তাকে রক্ষা করল। পরে সেই তাকে ছেড়ে দিল। গল্প শুনে কথক যখন বলল ঠিক এমনি গল্প বাবা বই থেকে শুনিয়েছেন তখন তিনি বললেন-

‘দাদা বললেন, ‘বিধি যদি চুরি করেন নিজে

পরের গল্প, জানি নে ভাই, আমি করব কী যে।’(৩৮)

এমনই নানা মাত্রিক গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে ছড়াগুলো। ‘প্রবাসে’ ও ‘দেশান্তরী’ ছড়ায় জীবনের বেদনার ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। আবার, ‘অচলা বুড়ি’, ছড়াটিতে এক পরোপকারী বুড়ির ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। অন্য এক ধরনের প্রতিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ‘সুধিয়া’ ও ‘মাধো’ ছড়াদুটিতে। সুধিয়া ও মাধো উভয়ই প্রচুর সাহসী ও নিজের পোষা প্রাণীকে বাঁচাতে ক্ষমতাশীলদের সাথে লড়াই বাঁধাতে দ্বিধা করে না। তারা অত্যাচারের শিকার হলেও সাহস দেখিয়ে নিজের মাথা উঁচু করে বাঁচতে বদ্ধপরিকর।

‘আতার বিচি’ ও ‘মাকাল’ ছড়াদুটিতে শিশুর সরল বোকামির ঘটনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ছড়ার আদলে গল্পকে রূপায়িত করেছেন। প্রাচীন কাল থেকেই ছড়ায় ছড়ায় গল্প বলার প্রবণতা মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। নির্মলেন্দু ভৌমিকের মতে ‘ছড়ার ভাববস্তু ও রূপ নির্মাণে কথা ও কাহিনির ভূমিকা অসামান্য। কথা কাহিনি চরিত্রের আভাসে রচিত ছড়ার পরিমাণ কম নয়। কে জানে সবচেয়ে বেশিই কিনা।’৩৯ এসব কাহিনি বিষয়ক ছড়া শিশু, বয়স্ক সকলের মনে আনন্দ দানে সক্ষম।

 রবীন্দ্রনাথ সমাজ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন। সমাজ ব্যবস্থার অবনতি তাঁকে ব্যথিত করতো। তাই কখনো সরাসরি কখনো ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে তিনি সমাজকে তুলে ধরেছেন। ‘খাপছাড়া’ গ্রন্থের অনেক ছড়াই তাঁর রসিক মন ও সমাজ সচেতনতার পরিচয় বহন করে। বুদ্ধদেব বসু তাই এই গ্রন্থ সম্পর্কে বলেছিলেন- ‘প্রতিভাবানের খেয়াল, অবসর কালের আত্মবিনোদন, চিরচেনা রবীন্দ্রনাথেরই নতুনতর ভঙ্গি।’৪০ এই গ্রন্থের ৪, ৬, ৯, ১২, ১৫, ১৭, ২০, ৮৮, সংজোযন অংশের ৭, ১৮, ১৯, ২০, ২৩, ২৪ ইত্যাদি সংখ্যক ছড়াতে ব্যঙ্গ করে বাস্তব চিত্র ধারণের অসাধারণ প্রতিভা প্রকাশিত হয়েছে। যেমন : ৬নং ছড়ায় নিধু নামক এক কপট ব্যক্তিকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। স্ত্রী তার অত্যাচারে গলায় দড়ি দিলে সে ‘এটা ঘরোয়া’ বলে ঠেকিয়ে রাখতে চায়। পুলিশ এলে পা ধরে তার থেকে মুক্তির উপায় খোঁজে। সে এমনই নির্লজ্জ যে লোকে তাকে গালি দিলে সে বলে দাদা আরো বলো কান জুড়িয়ে গেল। অফিসে সাহেবের গালি খেয়েও তার কিছু মনে হয় না। স্ত্রী কাঁদলে হেসে হেসে ‘তবে আসি’ বলে সে চলে যায়। ৫৮ নং ছড়ায় ছড়াকার ডাক্তারি চিকিৎসার ব্যঙ্গ করে তাদের টাকা লুটবার ফন্দিকে দেখিয়ে দিয়েছেন। অশীতিবর্ষীয় একজন মানুষের বাঁচার আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করে ডাক্তারেরা প্রচুর টাকা রোজগার করে। তাদের এই অন্যায়কেই তিনি ব্যঙ্গ করেছেন। সবথেকে অসাধারণ ব্যঙ্গ তিনি করেছেন ২০নং ছড়ায়। এখানে তিনি আধুনিক কবিদের কাব্যের অস্পষ্টতা ও ঘোলাটে ভাবকে ব্যঙ্গ করেছেন এভাবে-

‘মন উড়–উড়– চোখ ঢুলুঢুলু

ম্লান মুখখানি কাঁদুনিক

আলুথালু ভাষা, ভাব এলোমেলো,

ছন্দটা নিরবাঁধুনিক।

পাঠকেরা বলে ‘এতো নয় সোজা

বুঝি কি বুঝিনে যায় না সে বোঝা।’

কবি বলে, ‘তার কারণ, আমার

কবিতার ছাঁদ আধুনিক।’(৪১)

৮৮ নং ছড়ায় তিনি অনুপযুক্ত মানুষের হাতে সাহিত্যেও সৃজনকে ব্যঙ্গ করেছেন। এখানে একজন নিলামে চড়া খাট-টিপাই বাঁচাতে গল্পকে ‘নাট্যি-ভু’ করার ব্যবসা শুরু করে এবং সফলও হয়। তার লেখায় ক্রিটিক মহল ঠাণ্ডা হয়ে যায়। ভোজন ওজনে তার অযোগ্য লেখাকে অনুমোদনও দান করা হয়ে যায়।

মূলত বিভিন্ন অসংগতি ও অব্যবস্থার প্রতিবাদ রূপেই তিনি ব্যাঙ্গাত্মক ছড়াগুলো রচনা করেছিলেন। ব্যঙ্গের সাথে হাস্যরসের মিলন এই ছড়াগুলোকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

রবীন্দ্রনাথ সমকাল বিষয়েও ছিলেন সচেতন। তিনি সমকালীন রাজনীতি, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, মানুষের কর্মকাণ্ড ইত্যাদি নিয়ে ছড়া লিখেছেন। ‘খাপছাড়া’, ‘ছড়া’, ‘চিত্রবিচিত্র’ গ্রন্থের বিভিন্ন ছড়ায় সমকালকে তিনি তুলে আনেন। ‘ছড়া’ গ্রন্থের ৬ নং ছড়ায় তিনি হাস্যরসের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্বের তৎকালীন যুদ্ধের চিত্র তুলে ধরেন।

‘গ্যাঁগোঁ করে রেডিওটা, কে জানে কার জিত-

মেশিনগানে গুঁড়িয়ে দিল সভ্যবিধির ভিত।’(৪২)

আবার ‘চিত্রবিচিত্র’ গ্রন্থের ‘চলন্ত কলিকাতা’ ছড়ায় তিনি কলকাতার তৎকালীন অবস্থার বিবরণ দিয়েছেন। শহরমুখো মানুষের ভীড়, জবিনের কৃত্রিম চাঞ্চল্য, বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্ট ইত্যাদি তিনি তুলে ধরেছেন এই ছড়ায় সাবলীল ভাষায়। তিনি কলকাতার বর্ণনা দিয়েছেন অন্যভাবে-

‘ইঁটের টোপর মাথায় পরা

শহর কলিকাতা

অটল হয়ে বসে আছে

ইঁটের আসন পাতা।’(৪৩)

এভাবে তিনি অন্যরকম ভঙ্গিতে সমকাল ও সমকালীন প্রেক্ষাপটকে তুলে আনেন ছড়ায়।

সকল বয়সের উপযোগী ছড়া :

শিশুরা শিশুদের মত করেই চিন্তা করে এবং তাদের মনের মত করে কথা বললে তারা আনন্ধ পায়। আবার বয়স্কদের ক্ষেত্রে শুধু কথা বলেই আনন্দ দান করা সম্ভব হয় না। তার সাথে কিছু জ্ঞানের খোরাক, বুদ্ধির বীজ রোপন করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অসাধারণ বিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি তাই এমন বিষয় নিয়েও ছড়া রচনা করেছেন যা ছোট বড় সবার জন্যই আনন্দ দায়ক। উভয় বয়সের উপযোগী রচনায় তিনি অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তাঁর ছড়া সাহিত্যে। হাস্য রসাত্মক, উদ্ভট, প্রকৃতি বিষয়ক, ম্মৃতিকথামূলক ছড়াগুলোতে তিনি সকলের জন্য আনন্দের বীজ বপন করে গেছেন।

হাস্য রসাত্মক :

মানুষ খুব সহজেই হাসে কিন্তু তাকে হাসানো খুব সহজ নয়। রবীন্দ্রনাথ মানুষের এই বিষয়টি খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি জানতেন-

‘ছড়া জিনিসটা যাহার পক্ষে সহজ তাহার পক্ষে নিরতিশয় সহজ, কিন্তু যাহার পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন তাহার পক্ষে একেবারেই অসাধ্য। যাহা সর্বাপেক্ষা সহজ তাহা সর্বাপেক্ষা কঠিন, সহজের প্রধান লক্ষণই এই।’(৪৪)

এমন কঠিনতর সহজকে তিনি বশ মানিয়ে সবার উপযুক্ত করে তৈরি করতে চেয়েছেন। রচনা করেছেন হাস্যরসাত্মক বিষয় ও কার্যক্রম নিয়ে ছড়া। ‘খাপছাড়া’ গ্রন্থের বেশিরভাগ ছড়াই হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে তিনি উপস্থাপন করেছেন। এসব ছড়ার বিষয় যেমন হাসির উদ্রেক করে তেমনি মানুষের কার্যক্রম ও সংলাপও পাঠককে হাসির রাজ্যে নিয়ে যায়। ১৬ নং ছড়ায় এক বউ নিয়ে মোটা ফণী ও রোগা পঞ্চিতে ভীষণ ঝগড়া বাঁধে। চেঁচামেচি করে কেবল তারা নৌকার ভাড়াই বাড়াতে থাকে কিন্তু অবশেষে দেখা যায় সেই বউটি তাদের কারোই নয়। ১৮নং ছড়ায় হাস্যরসের উদ্রেক ঘটায় অনুকূল বাবু নামের এক লোক। ঘাসে ভিটামিন আছে বলে তিনি ঘাস খাওয়ার অভ্যাস করতে থাকেন। গৃহিণীর দোহাই সত্ত্বেও তিনি মাঠে চরে ঘাস খান, বাধা দিলে বলেন মানুষের ভালোর জন্যই তিনি কারো কথা শুনবেন না। কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই লোকটা মারা গেল আর বিজ্ঞানে এই শোকটা রয়ে গেল।

আরেক ধরনের হাস্যরস ছড়িয়ে আছে ২২ নং ছড়ায়। যেখানে রাজা ধ্যানে বসলে বিশজন সর্দার চিৎকার করে সবাইকে চুপ থাকতে বলে। নীরবতা আনতে নেওয়া হয় অনেক পদক্ষিপ। সেনাপতির ডাকে, ঢাকঢোলের তীব্র শব্দে পশুপাখি পর্যন্ত লাফঝাঁপ শুরু করে আর রাণীরা পর্দার আড়ালে এই কাণ্ড দেখে মুর্ছা যায়। ধ্যানের বিঘ্ন রোধে এই বিপরীত আয়োজন হাস্যকর ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।

৩১ নং ছড়ায় গুপি পাড়ায় জন্মনেওয়া লোকটি নিন্দা সইতে না পেরে মোগল সরাই জংসনে আত্মহত্যা করতে গেল কিন্তু সেখানে গিয়েই সে মরার কথা বেমালুম ভুলে লেগে গেল কোর্মা কাবাব ধ্বংসের কাজে। নিজে তো সব সাবার করলোই সঙ্গেও গুরুপুত্রকেও তার সাথে অংশ নিতে বলল। এমনই আরেক হাস্যরসের সন্ধান পাওয়া যায় ৩৫ নং ছড়ায়। ঘোষালের বক্তৃতা করা কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ভেবে সে তার আয়োজনে লেগে যায়। বেঞ্চি চৌকি সব তার আছে। মাতৃভূমির ভালোর জন্য সারা পাড়া ঘুরে ঘুরে সে একাই একশোটি টিকিট বিক্রি করলো। সব বুজে ভাবল সব সভ্যই বুঝি চলে এল কিন্তু যখনই সে চোখ খুলল দেখল তার হাতে নিরানব্বইটা টিকটই অবশিষ্ট রয়ে গেছে। এমন দিবাস্বপ্ন এখানে হাস্যরস সৃষ্টি করেছে।

৩৮ নং ছড়ায় দেখা যায় গোপেন্দ্র মুন্তফির হাস্যকর কাণ্ডকারখানা। সন্ধ্যে বেলায় সে চুপ চুপ করে ‘বন্ধুঘরে’ ঢুকে। রাত্রে ফিরে এলে পাগড়িতে দেখা যায় তার জুতো জোড়া আর পায়ে রয়েছে রঙিন টুপি। এই অবস্থাকে সামাল দিতে মাতাল গোপেন্দ্র-

‘এই উপদেশ দিতে এল-

সব করা চাই এলোমেলো,

‘মাথায় পায়ে রাখবোনা ভেদ’

চেঁচিয়ে বলে গুপি।’(৪৫)

৫৩ নং ছড়ায় রাজার বোকামি হাসির খোরাক যোগায়। গব্বু রাজার খাওয়ার পাতে যখন ছাগলের কোরমার সাথে একটা আস্ত তেলাপোকা পাওয়া গেল তখন রাজা খেপে গিয়ে খানসামাকে তলব করলেন। মন্ত্রী তখন রাজাকে বোঝালেন ছাগল ও তেলাপোকা সবই এক প্রাণী। এই কথা শুনে রাজা জীবের প্রেমে একদম থেমে গেলেন, তার ভুল ভেঙে গেল।তার তলোয়ার ঠোকানও হয়ে গেল বন্ধ। ৫৩ নং ছড়ায় ভোলানাথ নামের ছাত্র তিন চারে নব্বই লেখায় গণিতে তার সব নাম্বার কেটে নেওয়া হল। মাস্টার তার ভুল ধরিয়ে দিলে সে যা উত্তর দেয় তাতেই ছড়াটিতে হাস্যরস সঞ্চারিত হয়-

‘তিন চারে বার হয়

মাস্টার তাওে কয়,

‘লিখেছিনু ঢের বেশি’

এই তার গর্বই।’(৪৬)

এভাবে নানা ধরনের ঘটনা ও কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে হাস্যরসাত্মক ছড়ায় সবার মনে আনন্দ সঞ্চার করেন রবীন্দ্রনাথ।

উদ্ভট বিষয় :

অনেক সময় খামখেয়িলর বশেই রবীন্দ্রনাথ আবোল-তাবোল,উদ্ভট ছড়া রচনা করেছেন। এগুলোর সঠিক কোন অর্থ নেই, নেই ঘটনার কোন পারম্পর্য। এলোমেলো ছবি আর অসংলগ্ন ভাবের সমন্বয়ে তিনি উদ্ভট বিষয়কে ছড়ার উপকরণ করেছেন। ‘খাপছাড়া’ গ্রন্থের ১, ৫, ৭, ১৩, ২৭, ২৯, ৪৫, ৫৫, ৬৭, ১০৪ সংযোজন অংশের ২১, ২২ এবং ‘ছড়া’ গ্রন্থের ১১, ১৭ ইত্যাদি ছড়ায় উদ্ভট রসের সাক্ষাত মেলে। ‘খাপছাড়া’র প্রথম ছড়াটিতেই এক উদ্ভট রসের সঞ্চার করেন তিনি। ক্ষান্ত বুড়ির দিদি শ্বাশুড়ির তিন বোনের উদ্ভট কর্মকাণ্ড নিয়ে ছড়াটি রচিত। তারা শাড়িগুলো উনুনে বিছায় আর হাঁড়িগুলো রাখে আলনাতে, নিন্দুকে পাছে দোষ ধরে তাই টাকাকড়িগুলো জানালায় হাওয়া খেতে রেখে দিয়ে নিজেরা সিন্দুকে ঢুকে থাকে। তাদের কাজ এমনি বিচিত্র যে তারা লবণ দিয়ে পান সাজায় আর ডাল রাঁধে চুন দিয়ে। ২৯ নং ছড়ায় কেষ্টা নামের লোকটির হাতির হাঁচি শোনার উদ্ভট শখ হয় বলে সে নেপালের বনে বনে ঘুরে বেড়ায়, জল-কাদায় মাখামাখি হয়ে অবশেষে নিজে হাঁচতে হাঁচতে মারা যায়।

৫৫ নং ছড়াতে একেবারে কাল্পনিক ও উদ্ভট চিন্তা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বহুকোটি বছর পরে হঠাৎ যখন জলচর প্রাণীরা কথা বলার কণ্ঠ পেল তখন কি হাঙ্গামা শুরু হল তাই নিয়ে এই ছড়া। সেখানে ইলিশ যেমন বেহাগ ভাঁজতে শুরু করল তেমনি-

‘শাখগুলো বাজে, বহে

দক্ষিণে হাওয়া যেই;

গান গেয়ে শুশুকেরা

লাগে কুচ-কাওয়াজেই।’(৪৭)

‘ছড়া’ গ্রন্থের ১ নং ছড়াটিতেও উদ্ভট সব কাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। সেখানে আদম দিঘির পাড়ে রামছাগলের ঘাড়ে চড়ে লাল বাঁদর নাচে, সেই ছাগলের ডাক চৌকিদারের নাকে সুড়সুড়ি দেয়, সেই সুড়সুড়ি খেয়ে চৌকিদার এমন হাঁচি দেয় যে তেঁতুল বনে ঝড়ের দমক ওঠে আর গাছ থেকে ইঁচরগুলো খসে পড়ে। হাঁচি শুনে দত্ত বাড়ির ঘাটে জল নিতে এসে বউ কাঁখের কলস ফেলে দেয়। এমনই আরো উদ্ভট উদ্ভট ঘটনায় ছড়াটি ভরা।

৭ নং ছড়াটিও এমন উদ্ভট ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত। এখানে দেখা যায়-

‘গলদাচিংড়ি তিংড়িমিংড়ি

লম্বা দাঁড়ায় করতাল,

পাকরাশিদেও কাঁকড়াডোবায়

মাকড়সাদের হরতাল।’(৪৮)

এছাড়াও এখানে মুল্লুক জুড়ে উল্লুক ডাকে, হেড মাস্টার মুখ ভেংচিয়ে ঠাট্টা করে, গুবরে পোকার মড়ক লাগে, কাকাতুয়া চঞ্চু হানে এমনি আরো অনেক অদ্ভুত কার্যক্রমে হরি হরি বলে রথযাত্রা শেষ হয়।

মূলত নিছক আনন্দ দানে ও এলোমেলো ভাবে মনের কল্পনাকে বিচরণ করাতেই তাঁর হাস্যরসাত্মক ছড়াগুলোর সৃষ্টি।

প্রকৃতি বিষয়ক :

রবীন্দ্রনাথ খুব ছোট বেলা থেকেই প্রকৃতির একেবারে নিবিড় সান্নিধ্য অনুভব করতেন। খোলা আকাশ, পুকুরের ঘাট, মানুষের চলাচল, পাখ-পাখালি, বাতাস, ফুল, আলো, আঁধার তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতো। তিনি সব সময় চাইতেন বদ্ধ ঘর থেকে মুক্ত হয়ে বাইরের খোলা পৃথিবীতে বিচরণ করতে। প্রকৃতি তাকে টানতো বলেই তিনি প্রকৃতিকে একান্ত আপন করে চাইতেন। তিনি ‘জীবনস্মৃতি’তে বলেছিলেন- ‘প্রত্যহ প্রভাতে ঘুম হইতে উঠিবামাত্র আমার কেমন মনে হইত, যেন দিনটাকে একখানি সোনালি পাড় দেওয়া নুতন চিঠির মত পাইলাম।’৪৯ প্রকৃতির প্রতি তাঁর এই মমত্ববোধ ও ভালোবাসার পরিচয় তাঁর প্রকৃতি বিষয়ক ছড়াগুলোতে প্রকাশ পেয়েছে। ‘শিশু’ গ্রন্থের ‘শীত’, ‘শীতের বিদায়’, ‘ফুলের ইতিহাস’, ‘পুরোনো বট’; ‘ছড়ার ছবি’ গ্রন্থের ‘ঝড়’, ‘ঘরের খেয়া’, ‘অজয় নদী, ‘চিত্রবিচিত্র’ গ্রন্থের ‘ঝোড়ো রাত’, ‘শরৎ’, ‘ফাল্গুন’ ইত্যাদি ছড়া প্রকৃতির অপূর্ব বর্ণনা ধারণ করে আছে।

‘শীতের বিদায়’ ছড়াটিতে শীত চলে যাওয়ার বেলায় নতুন রূপে ফুলে ফুলে প্রকৃতি যেভাবে সাজে সে রূপটিকে তিনি তুলে ধরেছেন। বসন্তের আগমনে কোকিল কুহু গানে এসময় সবাইকে পাগল করে, ফুলের গন্ধ হরণ করে প্রাণ, ফুলের রেণু আর পাপড়ি উড়ে বেড়ায় বন পথে। তিনি ফুলের রাজ্যে খুশির হাওয়াকে অপূর্বভাবে বর্ণনা করে বলেন-

        ‘রঙ্গ দেখে হাসে মল্লিকা মালতী,

আশেপাশে হাসে কতই জাতি যূথী,

মুখে বসন দিয়ে হাসে লজ্জাবতী

বনফুল বধূগুলি।’(৫০)

‘পুরোনো বট’ ছড়াটিতে বটের জীবন ও তার হাসি, কান্না, আনন্দের কথা বলেছেন ছড়াকার। প্রকৃতির এমন অনুভূতিশীল বর্ণনা দেওয়া তার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। পুকুর ধারের বটটি শুধু স্তব্ধ পটে আঁকা ছবি হয়েই দাঁড়িয়ে থাকে না তাঁর ছড়ায়। সে প্রাণ পায়, বাতাসের সাথে কোলাকুলি করে গভীর প্রেমে, ঝড়ের সময় লক্ষ কোটি পাতা দুলিয়ে সে গান গায়, হাজার পাখির জীবন কথা বটের স্মৃতিতে আঁকা হয়ে থাকে।

প্রকৃতির অসাধারণ সুন্দর ও মুখরিত রূপের বর্ণনা পাওয়া যায় ‘ফাল্গুন’ ছড়ায় যেখানে ফাল্গুনের মোহময়তায় প্রকৃতি আনন্দে উদ্বেলিত হয়-

‘চঞ্চল মৌমাছি

গুঞ্জরি গায়,

বেণুবনে মর্মরে

দক্ষিণ বায়।’(৫১)

গরল নির্মল প্রকৃতির পাশাপাশি প্রলয়ংকরী ঝড়ের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি ‘ঝড়’ ছড়াটিতে। ঝড় এলে ঢেউগুলো ফুলে ওঠে, আকাশ ছেয়ে যায় মেঘে, ডঙ্কা বাজে, কাকগুলো প্রাণ ভয়ে উড়ে যায় কিন্তু বাতাসের তোড়ে শেষে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে। ভয়াবহ দৃশ্য সৃষ্টি হয়-

‘বিজুলি ধায় দাঁত মেলে তার ডাকিনীটার মতো

দিক্দিগন্ত চমকে ওঠে হঠাৎ মর্মাহত।’(৫২)

শুধু প্রকৃতি নয় ঝড়ে উত্তাল হয় নদী, অস্থির হয়ে ওঠে মাঝিরাও। তারা দ্রুত গতিতে চরের দিকে চলে যায়। ঝড় থামলে আবার নতুন ভাবে জীবন শুরু করে।

প্রকৃতির নির্মল ও নিষ্ঠুর উভয় বর্ণনাই তাঁর প্রকৃতি বিষয়ক ছড়াগুলোর উপকরণ হয়েছে যা ছোটরড় সবার জন্যই উপভোগ্য।

স্মৃতিকথামূলক :

রবীন্দ্রনাথের ছড়া সাহিত্যে কিছু স্মৃতিমধুর ছড়াও পাওয়া যায়। এসব ছড়ায় কখনো তিনি নিজের ছেলেবেলার স্মৃতি মনে করে সেদিনে ফিরে গেছেন কখনো আবার পুরোনো দিনের কথা মনে করে অসাধারণ অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। ‘শিশু’ গ্রন্থের ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’, ‘আকুল আহ্বান’, ‘ছড়ার ছবি’ গ্রন্থের ‘কাঠের সিঙ্গি’, ‘আকাশ’, ‘পিছু ডাকা’; ‘শিশু ভোলানাথ’ গ্রন্থের ‘মনে পরা’ ইত্যাদি ছড়ায় আমরা তার স্মৃতি কথার উল্লেখ পাই। ‘বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর’ ছড়ায় তিনি বৃষ্টির মনোরম বর্ণনা দিতে দিতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। তাঁর বাল্যকালের খেলার কথা মনে পড়ে যায়-

‘মেঘের খেলা দেখে কত

                খেলা পড়ে মনে

কত দিনের লুকোচুরি

                কত ঘরের কোণে।’(৫৩)

তার সাথে মনে পরে ছেলে বেলায় গাওয়া বৃষ্টির গান, মনে পড়ে বুক কাঁপানো মেঘের ডাকে মায়ের উপর তার দৌরাত্ম্য, ঘরের ভেতর দাপাদাপি আর মায়ের স্নেহমাখা মুখ। তাঁর মনে পড়ে সুয়োরাণী, দুয়োরাণীর কথা, অভিমানী কঙ্কাবতীর ব্যাথা যার গল্প শুনে দস্যি ছেলেও একেবারে চুপ হয়ে যেত। ছোটবেলার সে গল্পের শিবঠাকুরের তিন কন্যাকে বিয়ে করার কথা তাঁর মনে হয়। এতদিন পরে তাদের কী অবস্থা হল তাই নিয়ে তিনি ভাবেন।

বৃষ্টি দেখে বৃষ্টির দিনে বাল্যকালের আনন্দময় সময়ের কথা যেমন তার মনে পড়েছে, তেমনি মনে পড়েছে আকাশের দিকে তাকিয়ে তার বেদনার কথাও। ‘আকাশ’ ছড়াটিতে সেই বেদনারই ছাপ ফুটে উঠেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি ভেবেছেন সেইসব দিনের কথা যখন তাঁকে অতৃপ্ত মন নিয়ে ঘরের দেয়ালে আটকা থাকতে হত। তিনি ভাবতেন যে চিলটি একা নিঃসঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে বুঝি তার মনের কথা জানে। ঝড় উঠলে তার মনে হয় ঝড় বুঝি সব আকাশের নীলকে তার চঞ্চুর আঘাতে কেড়ে নেবে। আকাশ আর ঝড় তার মনে অন্যরকম অনুভূতির সঞ্চার করে। মনে হয় তারা তাঁর মনের সব হারানো ছুটির মূর্তি গড়ে তুলেছে। তিনি বোঝেন শান্তি যেমন মুক্তি দেয় তেমন অশান্তিও মুক্তি দিতে পারে।

নিজের কষ্টের গণ্ডীবদ্ধ জীবনের সুখ-দুঃখকে ছড়াকার বিভিন্ন সময়ে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করেছেন। প্রকৃতির চিরচেনা রূপ যখনই তার সামনে এসেছে তিনি স্মৃতিকাতর হয়েছেন। এ বিষয় নিয়ে রচিত তাঁর ছড়াগুলো অসাধারণ মানসিকতারও পরিচায়ক।

রবীন্দ্রনাথ নিজেকে উজার করে দিয়ে ছড়া রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। মনের কালিমা দূর করতে, মনকে শিশুর সরলতায়, আবোল-তাবোল খেয়ালে তিনি ভাসিয়ে দিয়েছেন। আশ্রয় করেছেন বিচিত্র সব বিষয় যা তার ছড়ার বৈচিত্র্য রক্ষা করেছে। তাঁর ছড়া কখনো হয়ে উঠেছে সামাজিক অনাচারের প্রতিচ্ছবি কখনো হয়ে উঠেছে আনন্দ দানের খোরাক। তাই রবীন্দ্রনাথের ছড়া সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ তাঁর ছড়ার বিষয় বৈচিত্র্য। 

তথ্যসূত্র

১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লোকসাহিত্য, কলকাতা, বিশ্বভারতী প্রকাশনা, ১৩৯৯, পৃ. ৬

২। আতোয়ার রহমান, লোকসাহিত্যের কথা, ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৪, পৃ. ৭০

৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিশু, রবীন্দ্র রচনাবলী, নবম খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৪৮

৪। প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪

৫। প্রাগুক্ত, পৃ.১৬

৬। প্রাগুক্ত, পৃ.৬৯

৭। প্রাগুক্ত, পৃ.৭৬

৮। প্রাগুক্ত, পৃ.৯৬

৯। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিশু ভোলানাথ, রবীন্দ্র রচনাবলী, এয়োদশ খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৪৯ ক, পৃ.৭১

১০। প্রাগুক্ত, পৃ.৭২

১১। প্রাগুক্ত, পৃ.৭২

১২। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ও শিশুসাহিত্য, কলকাতা, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, ১৩৭৭, পৃ. ৩৮

১৩। রবীন্দ্রনাথ, প্রাগুক্ত, পৃ.২৫

১৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্র রচনাবলী, সপ্তদশ খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৪৯, পৃ ২৪৬

১৫। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিশু ভোলানাথ, রবীন্দ্র রচনাবলী, এয়োদশ খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৪৯ক, পৃ.৩৮

১৬। প্রাগুক্ত, পৃ.৪১

১৭। প্রাগুক্ত, পৃ.৩২

১৮। প্রাগুক্ত, পৃ.৯৭

১৯। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্রবিচিত্র, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৭৬, পৃ. ২৩

২০। মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন কাসিমপুরী, লোকসাহিত্যে ছড়া, ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ১৯৬২, পৃ. ৬

২১। আশুতোষ ভট্টাচার্য, রবীন্দ্রনাথ ও লোকসাহিত্য, কলকাতা, এ মুখার্জী এ- কোম্পানি প্রা. লি., ১৯৭৩, পৃ.৪৪

২২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিশু, রবীন্দ্র রচনাবলী, নবম খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৪৮,পৃ.৬২

২৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিশু ভোলানাথ, রবীন্দ্র রচনাবলী, এয়োদশ খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৪৯ক, পৃ.৮৭

২৪।সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, ‘ছড়ার ছবি : রবীন্দ্র-স্মৃতিকথার পদ্য’, সাহিত্য পত্রিকা, (সম্পাদনা : সিদ্দিকা মাহমুদা), বর্ষ ৪৯ // সংখ্যা : ৩, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১২, পৃ.৪৪

২৫। সুকুমার সেন, লোকসাহিত্য, ২য় খণ্ড, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৬৩, পৃ.৩০৬

২৬। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খাপছাড়া, রবীন্দ্র রচনাবলী, একবিংশ খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৯৪ক, পৃ. ১৫

২৭। প্রাগুক্ত, পৃ.২৫

২৮। প্রাগুক্ত, পৃ.২৭

২৯। প্রাগুক্ত, পৃ.৪২

৩০। প্রাগুক্ত, পৃ.৩১

৩১। প্রাগুক্ত, পৃ.৪৫

৩২। প্রাগুক্ত, পৃ.৩৯

৩৩। প্রাগুক্ত, পৃ.৬১

৩৪। প্রাগুক্ত, পৃ.৪৯

৩৫। প্রাগুক্ত, পৃ.৫৫

৩৬। প্রাগুক্ত, পৃ.২৪

৩৭। ছড়ার ছবি, রবীন্দ্র রচনাবলী, একবিংশ খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৯৪খ, পৃ.৭৪

৩৮। প্রাগুক্ত, পৃ.৮

৩৯। নির্মলেন্দু ভৌমিক, বাংলা ছড়ার ভূমিকা, প্রথম খণ্ড, কলকাতা, সাহিত্য শ্রী, ১৩৮৬, পৃ.৬১

৪০। বুদ্ধদেব বসু, বাংলা শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ সংকলন, পরিমার্জিত দ্বেজ সংস্করণ, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং,

 ১৯৮২, পৃ.১৪৭

৪১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খাপছাড়া, রবীন্দ্র রচনাবলী, একবিংশ খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৯৪ক, পৃ.১৮

৪২। ছড়া, রবীন্দ্র রচনাবলী, ষড়বিংশ খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৯৩, পৃ.২২

৪৩। চিত্রবিচিত্র, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৭৬, পৃ.৬৯

৪৪। ‘নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি’, রবীন্দ্র রচনাবলী, অচলিত সংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড, কলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৪৮, পৃ.৮

৪৫। খাপছাড়া, রবীন্দ্র রচনাবলী, একবিংশ খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৯৪ক, পৃ.২৬

৪৬। প্রাগুক্ত, পৃ.৩৮

৪৭। প্রাগুক্ত, পৃ.৩৪

৪৮। ছড়া, রবীন্দ্র রচনাবলী, ষড়বিংশ খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৯৩, পৃ.২৪

৪৯। শিশু ভোলানাথ, রবীন্দ্র রচনাবলী, এয়োদশ খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৪৯ক, পৃ.২৩৮

৫০। ‘নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি’, রবীন্দ্র রচনাবলী, অচলিত সংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড, কলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৪৮, পৃ.৮৬

৫১। চিত্রবিচিত্র, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৭৬, পৃ.৪৩

৫২। ছড়ার ছবি, রবীন্দ্র রচনাবলী, একবিংশ খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৯৪খ, পৃ.৬৯

৫৩। শিশু, রবীন্দ্র রচনাবলী, নবম খণ্ড, কোলকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৪৮, পৃ.৫৯

(নাজিয়া ফেরদৌস, প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)

আপনার মতামত লিখুন :

One response to “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছড়া সাহিত্যের বিষয়”

  1. জুয়েল মিয়া says:

    এক কথায় অসাধারণ 😍

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *