৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, রবিবার, সন্ধ্যা ৬:৩৭
বাংলা ছোটগল্পে ডাইনি চরিত্র
বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

মিল্টন বিশ্বাস

(সংক্ষিপ্তসার : ডাইনি বা ডাইনিবিদ্যা কোনো পেশা নয় তা লোকসংস্কারের বিচারে নারীর অলৌকিক ক্ষমতা ও অশুভ স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। অথচ সেই বাস্তব নারী মানবিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন। তাহলে ডাইনি নামের যৌক্তিকতা কি? ভারতবর্ষের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসে ডাইনিবিদ্যা চর্চার সম্যক পরিচয় পাওয়া গেলেও লোকমানসসম্ভূত সেই ধারণা-বিশ্বাসজাত শুভ-অশুভ ডাইনির অস্তিত্ব আজ অবলুপ্ত। বরং কুসংস্কারজাত মন্দ ডাইনি-বিশ্বাস লোকজীবনে এখনো বিদ্যমান। বাংলা ছোটগল্পে ডাইনি চরিত্রের স্বরূপ অন্বেষণ করতে গিয়ে ডাইনিবিদ্যার নৃতাত্ত্বিক কিংবা সমাজতাত্ত্বিক পরিচয়ের পরিবর্তে লোকসংস্কারকে কেন্দ্র করে রচিত ‘ডাইনি’ শিরোনামে গল্পগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গল্পকাররা লোকবিশ্বাস ও সংস্কারে চিহ্নিত ডাইনি চরিত্র রূপায়ণে মানুষের মানবিক প্রবৃত্তিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। লোক-প্রচারিত নারীর ডাইনিসত্তাকে আবৃত করে দিয়েছে তার মাতৃস্নেহ মমত্ববোধ আর সন্তানবাৎসল্যের অবারিত প্রকাশে। প্রকৃতপক্ষে লোকবিশ্বাসের সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক ভিত্তি যাই থাকুক না কেন নারীর ডাইনিসত্তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই- গল্পকারদের প্রত্যেকের অন্তিম ভাষ্য ঠিক তাই। )

ডাইনিবিদ্যা হলো বিভিন্ন ধরনের জাদুকরি বা অতিমানবিক ক্ষমতা নিয়ে চর্চা। এসব জাদুকরি ক্ষমতা নিয়ে যিনি কাজ করেন বা ক্ষমতা দাবি করেন তাকে ডাইনি বলা হয়ে থাকে। ‘ডাক’ হিন্দু দেবতা শিবের অনুচর। ডাক হচ্ছে এক ধরনের পিশাচ। ডাকের স্ত্রী লিঙ্গ ডাকিনী। ডাকিনী থেকেই ‘ডাইনি’ শব্দের উৎপত্তি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ (১ম খণ্ড)-এ ডাইন বা ডাইনি অর্থ নির্ণয়ে কয়েকটি বিষয় লিপিবদ্ধ রয়েছে। জাদুবিদ্যাবলে দৃষ্টিমাত্রে শিশুর অনিষ্টকারিণী স্ত্রীলোকই ‘ডাইনি’। কথিত আছে, এরা মন্ত্রবলে শিশুর রক্ত চুষে শিশুকে শীর্ণ করে। এদের দৃষ্টি শিশুর স্বাস্থ্যভঙ্গ করে।(২০০৮: ৯৯৬) অর্থাৎ উপদ্রবকারিণী নারী হিসেবে ডাইনিকে চিহ্নিত করা হয়েছে।  ভারতকোষ (তৃতীয় খণ্ড)-এ লেখা আছে- ডাকিনী শব্দটি ডাক শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। ‘ডাক’ অর্থ মন্ত্রসিদ্ধ গুণী পুরুষ, বিজ্ঞ অভিজ্ঞ ব্যক্তি। ডাক শব্দ এখন অপ্রচলিত তবে ডাকিনী শব্দ (তদ্ভব ‘ডাইনি’) মন্ত্রসিদ্ধ দৃষ্টিবিষ বৃদ্ধা গুণিনীর অর্থে এখনো প্রচলিত। এখন ডাকিনী হয়েছে ডাইনি। এরা শিশুর অরিষ্টকারী। যেমন চৈতন্যচরিতামৃত কাব্যে আছে- ‘ডাকিনী শাকিনী হৈতে শঙ্কা উপজিল চিতে ডরে নাম থুইল নিমাই।’ (ভারতকোষ তারিখবিহীন: ৬৪৩) নিমাই শব্দের অর্থ মাতৃহীন বা নিমের মতো তেতো। এ নাম দেওয়ার কারণ ডাকিনী-শাকিনীর মনে দয়ার উদ্রেক হবে এবং তারা শিশুর প্রাণ নাশ করবে না। এই ছিল বিশ্বাস। অপরদিকে ‘তেতো হওয়ায় অনিষ্টকারীরা শিশুটিকে গ্রাস করা থেকে বিরত থাকবে।’(দেবব্রত ভট্টাচার্য ২০০৮:৪১) মঙ্গলকাব্যেও এ ধরনের প্রসঙ্গ রয়েছে। বিশেষ শক্তিসম্পন্না ডাকিনীরা তাদের উচ্ছৃঙ্খল জীবনের জন্য হিন্দু সমাজে বিশেষ নিন্দনীয় হতো। তবে কোনো কোনো ডাকিনী পরবর্তীকালে মঙ্গলচণ্ডীর সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়। মঙ্গলকাব্যে ‘ডাইনি-ডাকিনী’ উভয় শব্দই আছে। যেমন, ‘তোমার মোহিনী বালা/ শিখিয়া ডাইনী কলা/ নিত্য পূজা ডাকিনী দেবতা।’(আশুতোষ ভট্টাচার্য ২০০৯ : ৩৬০) মূলত এক সম্প্রদায়ের তান্ত্রিক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে ডাকিনী বলা হতো। বৌদ্ধগীতি সাহিত্যে ডাকিনী শব্দ আছে। যেমন সরহপাদের রচনা- ‘ডাকিনীবজ্রগুহ্যগীতি’।(উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ১৪০৮:১৩০) আবার হিন্দু তন্ত্র সাধনায় ডাকিনী শক্তির কথা পাওয়া যায়। (১৪০৮: ৪৩৯) আসলে প্রাচীন শব্দ ডাকিনী তন্ত্রশাস্ত্রে প্রযুক্ত হলেও এটি দ্বারা ইন্দ্রজাল বিদ্যায় পারদর্শিনী এক শ্রেণির নারীকে বোঝানো হতো। পূর্বেই বলা হয়েছে ‘ডাইনি’ শব্দটি ডাকিনী শব্দের অপভ্রংশ। ‘ডাকিনী’ শব্দের উদ্ভব সম্পর্কে শশিভূষণ দাশগুপ্ত লিখেছেন- ‘ডাক’ কথাটি তিব্বতী, অর্থ জ্ঞানী; এর স্ত্রীলিঙ্গ ডাকিনী। ‘আমাদের খনার বচনের ডাকের বচন কথার মূল অর্থ বোধ হয় জ্ঞানীর বচন। ডাকিনী কথার মূল অর্থ বোধ হয় ছিল ‘গুহ্যজ্ঞানসম্পন্না’; আমাদের বাঙলা ‘ডাইনী’ কথার মধ্যে তাহার রেশ আছে; মধ্যযুগের নাথসাহিত্যেও রাজা গোপীচাঁদের মাতা ময়নামতী মহাজ্ঞানসম্পন্না এক-জাতীয় ‘ডাইনী’ ছিলেন। সুতরাং মনে হয়, এই ‘ডাকিনী’ দেবী কোনো নিগূঢ় জ্ঞানসম্পন্না তিব্বতী দেবী হইবেন।(শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত, ১৩৬৭:১৩) ডাকিনীরা নানাবিধ তান্ত্রিক আচার পালন এবং ঐন্দ্রজালিক বিদ্যা-প্রদর্শন করে সাধারণ লোকের মনে শ্রদ্ধা ও বিস্ময় সৃষ্টি করত।

 ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত চেম্বার্সের বিশশতকের অভিধানে ‘উইচ’ শব্দের বুৎপত্তি হলো- অ্যাংলো স্যাক্সন ‘উইটিগা’ বা ‘উইগা’ থেকে ‘উইচ’ বা ডাইনি শব্দটির সৃষ্টি। উইটিগা বা উইটগার অর্থ হচ্ছে ‘উইচডম’; অর্থাৎ ‘প্রজ্ঞা বা জ্ঞান’। (মাসুদুজ্জামান ২০১৩: ৪৪) ‘ডাইনি তারাই যারা প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের অনুসারী।’ (২০১৩:৪৫) এদের অলৌকিক এবং মানববিরোধী অপশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ইউরোপে। ইউরোপে ভাবা হতো, জীবনকে বদলে দেবার নানা কৌশল তাদের আয়ত্তাধীন। ইউরোপে ‘পুরুষতন্ত্রই ডাইনিপ্রথার দ্রষ্টা। পুরুষতন্ত্রের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ‘ডাইনি’ ধারণার প্রচলন ঘটে। সাধারণত পুরুষের প্রাধান্য খর্ব হলে বা খর্ব হওয়ার ভীতি সৃষ্টি হলে পুরুষের তুলনায় মেধাবী, বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও প্রতাপশালী নারীকে ‘ডাইনি’ আখ্যা দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে; পুরুষের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।(২০১৩: ৪১) ডাইনি হিসেবে খ্যাত নারীরা কেউ কেউ ছিল লোকচিকিৎসক; গরিব মানুষের ভরসার স্থল। বিশেষত নারীর রোগ-যন্ত্রণা উপশমে প্রকৃতির কাছ থেকে শেখা প্রতিষেধক বা বন্য গাছগাছালি ব্যবহার করা হতো। কবিরাজি প্রথার প্রচলন তাদের মাধ্যমেই শুরু হয়; কেউ বা জাদুবিদ্যায় পারদর্শী ছিল।

ভারতবর্ষের লোকজীবনে শুভ-অশুভ ধারণা কিংবা অনিষ্টকর চিন্তায় নিজেদের অসহায়বোধ থেকে ডাইনি-ভীতির সৃষ্টি অনেক পুরানো। উপরন্তু এখানে ডাইনিবৃত্তি একটি আদিম সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃত। এই সংস্কৃতিজাত অন্ধবিশ্বাস সমকালেও জীবন্ত। ডাইনিবৃত্তি সম্পর্কীয় ধর্মীয় সংস্কার, আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, টোটেম-ট্যাবু ইত্যাদি পুরুষানুক্রমিকভাবে মৌখিক রীতিতে প্রাণবন্ত বিভিন্ন গোষ্ঠীজীবনে। মনে রাখতে হবে ‘প্রাচীন ভারতের তক্ষশিলা, নালন্দা ও বিক্রমশিলার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় ডাকিনীবিদ্যা অধ্যয়ন ও গবেষণা করা হতো।’ (দেবব্রত ভট্টাচার্য ২০০৮: ১৮৬-১৯১) সে সময় সাধারণ মানুষ জানত যে, ডাইনিবৃত্তির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, আকাশচারণের ক্ষমতা এবং ডাকিনীদের মধ্যেই এর ব্যাপক চর্চা হয়ে থাকে। তারাশঙ্করের ‘ডাইনী’ গল্পে এই প্রাচীন বিশ্বাসের প্রকাশটি লক্ষ করা যায়। আসলে বৌদ্ধযুগে জাদুবিদ্যা, মায়াবিদ্যা ও রহস্যবিদ্যার যথেষ্ট প্রসার হয়েছিল। বিশেষত বৌদ্ধ তান্ত্রিক আচারের মধ্য দিয়েই ডাকিনীচর্চার সূত্রপাত ঘটে। তখন ডাকিনী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়- এরা হঠাৎ হঠাৎ হিংস্র হয়ে ওঠে, কারণে-অকারণে লোকের অনিষ্ট করে, মন্ত্রমুগ্ধ করে মানুষকে ভুল পথে চালিত করে, রূপের পরিবর্তন করে, আকাশপথে বিচরণ করে, নরমাংস ভক্ষণ করে ইত্যাদি।(দেবব্রত ভট্টাচার্য ২০০৮:১৮২) ছোটগল্পে ডাইনি চরিত্র রূপায়ণের ক্ষেত্রে বাঙালি লেখকরা ঠিক এসব বৈশিষ্ট্য বা অনুষঙ্গই ব্যবহার করেছেন। উল্লেখ্য, ভারতবর্ষে বৈদিকযুগে মায়াবিদ্যার চর্চা হয়েছে। হিন্দু তান্ত্রিক যুগের তন্ত্রেও ষড়াধারের মূলাধার চক্রে ডাকিনী দেবীর অধিষ্ঠান লক্ষ করা যায়। আদিম ধর্ম বিশ্বাস থেকে গড়ে ওঠা ডাইনিবৃত্তির চর্চার ঐতিহ্যকে ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মানুষ বহন করে এসেছে। তা লোকজীবনের অঙ্গ, লোকসংস্কৃতির অংশ।

ইউরোপীয় ‘উইচক্রাফট’ ভারতীয় ডাইনিতন্ত্র থেকে আলাদা যদিও ভারতের ডাইনিরা ইউরোপের মতো একসময় শিষ্ট ও দুষ্ট এবং কালো-সাদা হিসেবে দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। কিছু কিছু আদিবাসী এখনো প্রকাশ্যে ডাইনিচর্চা করে। নিয়মমাফিক গোষ্ঠীজীবনকে নিরাপদ করতে এবং রোগ, ব্যাধি, যন্ত্রণা, অশুভ শক্তির আক্রোশ ও কালো ডাইনির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সাদা ডাইনির শরণাপন্ন হয় তারা। ইউরোপের ডাইনিতন্ত্রকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মনোবিজ্ঞানীরা গণমৃগী রোগ বা ‘ম্যাস হিস্টিরিয়া’ বলে আখ্যায়িত করেছেন তাকে। ডাইনিবিদ্যা চর্চায় যারা নিয়োজিত ছিল তারা চিকিৎসক হিসেবে খ্যাত হয়। একসময় ইউরোপে ‘ডাইনি চিকিৎসক’ অভিধা প্রচলিত ছিল। ডাইনিদের ভালো-মন্দ, ইষ্ট-অনিষ্ট ইত্যিাদি যাবতীয় চিন্তা করতে হতো সেই চিকিৎসককে। সেই চিকিৎসক ভেষজবিদ্যা, জাদুবিদ্যা এবং জ্যোতিষবিদ্যায় পারদর্শী হতো। ইউরোপে চৌদ্দ শতক থেকে সতেরো শতক পর্যন্ত এসব গুণবতী নারীকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে বিচারের নামে গণহত্যা করা হয়। প্রায় পাঁচ লাখ নারীকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে মারা হয়। কারণ ‘যে নারীর শরীরে কোনো পুরুষ প্রবেশ করেনি, সে যখন আইবুড়ো হয় তখন পুরুষ তাকে মনে করে ডাইনি, অভিচারিণী।… পুরুষের কাছে পোষ না-মানা, বিদ্রোহী নারীমাত্রেই দানবী বা ডাইনি; কেননা সে পুরুষের সূত্র ও অনুশাসন মেনে নেয়নি।’(হুমায়ুন আজাদ ১৯৯৫: ৪৬)

যে লাখ লাখ নারীকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে মধ্যযুগের ইউরোপে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল সেই নারীরা ছিল নিরপরাধ। তারা কর্মজীবী নারী যারা আর্থনৈতিক কারণেই সমাজের প্রথাগত বিধি অমান্য করতে বাধ্য হয়েছিল। ‘তারা ছিল অবিবাহিত; পুরুষ ও অর্থের অভাবে তারা বিয়ে করতে পারেনি, তারা নিয়েছিল নানা পেশা জীবন ধারণের জন্য।’(হুমায়ুন আজাদ ১৯৯৫: ৪৭) সেই নারীরা সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি অমান্য করেছিল। পুরুষকে পাত্তা দেয়নি। এ কারণে পুরুষের চোখে ডাইনি হয়েছিল। ডাইনিবৃত্তির ইতিহাসে তাদের আচরিত কৃত্য খ্রিস্টধর্মের বিপরীত ছিল। ফলে প্রচলিত ধর্মের সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। পুরোহিতদের দৃষ্টিতে ডাইনিবিদ্যা ছিল নিকৃষ্ট বিদ্যা। ডাইনিরা দুষ্ট আত্মা বা ভূত প্রেতকে জাগিয়ে তোলে। এ ধরনের সংঘাত ভারতে কখনো ঘটেনি। ‘হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে ডাইনিচর্চা সুপ্রাচীনকাল থেকে। প্রচলিত ধর্মের বিরোধিতার কোনো নজির মেলে না ভারতীয় ডাইনিতন্ত্রে।’(দেবব্রত ভট্টাচার্য ২০০৮: ২৯) তবে ভারতবর্ষে আর্য ঋষিদের চোখে নারী হয়েছে সমস্ত অশুভ ও দোষের সমষ্টি। নারীকে দেখেছেন তাঁরা একটি বিশাল অতৃপ্ত যোনিরূপে। নারী হচ্ছে আপাতমস্তক যৌনি যে কাম ছাড়া আর কোনো সুখ বা নীতি মানে না। মহাভারতে বলা হয়েছে নারী জন্মদুশ্চরিত্র। ‘তার কামক্ষুধার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় আর সবকিছু। পঞ্চতন্ত্রে আছে নারীর মুখে মধু, অন্তরে শুধুই বিষ।’(হুমায়ুন আজাদ ১৯৯৫: ৫৩) কিন্তু ইউরোপে যেখানে পুরুষের অধিকারের বাইরের নারীকে মনে করা হয়েছিল ডাইনি, রক্তপায়ী ভ্যাম্পায়ার সেখানে ভারতবর্ষে ডাইনিবৃত্তিচর্চা ছিল আলাদা রকমের। মানব ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায় ইউরোপের ডাইনি নিধনযজ্ঞ। অবাস্তব মনগড়া অভিযোগের ভিত্তিতে অসংখ্য নারীকে পুড়িয়ে পিটিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় ডাইনি নাম দিয়ে। সে সম্পর্কে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক বিশ্লেষণ করা হলেও ঠিক নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবর্ষের ডাইনিবিদ্যা বিচার্য নয়। 

ভারতীয় সমাজের কোনো কোনো আদিবাসী জীবনে এক ধরনের ওঝার সন্ধান পাওয়া যায়। তবে নারী লোকচিকিৎসকের চরিত্র বাংলা ছোটগল্পে অনুপস্থিত। এদেশের লোকাচার বিদ্যা হিসেবে ডাইনিবিদ্যাকে গ্রহণ করা হয়েছে। অতিপ্রাকৃতে চিন্তা, ইষ্ট-অনিষ্ট ভাবনা এসবই মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। গোষ্ঠীজীবনের কল্যাণকামনা, রোগ-নিরাময় এবং অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষার ডাইনিদের মন্ত্রশক্তি কাজে লাগান হতো। ভারতের প্রাচীনবিদ্যার একটি হলো ‘ইন্দ্রজাল’ বা ‘জাদুবিদ্যা’। জাদু, তন্ত্র, মন্ত্র প্রচলন প্রাচীন কাল থেকে। ডাইনি বিশ্বাসের সঙ্গে এই বিদ্যাগুলোর যোগাযোগ নিবিড়। বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ফসল ফলানোর কাজে এগিয়ে আসে সাদা ডাইনি; সৎ কাজ করে। কালো ডাইনির বিষ নজর থেকে মানুষকে রক্ষা ও নানান ব্যাধি নিরাময় করে; ভূতের ভয় থেকে রক্ষা করে। ডাইনিদের এরকম কিছু ক্রিয়াকলাপ ছিল কল্যাণমুখী। গোষ্ঠীজীবনের সর্বাঙ্গীণ কুশল ও কল্যাণকামনাই ছিল তাদের জাদুমন্ত্র উচ্চারণের চরম ও পরম লক্ষ্য।  

দেবব্রত ভট্টাচার্য তাঁর ‘ভারতীয় লোকজীবন ও সাহিত্যে ডাইনিবৃত্তির প্রভাব ও প্রসার’ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায় ‘ডাইনি ও ডাইনি শব্দ’ সম্পর্কে লিখেছেন- ‘ভারতের এমন কোন গ্রাম-গঞ্জ নেই, যেখানে ডাইন, ডাইনি, চুরেল নেই। আর তারা যেখানকারই হোক না কেন, তারা সব একইরকমের হিংস্র, দুষ্ট, অনিষ্টকারিণী। অকারণে মানুষের অনিষ্ট করা ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নেই। এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে গিয়ে তারা বিষ ছড়িয়ে মহামারীর সৃষ্টি করে। গবাদি পশুদের মধ্যে মড়ক লাগায়। গোরুর দুধে রক্ত এসে যায় ডাইনির চোখ লেগে। এমনকি মায়ের বুকের দুধ শুকিয়ে যায় ডাইনির বিষ নজরে। বিষধর সাপের চাইতেও সে আরও ভয়ঙ্কর বলে ডাইনির নাম হয়েছে কালসাপিনী। তাই এই ডাইনির চেহারা কুৎসিত, কদাকার, ভীতিপ্রদ হতে বাধ্য। এ ধারণা বা বিশ্বাস আমাদের দেশের মানুষের যে মজ্জাগত, তা বলাই বাহুল্য।’(২০০৮:৩৫)

বাংলা ছোটগল্পে ঠিক এই ধারণাগুলো ব্যবহার করে ডাইনি চরিত্র সৃজন করেছেন গল্পকাররা। অথচ আমরা জানি খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজারা ডাইনি বিদ্যাচর্চাকারীদের আপনজনের মতো কাছে টানতেন। দুষ্ট বা অশুভ প্রতিহতের জন্য ডাইনিবিদ্যাবিদকে দরকার হতো। আর লোকজীবনে মায়াবিদ্যা বা জাদুবিদ্যার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। প্রাচীন ভারতে প্রথমদিকে পুরুষের হাত দিয়ে ডাইনিবিদ্যাচর্চার আরম্ভ হলেও পরবর্তীকালে নারীরা এই বৃত্তিচর্চায় অনেক বেশি পারদর্শিনী হয়ে ওঠে। এক সময় এই নারীরা সাধারণের চোখে মায়াবী, ইন্দ্রজালিক, কুহকী, বাজিকরে পরিণত হয়। এই ডাইনি বিদ্যাচর্চায় সিদ্ধা নারীরা ছলাকলায় গ্রামের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। তেমনি আদিবাসী সমাজে ডাইনিবৃত্তি সম্পর্কে নানা ধরনের গুপ্ত ক্রিয়াকর্মের প্রতি আসক্তি জাগিয়েছিল। ফলে গ্রামীণ মানুষের কাছে এক ধরনের ডাইনি ভীতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেকড়বাকড়, তাবিজে আস্থাশীল লোকমানসে নানা বিধিবিধান গড়ে ওঠে। কোলের শিশুকে ডাইনির নজর থেকে রক্ষা করার জন্য অনেক রকম নজর কাঠির আবিষ্কার করে মায়েরা। ডাইনির নজর দেওয়ার বিষয়টি বাংলা ছোটগল্পে লক্ষ করা যায়। আদিবাসীদের ধারণা ‘ডাইনি হল এমনই এক নারী, যাকে নাকি বিষ নজর দিয়েই প্রকৃতি এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছে।’(দেবব্রত ভট্টাচার্য ২০০৮: ১২৭) অনেক আদিবাসী সমাজে মনে করা হয় নারী সকল অনিষ্টের মূল। নারীর মধ্যেই উপ্ত রয়েছে ধ্বংসের বীজ। নারীই প্রথম আয়ত্ত করেছে অনিষ্টকর জাদুমন্ত্র ও সে সবের প্রয়োগ পদ্ধতি। আর নারীরাই তার মোহিনী শক্তির বলে যে কোনো দেবতাকে তুষ্ট করতে পারে, খুব সহজেই অতিপ্রাকৃত বা অতিলৌকিক ক্ষমতার অধিকারিণী হয়ে যেতে পারে পুরুষের অলক্ষ্যে। নারীকে যখন ডাইনি ভাবা হয় তখন এই ক্ষমতাগুলোর কথাই চিন্তা করে লোকসমাজ। এছাড়া মোহিনী শক্তির বলে যে কোনো ব্যক্তিকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখতে পারে তারা। ইচ্ছে মতো রূপের পরিবর্তন ঘটিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। মায়া বা জাদুর প্রভাবে মায়াজালের সৃষ্টি করে, মানুষকে বিপথগামী করার জন্য। ছলনা ও কপটতাই হল ডাইনির দুটি কালো হাতের মারণ অস্ত্র। ডাইনিকে অনেকেই পিশাচী আখ্যা দিয়েছে। কারণ মানুষের মাংসখাকী তারা। আসলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিতে ডাইনি একইসঙ্গে মানুষ আবার দেবী, পেত্নী, গন্ধর্ব তুকতাক, জাদুমন্ত্র বা অনিষ্টকারিণী। 

শ্রীশ্রীহর্ষ মল্লিক লিখেছেন, ডাইনি আছে কি নেই এ নিয়ে কখনও বিবাদ হয় না, তবে ডাইনি চরিত্রের উদ্ভব যে সমাজিক কাঠামো থেকেই সে সম্বন্ধে সকলেই একমত।(২০০৪: ২১১) এই সমাজ কাঠামো গ্রামীণ কিংবা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর; যেখানে ডাইনি সম্পর্কে অন্ধবিশ্বাস প্রচলিত। আসলে বাংলাদেশের সমাজে বহুকাল ধরে ডাইনি সম্পর্কে প্রচলিত লোকবিশ্বাস ও সংস্কার বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষের কাছে ডাইনিদের জীবন ও আচরণ রহস্যময় এবং ভীতিকর। ছোটগল্পে ঠিক সেভাবেই তাদের চিত্রণ রয়েছে। সমাজপরিত্যক্ত, পরিবারবিচ্ছিন্ন বা অন্ত্যজ এক শ্রেণির নারীকেই বাস্তব সমাজে ডাইনিতুল্য ব্যক্তিরূপে গণ্য করা হয়। সামাজিক গঠনের জন্য বা মানুষের নির্মমতার কারণেই তাদের এ জাতীয় জীবন তৈরি হতে বাধ্য হয়। ‘আমরা জানি সংস্কারাচ্ছন্ন লোকমানসই ডাইনি-অস্তিত্বের জন্মদাতা। যে লোকসমাজ রূপকথার ডাইনিকে জন্ম দিয়েছে, কালক্রমে ওই লোকসমাজই স্বসমাজের মানুষের মধ্যেই ডাইনির অস্তিত্ব আবিষ্কার করেছে। আর পুরুষশাসিত সমাজে লৈঙ্গিক বিভাজনের শিকার নারীরাই ওইসব লোকসম্ভূত অপশক্তির সহজলভ্য আধার হয়েছে। না হলে মানুষ কি কখনো ডাইনি হয়? যে নারীকে কন্যা-জায়া-জননীরও অধিক মানুষ বলে স্বীকার করি, তাঁকে ডাইনি অভিধায় একঘরে করে রাখার মধ্যে যে মধ্যযুগীয় মানসিকতা নিহিত, তারও তো রয়েছে এক সমাজবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। আমাদের কথাশিল্পীদের মধ্যে লোকমানসসম্ভূত এইসব ডাইনি সম্পর্কে তির্যক পর্যবেক্ষণ ও সহানুভূতি লালন করেছেন অনেকেই।’(ভীষ্মদেব চৌধুরী ২০১৩: ১৩১) তবে কথাশিল্পীরা ডাইনি চরিত্র রূপায়ণে তাদের স্বভাবের কুটিলতা বা নেতিবাচক দিকগুলি লোকসমাজের দৃষ্টিতে চিত্রিত করেছেন। লোকসমাজে তাকে বঞ্চিত, প্রত্যাখ্যাত, অবহেলিত এক দুর্দশাগ্রস্ত নারীরূপেই দেখা যায়Ñ যারা সমাজের বিশেষত পরিবারের অমঙ্গল কামনা করে। তারা নানা অলৌকিক শক্তিতে বলীয়ান হয়। পরলোকগত অধিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে প্রভৃতি। তাদের সাহায্যে আবার অনেকে শত্রু নিধন, বশীকরণ প্রভৃতি কাজে উপকৃত বা সফল হয়েছে।

ভারতের অনেক প্রদেশে এখনো দরিদ্র, অসহায় নারীকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। পশুর মতো আচরণ করা হয় তাদের সঙ্গে। নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, অসহায় নারীরা বিপদের মুহূর্তে থানা-পুলিশের সহায়তা পায় না। মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য তাদের পক্ষে কেউ দাঁড়ায় না। নিচুস্তরের এসব নারী কেবল কুসংস্কারের কাছে নিজেদের উৎসর্গ করে আসছে অনেকদিন থেকে। পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, উত্তর অন্ধ্রপ্রদেশ আর পশ্চিম উড়িষ্যা, বিহার প্রভৃতি রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভেতর গত ৫০ বছরে ২৫০০ নারীকে ডাইনি অভিযোগে হত্যা করা হয়েছে। ছত্তিশগড়ে গরিব, নিম্নবর্ণের নারীরা এর সহজ শিকার। কেবল ২০০৪-২০০৯ সালের মধ্যে ১৩৭ জন নারীকে ডাইনি হিসেবে চিহ্নিতকরণের পর হত্যা করা হয়েছে ভারতের বিভিন্ন গ্রামে। ১৮৪৪ সালে প্রকাশিত উইলিয়াম হেনরী স্লি­ম্যান (১৭৮৯-১৮৫৬) লিখিত ‘জধসনষবং ধহফ ৎবপড়ষষবপঃরড়হং ড়ভ ধহ ওহফরধহ ড়ভভরপরধষ’ বইতে পাওয়া যায় ভারতীয়দের ডাইনি বিশ্বাসের গল্প। গ্রন্থের মোট ৭৭টি অধ্যায়ের মধ্যে একাদশ অধ্যায়ের লেখক নামকরণ করেছেন  ডরঃপযপৎধভঃ। এখানে নানান ঘটনার দৃষ্টান্ত দিয়ে ভারতীয় সমাজের লোকবিশ্বাসের কথা তুলে ধরা হয়েছে। বুড়ির কাছ থেকে দুধ কিংবা মোরগ নিয়ে সৈনিকরা দাম পরিশোধ না করায় পেটের ব্যথায় যন্ত্রণাকাতর হয়েছে কিংবা মারা গেছে। স্লিম্যান লিখেছেন- জব্বলপুর শহরে বিশ হাজার লোকের বাস, আর প্রত্যেকে বিশ্বাস করে পেটের ভিতরের মুরগীর গল্প। তাঁর মতে, ভারতীয়দের বিশ্বাস মানুষের কলজেটা খায় ডাইনির সঙ্গের বদ-আত্মা। মাঝে মাঝে এরা অল্পবয়সী বাচ্চাদের কবর খুঁড়ে বের করে আনে, আবার বাঁচিয়ে তোলে আর বদ-আত্মাদের তাদের কলজে খাওয়ায়। প্রত্যন্ত গ্রামের বাচ্চাদের একধরনের যকৃতের অসুখ হয় যেখানে তারা মরলে বাইরে কোন চিহ্ন থাকে না। এই মৃত্যুগুলিকে ডাইনির আছর ধরে নেয়া হয়, আর একটু ছিটওয়ালা বুড়ি যাদের বিড়বিড় করা স্বভাব তাদের দোষী করা হয়। যারা ভেষজ ওষুধ তৈরি করে এদেরও জাদুকর ডাকা হয়, কারণ যখন গ্রামবাসী দেখে পৌনে তিনদিন ঝাড়ফুঁক আর তন্ত্রমন্ত্র করে যার চোখ খোলা যাচ্ছে না তাকে এরা একঢোক ‘আরক’ খাইয়ে তাজা করে তোলে তখন ধরে নেয়া হয় নিশ্চয় ব্যাটা শয়তানের পেয়াদা, তার হাতেই জন্মমৃত্যু। অনেক এলাকার লোকেরা বিশ্বাস করে কোনো কোনো গ্রামের প্রত্যেক বুড়ি বাণ মারতে জানে। প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে একটা দু’টা ডাইনি থাকে না। ডাইনি ছাড়া গ্রামে লোকে মেয়ে বিয়েই দিত না, ওই নারীর গর্ভে নাতিনাতনি হলে তাদের অন্য গ্রামের ডাইনি থেকে কে বাঁচাবে? এক অদ্ভুত ভয়ে ভরা দেশ ভারত। ‘এমনই শক্ত ছিল মানুষের ডাইনির ভয়। ডাইনি অপবাদে এককালে মেয়েদের পুড়িয়ে মারতো। ব্রুনো নামের বিজ্ঞানীকে পুড়িয়ে মারায় একটা কথা বুঝেছিলাম, সমাজের ধর্মের চোখে যেই হুমকিস্বরূপ তাকেই পুড়িয়ে মারাটা সহজ। মেয়ে হলে ডাইনি নাম দেয়াও সহজ। বান্দরবানে এরকম ডাইনি আছে শুনেছি। তান্ত্রিক বলা হয় ‍ওদের।’ (ডরষষরধস ঐবহৎু ঝষববসধহ, ১৮৪৪: ১৪৪-১৫১) সারা বিশ্বের অনেক সংস্কৃতিতেই ডাইনি-শিকার হয়ে আসছে প্রাচীন ও আধুনিককাল জুড়ে। মানুষ কুসংস্কারে আক্রান্ত হয়ে ডাইনিভীতিতে ডাইনিদের বা যারা ডাকিনীবিদ্যা চর্চা করে তাদের হত্যা করে আসছে অথবা বর্জন করেছে। ডাইনি-শিকার এখনও আধুনিক সমাজে চলছে যেখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ ডাকিনীবিদ্যা ও গুপ্তবিদ্যা সমর্থন করে না। ডাইনি-শিকার বলতে এটাও বোঝায় যে আতঙ্কজনিত কারণে আসল ডাইনি বাদে অন্য সন্দেহজনক ভুল মানুষকে খোঁজা।

২.

বাঙালি সমাজ বিচিত্র কুসংস্কার ও লোকবিশ্বাসের জালে আবদ্ধ। এসবের সঙ্গে আছে অপসিদ্ধান্ত ও ভুল ধারণা। এখানে মানুষের জীবন অতিবাহিত হয় সংস্কারের মধ্য দিয়ে। ফলে শোধন করার সুযোগ ঘটে না। ডাইনি ধারণা ঠিক সে রকম সংস্কার-বিশ্বাস। আমাদের সমাজে ধর্মীয় কারণে কুসংস্কার প্রাধান্য বিস্তার করেছে। অন্ধবিশ্বাস মানুষকে অমানবিক করে তুলেছে। এজন্য অসুখ-দারিদ্র্য-অনাহারকে আয়ত্ত করতে না পারায়, আকস্মিক বিপর্যয় ও মৃত্যুর কারণ হিসেবে গ্রামীণ সমাজে একজন রক্তমাংসের মানুষকে চিহ্নিত করা হয় ডাইনি হিসেবে। কখনও কখনও এর পিছনে ব্যক্তিস্বার্থ বা উদ্দেশ্য যে থাকে না তা নয়। কিন্তু মূল কারণ ওই বাস্তব। নারীকে ডাইনি বলা হয় তা এই অন্ধসংস্কার থেকেই। জাতিবর্ণ ও শ্রেণিগত দিক থেকে ডাইনি আখ্যা পাওয়া অধিকাংশ নারী নিম্নবর্গীয়। ধর্ম সংলগ্ন কুসংস্কারের ও সামাজিক বৈষম্যের কারণে যে রাজনীতি গড়ে ওঠে তা ডাইনিবিদ্যার মতই কুসংস্কারগ্রস্ত। দারিদ্র্য অনাহার পরাধীনতা এই নারীকে বদ্ধ কুসংস্কারের যাতাকলে পিষ্ঠ করে। অর্থাৎ বিজ্ঞানপ্রযুক্তির পরাকাষ্ঠার যুগেও ডাইনি বিশ্বাস বিলুপ্ত হয়নি; চেতনাকে শাণিত করা যায়নি দেবতা-অপদেবতার জায়গায় প্রযুক্তিকে বসানো সত্ত্বেও। এজন্যই কুসংস্কারের জটিল রূপ উন্মোচিত হয় ডাইনি ধারণায়।

জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘ডাইনী’ নামে একটি গল্পের কথা উল্লেখ করেছেন অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর কালের পুত্তলিকা গ্রন্থে।(২০১০: ১৬৯) কিন্তু গল্পটি কোনো সংকলনে না পাওয়া যাওয়ায় এ প্রবন্ধে সেটির আলোচনা সংযুক্ত করা গেল না। উল্লেখ্য, জ্যোতির্ময়ী দেবীর অধিকাংশ গল্পে নির্যাতিত নারীর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা হয়েছে। উক্ত গল্পটি তাঁর অভিজ্ঞতা ও সহানুভূতির চিত্রণ বলেই মনে হয়। অবশ্য রাজস্থানের সাধারণ নারীর কাহিনি সেখানে ব্যক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়। পাঠকের কাছে গল্পের বিষয়বস্তুতে অভিব্যক্ত অচেনা নারীর মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি সত্যরূপে প্রতিভাত। অন্যদিকে প্রমথনাথ বিশীর ‘ডাকিনী’ নামক গল্পে জমিদার বাড়ির বধূ মল্লিকাকে ডাইনি আখ্যা দেওয়ায় সে আত্মহত্যা করেছে। সুবোধ ঘোষ তাঁর ‘ডাইন সংস্কৃতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে ডাইন নির্যাতনের বিবরণ লিখেছেন। তাঁর মতে, হতভাগ্য ডাইন সমাজ বহির্ভূত, অপশক্তির আধার, সর্বনাশের বাহন। মানুষ তাকে ভয় পায় আর বাগে পেলে হত্যা করে।(দেবব্রত ভট্টাচার্য ২০০৮:১৭৫-৭৬) আশাপূর্ণা দেবীর শিশুতোষ রচনায় ডাইনিবুড়ির কথা আছে। পরশুরামের ‘ভূশণ্ডীর মাঠ’ গল্পে ডাকিনীর প্রসঙ্গ আছে। ছ’টি গল্প নিয়ে একটি সুখপাঠ্য কিশোর গল্প সংকলনে দীপঙ্কর চৌধুরীর ‘ডাইনি’ গল্পটি অন্তর্ভুক্ত। (২০১১: ২৫) পশ্চিমদেশে াধসঢ়রৎব-এর রক্ত খাবার পিপাসা ও প্রচেষ্টা নিয়ে অনেক গল্প, অনেক চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। ভয়-পিপাসু পাঠক ও দর্শকদের তা আজও আনন্দ দিয়ে থাকে। মূলত ডাইনিদের পায়ের পাতা উল্টোদিকে থাকে বা জ্বালানি কাঠের বদলে তারা তাদের পা ঢুকিয়ে দেয় উনুনে বা কাজের লোকের ছদ্মবেশে গৃহস্থবাড়িতে ঢুকে জিজ্ঞেস করে ‘বাড়িতে বাচ্চা বা বেড়াল আছে’ কিনা, এসব রূপকথার দৃশ্যাবলি অঙ্কন করেছেন গল্পকার। একইভাবে জার্মানির গ্রিম ব্রাদারদের (Grimm brothers, Jacob and Wilhelm: Grimm’s Fairy Tales) রূপকথায় ডাইনি বুড়ি আছে যে ছোট বাচ্চাদের ধরে রান্না করে খেত।    

তবে ‘বাংলা ছোটগল্পে ডাইনি চরিত্র’ বিশ্লেষণে প্রধানত ছয়টি গল্পকে গ্রহণ করা হয়েছে- জগদীশ গুপ্তের ‘হাড়’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডাইনী’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাইনি বিষয়ক তিনটি গল্প এবং মহাশ্বেতা দেবীর ‘ডাইনি’। এসব গল্পে লোকবিশ্বাসে নিহিত কুসংস্কারের চাপে নারীদের জীবনে মানবিক ¯েœহ-প্রীতি কামনা-বাসনা উপেক্ষিত হয়েছে। মানুষের নিরন্তর অভিযোগে অভিযুক্ত কেউ কেউ নিজেকে ডাইনি বলে বিশ্বাস করেছে। দরিদ্র নারীর ক্ষুধা নিবৃত্তির আশায় তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিকে সমাজ ‘ডাইনির দৃষ্টি’ আখ্যা দিয়েছে। গল্পে দরিদ্র নারীর জীবন উপস্থাপনে সামাজিক বৈষম্যের প্রকাশ রয়েছে। অর্থাৎ নিম্নবর্গ বলেই সমাজের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের শিকার হয়ে অত্যাচারিত হয়েছে ডাইনি হিসেবে আখ্যায়িত নারীরা।

জগদীশ গুপ্তের(১৮৮৬-১৯৫৭) ‘হাড়’ গল্পে ডাইনির প্রসঙ্গ আছে। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস ইঙ্গিতে সুস্পষ্ট এখানে। রক্ষার স্বামী সনাতনের করুণ পরিণতি দেখানো হয়েছে এ গল্পে। কিন্তু এ গল্পে রক্ষার মাসি রসিকে ডাইনি আখ্যা দেওয়া হয়েছে লোকপ্রচলিত অন্ধসংস্কারের কারণে। রক্ষা রসি মাসিকে তার ছেলে মথুরের লালন-পালনের দায়িত্ব দিতে চেয়েছিল। সেই মাসিকেই সনাতন বলেছে ‘মাগি ডাইনি’। ‘ডাইনি শব্দটিও গাল, উপরন্তু নারীর মাতৃহৃদয়কে অপমান।’(জগদীশ গুপ্তর গল্প ১৯৭৭: ১৪০) লোকবিশ্বাস মতে রসি মন্ত্রতন্ত্র জানে। সে একটি শিকড়ের ছোঁয়া দিয়ে যে কোনো মানুষকে যে কোনো জন্তুতে পরিণত করতে পারে, ইচ্ছা করলেই সাড়ে তিন হাত লম্বা রসি হাত বাড়িয়ে তাল গাছের মাথা ছুঁতে পারে, কবর খুঁড়ে মড়ার মাংস সে চিবিয়ে খায়; অসংখ্য মড়ার মাথা তার ঘরের মেঝেতে পোঁতা আছে ইত্যাদি। দাশুর পুত্রবধূ মানীর গর্ভ নষ্ট হয় ভূত-আতঙ্কে। মূর্ছার ঘটনার পূর্বদিন রসি তাকে গর্ভ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল বলেই অপবাদ রটে- ‘রসিই খেয়েছে ওর ঐ পেটের ছেলেটাকে।’(১৯৭৭: ১৪২) রসিকে কেউ মা বলে ডাকেনি; কেউ ডাকবেও না। তবু একটি কচি প্রাণ নিঃশেষ করেছে সে। গর্ভের সন্তান যে বের করে খায় সেই রাক্ষসী চেয়েছে সনাতনের সন্তানকে। সনাতন- রসি ‘আঁটকুড়ি, ডাইনি’(১৯৭৭: ১৪২) কিংবা পূর্বে উল্লিখিত ‘মাগি ডাইনি’- এসব বলে নারীত্ব ও মাতৃহৃদয়কে অপমান করেছে। কেবল সনাতনের কথা নয় সারা গ্রামে রটনা হয় রসি ডাইনি, মন্ত্রতন্ত্র জানে। এই ডাইনির ভয় আর সনাতনের রসিকে অপমান করার ঘটনায় গ্রামের লোক তটস্থ থাকে। অন্ধসংস্কারে তারা ভাবে রসির এই অপমানে হয়ত সারা গ্রামে নেমে আসবে চরম অশুভ শক্তির ছায়া। এই অপবিশ্বাস থেকেই মানীর ওপর মিথ্যা-কল্পনায় ভূতের ভর এবং গর্ভস্থ সন্তান নষ্ট হওয়ার যাবতীয় দায় গ্রামের লোকজন চাপায় রসির ওপর। রসি কিন্তু নারী হিসেবে এবং রক্ষার শেষ অনুরোধ পালন করতে মাতৃত্বের দায়েই একান্ত উৎসুক। এই ঘটনায় সনাতন গ্রামের অন্যদের মতো রসিকে অভিযুক্ত করেছে। গর্ভের সন্তান নষ্ট করে সে আবার তার ছেলেকে চায়। এভাবে ছোট ছোট ঘটনা-চিত্রে গল্পে রসির ডাইনিত্ব তুলে ধরা হয়েছে। রসি অপমানবোধ ও আত্মসম্মানবোধ থেকে রক্ষা করেছে নিজেকে। গ্রামের রটনায় রসিকে ডাইনি বলা হলেও সে কুসংস্কারের শিকার। ডাইনির মতো প্রথাসিদ্ধ কোনো মানসিকতা তার ছিল না। মথুরকে পোষ্য নিতে চেয়েছে কেবল রক্ষার মৃত্যুকালীন অনুরোধ রাখার জন্য। সে ন্যায়বোধে মানবিক। মানুষের প্রতি তার গভীর মমত্ববোধ আছে, অন্তঃসত্ত্বা নারী মানীর প্রতি তার মাতৃভাবই প্রকাশিত হয়েছে এ গল্পে। মানবিক ও সুস্থ নারীর আকাঙ্ক্ষা এরকম- ‘রসির একান্ত ইচ্ছা, মরা মানুষের কথাটা রাখে। অপমান হইয়াও সে নিজের হইতে চাহে নাই। এবার সে মনের ইচ্ছাটা মানুষের মুখে গুঁজিয়া দিলো।…ইহজম্মে রসিকে কেহ মা বলিয়া ডাকে নাই, কেহ ডাকিবে এ আশাও নাই.. . তবু একটি কচি প্রাণ, প্রথমে নির্লিপ্ত

তারপর ধীরে ধীরে বেড়িয়া ধরিবে

এ যে বড়ো লোভের জিনিশ.. .’(১৯৭৭: ১৪২)

জেলখাটা, বেপরোয়া, দাম্ভিক সনাতনের শ্বাসনালীর মুখে আটকে থাকা মাছের শিরদাঁড়ার হাড়ে মৃত্যু ‘কথিত ডাইনি’ রসির ভেতর কোনো আনন্দ-উল্লাস সৃষ্টি করেনি। তারাশঙ্করের ডাইনির মতোই এ নারী মাতৃরূপিণী; মানবিক ও সন্তানপিপাসায় বুভুক্ষু। ‘হাড়ে তেমন জোর নাই, মুখের দন্ত নাই; কিন্তু মনের জোর বেজায়।’- সে না করিতে পারে এমন কাজ নাই।’(১৯৭৭: ১৪৩) মাছ ধরতে যাবার আগে সনাতনের  ‘তুই মরবি কবে’ বলায় অভিশাপ দেয় সে। এই দৃশ্যটিও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডাইনী’ গল্পে ভীত পলায়নপর বাউরি যুবককে লক্ষ করে বৃদ্ধার ক্রুদ্ধ মূর্তির অভিব্যক্তিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘রসির মূর্তি ক্রুদ্ধ মার্জারীর মতো ভয়ঙ্কর। .. .রাগে তার গা ফুলিয়া রোঁয়া খাড়া হইয়া উঠিয়াছে.. .দৃষ্টি স্থির. . .চক্ষু জলপূর্ণ… চোখের উপরকার লোল চর্মটা পর্যন্ত যেন কাঁপিতেছে।’(১৯৭৭: ১৪৪) রসির অভিসম্পাত প্রকৃতপক্ষে তার বেদনারই প্রকাশ- অযাচিত দোষারোপে বিভ্রান্ত নারীর রক্তক্ষরণ। তবে এ গল্পে দরিদ্র অশিক্ষিত সনাতন গ্রামের প্রচলিত (ডাইনি) অন্ধবিশ্বাসকে ভেঙেছে; চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে। গ্রামের কেউ রসিকে চটাতে সাহস করে না, মাতব্বর পর্যন্তও। সে তাদের বিপরীতে রসিকে পরাজিত করতে চায়। কিন্তু সমাজসত্য ভিন্ন। তাকে দিয়ে ডাইনি অপবিশ্বাস তাড়িয়ে গল্পকার বিপ্লব সংঘটিত করেননি। বরং তার করুণ পরিণতি ও মৃত্যুর ছবি এঁকেছেন। শেষে রসিকে তার সামনে এনে এবং নীরবে প্রস্থান করিয়ে গল্পটির মানবিক দিকই তুলে ধরেছেন। ‘রসিও আসিয়াছিল; অন্ধকারে দাঁড়াইয়াছিল। লুকাইয়া আস্তে আস্তে সে বাহির হইয়া গেলো।’(‘হাড়’ ১৯৭৭: ১৪৯)

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধায়ের(১৮৯৪-১৯৫০) ‘ডাইনী’ মানবিক মমত্ববোধের গল্প; এখানে মাতৃ¯েœহ তথা মায়ের বাৎসল্য রূপ অঙ্কিত হয়েছে। ‘ডাইনী গল্পে এক সন্তানহীনা বধূর সন্তান¯েœহের প্রকাশ ডাইনীগিরির মতলবে ব্যাখ্যাত। গল্পটি মামুলি, নিবিড়তা বা বিস্ময় খুবই কম।’(সুনীল চট্টোপাধ্যায় ১৯৮১: ২৬৪) মূলত এ গল্পে এক মৃতসন্তান প্রসবকারী এবং অপর সদ্যোজাত শিশুর বিয়োগ-ব্যথায় কাতর গৃহবধূ কমলার সুতীব্র ও অস্বাভাবিক স্নেহ-ক্ষুধার বাৎসল্যরূপ প্রকাশিত।   

চরিত্রনির্ভর এ গল্পে অন্ধবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে কলকাতাবাসী মধ্যবিত্ত পরিবারের স্ত্রী বিজু অপর নারী কমলাকে ডাইনি বলে আখ্যায়িত করেছে। নারী চরিত্র রূপায়ণে বিভূতিভূষণ তাঁর অধিকাংশ গল্পে পারিবারিক পরিমণ্ডলে মায়া-মমতা, স্নেহ-প্রীতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তারা নিজেরা হৃদয় মমতার অফুরন্ত ভাণ্ডার আর তা অযাচিত দান করার আকাক্সক্ষা পোষণে অকৃপণ। গল্পে মধ্যবিত্ত কথক তার স্ত্রী ও আড়াই বছরের কন্যা শানিকে নিয়ে যে বাসায় থাকেন তার পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী কমলা পরপর দুটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু প্রথমটি মৃত ও দ্বিতীয়টি জন্মের কিছুদিন পর গত হয়। একারণে তার প্রতিবেশী শিশু কন্যাটির প্রতি গভীর মমত্ববোধ অনুভব করেছে। আর এই মমত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে পোড়াকপালী নারী অপর নারী কর্তৃক উপেক্ষিত হয়েছে। অভাগা নারীর সন্তানবাৎসল্যকে ডাইনির নজর হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিজু- ‘-চারিদিকে সব ডাইনী। একটা মেয়ে নিয়ে যাও বা ঘর করছি, তা যদি ওদের সহ্যি হয়।’ (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ডাইনী’, ২০১০: ২৩৭) কথক ওই অন্ধবিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেননি এবং বারবারই কুসংস্কারবিরোধী মনোভাব প্রকাশ করেছেন। যেমন তিনি যথার্থই ভেবেছেন, কমলার স্বামীর সিফিলিসের কারণে সন্তান সুস্থ হচ্ছে না। অপরদিকে কন্যা শানি অসুস্থ হলে কমলার ওপর তার স্ত্রীর দোষারোপকে পাত্তা না দিয়ে অনবরত টক খাওয়া এবং পরে ডাক্তারের ওষুধে নিরাময় হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন লেখক। তাঁর স্ত্রীর বিশ্বাস জলপড়ায়; এজন্যই শাবক হারা বিড়ালের করুণ সুরের বিলাপকে অলক্ষুণে বলেছে। বিজু কমলাকে রাক্ষুসী বললেও কথক তার মাতৃহৃদয়ে কন্যা বিচ্ছেদের বেদনাকে উপলব্ধি করেছেন। তাঁর স্ত্রীর ভাবনা- ‘কমলা রোজ রোজ শানির পানে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলবে আর কাঁদবে। বাছার আমার অকল্যাণ হবে তাও বুড়ো মাগী ভুলে যায়।’(বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ডাইনী’, ২০১০: ২৩৮) নিজের সন্তান হারিয়ে অপরের সন্তানকে আকড়ে ধরার আকুতিকে কেবল অন্ধবিশ্বাসের কারণে ডাইনিত্ব অভিধা দেওয়া হয়েছে। কথক জানিয়েছেন কমলার কুনজর থেকে বাঁচার জন্য স্ত্রীর উপর্যুপরি অনুরোধে বাসা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। এ গল্পে শিশুর অনিষ্টকারিণী হিসেবে ডাইনি চরিত্রের একটি দিক তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু লোকবিশ্বাসের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় এখানে অনুপস্থিত। যদিও শিশুর প্রতি আগ্রহী নারী চরিত্রের বিশেষ দিকই ডাইনি শিরোনামের গল্পগুলোর একটি বিশিষ্টতা। তবে ‘ডাইনী’ গল্পের মতো শিশুদের প্রতি বাৎসল্যে উচ্ছ্বসিত নারীচরিত্র (আতুরী ডাইনি) সৃজনে আলাদা পরিবেশ-পরিস্থিতি রয়েছে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে।

৩.

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের(১৮৯৮-১৯৭১) তিনটি ছোটগল্পে ডাইনি চরিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। ছলনাময়ী (১৯৩৬) গল্পগ্রন্থের ‘ডাইনীর বাঁশী’(১৩৪০), বেদেনী(১৯৪৩) গ্রন্থের ‘ডাইনী’(১৩৪৭) এবং জগদীশ ভট্টাচার্য সম্পাদিত তারাশঙ্করের গল্পগুচ্ছের তৃতীয় খণ্ডের ‘ডাইনী’(১৩৫৭) এই তিনটি গল্পে লেখক রাঢ় অঞ্চলের গ্রামীণ পটভূমিতে নিম্নবর্গ নারীর জীবন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের পরিচয় তুলে ধরেছেন। তারাশঙ্করের অভিজ্ঞতার রাজ্যে বসবাস ছিল বাউল, বৈষ্ণব, ডোম, কাহার, সাঁওতাল, বেদে, বাগদি, ঝুমুর নাচিয়ে, বাজিকর, কৃষক প্রভৃতি নিম্নবর্গ মানুষ। খুব কাছে থেকে এসব মানুষ ও তাদের জীবনকে দেখেছেন তিনি। সেকালে তাদের দৈন্য-দুঃখের, বঞ্চনা-ক্ষোভের নিজেকে অংশীদার বিবেচনা করেছেন তিনি। এছাড়া তিনি লিখেছেন-‘ডাইন ডাকিনী ভূত প্রেত-সমাকুল আমার সে-কাল।’(তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৩৮৭: ৭৩) তারাশঙ্করের ‘ডাইনীর বাঁশী’ পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ-তারাশঙ্করের পত্রাবলিতে তার সাক্ষ্য রয়েছে। উভয়ের আলাপচারিতা ও রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যের বরাত দিয়ে আমরা তারাশঙ্করের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্কের পরিচয়টিকে আরো পরীক্ষা করে নিতে পারি।

আমি একেবারে গ্রাম্য লোকের মতই বলে উঠলাম, না-না। স্বর্ণ ডাইনি যে আমাদের পাড়ায় থাকে। এখনও আছে। আমাদেরই কাছারি বাড়ির সামনের পুকুরের ঈশানকোণে তার বাড়ি। আর-এতক্ষণে একটু সংযত হয়ে সবিনয়ে বললাম- আমি তো ইংরেজীও ভাল জানি না। যেটুকু জানি তার উপযুক্ত পড়াবার বইও পাই না আমার দেশে। কোথায় পাব? ওদের দেশের গল্প তো আমি বেশি পড়িনি।

কবি হেসে বললেন- আমি জানি, আমি বুঝতে পারি। তোমাকে আমি বুঝেছি। দেখবার আগেই বুঝেছি। ও-কথাটা তোমাকে বললাম কেন জানো? বললাম আমাদের দেশের সাহিত্যিকদের দেশের সঙ্গে পরিচয় কত সংকীর্ণ তা বোঝানোর জন্য। ডাইনি মানেই তাদের কাছে উইচক্রাফট হলেই সে ইয়োরোপ ছাড়া এ-দেশে কী করে হবে। আমাদের দেশের ডাইনি এরা দেখেন নি, জানেন না, বিশ্বাস করেন না। আমি তাই তাদের বললুম, বললুম-উঁহুঃ উঁহুঃ! এ তারাশঙ্করের চোখে দেখা। আমি যে নিজে দেখতে পাচ্ছি গ্রীষ্ম কালের দুপুরে তালগাছের মাথায় বসে চিলটা লম্বা ডাক ডাকছে, গলাটা তার ধুক ধুক করছে। আর নিজের ঘরের দাওয়ার বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে স্বর্ণ ডাইনি বসে আছে আচ্ছন্নের মতো। আমি চোখে দেখতে পাচ্ছি। তাই তো চিলের ডাক শুনে ছবিটা চোখে ভেসে উঠল : গল্পটা মনে পড়ে গেল। …মাটিকে এবং মানুষকে ও জানে, এর সঙ্গে ওর যোগ আছে। (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৭: ৯৪-৯৫)

বীরভূম-বর্ধমান-বাকুঁড়া এই ভৌগোলিক অঞ্চলের বিচিত্র মানুষের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় তারাশঙ্করের গল্পে। বাউল, বৈষ্ণব, সন্ন্যাসী, পটুয়া, বাজিকর, বেদে, ডাইনি প্রভৃতির কথা তিনি আমার কালের কথা গ্রন্থে বলেছেন। ‘লোকসম্ভূতা ডাইনি নিয়ে দুটি স্মরণীয় গল্প লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘‘ডাইনী’’ ও ‘‘ডাইনীর বাঁশী’’। ওই দুটি গল্পের মধ্যেই বিবৃত আছে মানবীর লোকমানসসম্ভূতা ডাইনি হয়ে ওঠার শিল্পিত ইতিহাস। উল্লিখিত গল্প দুটিতেই প্রবাহিত হয়েছে বাৎসল্যের প্রবণ। বিশেষত দ্বিতীয় গল্পের স্বর্ণ-ডাইনির মতো স্নেহবুভুক্ষু নারীকে শিশুর কাছে ভীতিকর করে তুলে অপয়া হিসেবে চিহ্নিত করে রাখার মধ্যে যে মানসিক নিপীড়ন, তার তুলনা বুঝি নেই। জগদীশ গুপ্ত ‘‘হাড়’’ গল্পে রসি নামের যে তথাকথিত অপয়া নারীকে সৃজন করেছেন, তার মধ্যেও লক্ষ করি শিশুপারনের আকুতি। অথচ অপশক্তির প্রতিভূ রূপে এদেরকে সমাজ লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চেয়েছে, আমৃত্যু নির্বাসন দণ্ড দিয়ে অপত্যস্নেহধারায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।’(ভীষ্মদেব চৌধুরী ২০১৩: ১৩২)

মূলত তারাশঙ্করের ‘ডাইনীর বাঁশী’, ‘ডাইনী’’, ‘ডাইনী’ (গল্পগুচ্ছ ৩য় খ- ) এই তিনটি গল্প এবং মহাশ্বেতা দেবীর ‘ডাইনি’ ও জগদীশ গুপ্তের ‘হাড়’ গল্পে গ্রামীণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসে অপধারণার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। গ্রামীণ মানুষের গোষ্ঠীগত বিশ্বাসও ফুঠে উঠেছে এসব গল্পে। কুসংস্কার, লোক-বিশ্বাস ও অতিলৌকিক রহস্যের আলোছায়ায় নিম্নবর্গের নারীর করুণ পরিণতিই বর্ণিত হয়েছে গল্প তিনটিতে। ধর্মীয় আচরণের সংস্কার এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। তারাশঙ্কর ডাইনি বিশ্বাসের প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে : ‘আজ সেকালের পরিবর্তন হয়েছে। ডাইনীতে বিশ্বাস ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে আসছে। ডাইনীও আজ আর নাই বললেই হয়। অশিক্ষার গাঢ় অন্ধকারে যারা আজ ডুবে আছে তাদের মধ্যে হয়তো আছে। সেকালের ডাইনীর বিচিত্র গল্পও আজ লোকে ভুলে আসছে। এই গল্পগুলির মধ্যে শুধু অন্ধ বিশ্বাসই তো নাইÑ আছে কত মানুষের মর্মান্তিক বেদনা। সারাটা জীবন তারা এই অপবাদের গ্লানি বহন করে চলত। নিজেরাও বিশ্বাস করে নিত এই অপবাদকে সত্য বলে আর ভগবানকে ডাকত স্বর্ণের মত আমার এ লজ্জার বোঝা নামিয়ে দাও প্রভু। এ ভয়ঙ্কর জীবনের অবসান কর। চোখের জল মুছে ফেলত কাপড়ের আঁচলে, মাটিতে কোনক্রমে একফোঁটা ঝরে পড়লে শিউরে উঠত, মা বসুমতীর বুক যে জ্বলে উঠবে।’(‘ডাইনী’ ১৯৭৭:১২৪) লোকসংস্কারে বিভিন্ন আচার-আচরণ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকে এবং যা বিভিন্ন কৃত্যে অনুসৃত হয় আবশ্যিক হিসেবে। এভাবে ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে অনেক আচার-কৃত্য। অন্যদিকে লোকবিশ্বাস আবশ্যিক কৃত্য নয়। মানসিক প্রতিক্রিয়া এতে অন্যভাবে সক্রিয়। ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ ক্ষীণ এর। লোকবিশ্বাস গড়ে ওঠে একটা ধ্যান-ধারণাকে কেন্দ্র করে। লোকবিশ্বাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তি নয় সামষ্টিক মানুষের প্রত্যয় বিজড়িত। ‘মানুষের মানসিক দুর্বলতা, অনিশ্চয়তা, শুভাশুভ বোধ থেকেই লোক-বিশ্বাস ও সংস্কারের উদ্ভব।… সংহত সমাজের মানুষ যে বিশ্বাস করে এবং সেইমত যদি আচরণ করে তবেই তা লোকবিশ্বাস ও সংস্কারের পর্যায়ভুক্ত হয়।’(বিনয় ঘোষ ১৯৭৬:৪৩)

 ‘ডাইনীর বাঁশী’ গল্পে রাধানগর গ্রামের বেনেদের দরিদ্র মেয়ে স্বর্ণের লোকবিশ্বাসের দৃষ্টিতে স্বর্ণ ডাইনিতে পরিণত হওয়ার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। পিতৃ-মাতৃহীন বিধবা স্বর্ণ গ্রামীণ মানুষের অপবিশ্বাসের বলি, স্বর্ণের মায়ের ডাইনি অপবাদ নিয়ে গ্রামের লোকে নানা কথা বলে। মায়ের সেই প্রবৃত্তি তার মধ্যে জাগ্রত হওয়ার আশঙ্কা অনুভব করে সে। পরের ছেলেমেয়েদের উপর তার মায়া এবং গ্রামীণ নারী সমাজের প্রিয় মুখ হলেও স্বর্ণ মুখুজ্জে বৌকে পোয়াতী বলায় মানদা বলেছে ডাইনিরা পোয়াতীর পেটের ভেতর মরা ছেলে দেখতে পায়।(১৯৭৫: ২৩০) সে লোকবিশ্বাসের  আরো  পরিচয় দিয়েছে  ‘আমার শ্বশুরবাড়িতে এক ডাইনী ছিল শুনেছি, সে নাকি সব দেখতে পেতো। মানুষের বুকের ভেতর প্রাণ নড়ছে, শিরার মধ্যে  রক্ত চলছে, পোয়াতীর পেটের ভেতর ছেলে, গাছের  ফুলের ফল Ñ সব সে দেখতে পেতো।’(১৯৭৫: ২৩০) তার কথা অনুসারে ডাইনিদের মত অনিষ্টকারী পৃথিবীতে আর নেই। ফলন্ত গাছ, পোয়াতী, শিশুছেলে এদের ওপর রাক্ষসীদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। মানুষের শরীরের রক্ত চুষে খেয়ে নেয়।(১৯৭৫: ২৩০) রাতে আবার চিৎকার করত আর ‘বাট বয়ে বয়ে বেড়াত’। সে মৃত্যুর পূর্বে একটি পোষা  বেড়ালকে সেই বিদ্যা দিয়ে যায়। কিছুদিন পর হঠাৎ বিড়ালটিও ডাইনি হয়ে ওঠে। টুকুর মা মানদার এই ডাইনি বৃত্তান্ত শুনে স্বর্ণের প্রতিক্রিয়া- ‘মানদার কথাগুলা ক্রমাগত তাহার মনের মধ্যে ঘুরিতেছিল। ডাইনী সে ডাইনী।’(১৯৭৫: ২৩১) একসময় স্বর্ণ মানুষের কুসংস্কারকে বিশ্বাস করে ডাইনি সত্তায় রূপান্তরিত হয়। ‘গর্ভিণী বধূটির প্রতি তার প্রীতি, শিশু টুকুর প্রতি তার গভীর বাৎসল্যÑ সবকিছুর মধ্যেই যেন রয়েছে ডাইনীর পাপদৃষ্টি। স্বর্ণ মনে মনে ডাইনী হয়ে উঠল। ডাইনী হয়ে ওঠার মানসিক যন্ত্রণা সে ভোগ করতে লাগল। জনশ্রুতিতে, ভর্ৎসনায়, ঘৃণায়, ভীতিতে স্বর্ণ যেভাবে নিজেকে ডাইনী ভাবতে শুরু করল তারাশঙ্কর তার সেই মানসিক স্তরগুলোকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন শিল্পীর গাঢ় অনুভূতিতে, তীব্রতর প্রকাশভঙ্গিতে।’(সফিকুন্নবী সামাদী ২০০৪ : ৪৬-৪৭) এই গল্পে ডাইনির ধ্যানধারণাকে কেন্দ্র করে লোকবিশ্বাস প্রকাশিত হয়েছে। মানুষের কুসংস্কার, অতিলৌকিকে বিশ্বাস, একজন গ্রাম্য অসহায় নারীকে মনোঘটিত ভ্রান্তিতে উত্তীর্ণ করেছে। সে নিজেই নিজেকে ডাইনিতে রূপান্তরিত ভেবেছে। তবে সামাজিক পরিস্থিতিগুলো মেনে নিতে পারেনি সে। ভেবেছে  ‘নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহরে বসিয়া স্বর্ণ আপন অদৃষ্টের কথা ভাবিতেছিল, আর রাক্ষসী মাকে তাহার অভিসম্পাত দিতেছিল। সত্যই তাহার বুকের মধ্যে জর্জর-লোলুপ একটা ক্ষুধা অজগরের মত অনিবার লক্-লক্ করিতেছে। টুকুকে আবার তেমনি করিয়া বুকে চাপিয়া চুম্বন করিতে চিত্ত তাহার উন্মত্ত অধীর হইয়া উঠিতেছে কি কোমল টুকু।’(১৯৭৫: ২৩৪-২৩৫)

‘ডাইনীর বাঁশী’ গল্পে যে স্বর্ণ ডাইনির ডাইনিত্ব বর্ণিত হয়েছে তারই পরিণতি ব্যক্ত হয়েছে তারাশঙ্করের ‘ডাইনী’ গল্পে। সুরধুনীর ‘মর্মান্তিক অন্তিম পরিণতি’ লোকবিশ্বাসকে উপজীব্য করে এই গল্পে রূপায়িত হয়েছে। ‘মানবমনের অন্ধ আদিম সংস্কারকে অবলম্বন করে চরিত্রমুখ্য’ গল্প ‘ডাইনী’তে লেখকের সমস্ত সহানুভূতি বর্ষিত হয়েছে অভিশপ্তা মানবীর ওপর। ছাতিফাটা মাঠে পথ হারিয়ে ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত তরুণী মা তার কচি শিশু ক্রোড়ে নিয়ে ডাইনির গৃহে উপস্থিত হলে শিশুকে দেখে সুরধুনীর ডাইনিসত্তা জেগে ওঠে। পরবর্তীতে মাতৃক্রোড়ের কচি শিশুটির মৃত্যু হলে তরুণীর ডাইনির কুটিরে উপস্থিত হওয়াকে দোষারোপ করা হয়। ডাইনির গৃহের পাশে বাউরিদের স্বামীপরিত্যক্তা উচ্ছলা মেয়ে ও তার প্রণয়মুগ্ধ বাউরি তরুণের প্রণয় সংলাপ শোনার পর বৃদ্ধা ছেলেটির সামনে উপস্থিত হলে আতঙ্কে পালাতে গিয়ে যুবকটি আহত হয়। আর তার পলায়নে সুপ্ত ডাইনিসত্তা জেগে ওঠে বৃদ্ধার। তন্ত্রমন্ত্রে  তরুণ বেঁচে না উঠায় আতঙ্কিত ডাইনি সন্ধ্যার মুখে ছাতিফাটার মাঠ দিয়ে তার বসতি ত্যাগের সময় কালবৈশাখীর ঘূর্ণিঝড়ে পড়ে কণ্টকাকীর্ণ ‘খৈরী গুল্মে’র কাঁটা ডালের সূচালো ডগায় বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। অথচ শিশুটির মৃত্যু ঘটেছিল অতিরিক্ত গরমে ভীষণ ঘেমে দেহের সমস্ত জল বের হওয়ার ফলে। অন্যদিকে বাউরি যুবকের মৃত্যু হয় ধনুষ্টংকারে। লোকসমাজের বিশ্বাস অনুসারে তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয় সুরধুনীকে। এমনকি তার বাসস্থান নিয়ে লোকবিশ্বাস প্রচলিত হয়। লোকবিশ্বাস মতে ডাইনিরা নির্জনতাপ্রিয়; মানুষের সাক্ষাৎমাত্রেই এদের অনিষ্টস্পৃহা জাগ্রত হয়। এই ডাইনি তিন চারটে গ্রাম ধ্বংস করে একদা আকাশপথে একটি গাছকে চালিয়ে নিয়ে যেতে যেতে জনহীন, ছায়াশূন্য দিগন্ত বিস্তৃত ছাতিফাটা মাঠের নির্জন রূপে মুগ্ধ হয়ে নেমে এসে সেখানে বসতি স্থাপন করে। রামনগরের সাহাদের আমবাগানে গত চল্লিশ বৎসর যাবৎ বসবাসকারী ডাইনির দৃষ্টি নাকি অপলক স্থির, আর সে দৃষ্টি নাকি চল্লি­শ বৎসর যাবৎ নিস্তব্ধ হয়ে আছে মাঠটির উপরে। লোকে তাকে পরিহার করে চলে। কারণ সে ‘ভীষণ শক্তিশালিনী, নিষ্ঠুর ক্রূর এক বৃদ্ধা ডাইনী’।(১৯৭৬: ২৪৩) অভিশপ্ত ছাতি-ফাটার মাঠের উপর ক্রূর দৃষ্টি প্রসারিত করে আছেÑ এই লোকবিশ্বাস ছাড়াও ডাইনি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গুণিনের অলৌকিক ক্ষমতার কথাও এ-গল্পে বলা হয়েছে। ডাইনির মৃত্যুর মূলে গুণিনের মন্ত্রপ্রহারের কথা লোকসমাজের বিশ্বাস অনুসারে বর্ণিত হয়েছে। ‘আকাশ-পথে যাইতে যাইতে ঐ গুণীনের মন্ত্রপ্রহারে পঙ্গুপক্ষ পাখীর মত পড়িয়া ঐ গাছের ডালে বিদ্ধ হইয়া মরিয়াছে। ডালটার নীচে ছাতি-ফাটার মাঠের খানিকটা ধূলা কালো কাদার মত ঢেলা বাঁধিয়া গিয়াছে। ডাকিনীর কালো রক্ত ঝরিয়া পড়িয়াছে।’(১৯৭৬: ২৫৩) দেবব্রত ভট্টাচার্যের ভাষায়- ‘ডাইনি যে রাতের অন্ধকারে আকাশপথে ইচ্ছেমতো বিচরণ করতে পারে এবং ডাইনি হলেই যে তার গায়ের রক্ত কালো হয়ে যায় এ বিশ্বাস রাঢ় বঙ্গের নিম্নশ্রেণিভুক্ত তথা আদিবাসী উদ্ভূত বহু মানুষের মধ্যে আজও বাসা বেঁধে আছে।’(দেবব্রত ভট্টাচার্য ২০০৮:১৭৩) 

‘অশুভশক্তির প্রতি লোকসমাজের আত্যন্তিক বিশ্বাসনির্ভরতা এবং তারই করুণ পরিণতি সম্বলিত’ আরেকটি গল্প তারাশঙ্করের গল্পগুচ্ছের তৃতীয় খণ্ডের ‘ডাইনী’। এই গল্পে লেখক আত্মজীবনীর ভঙ্গিতে স্বর্ণ ডাইনির অন্তরজগতকে আলোকিত করেছেন। লোকের কুসংস্কার ও অপবিশ্বাস থেকে স্বর্ণ সম্পর্কে মিথ্যা সন্দেহ এবং কাকতালীয় ঘটনা পরম্পরায় তাকে দোষারোপের মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক প্রসঙ্গগুলো লেখক তুলে ধরেছেন। লোকসমাজের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও ডাইনি সম্পর্কে প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে লেখক। ডাইনি নিয়ে তিনটি ঘটনা হলো- স্বর্ণের মাসী তার ডাইনি সত্তা বিড়ালকে সংক্রামিত করে, তারপর বিড়ালটি মৃত্যুর পূর্বে স্বর্ণের মধ্যে ডাইনি সত্তা সঞ্চারিত হয়। দ্বিতীয় ঘটনা গ্রামের অবিনাশের ডাইনি ভর ও গুণিনের ডাইনিমুক্ত করার ঘটনা। তৃতীয়টি কাঁউর বিদ্যা জানা ডাইনির গাছ উড়িয়ে আকাশ পথে ভ্রমণ ও মন্ত্রবলে গুণিনের মাটিতে নামিয়ে আনা ও তার চামড়া ‘ছিলে’ অর্ধেক গাছ নিয়ে ডাইনির উড়ে যাবার কাহিনি বর্ণিত। তবে এধরনের অপবিশ্বাস কুসংস্কারের বিরুদ্ধে স্বর্ণ ডাইনির প্রতি লেখকের মমত্ব প্রকাশিত হয়েছে। লোকবিশ্বাস মতে, ডাইনির দৃষ্টি ভয়ঙ্কর, তারা কচি নধর দেহে এবং সুন্দর সুশ্রী মানুষের তরুণী নববধূর শরীরের অস্থি চর্ম মেদ মাংস ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করে খোঁজে প্রাণ-পুতুলী। তাকে পেলে চুষে খায়। গভীর রাতে বাট বয়। মাটির উপর বুকে হেঁটে বেড়ায়। উত্তরাধিকার সূত্রে স্বর্ণ তার মাসীর বিড়ালের মাধ্যমে ডাইনিতে রূপান্তরিত হয়। জেলেদের কচি ছেলেকে গুণিন ডাইনি মুক্ত করার সময় স্বর্ণের বিড়ালকে হত্যা করা হয়। বিড়ালের মাধ্যমে ডাইনিত্ব সংক্রমিত হলে স্বর্ণ ডাইনি হয়ে ওঠে। ‘সে আবার  কাউকে ডাইনীবিদ্যা দেবে তবে তার মরণ হবে।’(১৯৭৭: ১২১) তবে স্বর্ণের হাত নেই তার ভিতরের ডাইনির উপর। সতের/আঠার বছরের অবিনাশকে গোঁসাইবাবা ডাইনিমুক্ত করে অথচ স্বর্ণ প্রহৃত হয়। লেখকের স্মৃতি অনুসারে স্বর্ণ ছাড়া আরো অনেক ডাইনি ছিল গ্রামীণ সমাজে। তার চেয়ে গল্প ছিল অনেক বেশি। যেমন কাউরের বিদ্যা জানা গুণিনের ঘটনা ছিল অনেক। আসলে ডাইনি বিষয়ক তিন গল্পে তারাশঙ্কর ব্যক্ত করেছেন লোকসমাজের অবচেতনের সংগুপ্ত মনোবিকার। 

জগদীশ গুপ্তের ‘হাড়’, বিভূতিভূষণের ‘ডাইনী’ এবং মহাশ্বেতা দেবীর ‘ডাইনি’সহ তারাশঙ্করের ‘ডাইনীর বাঁশী’, ‘ডাইনী’ ও ‘ডাইনী’ (৩য় খণ্ড) অর্থাৎ সবগল্পে ‘ডাইনির কুনজর’ লোকবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বর্ণিত হয়েছে। বাংলা ছোটগল্পের সব ডাইনি চরিত্রে এই একই বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। মন্দব্যক্তির কুনজর পড়লে খাদ্যদ্রব্য, ফল-ফসল ও শিশুর ক্ষতি হয় বলে লোকবিশ্বাস প্রচলিত। ডাইনি শিশুদের উপর নজর দিয়ে রক্ত শোষণ করে, শিশু শুকিয়ে যায়। ‘ফলন্ত গাছ, পোয়াতী, শিশুছেলে এদের ওপর রাক্ষসীদের ভারি লোভ। মানুষের শরীরের রক্ত চুষে খেয়ে নেয়।’(১৯৭৫: ২৩০) তারাশঙ্করের ‘ডাইনী’ গল্পে সাবিত্রীর শাশুড়ি সুরধুনীকে সাবিত্রীর সদ্যোজাত খোকার প্রতি দৃষ্টিকে বলেছে ‘হারামজাদীর চোখ দেখ দেখি’(১৯৭৬: ২৪৭)- এর পূর্বে সরকার-গিন্নী তার ছেলেকে নজর দেওয়ার অভিযোগ এনেছিল ‘ওর ঐ চোখের দৃষ্টি দেখে বরাবর আমার সন্দেহ ছিল কখনও আমি ওর সাক্ষাতে ছেলে-পুলেকে খেতে দিই নে। আজ আমি খোকাকে খেতে দিয়ে ঘাটে গিয়েছি আর ও কখন এসে একেবারে সামনে দাঁড়িয়েছে সে কি দৃষ্টি ওর।’(১৯৭৬: ২৪৫) তারও পূর্বে বামুন বাড়ির হারু চৌধুরী ১০/১১ বছরের সুরধুনীকে অভিযুক্ত করে ‘হারামজাদী ডাইনী তুমি আমার ছেলেকে নজর দিয়েছ? তোমার এত বড় বাড়? খুন করে ফেলব হারামজাদীকে?’ (১৯৭৬: ২৪৪) অর্থাৎ খাদ্যগ্রহণরত শিশুকে কুনজর দেওয়ায় তারা পেট ব্যথায় ছটফট করে ওঠে- এই লোকবিশ্বাস বিবৃত হয়েছে এ-গল্পে। প্রকৃত অর্থে খাদ্যলোলুপতার জন্যই ক্ষুধার্ত সুরধুনীর দৃষ্টিতে মানুষ খুঁজে পায় কুদৃষ্টি। ‘ডাইনী’তেও(৩য় খণ্ডে) স্বর্ণ ডাইনির বিচিত্র স্থির দৃষ্টির কথা আছে। ‘ভাবলেশহীন শুষ্ক যেন খটখট করত দুটো হলদে চোখ এই পাথর শুকনো ডাঙার বুকে। ডাইনীর দৃষ্টি। এই দৃষ্টিতে ডাইনীরা কচি নধর দেহের, সুন্দর সুশ্রী মানুষের তরুণী  নববধূর দেহের অস্থিচর্ম মেদ মাংস ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করে খুঁজত প্রাণ পুতুলী। তাকে পেলে চুষে চুষে তারা খেয়ে ফেলে।’(১৯৭৭: ১১৯) স্পষ্টত কুনজরের প্রসঙ্গ এসেছে এখানে। এ-গল্পে লেখকের অবিনাশদাদাকে ডাইনি নজর দেয় দৃষ্টিবাণে বিদ্ধ করে, তার ভিতর প্রবেশ করে তাকে শুষে খায়। কুনজর দেওয়ার কারণ বর্ণিত হয়েছে তার ঘরের সামনে দিয়ে বড় বড় আম হাতে নিয়ে যাচ্ছিল অবিনাশ (১৯৭৭: ১২১) আম না পেয়ে তাকেই খেয়ে ফেলে ডাইনি।(১৯৭৭: ১২২)

৪.

বাংলা ছোটগল্পের এই ডাইনি প্রজ্ঞাবান কেউ নয়, লোকচিকিৎসকও নয়, ইউরোপের ডাইনিদের মতো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতিপক্ষও নয়। কিন্তু স্লিম্যান বর্ণিত লোকমানসসম্ভূত নির্মাণ। এখানে দরিদ্র একাকী অসহায় নারীকে গ্রামসমাজ ডাইনি বলে চিহ্নিত করে রেখেছে। তার কাছ থেকে অমঙ্গলের আশঙ্কা করেছে। তেমনি আবার আদিবাসী সমাজে নারীকে ডাইনি আখ্যা দেওয়ার করুণ চিত্রও রয়েছে বাংলা ছোটগল্পে। মানুষের শঠতার কারণে নারীকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে লাঞ্ছিত করার অ-মানবিক কাহিনি হলো মহাশ্বেতা দেবীর(১৯২৬-) ‘ডাইনি’। অন্ধবিশ্বাস ও সংস্কারে উন্মত্ত হয়ে একজন নারীকে নিক্ষেপ করা হয়েছে অমানবিক পরিস্থিতির মধ্যে। এই নারীর রয়েছে একদিকে মাতৃসত্তা অন্যদিকে সমাজের শঠ ব্যক্তিদের আরোপিত ডাইনিসত্তা। তারাশঙ্করের ‘ডাইনী’তে যেমন উভয় সত্তা একটির পর একটির জাগরণ ঘটেছে তেমনি নিষ্ঠুর, নির্মম মানবতাহীন সমাজের পরিচয় ব্যক্ত করেছেন মহাশ্বেতা দেবী।   

মূলত মহাশ্বেতা দেবীর ‘ডাইনি’(২০১৪: ৩২২-৩৫৫) গল্পে আদিবাসী সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের অন্ধ সংস্কার তুলে ধরা হয়েছে। তাদের বিশ্বাস কোনো মানুষের উপর প্রেত বা পিশাচ ভর করলে তারা ডাইনি হয়ে যায়। এ গল্পে ডাইনির ক্ষমতা দেখানো হয়েছে। তাদের প্রভাবে আকাল আসে, খরা হয়, মড়ক দেখা দেয়। নি¤œবর্গের সমাজে প্রভুত্বশক্তি হনুমান মিশ্র ব্রাহ্মণ, তাদের ভাষায় ‘বরাম্ভোন দেবতা’। সে নিজের পুত্রের  অপকর্মের দায় চাপিয়ে দেয় গঞ্জু, দোসাব, ধোবী, ওরাওঁ এবং মুণ্ডাদের ওপর। প্রচার করে যে ডাইনির আবির্ভাব হয়েছে তাদের পাপাচারের কারণে। এই ব্রাহ্মণের অপপ্রচারে নিম্নবর্ণের জীবনে পারস্পরিক অবিশ্বাস দানা বেধে ওঠে। নিজেদের মধ্যে ডাইনি খোঁজা শুরু হয়। এই সমাজে ডাইনি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হলো- ডাইনি দূর থেকে নজর দিয়ে বা তুক করে দুধে দই কাটায়, ছাগল-গাই মেরে ফেলে; শস্য নষ্ট করে, খরা ডাকে আকাল ঘটায়, ছোট ছেলেপিলের প্রাণ নেয়, রজস্বলা মেয়েকে স্বদলে টানে, গর্ভিনীর গর্ভে ঢোকে। এসব কারণে সেই সমাজ থেকে ডাইনিকে তাড়িয়ে দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। প্রকৃত ঘটনা গল্পের শেষে উন্মোচিত হয়েছে। টুরার পহানের মেয়ে সোমরিই ডাইনি বলে মিথ্যা অভিযুক্ত হয়েছে হনুমান মিশ্র কর্তৃক। তারই নিকৃষ্ট অপকৌশলে বোবা সোমরিই ডাইনি বলে বিতাড়িত হয়েছে। অসহায় সোমরিইকে গর্ভবতী করেছে হনুমানের ছেলে। তারপর তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে জঙ্গলে। আর ডাইনির মিথ্যা কাহিনি ছড়িয়ে সহজ সরল কুসংস্কারগ্রস্ত গ্রামবাসীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে। হনুমান মিশ্ররা নিজেদের অপরাধ আড়াল করার জন্য নারীসমাজকে এভাবে নিন্দিত করে তোলে। গ্রামবাসীরা শেষ পর্যন্ত প্রকৃত সত্য জানতে পেরে মিশ্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। গঞ্জু, দোসাব, ধোবী ও মুণ্ডদের এই পরিবর্তন এ গল্পের মুখ্য ব্যঞ্জনা।

গল্পে আদিবাসী সমাজে ডাইনি সম্পর্কিত নানা বিশ্বাসের প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে এসেছে। আকালের সঙ্গে যা যা ঘটেছে সবই ডাইনির কারণে। শিশুরা রিলিফ প্রদত্ত সয়াবিনের দুধ খেয়ে ঘাড় উলটে বমি তুলে মরে যাচ্ছে। মরছে গাই-মোষ। গাছ থেকে টাউরি খেয়ে ঘুরে পড়ে মরে যাচ্ছে দাঁড়কাক। ডাইনির উপস্থিতিতে এসব ঘটেছে। ডাইনি থাকলে অত্যাশ্চর্য সব ঘটনা ঘটতে পারে; চকমকি ঠুকে বিড়ি খেতে গিয়ে দেখা যায় চকমকি পাথর থেকে আগুন না, বেরিয়েছে রক্ত। আঁতুড়ে শিশু হেঁটে চলে যাচ্ছে, আগুনের মালসা পায়ে ঠেলে। সমাধির পাথর ঠেলে মৃতেরা উঠে বসে গান গাইছে। সামগ্রিক বিপর্যয় ও আতঙ্ক অধিকাংশই কেউ চোখে দেখে না কানে শুনে বিশ্বাস করে। টাহাড়ের হনুমান মিশ্র জানিয়েছে অধিবাসীরা মহাপাপী তাই ডাইনি কুরুডা, মুরহাই, হেসাডি আরো অনেক গ্রাম কেন্দ্র করে ঘুরছে। উলঙ্গ নারী রক্তবর্ণ মেঘে চেপে উড়ে গেছে। সেই ডাইনিকে খুঁজে বের করে তাড়াতে হবে। তাকে আঘাত করে রক্তপাত ঘটালে বা পুড়িয়ে মারলে সমূহ সর্বনাশ।

হনুমান মিশ্রের নির্দেশ অনুযায়ী ডাইনিকে গ্রামবাসীরা কুরুডা থেকে মুরহাই থেকে হেসাডি থেকে জিলাদের মাঠে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। ডাইনি তাড়াতে গিয়ে হেসাডি, ঢাই টুরা, কুরুডা সব গ্রামের শক্ত-পোক্ত পুরুষেরা জড়ো হয়ে নানা ক্রিয়াকা- ও আক্রমণ প্রতিআক্রমণ শেষে জানতে পারে ডাইনি নেই। প্রকৃত ঘটনা হলো টুরার পহানের মেয়ে সোমরিই ডাইনিরূপে মিথ্যা অভিযুক্ত। তাকে তাড়িয়ে দিয়ে জঙ্গলে প্রচার করেছে ডাইনিকে প্রাণে মের না তাড়িয়ে দাও। ‘শেষ পর্যন্ত গ্রামবাসীরা ডাইনির অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। ডাইনির অসত্যতা বিষয়ে এদের সম্যক উপলব্ধি হয়। মিশ্রজীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে। গঞ্জু, দুসাব, ধোবী ও মু-াদের এ ধরনের পদক্ষেপে সমাজ পরিবর্তনের এক ক্ষীণতম আশার সঞ্চার হয়।’(অজয় গুপ্ত ২০১৪: ৫৯৮)

‘ডাইনি’ গল্পে আদিবাসীদের নির্মম শোষণের চিত্র রয়েছে। ন্যূনতম খাদ্য জোটাতে যাদের প্রাণান্তকর চেষ্টা চলে তারা আবার অন্ধসংস্কারে আটকে যায়। সীমাহীন দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, বেঁচে থাকার করুণ অভিজ্ঞতা রূপ পেয়েছে এ গল্পে। অজ্ঞ, মূর্খ আদিবাসী নি¤œবর্ণের জীবনে ডাইনি একটা মজ্জাগত বিশ্বাস। নিজেদের পাপে গ্রামে ডাইনির আবির্ভাব ঘটেছে এই বিশ্বাস করানোর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে ব্রাহ্মণ শ্রেণির অপতৎপরতা যা শোষণের অংশ। নিজেদের মধ্যে ডাইনি খুঁজতে গিয়ে পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণও করে তারা। চূড়ান্ত নির্দয় হওয়ার ঘটনাও আছে এ গল্পে। 

বস্তুত ক্ষুরধার রচনাভঙ্গিতে নির্যাতিত জীবনের কাহিনি লিখেছেন মহাশ্বেতা দেবী। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে মমতায় চরিত্রগুলি জীবন্ত; ভাষা কাব্যময়। বিষয়-চরিত্র ও যথোপযুক্ত ভাষা প্রয়োগে গল্পটি শিল্পোত্তীর্ণ। কাল্পনিক নয় বাস্তব সমাজের চিত্রণ রয়েছে এতে। সমাজের শোষণের মাত্রাটি তুলে ধরেছেন লেখক। পরিবেশনার দক্ষতায় হতভাগ্য নারীর সমস্যা, নির্যাতন একাত্ম করে তোলা হয়েছে। মহাশ্বেতা দেবী তাঁর ‘বাঁয়েন’ গল্পেও ডোম সমাজের অলৌকিক বিশ্বাসের মানবিক পরিণতি দেখিয়েছেন। ডোম সমাজের বিশ্বাস বাঁয়েন রাক্ষুসী। সমাজের অনিষ্ট করে। মরা ছেলেকে আদর করে দুধ খাওয়ায়। লোক বিশ্বাস অনুযায়ী বাঁয়েনের দৃষ্টিতে আস্ত একটা গাছ পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। বাঁয়েন যদি কাউকে নেবার জন্য মনস্থ করে তবে প্রচ- রোদের মধ্যেও সে ছেলের মুখে ছায়া ফেলে রাখে ইত্যাদি। ছোট ছেলেদের অনিষ্টকারী বাঁয়েন চণ্ডী শেষে নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে সে মানব। ট্রেন দুর্ঘটনা থেকে মানুষকে বাঁচায় সে।(মহাশ্বেতা দেবী ‘বাঁয়েন’ ২০১৪: ৫১-৫২)  

৫.

ডাইনি চরিত্র কেন্দ্রিক গল্পগুলো কুসংস্কারবিরোধী গল্প হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।(সৌমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১২: ভূমিকা) এগুলো শিল্পমূল্যে, মানবিক মর্যাদায় অভিনন্দিত। জগদীশ গুপ্ত, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর ও মহাশ্বেতা দেবী- এই চারজন গল্পকারের ডাইনি চরিত্র সৃজন সম্পর্কে বলা যায়- সব ডাইনি চরিত্রই নিম্নবর্গীয়। গল্পকাররা ডাইনি চরিত্র সৃজনে ব্রাত্য, অন্ত্যজ, শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের আশ্রয় নিয়েছেন। সমাজের উচ্চবর্গের দৃষ্টিতে ডাইনি আখ্যায়িতরা ছোটলোক, প্রবৃত্তিচালিত, লোলুপ হলেও এসব শব্দ তাদের ওপর উচ্চবর্গ কর্তৃক আরোপিত প্রয়োগ। কিন্তু লেখকরা তাদের দারিদ্র্য, অসহায়ত্ব, সামাজিক অপবাদে বিপর্যস্ত জীবনকে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত দক্ষতায়। গোষ্ঠীগত জীবনের সঙ্গে ডাইনির নিপীড়ন তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নিপীড়িত নারী বস্তুনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। গল্পগুলোতে উচ্চবর্গের ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে দূরবর্তী তাদের জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার বিস্তৃত বিবরণ এবং জীবনের সমস্যার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রত্যেক লেখকের গল্প-উপন্যাসে ভিড় করেছে বিচিত্র চরিত্র ও পেশার মানুষ। তার ভেতর ডাইনি চরিত্রগুলো ব্যতিক্রম। গল্পকাররা ডাইনি চরিত্র রূপায়ণে সংলাপের চেয়ে বর্ণনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন বেশি। তবে এসব নিম্নবর্গের নারীর জীবন নিয়ে গ্রামীণ পটভূমিতে গল্প লেখার সময় নির্দিষ্ট এলাকার কথ্যভাষা ব্যবহার করেছেন। আবার গ্রামীণ জীবনকেন্দ্রিক ঘটনা রূপায়ণে মান্য চলিত ভাষা প্রয়োগে দক্ষতা দেখিয়েছেন। মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসী পাত্র-পাত্রীদের সংলাপে আঞ্চলিক উপভাষা ব্যবহার করেছেন কিন্তু বর্ণনাভঙ্গিতে চলিত ভাষা গল্পের অন্তর্বুনন সমৃদ্ধ করেছে। গল্পকাররা মৌলিক ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির শৈল্পিক প্রয়োগে, অনবদ্য কথনভঙ্গিমায় এবং বিজ্ঞানমনস্কতার সন্ধানী আলোয় উন্মোচিত করেছেন অনাবিষ্কৃত শাশ্বত সত্যকে যা অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা এবং অবাস্তব পরিত্যাজ্য মূল্যবোধের অনড় পাথরের নিচে চাপা পড়ে আছে। ‘ডাইনি’ চরিত্র সৃজন করে সামাজিক অত্যাচার আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মানবতার গল্পই লিখেছেন জগদীশ গুপ্ত, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর ও মহাশ্বেতা দেবী।

রচনাপঞ্জি

অজয় গুপ্ত (২০১৪), গল্প-পরিচয়, মহাশ্বেতা দেবী গল্পসমগ্র, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় (২০১০), কালের পুত্তলিকা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

আশুতোষ ভট্টাচার্য(২০০৬), বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, এ. মুখার্জী অ্যান্ড কোং প্রা: লি:, কলকাতা

উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (১৪০৮), বাংলার বাউল ও বাউল গান, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, কলকাতা

জগদীশ গুপ্ত(১৯৭৭), হাড়, সুবীর রায়চৌধুরী সম্পাদিত, জগদীশ গুপ্তর গল্প, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

জগদীশ ভট্টাচার্য (১৯৭৫), তারাশঙ্করের ছোটগল্প, তারাশঙ্করের গল্পগুচ্ছ ১ম খ-, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা

ড. বরুণকুমার চক্রবর্তী সম্পাদিত (২০০৪), বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ, অপর্ণা বুক ডিস্ট্রিবিউটার্স, কলকাতা

ড. শমিতা মান্না(২০০৪), ডাইনী বিদ্যা, বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতিকোষ, (সম্পাদনা: ড. বরুণকুমার চক্রবর্তী), অপর্ণা

                             বুক ডিস্ট্রিবিউটার্স, কলকাতা

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়(১৯৭৫), ডাইনীর বাঁশী (রচনাকাল ১৩৪০), জগদীশ ভট্টাচার্য (সম্পাদিত), তারাশঙ্করের

                                      গল্পগুচ্ছ ১ম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৭৬), ডাইনী(১৩৪৭), জগদীশ ভট্টাচার্য (সম্পাদিত), তারাশঙ্করের

                                      গল্পগুচ্ছ ২য় খ-, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা 

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৭৭),  ডাইনী(১৩৫৮), জগদীশ ভট্টাচার্য (সম্পাদিত), তারাশঙ্করের

                                      গল্পগুচ্ছ ৩য় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৩৮৭), আমার কালের কথা, তারাশঙ্কর স্মৃতিকথা, নিউ বেঙ্গল প্রেস প্রা: লি:, কলকাতা

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৯৭), আমার সাহিত্য জীবন, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৯৯), রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী,  তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি, (সম্পাদনা:

                                       অচিন্ত্য বিশ্বাস), রত্নাবলী, কলকাতা

দেবব্রত ভট্টাচার্য (২০০৮), ভারতীয় লোকজীবন ও সাহিত্যে ডাইনিবৃত্তির প্রভাব ও প্রসার, পুনশ্চ, কলকাতা

দীপঙ্কর চৌধুরী (২০১১), ডাইনি ও অন্যান্য গল্প, দাশগুপ্ত এ্যান্ড কোম্পানী প্রাঃ লিমিটেড, কলকাতা

বরুণকুমার চক্রবর্তী (১৪০৪), তারাশঙ্কর : আচার-ধর্ম ও সংস্কার, লোকসংস্কৃতি গবেষণা, (সম্পাদনা: সনৎকুমার

                                মিত্র), কার্তিক- পৌষ ১০ বর্ষ ৩য় সংখ্যা, কলকাতা

বিনয় ঘোষ (১৯৭৬), পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি প্রথম খ-, প্রকাশ ভবন, কলকাতা

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (২০১০), ডাইনী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ গল্প, (সম্পাদনা: হায়াৎ মামুদ),

                                       চারুলিপি, ঢাকা

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৩৯৮), পথের পাঁচালী, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা: লি:, কলকাতা

বীরেন্দ্র দত্ত (২০১৩), বাংলা ছোটগল্প : প্রসঙ্গ ও প্রকরণ, ১ম খ-, পুস্তক বিপণি, কলকাতা

ভারতকোষ (তৃতীয় খণ্ড), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা

ভীষ্মদেব চৌধুরী (২০১৩), সত্যবতীর আগমন ও প্রস্থান, সোমেন চন্দের গল্প ও গল্পপাঠ, (সংকলন ও সম্পাদনা:

                             আমিনুর রহমান সুলতান) ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা

মহাশ্বেতা দেবী (২০১৪), ডাইনি, মহাশ্বেতা দেবী গল্পসমগ্র, (সম্পাদনা: অজয় গুপ্ত), দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

মহাশ্বেতা দেবী (২০১৪), বাঁয়েন, মহাশ্বেতা দেবী গল্পসমগ্র, (সম্পাদনা: অজয় গুপ্ত), দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

মাসুদুজ্জামান (২০১৩), দেবদূত পুরুষ ও যৌনরাজনীতি, শুদ্ধস্বর, ঢাকা

মিল্টন বিশ্বাস (২০০৯), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্পে নিম্নবর্গের মানুষ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা

শ্রীশশিভূষণ দাশগুপ্ত (১৩৬৭), ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা

শ্রীশ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৮৪), বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, মডার্ন বুক এজেন্সি প্রা: লি:, কলকাতা

শ্রীশ্রীহর্ষ মল্লিক (২০০৪), ডাইনী, বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতিকোষ, (সম্পাদনা: ড. বরুণকুমার চক্রবর্তী), অপর্ণা বুক

                           ডিস্ট্রিবিউটার্স, কলকাতা

সত্যচরণ চট্টোপাধ্যায় (১৯৯৮), বাংলা ছোটগল্পের ক্রমবিকাশ, প্রজ্ঞা বিকাশ, কলকাতা

সফিকুন্নবী সামাদী (২০০৪), তারাশঙ্করের ছোটগল্প জীবনের শিল্পিত সত্য, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা

সুনীল চট্টোপাধ্যায় (১৯৮১), বিভূতিভূষণ : জীবন ও সাহিত্য, জিজ্ঞাসা, কলকাতা

সৌমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদনা ২০১২), বিশ শতকের কুসংস্কার বিরোধী গল্প, র‌্যাডিক্যাল, কলকাতা

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (২০০৮), বঙ্গীয় শব্দকোষ (১ম খণ্ড), সাহিত্য অকাদেমি, কলকাতা

হুমায়ুন আজাদ (১৯৯৫), নারী, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা

William Henry Sleeman(1844, reprinted 1915),  Rambles and recollections of an Indian official,  Oxford University Press, London

আপনার মতামত লিখুন :

One response to “বাংলা ছোটগল্পে ডাইনি চরিত্র”

  1. Goutam kr. Mandal says:

    খুব ভালো লেখা । লেখককে ধন্যবাদ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *