২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার, দুপুর ১২:৪১
সাব-অল্টার্ন স্টাডিজের ‘মহামারি’ ভাবনা
শুক্রবার, ২৪ জুলাই, ২০২০

মিল্টন বিশ্বাস ।।

সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক দীপেশ চক্রবর্তীর Community, state and the body : epidemics and popular culture in colonial India (শরীর, সমাজ ও রাষ্ট্র : ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও জনসংস্কৃতি, ১৯৯৯) শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ রচনা এবং ডেভিড আর্নল্ড-এর যথাক্রমে- Touching the Body: Perspectives on the Indian Plague, 1896-1900 (১৯৮৭) ও Smallpox and Colonial Medicine in Nineteenth-Century India (১৯৮৮) প্রবন্ধে উপস্থাপিত ভারতবর্ষের মহামারি প্রতিরোধে ব্রিটিশ শাসকদের অনুসৃত পথের অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে আমরা করোনা-ভাইরাস কবলিত বাংলাদেশের অবস্থা পর্যালোচনা করতে পারি। একইসঙ্গে ইতিহাস থেকে শিক্ষা অর্জন করে সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই করার অনুপ্রেরণা পেতে পারি। আমরা সাধারণভাবে বলে থাকি, ‘মহামারি’ হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণে একটি নির্দিষ্ট জনসংখ্যাকে আক্রান্ত করার অভিজ্ঞতা। এই ‘নির্দিষ্ট জনসংখ্যা’ আদমশুমারি দিয়ে নির্ণিত হয়। আর আদমশুমারি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থারই একটি অন্যতম দিক। অতীতের মারি-মড়ক ও মন্বন্তরের ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তৃত হওয়ার পরই ‘মহামারি’র প্রাদুর্ভাব ঘটে। তবে একইসময় এ ভূখণ্ডে আধুনিক রাষ্ট্রের আবির্ভাবও দেখি আমরা।

২.

আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র ও ক্ষমতা প্রয়োগের অন্যতম দিক হলো- শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, আর্থিক উন্নতি ও জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা। জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কটা অতীতে ছিল জটিল; বিশেষত ব্রিটিশ ভারতে। এজন্য মহামারি নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের হাতে থাকা অস্ত্রসমূহ তথা আইনিব্যবস্থা, সেনাবাহিনী, আর্থনীতিক ও চিকিৎসাব্যবস্থা দিয়ে ততটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয় তৎকালীন প্রশাসকরা। মহামারি নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতির সাথে অনেকক্ষেত্রে সেসময়ের রাজনৈতিক নেতা ও জনগণ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সঙ্গে একমত হতে পারেনি। ফলে ১৮১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত একশ বছরে সাতবারের কলেরা মহামারিতে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারালেও কিংবা ১৮৯৬ সালের প্লেগ মহামারি অথবা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হলেও জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে আধুনিক ধারণা উপমহাদেশের মানুষ স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করতে উৎসাহী হয়নি। সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মনীতি আমাদের পূর্বপুরুষদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, পরিচ্ছন্ন গৃহ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশÑ এই তিনটি মূল বিষয়কে সামনে রেখে ব্রিটিশ ভারতের জনস্বাস্থ্য গড়ে উঠেছিল। বাংলায় ১৮৬৭ সালে ইউরোপীয় চিকিৎসার ক্লিনিক ছিল ৬১টি। ১৯০০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০ এ। ১৮৯১ সালে একটি পত্রিকায় হাডসনস সাবানের বিজ্ঞাপনও বেরিয়েছিল। গৃহ ও স্বাস্থ্য ভাল রাখতে এই সাবান ব্যবহারের জন্য সকলকে উৎসাহ প্রদান করা হতো। উনিশ শতকে জীবাণুনাশক হিসেবে সাবানকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। যেহেতু শরীরের সঙ্গে শরীরের মালিকের সম্পর্ক ব্যক্তিগত সেজন্য সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়লে তার পিছনে কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় সংকেত না খুঁজে জীবাণুর বীজ অন্বেষণ করা দরকার ও তা ধ্বংস করতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবেÑ সেসময় এটাও প্রচার করা হয়েছিল।

৩.

ভারতবর্ষে ১৮৯৬ সালে প্রাদুর্ভাব ঘটলেও বাংলায় প্রথম প্লেগ হানা দেয় ১৮৯৮ সালে। কলকাতা, হুগলি, চব্বিশ পরগণা, বর্ধমান, মেদিনীপুর, রাজশাহীতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এই রোগের জীবাণু। প্লেগ রিপোর্টে দেখা যায়, ১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলায় প্লেগে প্রথম মৃত্যু হয়। কলকাতার কাপালিটোলা লেনের এক বাসিন্দার মরদেহ ময়নাতদন্ত করে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্তে আসেন- প্লেগেই তার মৃত্যু হয়েছে। দ্রুত গতিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে বেনিয়াপুকুর, বড়বাজার, কুমারটুলি, শ্যামপুকুরে। ৩০ এপ্রিল প্রশাসন বাধ্য হয়ে জানায়, কলকাতায় প্লেগ মহামারির আকার ধারণ করেছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল বড়বাজার ও জোড় বাগান অঞ্চল। প্লেগ জীবাণুর মূল বাহক ইঁদুর হলেও নাগরিক জীবনের অস্বাস্থ্যকর বসবাসও তার জন্য কম দায়ী ছিল না। ‘বাংলার প্লেগ পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে স্যানিটাইজেশন কমিশনার ডব্লিউ ডব্লিউ ক্লেমেসা লিখেছেন- প্লেগ গ্রামবাংলার খুব বেশি ক্ষতি করেনি। গুদামজাত পণ্য থেকে ইঁদুরের মাধ্যমে রোগ ছড়িয়ে পড়ে শহরাঞ্চলে। প্লেগে মৃত্যুহার ছিল বেশি- সংক্রমিতদের ৯০ শতাংশকেই বাঁচানো যায়নি। প্লেগের মহামারির আগে থেকেই গোটা বাংলাতেই ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বর ছড়িয়ে পড়ে ১৮৬১ সালের দিকে। এই রোগ মহামারি হয়ে ওঠে ১৮৮০ সালে। ম্যালেরিয়া বর্ধমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করেছিল। তবে ভারতবর্ষে প্রতি বছরই ম্যালেরিয়ায় কয়েক লক্ষ লোক মারা যেত। ম্যালেরিয়ার মারা যায় ১৯২১ সালে ৭ লক্ষ ৩৭ হাজার ২২৩ জন; ১৯২৯-এ ৩ লক্ষ ৩৫ হাজার ৪১৪, ১৯৩৮ সালে ৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৫২১ এবং ১৯৪৪-এ ৭ লক্ষ ৬৩ হাজার ২২০ জন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আহ্বানে ১৯৫৫ সালে বেঙ্গল কেমিক্যালে ম্যালেরিয়ার ওষুধ তৈরি করতে শুরু করা হয় চিকিৎসক কার্তিক বসুর নেতৃত্বে। অন্যদিকে কলেরা পরিব্যাপ্ত হয় দূষিত জল পান করে। গ্রাম বাংলার পুকুরের জল আর তীর্থযাত্রীদের ব্যবহৃত নোংরা পানিতে খুব দ্রুত পীড়িত হয় জনগোষ্ঠী। ১৯৪৩ সালেই কলেরায় মারা যায় বাংলার ২ লক্ষ ১৬ হাজার ৪২৮ জন মানুষ । এভাবে এদেশ নানা দশকে দশকে শহর আর গাঁ উজাড় করে দিয়েছে মারি, মড়ক আর মন্বন্তর। ১৮৯৬ সালে প্লেগের প্রাদুর্ভাবই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম মহামারি। বোম্বেতে প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটলেও তা কম সময়ের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছায় এবং মহামারির আকার ধারণ করে। এই মহামারির সময় ব্রিটিশ সরকার প্লেগের টিকা দিতে শুরু করলে তা নিয়ে গুজব ছড়ান হয়- এই টিকা নিলে অচিরেই মৃত্যু ঘটবে। মানুষের গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের ফলে কম সময়ের মধ্যে সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়। অথচ উইকিমিডিয়া কমন্স-এ প্রকাশিত আলোকচিত্র অনুযায়ী দেখা যায়, ১৮৯৪ সালে কলকাতায় কলেরার টিকা দেয়া শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রচলন শুরু ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৮ সালে ভারতে দেখা দেয় ভয়াবহ ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ মহামারি। বাংলায় এর তেমন প্রভাব না থাকলেও শিমলা থেকে বিহার পর্যন্ত ছড়িয়ে দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ তাতে উজাড় হয়ে যায়।

৪.

আসলে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে সাধারণ মানুষের জীবনে রোগব্যাধির অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন। প্রাক-ব্রিটিশ রাজনৈতিক চেতনায় বা জনসংস্কৃতি কিংবা লোকবিশ্বাসে মনে করা হতো- প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা মহামারি, মড়ক, বন্যা, খরা, ভূমিকম্প প্রভৃতি অনেক সময়েই রাজধর্মের ব্যত্যয় সূচিত করে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পাঁচটি দৈব-দুর্বিপাক যথা অগ্নিকাণ্ড, বন্যা, ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ ও মড়ককে রাজা ও রাজ্য বিনাশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মূলত  রাজত্ব ও ধর্ম- এই দুটি ধারণা একসূত্রে গাঁথা। তাই দৈবদুর্বিপাক নীতির স্খলন, অধর্মের সূচনা ও (ধর্ম) রাজত্বের বিনাশের ইঙ্গিত দেয়। দীপেশের মতে, এই ভাবনার আনুষঙ্গিকভাবে উনিশ শতকে মহামারি উপলক্ষে জনমানসে যা প্রতিফলিত হয়েছে তাকে ব্রিটিশ শাসনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমালোচনাই বলা চলে।’ অর্থাৎ এভাবে গুজব, লোকবিশ্বাস, আচারের মধ্য দিয়ে জনস্বাস্থ্যের ইতিহাস তৈরি হতে থাকে। আর এক্ষেত্রে ধর্মীয় চেতনা হয়ে ওঠে সামাজিক ও গোষ্ঠীগত তাৎপর্যে অভিষিক্ত। যেমন, বাংলাদেশে যারা দরিদ্র, দুর্বল ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিচুস্তরের; যারা ধনী কৃষক কিংবা অন্যদের বেগার দিতে এবং অস্পৃশ্য কাজ করতে বাধ্য তারা তাদের আচার-ব্যবহার ও ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে চৈতন্যের প্রকাশ ঘটায়। তারা নিজেদের নিচুস্তরের অবস্থানকে আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় কাহিনিতে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলেছে। তাদের কল্পনায় করোনা-ভাইরাস আত্মপ্রকাশ করেছে ভিন্ন মাত্রায়। এজন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লকডাউন থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের গোষ্ঠীগত ধর্মীয় নেতার জানাজায় শরিক হয় সকল সরকারি স্বাস্থ্যবিধি ও নির্দেশ অগ্রাহ্য করে। একইভাবে কলকাতায় গরুর শবযাত্রায় হাজার মানুষের সমাবেশ ঘটে। অর্থাৎ একদিকে শাসকের ক্ষমতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ অন্যদিকে মানুষের ধর্মবিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠানের বাস্তবতা বিশ্বের মহামারি মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।

৫.

১৮৬০ সালের পর থেকে লুই পাস্তুর এবং অন্যান্যদের গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জীবাণু তত্ত্ব’। বাতাস ও পানির দ্বারা অণুজীব মানবদেহে সংক্রমিত হওয়ার বিষয়টিও তাঁরা প্রকাশ করেন। তখন থেকে বিভিন্ন রোগের মূল বিভিন্ন জীবাণুতে- এই জীবাণু শনাক্ত করা এবং সেই অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া চিকিৎসাশাস্ত্রের মূল কাজ হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষে সংক্রামক ব্যাধি বা মহামারি ছড়িয়ে পড়লে তাতে প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোম্পানির সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ফলে রাষ্ট্র তার সেনাবাহিনীকে বাঁচানোর জন্য এ অঞ্চলের জনস্বাস্থ্যের দিকে নজর দেয়। অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস ও অভ্যাসজনিত কারণে তৈরি হওয়া নোংরা পরিবেশই সংক্রামক ব্যাধির উৎস- চিকিৎসাবিদ্যার এই ভাবনা থেকেই ব্রিটিশ শাসকরা সতর্ক হয়ে ওঠে। তাদের সেনা ও প্রশাসনিক অন্যান্য অফিসাররা জনসমাগম এড়িয়ে চলত। হাট-বাজার, গঞ্জ, মেলা, তীর্থক্ষেত্র- তাদের চোখে এসব জায়গা ছিল রোগ ছড়ানোর কেন্দ্র। তীর্থযাত্রীদের ভিড় বা দল বেঁধে ভ্রমণ ‘কলেরা’ সংক্রমণের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী কারণ ছিল। এজন্য ব্রিটিশ আমলে মেলা পরিচালনার জন্য পুলিশ, ডাক্তার, ওষুধ, পানীয় জল, মলমূত্রত্যাগের ব্যবস্থা, বাঁশের বেড়া ইত্যাদি দিয়ে জনগণের ভিড়কে নিয়ন্ত্রণ ও সুশৃঙ্খল করে রাখা হতো। বর্তমানে এদেশে সেই ব্রিটিশ ব্যবস্থাই প্রচলিত রয়েছে। তবে সেসময় জনস্বাস্থ্য নীতি ছিল শহরমুখী। তখনকার সেনানিবাসগুলো স্থাপিত হয়েছিল খোলামেলা ও সুন্দর পরিবেশে। অবশ্য শহরে শ্বেতাঙ্গপাড়া ও স্থানীয় বাসিন্দাদের এলাকা আলাদা থাকলেও মহামারির সময় ব্যাধি কেবল গরিব ও শ্রমজীবী পাড়াতেই আটকে থাকেনি। ফলে ১৮৯৬ সালে বোম্বাই নগরীতে সরকার প্লেগ প্রতিরোধে নানাবিধ বিধিনিষেধ জারি করলে কিংবা জোর করে অসুস্থকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে চাইলে ভারতীয়দের সাথে দাঙ্গা বাধে। অথচ দমননীতি বা বাধ্য করার মূল কারণ ছিল- ভারতীয়দের শরীরকে চিকিৎসাধীন না করতে পারলে ব্রিটিশ জীবনের আশঙ্কা বাড়বে এটা বুঝতে পেরেছিল সেসময়ের রাষ্ট্র। সেখানে প্লেগে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় ১৮৯৬ সালের আগস্ট মাসে। অক্টোবর থেকে প্লেগ প্রতিরোধে সরকার আইনগত নির্দেশ জারি করে এবং কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। জোর খাটিয়ে প্লেগ রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা থেকে শুরু করে মেলা, তীর্থযাত্রা (হজ্জসহ) বন্ধ করা, রেলযাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্লেগ সন্দেহ হলে আলাদা করে পরীক্ষা প্রভৃতি ব্যাপক তৎপরতা চলে। দুর্ভাগ্য হলো চিকিৎসার নামে মানুষকে মরণের দিকে ঢেলে দেয়া হচ্ছে- এ ধরনের মিথ্যা প্রচার ও গুজবের ফলে সেখানে হাসপাতাল আক্রান্ত হয় এবং ১৮৯৭ সালের জুন মাসে প্লেগ কমিশনার ডব্লিউ সি. র‌্যায়ান্ড খুন হন। প্লেগ সম্পর্কিত নির্দেশাবলির বিরুদ্ধে জনগণের ওই মারমুখী আচরণের কারণ ছিল ব্রিটিশরা ছিল বিদেশি শাসক এবং সাধারণ মানুষের চেতনায় মহামারি বা রোগব্যাধির দুর্দৈব নিয়ে বিচিত্র ধরনের সংস্কার ক্রিয়াশীল ছিল। এজন্য প্লেগ সংক্রান্ত সতর্কতা কিংবা কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেনি জনগণ- যেমন টিকার বিষয়ে তারা ছিল অনড় আবার গুজবে বিশ্বাসী। নিজেদের সমাজে তারা অভাবী কিংবা ঋণগ্রস্ত কিন্তু ধর্মীয়নেতার কথায় বাস্তব জগতে তারাই আবার সংঘবদ্ধ। আসলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সরল কল্পনা কেবল ভাবজগতেই সীমিত নয় সামাজিক সংগ্রামে তা পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে ঔপনিবেশিক শিক্ষা প্রসারের প্রচেষ্টা থেকে গ্রামীণ জীবনে আবির্ভূত দুই একজন শিক্ষিত ব্যক্তি ছাড়া একসময় অন্যরা মনে করত- প্রতিদিন স্নান, শৌচের জন্য পানি ব্যবহার, গৃহের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা প্রভৃতি উচ্চবর্ণ বা ব্রাহ্মণ্য সমাজের রীতিনীতি।

দীপেশ চক্রবর্তী এবং ডেভিড আর্নল্ড দেখিয়েছেন- ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারে গ্রামীণ সমাজে গোষ্ঠীগত মনোভাবের যে পরিচয় প্রকাশ পেয়েছিল তা সরকারের মহামারি মোকাবিলা বা সংক্রমণ প্রতিরোধে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। কারণ লোকবিশ্বাস, অলৌকিকতা ও নানান সংস্কার নিম্নবর্গকে গুজবে বিশ্বাসী করে তোলে। অতীতে আমরা দেখেছি কায়েমি স্বার্থসিদ্ধির তাগিদে অনেক সময় অনেক গুজব ছড়ানো হয়েছে। কিন্তু এসব গুজবের উদ্ভব সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব না হলেও এগুলো যে স্বতঃস্ফূর্ত আইন অমান্য করতে অনুপ্রেরণা জাগায় তা বলাবাহুল্য। একইভাবে ডেভিড আর্নল্ড তাঁর প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন, ব্রিটিশ প্রবর্তিত স্বাস্থ্যনীতির অধীনে ‘বসন্ত টিকা’ সম্পর্কে ভারতবাসীর গুজবে বিশ্বাসের ফলে কীভাবে সেই জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম ব্যর্থ হলো তার পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র। গুজব রটেছিল টিকার উদ্দেশ্য জাত-ভাঙানো, ধর্মনাশ করা, নতুন করে বসানো কারখানায় জোর করে কুলি হিসেবে ধরে নিয়ে যাওয়া প্রভৃতি। পাঞ্জাবে রটানো হয় সূচের আকার লম্বায় এক গজ, শরীরে ফোটালেই হয় মৃত্যু নয় বন্ধ্যাত্ব, ডেপুটি কমিশনার সাহেব টিকা নিতে গিয়ে আধ ঘণ্টা অসহ্য যন্ত্রণাভোগের পর মারা গেছেন। বুন্দেলখণ্ডে হেস্টিংসের সেনাবাহিনী যখন কলেরা-আক্রান্ত হয় তখন সাধারণ মানুষের কাছে এর কারণ রটনা হয় অন্যভাবে। শ্বেতাঙ্গ সৈনিকরা জনৈক ব্রাহ্মণের নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করে স্থানীয় রাজা হর্দুলকোনের স্মৃতিময় পবিত্র কোনও জায়গায় গোমাংস খাওয়ায় অধর্মাচরণের ফল হিসেবে কলেরায় আক্রান্ত হয়। এসব স্বতঃস্ফূর্ত গুজবের মধ্যে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করার আচরণ চিহ্নিত। জনগণ কলেরা কিংবা বসন্তের জীবাণু থেকে মুক্তি পাবার জন্য চিকিৎসাকেন্দ্রে না গিয়ে শরণাপন্ন হয়েছে ওলাবিবি কিংবা শীতলা দেবীর থানে। ফলে গ্রাম থেকে গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। মহামারি আর ব্যক্তিগত থাকেনি, হয়ে গিয়েছে সামাজিক। দলাদলি ও ক্ষুদ্রস্বার্থ ভুলে নিরন্ন মানুষ একজোট হয়েছে ধর্মীয় সংস্কারের মঞ্চে। ব্রিটিশরা এদেশের ধর্মান্ধ সমাজকে ভয় পেলেও নানাবিধ স্বাস্থ্য সতর্কতার ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছিল- দেখিয়েছেন ইতিহাসকার দীপেশ চক্রবর্তী। তবে শেষাবধি মানুষকে দ্বারস্থ হতে হয়েছে বিজ্ঞানের কাছেই। প্লেগ মহামারি নিয়ে গরিব মানুষের ভুল ধারণা এবং কুসংস্কার দূর করার জন্য সেসময় জাতীয়তাবাদী ভারতীয় নেতারা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে অনুরোধ জানিয়েছিল। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার প্রচারে সহযোগিতা করেছিল। তবে তা ছিল- শরীরকে সম্পূর্ণরূপে রোগশূন্য করার নাম স্বাস্থ্য- এই ভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ফলে ভারতীয় আয়ুর্বেদের চিন্তাধারাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল তখন। বর্তমান মহামারির পরিস্থিতি ভিন্ন। বাংলাদেশে করোনা-ভাইরাস ইতোমধ্যে তিন সহস্রাধিককে মৃত্যুর কোলে টেনে নিয়েছে, আক্রান্ত করেছে ৩ লাখের অধিক মানুষকে। এই জীবাণুতে ২৪ জুলাই (২০২০) পর্যন্ত সারাবিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ১,৫৫,১০,৫৮৮ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৯৪,৪০,০৯৮ জন। মৃত্যুবরণ করেছেন ৬,৩২,৮৩৬ জন। এই মহামারিতে টোটকা চিকিৎসার ওপর নির্ভর না করে বায়োটেকনোলজি কিংবা অণুজীব ও রসায়ন বিজ্ঞানের দিকে আমাদের চেয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।

৬.

মূলত সাব-অল্টার্ন স্টাডিজগোষ্ঠীর লেখক দীপেশ চক্রবর্তী ও ডেভিড আর্নল্ড তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, ভারতবর্ষের একেকটা ভয়াল মহামারি লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ সরকার তাঁর সেনাবাহিনীর শরীর বাঁচাতেই ভারতীয় শরীরে সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টায় নেমেছিল আর এদেশের মানুষ ‘টিকার সুঁই’ নিতে দ্বিধা কাটাতে না পেরে বরং ধর্ম আর লোকাচারের দ্বারস্থ হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা বিদায় নিয়েছে আর ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। কিন্তু দেশভাগের ৭৩ বছর পরও সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে ভারত কিংবা বাংলাদেশ এখনও কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের আচ্ছন্নতায় রয়েছে। বাজার আর জানাজায় ভিড় করা কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে চলাফেরা এখনো থেমে নেই। কলকাতায় উনিশ শতকে অস্থায়ী প্লেগ হাসপাতাল গড়ে উঠেছিল। তেমনি ২০২০ সালে ঢাকা শহরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে করোনা প্রতিরোধে হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। তবু ডিজিটাল যুগে এসেও ব্রিটিশ আমলের মতই প্রচারিত নানা গুজব আমাদের আতঙ্কিত করছে। ১৮৯৬ সালে প্লেগের সংক্রমণের সঙ্গে লড়াই না করে, কেউ বলেছিল মক্কায় হজ রুখতে ব্রিটিশরা রোগ ছড়াচ্ছে, কেউ আবার বলেছিল সাম্রাজ্যবিস্তারের লোভে কালীর পায়ে রক্ত দিয়ে নরমেধযজ্ঞ সারছে ব্রিটিশ। আর এই সব তর্ক-বিতর্ক, অন্ধ বিশ্বাস-সংস্কারের মাঝেই ঝরে গিয়েছিল লক্ষ লক্ষ তাজা প্রাণ। এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সকল ধর্মীয় সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসকে ঝেড়ে ফেলে আমরা করোনা-ভাইরাস প্রতিরোধে আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছি। আর এই আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার অকুণ্ঠ সমর্থক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্ব এবং দিকনির্দেশনা মেনে চললে বর্তমানের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব।

(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস,  বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *